হরনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার প্রথম কাজ সংগ্রাম সিনেমায়।
অভিনয়ের পোকাটা মাথায় নড়েছিল সেই ছোট্টবেলা থেকেই, যখন স্কুলে পড়ি। আর জি কর মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার পাশাপাশি চুটিয়ে নাটকও করেছি। ওখানে আমাদের একটি নাটকের দলও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে রেসিডেন্ট পোস্টে জয়েন করার পর নাটকের সুযোগটা একটু কমে গেল ঠিকই, কিন্তু সুযোগ এল সিনেমায় মুখ দেখানোর। আসলে ওই হাসপাতালের প্রাণপুরুষ ডাঃ সরোজ গুপ্তের আকর্ষণে নানা জগতের অনেক ভিআইপি সেখানে আসতেন। এসব কথা এই লেখায় আগেও আমি বলেছি। সুখেন দাসের সঙ্গে এখানে আমার পরিচয় হয়, পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠতাও। আর তারই ফলশ্রুতি ‘পাপ পুণ্য’ ছবিতে এক মিনিটের উপস্থিতি।
এসব সাড়ে তিন দশক আগের কথা। জীবন তখন এগোচ্ছে অনেক ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে। একটু থিতু হয়ে বড় এবং ছোটপর্দায় দ্বিতীয় ইনিংস খেলতে নামি ২০০০ সাল থেকে। ছোট পর্দায় খেলাটা জমিয়ে খেলছিলাম, কিন্তু বড় পর্দায় তেমন জুৎসই সুযোগ পাচ্ছিলাম না। এই সময় হঠাৎ হরনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে পরিচয় হল, আমার বন্ধু প্রখ্যাত চিত্রনাট্যকার মনোতোষ চক্রবর্তীর সৌজন্যে। সেটা ২০০৪ সাল। সুযোগ পেলাম ‘সংগ্রাম’ ছবিতে এক আদর্শবাদী শিক্ষকের চরিত্রে অভিনয় করার। আমার লিপে ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’ গানটি ছিল। ছবির হিরো ছিলেন প্রসেনজিৎ। একই ছবিতে কাজ করলেও ওঁর সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করার সুযোগ পেলাম না। মনে আফশোস ছিল। এক বছরের মধ্যেই সেটা হরনাথদাই পুষিয়ে দিলেন ‘রাজু আঙ্কেল’ ছবিতে আমাকে সুযোগ দিয়ে। এক নিঃসন্তান দম্পতির চরিত্রে ছিলাম আমি আর আমার সহ শিল্পী গীতা। প্রসেনজিতের অনাথ আশ্রম থেকে একটি অনাথ শিশুকে দত্তক নেওয়ার দৃশ্য ছিল আমার ফার্স্ট শট।
এর আগে প্রসেনজিতকে পর্দায় তো দেখেছিই, দু-একবার চাক্ষুষও দেখেছি। তবে এত কাছ থেকে, পাশে দাঁড়িয়ে অভিনয়ের সুযোগ এই প্রথম। কারও ভরসা না করে শুটিং-এর আগে নিজেই পরিচিত হলাম ওঁর সঙ্গে, ভয়ে ভক্তিতে জানিয়ে দিলাম একটু দেখিয়ে শুনিয়ে (পড়ুন মানিয়ে গুছিয়ে) নেবেন দাদা। মৃদু হাসলেন। ফ্লোর রেডি হবার পর মেকআপ ভ্যান থেকে লাইট জোনে এসে দাঁড়ালেন রাজার মতো। ভালো করে দৃশ্যটা বুঝে নিলেন। হরনাথ দা, সহকারী পরিচালক পাপ্পু, চিত্রনাট্যকার মনোতোষের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলোচনার সেরে মনিটর (রিহার্সাল) শুরু করলেন। এর আগে অনেকবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছি, ভয় না লাগলেও একটু টেনশন কিন্তু ছিল। ৩০০ ছবির হিরো বুম্বাদা বলে কথা! মনিটরে আমার লাইট নিতে একটু ভুল হচ্ছিল। বুম্বাদা নিজে এসে আমাকে ঠিক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন, ডায়লগটা আরেকটু ইমোশন দিয়ে বলুন। নিমেষে টেনশন উধাও। বুম্বাদা নিজে আমাকে সাজেশন (পড়ুন পাত্তা) দিয়েছেন! আর আমায় পায় কে!
এসব সাড়ে তিন দশক আগের কথা। জীবন তখন এগোচ্ছে অনেক ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে। একটু থিতু হয়ে বড় এবং ছোটপর্দায় দ্বিতীয় ইনিংস খেলতে নামি ২০০০ সাল থেকে। ছোট পর্দায় খেলাটা জমিয়ে খেলছিলাম, কিন্তু বড় পর্দায় তেমন জুৎসই সুযোগ পাচ্ছিলাম না। এই সময় হঠাৎ হরনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে পরিচয় হল, আমার বন্ধু প্রখ্যাত চিত্রনাট্যকার মনোতোষ চক্রবর্তীর সৌজন্যে। সেটা ২০০৪ সাল। সুযোগ পেলাম ‘সংগ্রাম’ ছবিতে এক আদর্শবাদী শিক্ষকের চরিত্রে অভিনয় করার। আমার লিপে ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’ গানটি ছিল। ছবির হিরো ছিলেন প্রসেনজিৎ। একই ছবিতে কাজ করলেও ওঁর সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করার সুযোগ পেলাম না। মনে আফশোস ছিল। এক বছরের মধ্যেই সেটা হরনাথদাই পুষিয়ে দিলেন ‘রাজু আঙ্কেল’ ছবিতে আমাকে সুযোগ দিয়ে। এক নিঃসন্তান দম্পতির চরিত্রে ছিলাম আমি আর আমার সহ শিল্পী গীতা। প্রসেনজিতের অনাথ আশ্রম থেকে একটি অনাথ শিশুকে দত্তক নেওয়ার দৃশ্য ছিল আমার ফার্স্ট শট।
এর আগে প্রসেনজিতকে পর্দায় তো দেখেছিই, দু-একবার চাক্ষুষও দেখেছি। তবে এত কাছ থেকে, পাশে দাঁড়িয়ে অভিনয়ের সুযোগ এই প্রথম। কারও ভরসা না করে শুটিং-এর আগে নিজেই পরিচিত হলাম ওঁর সঙ্গে, ভয়ে ভক্তিতে জানিয়ে দিলাম একটু দেখিয়ে শুনিয়ে (পড়ুন মানিয়ে গুছিয়ে) নেবেন দাদা। মৃদু হাসলেন। ফ্লোর রেডি হবার পর মেকআপ ভ্যান থেকে লাইট জোনে এসে দাঁড়ালেন রাজার মতো। ভালো করে দৃশ্যটা বুঝে নিলেন। হরনাথ দা, সহকারী পরিচালক পাপ্পু, চিত্রনাট্যকার মনোতোষের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলোচনার সেরে মনিটর (রিহার্সাল) শুরু করলেন। এর আগে অনেকবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছি, ভয় না লাগলেও একটু টেনশন কিন্তু ছিল। ৩০০ ছবির হিরো বুম্বাদা বলে কথা! মনিটরে আমার লাইট নিতে একটু ভুল হচ্ছিল। বুম্বাদা নিজে এসে আমাকে ঠিক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন, ডায়লগটা আরেকটু ইমোশন দিয়ে বলুন। নিমেষে টেনশন উধাও। বুম্বাদা নিজে আমাকে সাজেশন (পড়ুন পাত্তা) দিয়েছেন! আর আমায় পায় কে!
মহাকাল সিনেমায়।
ভালোয় ভালোয় উতরে গেল প্রি-লাঞ্চ সেশন। মাস্টার শট হয়ে গিয়েছে। এরপর ক্লোজ শট আর এসপি শট। ঘোষণা হল, ব্রেক ফর লাঞ্চ। বুম্বাটা ঢুকে গেলেন মেকআপ ভ্যানে। আমি অন্য শিল্পীদের সঙ্গে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওর মেকআপ রুমে। জমিয়ে খাচ্ছি। হঠাৎ মোবাইলে একটা ফোন এল বেলঘরিয়ার এক নার্সিংহোম থেকে। আমি ওখানকারই বাসিন্দা। ওখানে আগের দিন সকালে এক কিশোরীর টনসিল অপারেশন করেছিলাম। শ্যুটিংয়ে আসবার আগে আজ সকালবেলাও রাউন্ড দিয়ে এসেছি। পেশেন্ট ভালোই আছে। আগামী কাল ডিসচার্জ করে দেব। সেই পেশেন্টের নাকি মুখ দিয়ে কাশির সঙ্গে রক্ত উঠে আসছে! টনসিল অপারেশনের পর অনেক সময় পোস্ট অপারেটিভ ব্লিডিং হয়। সেই মতো টেলিফোনেই সিস্টারদের নির্দেশ দিলাম। ব্রেক ওভার। লাঞ্চ সেরে আবার ফ্লোরে গেলাম। শট নেওয়া শুরু হল। ঘণ্টা খানেক বাদে নার্সিংহোম থেকে আবার ফোন। পেশেন্ট ভালো আছে। তবে বাড়ির লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। সিস্টারকে বললাম, আমি কলকাতার বাইরে আছি ফিরতে রাত হবে, ফেরার পথে অবশ্যই দেখে আসব। পেশেন্ট ভালো আছে জানার পর মন দিয়ে আবার শট দিতে লাগলাম। কিন্তু একটু বাদে আবার ফোন। ব্লিডিং হচ্ছে, তবে খুবই অল্প পরিমাণে, পেসেন্ট পার্টি জানতে চাইছে, আমি কত তাড়াতাড়ি আসবো। ফোনে কথা বললাম ওদের সঙ্গে, আশ্বস্ত করলাম। শ্যুটিংয়ের কথা তো আর বলতে পারি না! তাই বললাম, অসুস্থ এক আত্মীয়কে দেখতে গিয়েছিলাম, এখন ফিরছি।
শ্যুটিং মাথায় উঠলো। প্রমাদ গুনলাম। দিনকাল খারাপ। যদিও পেশেন্ট বেটার, তবু যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার নার্সিংহোমে পৌঁছনো উচিত। তাই চাইছে সিস্টার এবং পেশেন্ট পার্টি। ব্যাপারটা অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পাপ্পুকে বললাম। ও তো শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসলো। বেশি রাত পর্যন্ত শ্যুটিং করে আজই এই সিন শেষ করতে হবে, বুম্বাদার ডেট প্রবলেম। আবার নার্সিংহোম থেকে ফোন। অগত্যা হরনাথদার কাছে পুরো ব্যাপারটা খোলসা করে এবার বলতেই হল। দাদা বুঝলেন পুরোটাই। ইউনিটকে বললেন তাড়াতাড়ি শট নিতে। কিন্তু বললেই তো আর হল না, এ তো ধর তক্তা মার পেরেক নয়। ছুটি পাওয়ার আশা নেই দেখে, একবার ভাবলাম কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে যাই। পেশাগত দায়বদ্ধতা তো আগে। না হয় এই ইন্ডাস্ট্রির দরজা আমার জন্য চিরতরে বন্ধই হয়ে যাবে! আগে তো পেশেন্টকে বাঁচাই, নিজেও বাঁচি। এমন সময়ে হরনাথদা ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘আপনার সমস্যাটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আপনি বুম্বাদাকে সরাসরি বলুন। আমি আভাস দিয়ে রেখেছি। যদি কিছু ওয়ে আউট বার করতে পারেন তো উনিই পারবেন।’
শ্যুটিং মাথায় উঠলো। প্রমাদ গুনলাম। দিনকাল খারাপ। যদিও পেশেন্ট বেটার, তবু যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার নার্সিংহোমে পৌঁছনো উচিত। তাই চাইছে সিস্টার এবং পেশেন্ট পার্টি। ব্যাপারটা অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পাপ্পুকে বললাম। ও তো শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসলো। বেশি রাত পর্যন্ত শ্যুটিং করে আজই এই সিন শেষ করতে হবে, বুম্বাদার ডেট প্রবলেম। আবার নার্সিংহোম থেকে ফোন। অগত্যা হরনাথদার কাছে পুরো ব্যাপারটা খোলসা করে এবার বলতেই হল। দাদা বুঝলেন পুরোটাই। ইউনিটকে বললেন তাড়াতাড়ি শট নিতে। কিন্তু বললেই তো আর হল না, এ তো ধর তক্তা মার পেরেক নয়। ছুটি পাওয়ার আশা নেই দেখে, একবার ভাবলাম কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে যাই। পেশাগত দায়বদ্ধতা তো আগে। না হয় এই ইন্ডাস্ট্রির দরজা আমার জন্য চিরতরে বন্ধই হয়ে যাবে! আগে তো পেশেন্টকে বাঁচাই, নিজেও বাঁচি। এমন সময়ে হরনাথদা ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘আপনার সমস্যাটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আপনি বুম্বাদাকে সরাসরি বলুন। আমি আভাস দিয়ে রেখেছি। যদি কিছু ওয়ে আউট বার করতে পারেন তো উনিই পারবেন।’
রাজু আঙ্কেল সিনেমার একটি নাটকীয় দৃশ্য।
অগত্যা বুম্বাদা! উনি তখন ফ্লোরের বাইরে শ্যুটিং ব্রেকে আরাম চেয়ারে বসে ব্ল্যাক কফি খাচ্ছেন। দাদা বলে পাশে বসে আমার সমস্যার সাতকাহন ওনাকে শোনালাম। শুনে বললেন, ‘আপনি এখনও যাননি কেন! আমায় কেন আগে জানালেন না। যাবার আগে কোর্ট টাই প্যান্ট খুলে রেখে যান। ডামি দিয়ে ব্যাক টু ক্যামেরা শট হবে। ‘বুম্বাদাকে থ্যাংকস জানিয়ে এক ছুটে পাপ্পু-হরনাথদা হয়ে ড্রেসার রুমে। সব খুলে ড্রেসারের দেওয়া জামা প্যান্ট পরে গাড়িতে এসে বসলাম। পাপ্পু দৌড়ে এসে বলল, বুম্বাদা বলেছেন গাড়ি আসতে চালাতে, আর পৌঁছেই একটা ফোন করতে। রবিবার। রাস্তা ছিল ফাঁকা, এক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম নার্সিংহোমে। এভরিথিং ফাইন, পেশেন্ট গভীর ঘুমে, নো মোর ব্লিডিং। পেশেন্ট পার্টিও খুশি। এবার ফোন করবো পাপ্পুকে। তার আগেই হরনাথদার ফোন। উদ্বিগ্ন বুম্বাদা পেশেন্টের খবর জানতে চাইছেন। জানালাম সব, সঙ্গে রিপিটেড থ্যাঙ্কস।
সেদিন থেকেই অভিনেতা প্রসেনজিতের ভিতরে যে একটা মানুষ প্রসেনজিৎ এখনও আছে, গ্ল্যামারের চাকচিক্যে সে যে ঢাকা পড়েনি, বেশ বুঝেছিলাম। শুধু আমার জন্যই পরের দিন দু’ঘণ্টা বাড়তি শ্যুটিং করতে হয়েছিল বুম্বাদাকে। এরপর আমি ওঁর কাছে অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছিলাম। ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘মহাকাল’, ‘বন্ধু’, ‘জোর যার মুলুক তার’- সহ আরও কয়েকটি ছবিতে এক সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। নানা বিষয়ে কথাও হয়েছে। মানুষটার হাতে সব সময় একটা অদৃশ্য রিমোট থাকে। এই সবার সঙ্গে গল্প গুজব করছেন, ফোনে কথা বলছেন, হঠাৎ বাইরের সব সুইচ অফ করে ভিতরের সুইচটা অন করে নিজের জগতে মানে অভিনয়ের জগতে ডুবে গেলেন। এই বুম্বাদা তখন অন্য এক বুম্বাদা। এ ধরনের ঘটনার সাক্ষী হয়েছি আমি জীবনে আরও কয়েকবার, তার মধ্যে দুটি ঘটনার উল্লেখ করি। প্রথমটি ছিল উত্তম কুমারের ‘বাঘবন্দী খেলা। ‘শুটিং হয়েছিল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে। উত্তমবাবু শট দেওয়ার আগে সিগারেট ধরিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করছিলেন মানে সংলাপ বলছিলেন এবং পায়চারি করছিলেন। আশেপাশে কেউ কিছু দেখছে বা ভাবছে, ওঁর কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না। অথচ একটু আগেই বেশ কয়েকজনের সঙ্গে খুব হাসাহাসি করছিলেন।
সেদিন থেকেই অভিনেতা প্রসেনজিতের ভিতরে যে একটা মানুষ প্রসেনজিৎ এখনও আছে, গ্ল্যামারের চাকচিক্যে সে যে ঢাকা পড়েনি, বেশ বুঝেছিলাম। শুধু আমার জন্যই পরের দিন দু’ঘণ্টা বাড়তি শ্যুটিং করতে হয়েছিল বুম্বাদাকে। এরপর আমি ওঁর কাছে অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছিলাম। ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘মহাকাল’, ‘বন্ধু’, ‘জোর যার মুলুক তার’- সহ আরও কয়েকটি ছবিতে এক সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। নানা বিষয়ে কথাও হয়েছে। মানুষটার হাতে সব সময় একটা অদৃশ্য রিমোট থাকে। এই সবার সঙ্গে গল্প গুজব করছেন, ফোনে কথা বলছেন, হঠাৎ বাইরের সব সুইচ অফ করে ভিতরের সুইচটা অন করে নিজের জগতে মানে অভিনয়ের জগতে ডুবে গেলেন। এই বুম্বাদা তখন অন্য এক বুম্বাদা। এ ধরনের ঘটনার সাক্ষী হয়েছি আমি জীবনে আরও কয়েকবার, তার মধ্যে দুটি ঘটনার উল্লেখ করি। প্রথমটি ছিল উত্তম কুমারের ‘বাঘবন্দী খেলা। ‘শুটিং হয়েছিল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে। উত্তমবাবু শট দেওয়ার আগে সিগারেট ধরিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করছিলেন মানে সংলাপ বলছিলেন এবং পায়চারি করছিলেন। আশেপাশে কেউ কিছু দেখছে বা ভাবছে, ওঁর কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না। অথচ একটু আগেই বেশ কয়েকজনের সঙ্গে খুব হাসাহাসি করছিলেন।
রবীন্দ্র সদনে চলচ্চিত্র উৎসব উদ্বোধনে। সঙ্গে রয়েছেন গৌতম ঘোষ।
সুচিত্রা সেনের শ্যুটিং দেখার এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। ছবির নাম ছিল ‘দত্তা। ‘ওই ছবিতে অভিনেতা দিলীপ বসু, যার হাত ধরে আমার ছাত্র জীবনে প্রথম শ্যুটিং দর্শন শুরু, অভিনয় করেছিলেন এক চাকরের ভূমিকায়। পরিচালক ছিলেন স্বনামধন্য অজয় কর এবং হিরো ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সুচিত্রা সেন আছেন শুনে, আমি দিলীপ দার কাছে বায়না করেছিলাম, আমাকে শ্যুটিং দেখাতেই হবে। উনি অজয় করের কাছ থেকে স্পেশাল পারমিশন আদায় করে আমাকে এবং আমার আর এক বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছিলেন স্টুডিও সাপ্লাই কো অপারেটিভ স্টুডিওতে। প্রায় ৪৫ বছর আগের ঘটনা তো হবেই। আমরা স্টুডিওতে ঢুকে একটু দূরে দূরেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। সুচিত্রা সেনকে গাড়ি থেকে নামতে দেখলাম। দুই একজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে মেকআপ রুমে চলে গেলেন। ঘণ্টা খানেক বাদে ফ্লোরে এলেন। দিলীপদা আমাদের সেটের থেকে অনেকটা দূরে এমন একটা জায়গায় বসিয়ে দিলেন, যেখান থেকে আমরা শ্যুটিং দেখতে পাবো। কিন্তু মিসেস সেন আমাদের দেখতে পাবেন না। দিলীপদা পই পই করে বলে দিলেন, আমরা যেন কথা না বলি, হেঁচে কেশে না ফেলি! একবার যদি মিসেস সেন টের পান, তাহলে শ্যুটিং ফ্লোর ছেড়ে সোজা গাড়িতে উঠে বাড়ি চলে যাবেন। বাইরের লোককে উনি কোনওভাবেই শ্যুটিং ফ্লোরে অ্যালাও করেন না। ক্যামেরা চালু হওয়ার আগে মিসেস সেন মজা করে কিছু বলছিলেন। উপস্থিত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-সহ অনেকেই হো হো করে হাসছিলেন, উনি নিজেও হেসে গড়িয়ে পড়ছিলেন। কী বলছিলেন সেসব আমরা দূর থেকে শুনতে পাইনি। তবে মিনিট দশেক খুব হই চই হওয়ার পর শট টেকিং শুরু হল। খুব ইমোশনাল সিন ছিল। সুচিত্রা সেন মুহূর্তে চরিত্র হয়ে গেলেন এবং দুই একটি সংলাপ বলার পর অনুচ্চারিত কান্নার অসাধারণ অভিব্যক্তি দিলেন। একটি টেকেই শটটি উতরে গেল।
আবার বুম্বাদার কথায় ফিরে যাই। ওঁর এক পাগল ভক্তর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। যে বুম্বাদার স্টাইলে হাঁটে, ঘাড় বেঁকায়, কথা বলে, হাসে, বুম্বাদার মূর্তি করে পূজা করে। ওঁকে একথা বলতেই ছেলেটিকে নিয়ে আসতে বললেন ষ্টুডিওতে। তখন স্বপন ঘোষালের ‘মহাকাল’ ছবির শুটিং চলছে। নিয়ে গেলাম ওঁর কাছে। কথা বললেন, ছবি তুললেন, অটোগ্রাফ দিলেন, চা খাওয়ালেন। ছেলেটির তো আনন্দে পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা! ‘মহাকাল’ সিনেমায় আমার চরিত্রটি ছিল কারামন্ত্রীর, যিনি জেল পরিদর্শনে গিয়ে নিজেই কিডন্যাপড হয়ে গেলেন একদল দুষ্কৃতীদের হাতে। সিনটা ছিল, বুম্বাদা আমার বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে একটি গাড়িতে তুলবেন এবং গাড়ি স্টার্ট করে বেরিয়ে যাবে। শট শুরুর আগে বললেন, অমিতাভদা, ‘আপনি শুধু এক্সপ্রেশন দিয়ে যাবেন, আমি আপনাকে যেভাবে টেনে বার করব, আপনি সেভাবেই এগোবেন। কোনও বাড়তি এফোর্ট দেবেন না। ‘আমি ঠিক তাই করেছিলাম। এবং এক শটেই এই লম্বা সিনটি ওকে হয়েছিল। আমার সহ শিল্পী ছিল রাজেশ শর্মা, কাঞ্চন, বিপ্লব এবং রাজা। অ্যাকটিং করতে গিয়ে দেখেছি বুম্বাদা ভীষণ প্রফেশনালি স্কিল্ড। ফিল্ম মিডিয়াটাকে গুলে খেয়েছেন।
আবার বুম্বাদার কথায় ফিরে যাই। ওঁর এক পাগল ভক্তর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। যে বুম্বাদার স্টাইলে হাঁটে, ঘাড় বেঁকায়, কথা বলে, হাসে, বুম্বাদার মূর্তি করে পূজা করে। ওঁকে একথা বলতেই ছেলেটিকে নিয়ে আসতে বললেন ষ্টুডিওতে। তখন স্বপন ঘোষালের ‘মহাকাল’ ছবির শুটিং চলছে। নিয়ে গেলাম ওঁর কাছে। কথা বললেন, ছবি তুললেন, অটোগ্রাফ দিলেন, চা খাওয়ালেন। ছেলেটির তো আনন্দে পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা! ‘মহাকাল’ সিনেমায় আমার চরিত্রটি ছিল কারামন্ত্রীর, যিনি জেল পরিদর্শনে গিয়ে নিজেই কিডন্যাপড হয়ে গেলেন একদল দুষ্কৃতীদের হাতে। সিনটা ছিল, বুম্বাদা আমার বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে একটি গাড়িতে তুলবেন এবং গাড়ি স্টার্ট করে বেরিয়ে যাবে। শট শুরুর আগে বললেন, অমিতাভদা, ‘আপনি শুধু এক্সপ্রেশন দিয়ে যাবেন, আমি আপনাকে যেভাবে টেনে বার করব, আপনি সেভাবেই এগোবেন। কোনও বাড়তি এফোর্ট দেবেন না। ‘আমি ঠিক তাই করেছিলাম। এবং এক শটেই এই লম্বা সিনটি ওকে হয়েছিল। আমার সহ শিল্পী ছিল রাজেশ শর্মা, কাঞ্চন, বিপ্লব এবং রাজা। অ্যাকটিং করতে গিয়ে দেখেছি বুম্বাদা ভীষণ প্রফেশনালি স্কিল্ড। ফিল্ম মিডিয়াটাকে গুলে খেয়েছেন।
নন্দনে এক অনুষ্ঠানে।।
আমার লেখা কয়েকটি বই বুম্বাদাকে প্রেজেন্ট করেছিলাম। নতুন কী লিখছি, দেখা হলেই জিজ্ঞেস করতেন। এমনকি বছর পাঁচেক আগে যখন ডাঃ সুব্রত মালাকারের সম্পাদনায় একটি মাসিক পত্রিকার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে হায়াত রিজেন্সি হোটেলে দেখা হল, উনি আমাকে দেখিয়ে সুব্রতদাকে বললেন, জানেন তো, অমিতাভদা কিন্তু ফাটাফাটি লেখেন।
বুম্বাদার স্ট্রাগলিং লাইফকে ব্যাকগ্রাউন্ড রেখে ওঁর ওই পাগল ভক্ত ছেলেটিকে নিয়ে একটি বড় গল্প লিখেছিলাম আমি বছর দশেক আগে। নাম ছিল ‘লম্বা রেসের ঘোড়া’। একটি জনপ্রিয় কিশোর পত্রিকার পুজোসংখ্যায় সেটি প্রকাশিতও হয়েছিল। পরে সংকলিত হয়েছিল দে’জ পাবলিশিং প্রকাশিত আমার এক গল্প সংকলনে। বুম্বাদার হাতে বইটি তুলে দিয়ে গল্পটি ওঁকে সংক্ষেপে শুনিয়েছিলাম। উনি সিনেমা করার ব্যাপারে আগ্রহও দেখিয়েছিলেন। যোগাযোগের অভাবে ব্যাপারটার আর এগোয়নি। বুম্বাদার হয়তো মনেও নেই। কিন্তু ওঁর জীবনটা এত চড়াই উৎরাই মেশানো যে তাঁকে নিয়ে একটা জম্পেশ ছবি তো করাই যায়। আমার গল্প না হোক, অন্য কোনও ভালো গল্পকারের গল্প নিয়ে। যায় না! বুম্বাদা নিজেও একটু ভেবে দেখতে পারেন কিন্তু!
ফটো সৌজন্যে: মতিলাল মণ্ডল
বুম্বাদার স্ট্রাগলিং লাইফকে ব্যাকগ্রাউন্ড রেখে ওঁর ওই পাগল ভক্ত ছেলেটিকে নিয়ে একটি বড় গল্প লিখেছিলাম আমি বছর দশেক আগে। নাম ছিল ‘লম্বা রেসের ঘোড়া’। একটি জনপ্রিয় কিশোর পত্রিকার পুজোসংখ্যায় সেটি প্রকাশিতও হয়েছিল। পরে সংকলিত হয়েছিল দে’জ পাবলিশিং প্রকাশিত আমার এক গল্প সংকলনে। বুম্বাদার হাতে বইটি তুলে দিয়ে গল্পটি ওঁকে সংক্ষেপে শুনিয়েছিলাম। উনি সিনেমা করার ব্যাপারে আগ্রহও দেখিয়েছিলেন। যোগাযোগের অভাবে ব্যাপারটার আর এগোয়নি। বুম্বাদার হয়তো মনেও নেই। কিন্তু ওঁর জীবনটা এত চড়াই উৎরাই মেশানো যে তাঁকে নিয়ে একটা জম্পেশ ছবি তো করাই যায়। আমার গল্প না হোক, অন্য কোনও ভালো গল্পকারের গল্প নিয়ে। যায় না! বুম্বাদা নিজেও একটু ভেবে দেখতে পারেন কিন্তু!
ফটো সৌজন্যে: মতিলাল মণ্ডল