পরের দিন যে আমার শ্যুটিং নেই সেটা আগেই জেনে গিয়েছিলাম। হোটেলে বেলা করে ঘুম থেকে উঠলাম। ব্রেকফাস্ট করে কিছুক্ষণ হোটেলের আশপাশে ঘুরে বেরিয়ে প্রোডাকশনের গাড়ি চেপে শ্যুটিং লোকেশনে গিয়ে পৌঁছলাম। মিঠুন চক্রবর্তী এলেন একটু পরেই৷ খোলা মাঠে শ্যুটিং৷ মাঠের বুক চিরে পিচঢালা রাস্তা৷ প্রচুর ক্রাউড নিয়ে শ্যুটিং শুরু হল। মাঠের মধ্যে বিশাল তাঁবু খাটিয়ে আর্টিস্টদের বসার ব্যবস্থা, মেকআপ, এমনকী খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ মিঠুনের সঙ্গে এর মধ্যে হাই-হ্যালো হয়ে গেছে। সবাই মিলে একসঙ্গে লাঞ্চ করার ফাঁকে আবদার করলাম ওঁর সঙ্গে একটা ফটো তোলার। মিঠুন গম্ভীরভাবে বললেন, পরে তুলব। লাঞ্চের পর কিছুক্ষণ মিঠুনের শ্যুটিং ছিল না। প্রোডাকশনের ছেলেরা খাবার টেবিল দুটোকে পরিষ্কার করে লম্বা করে পেতে তার উপর বিছানা সাজিয়ে দিল। মিঠুন দিব্যি সেই বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল, মাথার সামনে একটা পেডেস্টাল ফ্যান চালু করে দেওয়া হল। হাওয়া পাওয়ার আশায় আমি আমার চেয়ারটিকে টেনে ফ্যানের কাছাকাছি চলে এলাম। একটু বাদে ভাতঘুমের সঙ্গে মিঠুনের মৃদু নাসিকা গর্জন কানে এল।
ঘণ্টাখানেক বাদে শ্যুটিংয়ে ডাক পড়ল মিঠুনের। মিঠুন রেডি হয়ে চলে যেতেই আমি সেই শয্যার দখল নিলাম। এবার ঘণ্টাখানেক বাদে আমারও ডাক পড়ল। একটু আশ্চর্য হলাম। আমার তো আজ শ্যুটিং নেই! তাই মেকআপ করিনি, কস্টিউমও পরিনি। একটু দূরেই লোকেশন। গিয়ে দেখলাম আমাকে ডেকেছেন স্বয়ং মিঠুন। বললেন, এবার আমার সঙ্গে ফটোটা তুলে ফেলুন। ওঁর পাশের একটা খালি চেয়ারে আমাকে ডেকে বসালেন। একজনকে ডেকে আমার ক্যামেরাটা তাকে দিতে বললেন। দিলাম। তিনি পটাপট কয়েকটা ফটো তুলে দিলেন। দে’জ পাবলিশিং, যারা আমার বই প্রকাশ করে থাকে, সেখান থেকে মিঠুনের লেখা একটা বই বেরিয়েছিল। নাম ছিল, ‘সিনেমায় নামতে হলে’। সেই বইটা আমি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। বইটি ওঁর সামনে মেলে ধরে বললাম, আমার মেয়ের নাম লিখে তার নীচে আপনি একটা সই করে দিন। মিঠুন মেয়ের নাম জিজ্ঞেস করলেন, বয়স কত, কী করে ইত্যাদি জানতে চাইলেন। তারপর বইয়ের ভিতরের পাতায় লিখে দিলেন: ‘অনেক ভালোবাসা জানালাম অর্কমিতাকে, ভালো থেকো, মিঠুন চক্রবর্তী।’ মিঠুনের মুডটা ভালোই ছিল। তাই নানা বিষয়ে একটু কথাবার্তা বলার সুযোগ হল আমার। ওঁর সঙ্গে কীভাবে আমার পরিচয় হয়েছিল, সেটা সবিস্তারে জানালাম। ডাঃ সুনীল ঠাকুর, থ্যালাসেমিয়া, বইমেলা, ডাক্তারদের সমস্যা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা হল। পরের দিন মর্নিং ফ্লাইটে কলকাতা ফিরে এলাম।
এরপর প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে। আমি কয়েকবার হরদা-র অ্যাসিস্ট্যান্ট পাপ্পুর সঙ্গে ফোনাফুনি করেছি। সময় হলেই আমায় ডেকে নেবে, আশ্বাস দিয়েছে ও। অবশেষে ডাক পড়ল আমার। পাপ্পুই ফোন করে জানাল, কাল সন্ধেবেলা আপনি নিউ থিয়েটার্সে চলে আসবেন। একটা রঙিন পাঞ্জাবি এবং সাদা পাজামা পারলে ক্যারি করবেন। শুনে একটু আশ্চর্য হলাম! ডিএসপি মানে আমি, মিঠুনের সঙ্গে পাঞ্জাবি-পাজামা পরে ক্লাইম্যাক্স সিনে টক্কর দেব! পাপ্পুকে জিজ্ঞেস করলাম, কাল আমার কার সঙ্গে শ্যুটিং, মিঠুনের সঙ্গেই তো? পাপ্পু প্রত্যুত্তরে বলল, ওসব নিয়ে ভাববেন না, কাল আপনি চলে আসুন, হরদা আপনাকে বুঝিয়ে বলে দেবে সব। একটু সাসপেন্সে রেখে পাপ্পু ফোনটা ছেড়ে দিল।
পরের দিন বিকেল পাঁচটায় নিউ থিয়েটার্সে ঢুকেই দেখলাম সাজো সাজো রব। বিরাট শামিয়ানা খাটানো হয়েছে, হাজারখানেক লোক সেখানে উপস্থিত। প্রত্যেকেই মুসলিম চরিত্রে অভিনয় করবেন। দৃশ্যটি হল, রোজার শেষে ইফতার পার্টির। মেকআপ রুমে গিয়ে জানলাম, আমার চরিত্র পালটে গেছে। আমি একজন অসৎ প্রোমোটার মোহাম্মদ আলম-এর চরিত্রে এখন অভিনয় করব। একজনকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করলাম, মিঠুনদা আজ শটে আছেন তো? চোখ কপালে তুলে তিনি জানালেন, মিঠুনদাকে এখানে কোথায় পাবেন! এখন মুম্বইতে শ্যুটিং করছেন। পোশাক পরে, মেকআপ করে সরাসরি উপস্থিত হলাম হরদার কাছে। শুধোলাম, আমার রোলটা নাকি পালটে গেছে? হরদা একটু আমতা আমতা করে বললেন, এই রোলটা আরও ভালো। মিঠুনদার সঙ্গে নেই তো কী হয়েছে! এই রোলটা অনেক বেশি ইম্পর্টেন্ট। করেই দেখুন না।
না করেও তো তখন আর ফেরার কোনও উপায় নেই। শুধু ভাবছিলাম, সবাইকে যে বড় মুখ করে বললাম, আমি মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে অ্যাক্টিং করেছি, তার কী হবে! তখন হরনাথ চক্রবর্তীর সিনেমা মানেই সুপারহিট। সঙ্গে আবার মিঠুন। আমার পরিচিত বহু লোক সিনেমাটা দেখতে গিয়ে তো আমাকেই খুঁজবেন। আমার বন্ধু রনি ওরফে রজতাভ দত্ত-কে সংক্ষেপে ঘটনাগুলো বলতেই একগাল চওড়া হাসি হেসে বলল, আরে ছাড়ো তো। সিনেমাতে এরকম অনেক কিছুই হয়। মন দিয়ে অ্যাক্টিংটা করো। তাই করলাম। রনি ছাড়াও আমার সহ-অভিনেতা ছিলেন ওড়িশার বিখ্যাত অভিনেতা হর পট্টনায়ক, অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজেশ শর্মা। দৃশ্যটা ছিল ইফতার পার্টিতে কিছু অসৎ মানুষের ধান্দাবাজির বাক্যালাপ। যাঁরা তুলকালাম দেখেছেন বড় বা ছোট পর্দায়, তাঁদের দৃশ্যটি মনে পড়তে পারে। শ্যুটিং শেষে বিফল মনোরথ হয়েই বাড়ির পথ ধরলাম। তার আগে ফটোগ্রাফারকে ডেকে বললাম, মিঠুনের সঙ্গে আমার তো অনেক ছবি তুলেছ তুমি, দু’তিনটে ছবি আমাকে দিও, স্মৃতি হিসেবে রাখব। সপ্তাহ খানেক বাদে যথারীতি এই দৃশ্যটির ডাবিংও হয়ে গেল ঢাকুরিয়ার এক স্টুডিওতে। মাইশোরে করা দৃশ্যটির ডাবিং কিন্তু হল না। বুঝলাম, দৃশ্যটি পুরোপুরিই বাদ গেছে। মানে তুলকালামে মিঠুনের সঙ্গে আমার অভিনীত দৃশ্যটি আর রইল না। মিঠুন-শোক ভুলে ক’দিনের মধ্যেই আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলাম। তবে মনের মধ্যে খচখচানিটা রয়েই গেল। খবর পেলাম, বইয়ের পুরো শ্যুটিং শেষ হয়েছে, এবার পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শুরু হবে।
এর মধ্যে কেটে গেছে চার-পাঁচ সপ্তাহ। একদিন সকালে বাড়ির চেম্বারে পেশেন্ট দেখছি। হঠাৎ পাপ্পুর ফোন পেলাম। অমিতাভদা, এই সপ্তাহে আপনাকে দু’দিন কাজে লাগবে। ফ্রি আছেন? আউটডোরে যেতে হবে। একটু বাদে হরদা ফোন করে আপনাকে ডিটেলস জানাবেন। শুনে খুশি হলাম। হরনাথ চক্রবর্তীর পরবর্তী নতুন ছবিতেও তাহলে আমি সুযোগ পাচ্ছি! সন্ধ্যাবেলায় হরদার ফোন পেলাম। আমাকে হায়দরাবাদে রামোজি ফিল্ম সিটিতে দু’দিনের জন্য যেতে হবে। আবার মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে অভিনয় করতে হবে! এবং শুনে আশ্চর্য হলাম সিনেমাটির নাম তুলকালাম। যে রোলটি (মোঃ আলম) আমি নিউ থিয়েটার্সে মাসখানেক আগে করে এসেছিলাম, তারই কন্টিনিউয়েশন। তার মানে তুলকালামে মিঠুনের সঙ্গে আমার দ্বিতীয় বারের জন্য অভিষেক। গল্পের গোরু গাছে ওঠে শুনেছিলাম, সিনেমার গল্পও যে গাছে উঠতে পারে, জানা ছিল না!
আবার ইন্ডিগোর ইভিনিং ফ্লাইট। যথারীতি হায়দরাবাদ এয়ারপোর্টে প্রোডাকশনের গাড়ি হাজির। আমাকে নিয়ে সোজা রামোজি ফিল্ম সিটিতে। এ আমার চেনা শহর। বিশাল এক পাহাড়ের উপর এক বঙ্গসন্তান নীতীশ রায়ের পরিকল্পনায় তৈরি সাজানো-গোছানো এক রম্যপুরী। ১৯৯৮ সালে ইটিভি যখন প্রথম লঞ্চ করছে, তখন বাংলা সিরিয়াল ‘মা মনসা’য় ব্রহ্মা চরিত্র করতে বেশ কয়েকবার এখানে আসতে হয়েছে। তখন অবশ্য ট্রেনে আসতাম। প্রথমে নন এসি, তারপরে এসি, আর এখন অভিনয়জগতে আমার প্রমোশন হওয়াতে ফ্লাইট পেয়ে থাকি।
ঘণ্টাখানেক বাদে শ্যুটিংয়ে ডাক পড়ল মিঠুনের। মিঠুন রেডি হয়ে চলে যেতেই আমি সেই শয্যার দখল নিলাম। এবার ঘণ্টাখানেক বাদে আমারও ডাক পড়ল। একটু আশ্চর্য হলাম। আমার তো আজ শ্যুটিং নেই! তাই মেকআপ করিনি, কস্টিউমও পরিনি। একটু দূরেই লোকেশন। গিয়ে দেখলাম আমাকে ডেকেছেন স্বয়ং মিঠুন। বললেন, এবার আমার সঙ্গে ফটোটা তুলে ফেলুন। ওঁর পাশের একটা খালি চেয়ারে আমাকে ডেকে বসালেন। একজনকে ডেকে আমার ক্যামেরাটা তাকে দিতে বললেন। দিলাম। তিনি পটাপট কয়েকটা ফটো তুলে দিলেন। দে’জ পাবলিশিং, যারা আমার বই প্রকাশ করে থাকে, সেখান থেকে মিঠুনের লেখা একটা বই বেরিয়েছিল। নাম ছিল, ‘সিনেমায় নামতে হলে’। সেই বইটা আমি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। বইটি ওঁর সামনে মেলে ধরে বললাম, আমার মেয়ের নাম লিখে তার নীচে আপনি একটা সই করে দিন। মিঠুন মেয়ের নাম জিজ্ঞেস করলেন, বয়স কত, কী করে ইত্যাদি জানতে চাইলেন। তারপর বইয়ের ভিতরের পাতায় লিখে দিলেন: ‘অনেক ভালোবাসা জানালাম অর্কমিতাকে, ভালো থেকো, মিঠুন চক্রবর্তী।’ মিঠুনের মুডটা ভালোই ছিল। তাই নানা বিষয়ে একটু কথাবার্তা বলার সুযোগ হল আমার। ওঁর সঙ্গে কীভাবে আমার পরিচয় হয়েছিল, সেটা সবিস্তারে জানালাম। ডাঃ সুনীল ঠাকুর, থ্যালাসেমিয়া, বইমেলা, ডাক্তারদের সমস্যা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা হল। পরের দিন মর্নিং ফ্লাইটে কলকাতা ফিরে এলাম।
এরপর প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে। আমি কয়েকবার হরদা-র অ্যাসিস্ট্যান্ট পাপ্পুর সঙ্গে ফোনাফুনি করেছি। সময় হলেই আমায় ডেকে নেবে, আশ্বাস দিয়েছে ও। অবশেষে ডাক পড়ল আমার। পাপ্পুই ফোন করে জানাল, কাল সন্ধেবেলা আপনি নিউ থিয়েটার্সে চলে আসবেন। একটা রঙিন পাঞ্জাবি এবং সাদা পাজামা পারলে ক্যারি করবেন। শুনে একটু আশ্চর্য হলাম! ডিএসপি মানে আমি, মিঠুনের সঙ্গে পাঞ্জাবি-পাজামা পরে ক্লাইম্যাক্স সিনে টক্কর দেব! পাপ্পুকে জিজ্ঞেস করলাম, কাল আমার কার সঙ্গে শ্যুটিং, মিঠুনের সঙ্গেই তো? পাপ্পু প্রত্যুত্তরে বলল, ওসব নিয়ে ভাববেন না, কাল আপনি চলে আসুন, হরদা আপনাকে বুঝিয়ে বলে দেবে সব। একটু সাসপেন্সে রেখে পাপ্পু ফোনটা ছেড়ে দিল।
পরের দিন বিকেল পাঁচটায় নিউ থিয়েটার্সে ঢুকেই দেখলাম সাজো সাজো রব। বিরাট শামিয়ানা খাটানো হয়েছে, হাজারখানেক লোক সেখানে উপস্থিত। প্রত্যেকেই মুসলিম চরিত্রে অভিনয় করবেন। দৃশ্যটি হল, রোজার শেষে ইফতার পার্টির। মেকআপ রুমে গিয়ে জানলাম, আমার চরিত্র পালটে গেছে। আমি একজন অসৎ প্রোমোটার মোহাম্মদ আলম-এর চরিত্রে এখন অভিনয় করব। একজনকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করলাম, মিঠুনদা আজ শটে আছেন তো? চোখ কপালে তুলে তিনি জানালেন, মিঠুনদাকে এখানে কোথায় পাবেন! এখন মুম্বইতে শ্যুটিং করছেন। পোশাক পরে, মেকআপ করে সরাসরি উপস্থিত হলাম হরদার কাছে। শুধোলাম, আমার রোলটা নাকি পালটে গেছে? হরদা একটু আমতা আমতা করে বললেন, এই রোলটা আরও ভালো। মিঠুনদার সঙ্গে নেই তো কী হয়েছে! এই রোলটা অনেক বেশি ইম্পর্টেন্ট। করেই দেখুন না।
না করেও তো তখন আর ফেরার কোনও উপায় নেই। শুধু ভাবছিলাম, সবাইকে যে বড় মুখ করে বললাম, আমি মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে অ্যাক্টিং করেছি, তার কী হবে! তখন হরনাথ চক্রবর্তীর সিনেমা মানেই সুপারহিট। সঙ্গে আবার মিঠুন। আমার পরিচিত বহু লোক সিনেমাটা দেখতে গিয়ে তো আমাকেই খুঁজবেন। আমার বন্ধু রনি ওরফে রজতাভ দত্ত-কে সংক্ষেপে ঘটনাগুলো বলতেই একগাল চওড়া হাসি হেসে বলল, আরে ছাড়ো তো। সিনেমাতে এরকম অনেক কিছুই হয়। মন দিয়ে অ্যাক্টিংটা করো। তাই করলাম। রনি ছাড়াও আমার সহ-অভিনেতা ছিলেন ওড়িশার বিখ্যাত অভিনেতা হর পট্টনায়ক, অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজেশ শর্মা। দৃশ্যটা ছিল ইফতার পার্টিতে কিছু অসৎ মানুষের ধান্দাবাজির বাক্যালাপ। যাঁরা তুলকালাম দেখেছেন বড় বা ছোট পর্দায়, তাঁদের দৃশ্যটি মনে পড়তে পারে। শ্যুটিং শেষে বিফল মনোরথ হয়েই বাড়ির পথ ধরলাম। তার আগে ফটোগ্রাফারকে ডেকে বললাম, মিঠুনের সঙ্গে আমার তো অনেক ছবি তুলেছ তুমি, দু’তিনটে ছবি আমাকে দিও, স্মৃতি হিসেবে রাখব। সপ্তাহ খানেক বাদে যথারীতি এই দৃশ্যটির ডাবিংও হয়ে গেল ঢাকুরিয়ার এক স্টুডিওতে। মাইশোরে করা দৃশ্যটির ডাবিং কিন্তু হল না। বুঝলাম, দৃশ্যটি পুরোপুরিই বাদ গেছে। মানে তুলকালামে মিঠুনের সঙ্গে আমার অভিনীত দৃশ্যটি আর রইল না। মিঠুন-শোক ভুলে ক’দিনের মধ্যেই আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলাম। তবে মনের মধ্যে খচখচানিটা রয়েই গেল। খবর পেলাম, বইয়ের পুরো শ্যুটিং শেষ হয়েছে, এবার পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শুরু হবে।
এর মধ্যে কেটে গেছে চার-পাঁচ সপ্তাহ। একদিন সকালে বাড়ির চেম্বারে পেশেন্ট দেখছি। হঠাৎ পাপ্পুর ফোন পেলাম। অমিতাভদা, এই সপ্তাহে আপনাকে দু’দিন কাজে লাগবে। ফ্রি আছেন? আউটডোরে যেতে হবে। একটু বাদে হরদা ফোন করে আপনাকে ডিটেলস জানাবেন। শুনে খুশি হলাম। হরনাথ চক্রবর্তীর পরবর্তী নতুন ছবিতেও তাহলে আমি সুযোগ পাচ্ছি! সন্ধ্যাবেলায় হরদার ফোন পেলাম। আমাকে হায়দরাবাদে রামোজি ফিল্ম সিটিতে দু’দিনের জন্য যেতে হবে। আবার মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে অভিনয় করতে হবে! এবং শুনে আশ্চর্য হলাম সিনেমাটির নাম তুলকালাম। যে রোলটি (মোঃ আলম) আমি নিউ থিয়েটার্সে মাসখানেক আগে করে এসেছিলাম, তারই কন্টিনিউয়েশন। তার মানে তুলকালামে মিঠুনের সঙ্গে আমার দ্বিতীয় বারের জন্য অভিষেক। গল্পের গোরু গাছে ওঠে শুনেছিলাম, সিনেমার গল্পও যে গাছে উঠতে পারে, জানা ছিল না!
আবার ইন্ডিগোর ইভিনিং ফ্লাইট। যথারীতি হায়দরাবাদ এয়ারপোর্টে প্রোডাকশনের গাড়ি হাজির। আমাকে নিয়ে সোজা রামোজি ফিল্ম সিটিতে। এ আমার চেনা শহর। বিশাল এক পাহাড়ের উপর এক বঙ্গসন্তান নীতীশ রায়ের পরিকল্পনায় তৈরি সাজানো-গোছানো এক রম্যপুরী। ১৯৯৮ সালে ইটিভি যখন প্রথম লঞ্চ করছে, তখন বাংলা সিরিয়াল ‘মা মনসা’য় ব্রহ্মা চরিত্র করতে বেশ কয়েকবার এখানে আসতে হয়েছে। তখন অবশ্য ট্রেনে আসতাম। প্রথমে নন এসি, তারপরে এসি, আর এখন অভিনয়জগতে আমার প্রমোশন হওয়াতে ফ্লাইট পেয়ে থাকি।
পরের দিন সকাল বেলায় শ্যুটিং। প্রোডাকশনের গাড়িতে সকাল আটটাতেই লোকেশনে পৌঁছে গেলাম। লোকেশন বলতে আমাদের গেস্ট হাউস থেকে রামোজি ফিল্ম সিটির মধ্যেই মিনিট দশেক দূরে শিল্প নির্দেশকের তৈরি করা একটি গ্রামে। গ্রামে বিয়ার ফ্যাক্টরি করার জন্য আমি জমি দখল করতে এসেছি দলবল নিয়ে। গ্রামবাসীরা প্রতিবাদ করবে এবং তর্কাতর্কির পর নেতৃস্থানীয় একজন মহিলা আমার গালে চড় কষাবেন। যে ভদ্রমহিলা চরিত্রটি করছিলেন, এর আগে তার সিনেমায় কাজ করার কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। সিনেমায় অনেক কিছুই চিটিং করে নেওয়া হয়। চড়টাও এমনভাবে মারা হয়, যাতে, যিনি চড়টি খাচ্ছেন তাঁর গালে হাতের স্পর্শও না লাগে। অর্থাৎ সময়মতো তিনি গালটি সরিয়ে নেবেন। অথচ সিনেমার পর্দায় দেখলে মনে হবে সত্যিই চড়টি গালে গিয়েই লাগল। ভদ্রমহিলা খুব উত্তেজিত হয়ে সংলাপ বললেন এবং তারপর সপাটে আমার গালে চড় মারলেন। আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম। শুধু মাস্টার শটে নয়, মিড শট, লং শট, ক্লোজ শটেও। সব মিলিয়ে আমি বাঁ গালে চারবার চড় খেলাম। আর প্রতিবারই চড় মারার পরে উনি হাত দুটো ধরে বলতেন, সরি ভাই, লাগেনি তো। এভাবেই মিঠুনের প্রবেশের আগে পর্যন্ত সিনের যেটুকু অংশ ছিল সেটার শ্যুটিং শেষ হল। এবার মিঠুনের জন্য প্রতীক্ষা। আধ ঘণ্টার মধ্যেই উনি এলেন। চেয়ারে বসতে না বসতেই সবাই প্রায় লাইন দিয়ে পায়ের ধুলো গ্রহণ করল। প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে গেলে আমি গুটি গুটি পায়ে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাতজোড় করে নমস্কার করলাম। উনিও প্রতি নমস্কার করলেন। আমি খুব সংক্ষেপে আমার চরিত্রটি পালটে যাওয়ার পুরো ঘটনাটা ওঁকে বললাম। শুনে বললেন, আমি সব জানি৷ আপনি তো নাটক করেন। আমিই হর-কে বললাম এই রোলটা ডাক্তারবাবুকে দিতে। রোলটা অনেক বেশি ড্রামাটিক। আমি তো আহ্লাদ এবং কৃতজ্ঞতায় প্রায় মাটিতে মিশে গেলাম। তবে সত্যিই উনি এই চরিত্রে আমার নাম সাজেস্ট করেছিলেন কি না, এ বিষয়ে আমার আজও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমার মনে হয়, পুরো ব্যাপারটাই কাকতালীয়। কিংবা যাঁরা ভাগ্যে বিশ্বাস করেন, তাঁরা বলতে পারেন, তোর ভাগ্যে মিঠুন চক্কোত্তির সঙ্গে অভিনয় করার কথা ছিল, তাই এমনটা হল।
আগের সিন যেখানে শেষ হয়েছিল অর্থাৎ ভদ্রমহিলা আমাকে বলেছিলেন, ‘তোর ঘরে মা বোন নেই’ বলে সপাটে চড় কষিয়েছিলেন আমার গালে, মিঠুন তখন প্রবেশ করে বলবেন, এক গালে নয়—এক গালে নয়, দু গালে। এই কথার এগেনস্টে আমি কিছু বলব, আবার মিঠুন বলবেন, আবার আমি বলব— এই ভাবে সিনটা এগোবে এবং শেষে আমার দলবলের সঙ্গে মিঠুনের ভয়ংকর মারামারি শুরু হবে। মিঠুন একাই সবাইকে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবেন। ক্লোজ শট শুরু হল, অর্থাৎ ক্যামেরা আমার মুখের উপর। যথারীতি ক্যামেরার পিছনে চেয়ারে ঠ্যাং তুলে বসে মিঠুন তাঁর সংলাপগুলো বলছেন। আমি পালটা বলছি। আমারটাই ক্যামেরায় তোলা হচ্ছে। হঠাৎ নার্ভাস ব্রেকডাউন হল। যে মেজাজে মিঠুনকে চমকে আমার পালটা উত্তরগুলো দেওয়া উচিত, আমি সেই স্কেলে একদম পৌঁছতে পারছিলাম না। মিঠুন ব্যাপারটা বুঝলেন। বললেন ডাক্তারবাবু, এই সিনটার হিরো কিন্তু আপনি, কাজেই হাই স্কেলে ধমকি দিয়ে কথা বলুন। আমি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম, দাদা আপনি যদি একটু দেখিয়ে দেন। মিঠুন পিলে চমকানো স্বরে আমার একটা ডায়লগ বললেন। আমারও নার্ভাস ব্রেকডাউন ব্রেক হয়ে নার্ভগুলো স্ট্রং হয়ে গেল। বেশ মেজাজ নিয়েই সংলাপগুলো বললাম এবং যথারীতি পরিচালকের সেগুলো পছন্দ হল। এরপরই ঘোষণা হল, লাঞ্চ ব্রেক।
আগের সিন যেখানে শেষ হয়েছিল অর্থাৎ ভদ্রমহিলা আমাকে বলেছিলেন, ‘তোর ঘরে মা বোন নেই’ বলে সপাটে চড় কষিয়েছিলেন আমার গালে, মিঠুন তখন প্রবেশ করে বলবেন, এক গালে নয়—এক গালে নয়, দু গালে। এই কথার এগেনস্টে আমি কিছু বলব, আবার মিঠুন বলবেন, আবার আমি বলব— এই ভাবে সিনটা এগোবে এবং শেষে আমার দলবলের সঙ্গে মিঠুনের ভয়ংকর মারামারি শুরু হবে। মিঠুন একাই সবাইকে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবেন। ক্লোজ শট শুরু হল, অর্থাৎ ক্যামেরা আমার মুখের উপর। যথারীতি ক্যামেরার পিছনে চেয়ারে ঠ্যাং তুলে বসে মিঠুন তাঁর সংলাপগুলো বলছেন। আমি পালটা বলছি। আমারটাই ক্যামেরায় তোলা হচ্ছে। হঠাৎ নার্ভাস ব্রেকডাউন হল। যে মেজাজে মিঠুনকে চমকে আমার পালটা উত্তরগুলো দেওয়া উচিত, আমি সেই স্কেলে একদম পৌঁছতে পারছিলাম না। মিঠুন ব্যাপারটা বুঝলেন। বললেন ডাক্তারবাবু, এই সিনটার হিরো কিন্তু আপনি, কাজেই হাই স্কেলে ধমকি দিয়ে কথা বলুন। আমি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম, দাদা আপনি যদি একটু দেখিয়ে দেন। মিঠুন পিলে চমকানো স্বরে আমার একটা ডায়লগ বললেন। আমারও নার্ভাস ব্রেকডাউন ব্রেক হয়ে নার্ভগুলো স্ট্রং হয়ে গেল। বেশ মেজাজ নিয়েই সংলাপগুলো বললাম এবং যথারীতি পরিচালকের সেগুলো পছন্দ হল। এরপরই ঘোষণা হল, লাঞ্চ ব্রেক।
লাঞ্চের পরে আরও চমক বাকি ছিল আমার জন্য। হরনাথদা আমাকে বললেন, অমিতাভদা, আপনার পোশাক-আশাকগুলো, মানে কোট-প্যান্ট একটু খুলতে হবে। খুলতে হবে মানে, সব খুলে ফেলতে হবে! পালটা শুধোলাম আমি। হরনাথদা আমাকে ড্রেসার রুমে নিয়ে গেলেন। পোশাক-আশাক সব খুলিয়ে আন্ডার গার্মেন্টসের উপর একটা সাদা আন্ডারওয়্যার পরিয়ে দিলেন। গায়ে কিছু নেই। নিজের হাতে গলায় টাই ঝুলিয়ে দিলেন। এরপর দৃশ্যটা বুঝিয়ে বললেন। মিঠুনের হাতে ব্যাপক প্যাঁদানি খেয়েছে আমার দলবল। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি ছুটে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছি গ্রামবাসীদের হাতে। তারা ঝাঁটা, লাঠি, কুলো দিয়ে আমাকে বেধড়ক পিটিয়ে জামাকাপড় খুলে প্রায় উলঙ্গ করে দিয়েছেন। আমি সেই অবস্থায় পাঁই পাঁই করে ছুটে পালাচ্ছি। ভালো করে দৃশ্যটা বুঝে নিলাম। এরপর আয়নার সামনে নিজেকে দেখে নিজেই চমকে উঠলাম! শট টেকিং-এর আগে দু’বার মনিটর মানে রিহার্সাল হল। গ্রামবাসীদের মধ্যে সামনের দিকে অধিকাংশই ছিল তেলেগু জুনিয়র আর্টিস্ট। তারা তাড়া করে এসে এমন প্যাঁদান প্যাঁদালো আমাকে যে আমি রীতিমতো অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম। হরনাথদা বিশুদ্ধ বাংলায় তাদের চোদ্দোগুষ্টি উদ্ধার করলেন, তারপর ওদের পিছনের দিকে রেখে জনতার সামনের দিকে নিয়ে এলেন বাঙালি জুনিয়র আর্টিস্টদের। ওরাও আমাকে মারল, তবে সেটা মিছিমিছি মার। নানা অ্যাঙ্গেলে বার চারেক একই শট টেক করা হল। এই শট দিয়েই তুলকালামে আমার শ্যুটিং পর্ব শেষ হল। মেকআপ তুলে ফ্রেশ হয়ে এসে মিঠুনের মারপিটের দৃশ্য গ্রহণ দেখতে লাগলাম। প্রায় কোনও রিহার্সাল ছাড়াই ফাইটারদের সঙ্গে কি লড়াইটাই না লড়ে গেলেন! রিকোয়েস্ট করা সত্ত্বেও কোনও ডামি নিলেন না। কী বডি ফিটনেস, কী ডেডিকেশন, কী স্কিল, কী টাইমিং! একটু ভুলচুক হলেই কিন্তু চোট খাবার বিরাট সম্ভাবনা! আমরা সবাই হাঁ করে দেখছিলাম। ক্রেন থেকে মিঠুনকে ঝুলিয়ে দেওয়া হল, সেই অবস্থায় যেন শূন্যে থেকে নেমে এসে দুজন ফাইটার সঙ্গে লড়তে শুরু করে দিলেন।
একসময় তুলকালাম বড়পর্দায় মুক্তি পেল। এবং সুপারডুপার হিট হল। বিরতির আগেই ছিল আমাকে প্যাঁদানোর দৃশ্য। আমি যখন মার খাচ্ছি, তখন দর্শকদের সে কী উল্লাস! চিৎকার করে বলছে, মার শালাকে—মার শালাকে। একজন অভিনেতার কাছে এর থেকে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে। অসংখ্য ধন্যবাদ আমার প্রিয় পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তীকে, যিনি আমাকে মিঠুন চক্রবর্তীর মতো একজন তিন-তিনবারের জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী সুপারস্টারের সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
ছবি: লেখক
একসময় তুলকালাম বড়পর্দায় মুক্তি পেল। এবং সুপারডুপার হিট হল। বিরতির আগেই ছিল আমাকে প্যাঁদানোর দৃশ্য। আমি যখন মার খাচ্ছি, তখন দর্শকদের সে কী উল্লাস! চিৎকার করে বলছে, মার শালাকে—মার শালাকে। একজন অভিনেতার কাছে এর থেকে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে। অসংখ্য ধন্যবাদ আমার প্রিয় পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তীকে, যিনি আমাকে মিঠুন চক্রবর্তীর মতো একজন তিন-তিনবারের জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী সুপারস্টারের সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
ছবি: লেখক