রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


পরান বন্দ্যোপাধ্যায়। আমাদের সবার প্রিয় পরানদা। আমাদের সবার এনার্জি টনিক। জীবনের ৮৩টি বসন্ত পার করেও প্রাণচাঞ্চল্যে এখনও টগবগে তরুণ। দাদার সংস্পর্শে কিছুক্ষণের জন্য আসা মানেই একটা পজিটিভ এনার্জি নিয়ে বাড়ি ফেরা। একটি শব্দও বাড়িয়ে বলছি না। এই তো মাসখানেক আগে তপন থিয়েটারে পরানদার নাট্যদল শ্রুতি রঙ্গমের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে দেখে এলাম তাঁর রচিত, নির্দেশিত এবং অভিনীত নাটক মিথ্যাবাদী। প্রায় দু’ঘণ্টার নাটকে দাপটে অভিনয় করলেন।

পরানদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় তিন দশকের। কোথা থেকে যে শুরু করব সেটাই ভাবছি! একদিন সকালে চেম্বারে বসে রোগী দেখছি। পরানদার ফোন এল, ‘আমি তোকে একটু দেখাতে আসব, কতক্ষণ আছিস?’ আমি বললাম, সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। পরানদা এগারোটার কিছু পরেই এলেন। চেম্বারে ঢুকতেই উপস্থিত কয়েকজন রোগীর তো চোখ কপালে! উঠে দাঁড়িয়ে আসুন আসুন বলে তাঁরাই দাদাকে ভেতরে নিয়ে এলেন। একজন সেলফি তোলার আবেদন করতেই পরান দা সহাস্যে বললেন, ‘এই ব্যাপারটায় আমি খুব সেলফিশ। নো সেলফি। আপনারা উঠে দাঁড়ালেন কেন! সবাই বসুন। আজ আপনাদের মতো আমিও একজন পেশেন্ট। আপনাদের সবাইকে দেখা হলে তারপর আমি ডাক্তারকে দেখাবো।’ আমি দাদাকে নিয়ে দোতলায় গিয়ে আমার গিন্নির জিম্মায় জমা করে দিয়ে চলে এলাম।

ভীষণ রকম বৈঠকি মেজাজের মানুষ পরানদা। অনর্গল কথা বলতে পারেন বিভিন্ন বিষয়ে এবং সেই কথা বলার মধ্যে এমন একটা মোহিনী শক্তি থাকে যে আপনাকে মোহাবিষ্ট হয়ে শুনতেই হবে। এবং এই কথা বলার মধ্যে থাকে ছোট্ট ছোট্ট হিউমার এবং স্যাটায়ারের মোচড়। নানা মুডে পরান সঙ্গ করেছি আমি। পর্দাতে তো কাজ করেছিই। তার বাইরেও নানা অনুষ্ঠানে, আমার বাড়ির ঘরোয়া আড্ডায়, বইমেলায়, দাদার নিজের বাড়িতে একান্তে তাঁকে পেয়েছি। ফোনে যখন কথা বলি, আমাদের কথা যেন শেষ হতেই চায় না। যত তাঁর কথা শুনি, আলাপচারিতায় মাতি, নিজে আরও ঋদ্ধ হই।
যে কোনও নাটকের দর্শকের মতো পরানদার নাটকের দর্শকও সীমিত। উনি যে দীর্ঘ ছয় দশক ধরে নাটক করে যাচ্ছেন, জানেন খুব কম লোকই। দাদার আকাশ চুম্বী জনপ্রিয়তা কিন্তু পর্দায় তার উপস্থিতির জন্যই অর্থাৎ সিনেমা এবং সিরিয়াল থেকে। আর সম্প্রতি টনিক সিনেমার অভূতপূর্ব সাফল্য দাদাকে জনপ্রিয়তার আইফেল টাওয়ারের চূড়ায় বসিয়ে দিয়েছে। উনি যে ভালো গান গাইতে পারেন, বিশেষ করে পুরাতনী এবং শচীন কর্তার গান, সেটিও আমরা জেনে গিয়েছি মীরাক্কেল কমেডি শো-র সৌজন্যে।

দাদার আরেকটি ক্যারিশমা অজানা ছিল অনেকের কাছেই, সেটি হল তার নাটক লেখা। দীর্ঘদিন ধরেই এই কাজটি করছেন তিনি, কিন্তু অনেকের কাছেই সেটি ছিল অজানা। সম্প্রতি দে’জ পাবলিশিং থেকে দাদার ‘নাটক সমগ্র’ প্রকাশ পেল। এই বইটির প্রস্তুতি পর্ব থেকে প্রকাশ লগ্ন পর্যন্ত জড়িয়ে ছিলাম আমি। নাটকগুলো একাধিকবার পড়তে হয়েছে আমাকে, টুকটাক সম্পাদনাও করেছি তাঁর অনুমতি নিয়েই। এবং এগুলো করতে গিয়ে দেখেছি, যে মানুষটিকে আমরা অভিনেতা হিসেবে কমেডিয়ান বলে ভাবতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি, তার মধ্যে কিন্তু একজন সমাজ শিক্ষক রয়েছেন, যিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে ভালোবাসেন তাঁর নাটকে, ভালোবাসেন তাঁদের সুখ-দুঃখের কথা বলতে। পরানদা আসলে নাটকের লোক। যৌবনে গণনাট্যের সংস্পর্শে এসেছিলেন। প্রতিবাদী নাটক করেছেন এক সময় চুটিয়ে, রাজনৈতিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী এই মানুষটির সেই গণ সংযোগ রয়ে গিয়েছে আজও। মাটিতে পা রেখে চলতে ভালোবাসেন যে। আর সেজন্যই তিনি এই বয়সেও এত জনপ্রিয়।
পরানদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠার পেছনে আরেকটি কারণ হল, একসময় উনি বেলঘরিয়ার মোহিনী মিলের কাছে থাকতেন, আমার বাড়ি থেকে হাঁটা পথে ৭-৮ মিনিটের দূরত্বে। দাদার যখন গণনাট্যে নাট্য জীবন শুরু হয়, তখন আমি নিতান্তই শিশু। পরবর্তীকালে আমার এক দাদা মানবেন্দ্র গোস্বামী, যিনি বেলঘরিয়াতেই থাকতেন, এবং পরানদার সঙ্গে গণনাট্যে নাটক করতেন, তার থেকে তাঁর কথা মাঝে মাঝে শুনতাম। তবে তখন পরানদার সেই অর্থে কোনও পরিচিতি নেই, একজন কমিটেড অ্যান্ড ডেডিকেটেড গণনাট্য কর্মী এবং সরকারি চাকুরে ছাড়া। পরানদার কাছে আমি বেলঘরিয়ার পুরনো ইতিহাস একাধিকবার শুনেছি। বিশেষ করে জরুরি অবস্থায় কংগ্রেসি জমানায় পুলিশি অত্যাচারের কথা, বামপন্থী কর্মীদের পালিয়ে বেড়ানোর কথা এবং এই প্রতিকূল সময়ে দাঁড়িয়ে নাটক করার কথা।

মনে আছে বছর ১২-১৩ আগে দাদা একদিন আমার বাড়িতে এসেছেন, তিন তলার ছাদে বসে আড্ডা হচ্ছে। হঠাৎ বললেন, চল চিলেকোঠার ছাদে উঠে একটু চারপাশটা দেখি। তাঁর বয়স তখন ৭০ পেরিয়েছে, আমি একটু না-না করছিলাম, তবুও উনি ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে একেবারে টঙে উঠে গেলেন, তারপর চারপাশে নানা দৃশ্য দেখে আমাকে চেনাতে লাগলেন আমারই জন্মভূমি বেলঘরিয়াকে। ‘ওই পিছনের দিকে ওই যে বিশাল ঝিল ওখানে প্রায়ই যেতাম, ওখানে একবার বিরাট একটা কুমির ধরা পড়েছিল। তুই জানিস সেটা।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমরাও দশ পয়সার টিকিট কেটে সেই সময় কুমির দেখতে গিয়েছিলাম।’ সেদিন পরানদা তাঁর ছেড়ে যাওয়া এই এলাকা নিয়ে বড্ড বেশি নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলেন। আধঘণ্টা ধরে অনেক রকম কথা বলেছিলেন। আমিও নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছিলাম আমার এই জন্ম এবং বাসভূমি বেলঘরিয়াকে।
দাদার সঙ্গে আমি প্রথম মুখোমুখি কাজ করার সুযোগ পাই কলকাতা দুরদর্শনের ‘আলেয়া’ বলে একটি মেগা সিরিয়ালে। সালটা ছিল ২০০৫। আমার চরিত্রটি ছিল একজন উঠতি চলচ্চিত্র পরিচালকের। পরানদা অভিনয় করেছিলেন নায়িকার বাবার চরিত্রে, যিনি একজন নিম্নবিত্ত অভাবী পিতা। যিনি তাঁর মেয়েকে সিনেমার জগতে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। নায়িকার চরিত্রটি করেছিলেন অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, পরবর্তীকালে যিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় সম্মান পেয়েছিলেন। এই সিরিয়ালে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে আমি পরানদার থেকে অভিনয়ের টুকিটাকি অনেক কিছুই শিখেছি। বিশেষ করে অ্যাক্টিংয়ে ‘পজ’-এর ব্যবহার। একদিন শ্যুটিং থেকে সরাসরি আমি কলকাতা দূরদর্শনে ‘হ্যালো ডাক্তারবাবু’ লাইফ প্রোগ্রাম করতে যাচ্ছিলাম। পরানদার কাছে টিপস চাইলাম এবং শুরুটা আমি যেভাবে করব বলে ভেবেছি, সেটা বলে গেলাম। পরানদা সংলাপ বলে দেখিয়ে দিলেন, কোন কোন শব্দে জোর পড়বে, শব্দের ওঠানামা কেমন হবে, কোথায় শ্বাস নিতে হব- ছাড়তে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
‘ধ্যাৎতারিকা’-সহ বেশ কিছু সিরিয়ালে দাদার অসাধারণ কমেডি আপনারা দেখেছেন। আমিও স্বপন ঘোষালের পরিচালনায় ‘সদানন্দের কড়চা’ বলে একটি কমেডি সিরিয়ালে দীর্ঘদিন দাদার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। দাদার চরিত্রের নাম ছিল সদানন্দ, যে একজন প্রেমের গল্প এবং উপন্যাসের লেখক, আর আমি ছিলাম তাঁর সেই সমস্ত বইয়ের প্রকাশক। কমেডি অ্যাক্টিংয়ের ক্ষেত্রে টাইমিং একটা বড় ফ্যাক্টর, জানেন সবাই। পরানদার অভিনয়ে আমি হাঁ হয়ে দেখতাম সেইসব টাইমিংয়ের ব্যবহার। একটা দৃশ্যের কথা বলি। শ্যুটিং হচ্ছিল টেকনিশিয়ান স্টুডিওর উল্টো দিকের গলিতে একটি ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে। সেটা সদানন্দের বাড়ি। আমি প্রকাশক। একটা ছোট ম্যাটাডোর ভর্তি করে সদানন্দের অবিক্রিত বই নিয়ে তাঁর বাড়ির সামনে হাজির হয়ে হাঁকডাক করছি। মনিটরে অর্থাৎ রিহার্সালে আমার সংলাপ বলার ধরন দেখে দাদা বললেন,’ তুই কি চেম্বারে রোগী বসিয়ে রেখে অ্যাক্টিং করতে এসেছিস! ‘আমি বললাম, ‘না তো! চেম্বার শেষ করেই তো এসেছি।’ ‘তাহলে এতো তড়বড় করছিস কেন! অনেক কিছু কথা থাকে ‘ইন বিটুইন দি লাইনস’, যেগুলো এক্সপ্রেশনে বোঝাতে হয়। অ্যাক্টিংটা সেভাবে কর। ভুলে যাস না, তুই নাটক করা ছেলে।’
এরকম অনেক ঘটনাই মনে পড়ে, যেখানে পরানদা ভালোবেসে আমাকে অনেক অ্যাক্টিং টিপস দিয়েছেন, গাইড করেছেন। যদি দাদার সঙ্গে নাটকে একসঙ্গে কাজ করতে পারতাম, তাহলে হয়তো আরও অনেক কিছুই শিখতে পারতাম, আরও অনেক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতাম। এরকম আরেকটি ঘটনার কথা বলি। গিরিশ মঞ্চে আমার নাটকের দল বেলঘরিয়া থিয়েটার অ্যাকাডেমি গত বছর লকডাউন উঠে যাওয়ার পরে এক নাট্য সন্ধ্যার আয়োজন করেছিল। আমরা পরপর দুটি মজার নাটক মঞ্চস্থ করেছিলাম, ‘কাগজের বিয়ে’ এবং ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী’। দুটি নাটকই আমার লেখা এবং আমার পরিচালনা। দাদাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। উনি আগাগোড়া দুটি নাটক দেখলেন। আমার আমন্ত্রণে নাটক শেষে মঞ্চে উঠে দর্শকদের ধন্যবাদ জানালেন, এমন পরিস্থিতিতে নাটক দেখতে আসার জন্য। নাটক নিয়ে তখন আর কোনও কথা হল না। পরের দিন দুপুরের দিকে উনি নিজেই ফোন করলেন। এক্সপার্ট সার্জেনের মতো দুটি নাটককেই কাটা ছেঁড়া করলেন। পরিশেষে বললেন ‘তোর গ্রুপের ছেলেমেয়েগুলো সিনসিয়ার, ভালো অ্যাক্টর, কিন্তু ওদের একটু গ্রুমিং করানো দরকার। আমি ওদের নিয়ে একটু বসতে চাই।’

আমাদের মতো নাট্য কর্মীদের কাছে এতো মেঘ না চাইতেই জল। আমরা একটা ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করলাম আমার বাড়িতেই। উপস্থিত ছিলেন পরান বন্দ্যোপাধ্যায় আর শুধু আমাদের গ্রুপের সদস্যরাই। সেখানে এক অন্য পরাণদাকে আবিষ্কার করলাম আমরা, যিনি শুধু একজন ভালো অভিনেতা নন, একজন অসাধারণ নাট্য শিক্ষকও বটে। প্রায় তিন ঘণ্টা নাটকের বিভিন্ন দিক নিয়ে বললেন তিনি। মাঝে দু’বার দশ মিনিট করে বিরতি দেওয়া হয়েছিল। শুধু বললেন নয়, নিজে অভিনয় করে দেখালেন, সংলাপ উচ্চারণ কীভাবে করতে হয়, কোথায় কতটা সময় ধরে ‘পজ’ নিতে হয়, এগুলোও অভিনয় করে দেখালেন। শুধু নিজে করলেন যে তাই নয়, আমাদের ছেলেমেয়েদের নানা রকম প্রশ্ন করলেন, তাঁরাও কিছু প্রশ্ন করলেন দাদাকে, তিনি উত্তর দিলেন। কিন্তু সবটার মধ্যে ছিল একটা রসের ধারা। কত ভারী-ভারী কথা বলা হল, শোনা হল, আলোচনাও হল; কিন্তু একবারও মনে হল না এটা কোনও অ্যাকাডেমিক নাট্য প্রশিক্ষণ। এখানেই অনবদ্য পরান বাড়ুজ্যে এবং তাঁর বাচনভঙ্গি। পরানদাকে নিয়ে আরও অনেক মজার গল্প শোনাবো আগামী সপ্তাহে, আগামী কিস্তিতে।

Skip to content