অনুষ্ঠানের শেষে মাধবী-দি'র সঙ্গে সপরিবারে আমি।
তখনও বইমেলা ঠাঁই নাড়া হয়নি। ফি বছর বইমেলার তখন ঠিকানা ছিল কলকাতা ময়দান। তখন মেলা প্রাঙ্গণের ইউ বি আই অডিটোরিয়ামে বই সংক্রান্ত নানা ধরনের অনুষ্ঠান হত। আমার প্রথম বই দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯১-এ বইমেলার শেষ দিনে। বইটির নাম ছিল, ‘শরীর স্বাস্থ্য জিজ্ঞাসা’। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আগেই লিখেছিলাম। শেষদিনে প্রকাশিত হয়েছিল বলে বইমেলায় এই বইয়ের কোনও আনুষ্ঠানিক প্রকাশ তখন করতে পারিনি। আর তাছাড়া কীভাবে এই ধরনের অনুষ্ঠান করতে হয়, তার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতাও আমার ছিল না। তবে এটা মনে আছে, সেই বছর ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কামারহাটি শাখার বার্ষিক অনুষ্ঠানে কামারহাটি সমাজ সদনে বইটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং আমার সাহিত্যগুরু সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়।
পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯২-এর বইমেলায় আমার দ্বিতীয় বই, ‘রোগটা যখন ক্যানসার’ প্রকাশিত হয়। এবার আমার খুব সাধ হল একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠান করার, কিন্তু সাধ্য ছিল না। এই সময় ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতি কর্ণধার এবং বিজ্ঞান লেখক প্রবীরকুমার ঘোষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। প্রবীরদা তখন লেখক হিসেবে হটকেক। ওঁর লেখা দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত, ‘লৌকিক না অলৌকিক’ তখন বেস্ট সেলার। প্রবীরদা আমার অভিপ্রায় শুনে বললেন, আমি তো প্রতিবছরই উদ্বোধন অনুষ্ঠান করি যুক্তিবাদী সমিতির পক্ষ থেকে। আপনি আমার সঙ্গে অনুষ্ঠান করুন। তাই করলাম। বেশ কিছু গুণীজনকে এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, তাঁরা এসেও ছিলেন। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের কর্ণধার সরোজ গুপ্ত, প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথ ভোলানাথ চক্রবর্তী, প্রখ্যাত ইএনটি বিশেষজ্ঞ ডাঃ আবিরলাল মুখোপাধ্যায়, চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ রণবীর মুখোপাধ্যায়ের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। তবে এই অনুষ্ঠানটি সার্বিকভাবেই ছিল প্রবীরদার অনুষ্ঠান।
পরপর দু’বছর স্বাস্থ্য বিষয়ক দুটি বই বের হল দে’জ পাবলিশিং থেকে। কিন্তু যেহেতু আমি নাটকের লোক এবং তখন আমার বেশ কিছু শ্রুতিনাটক প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, তাই সাধ হল, এগুলোর একটা সংকলন যদি বার করা যায়! আমার বাসনা জানালাম দে’জ-এর কর্ণধার সুধাংশুশেখর দে-কে। শুনে একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন, আপনি নাটক করেন নাকি! বললাম, শুধু করি না, আমার একটি নাটকের দলও আছে, টুকটাক নাটক লিখছিও। সুধাংশুদা বললেন, আমি বুদ্ধদেব বসুর কাব্যনাটক ছেপেছি ঠিকই, কিন্তু নিয়মিতভাবে নাটকের বই তো আমরা প্রকাশ করি না। কলেজ স্ট্রিটে দু-একজন প্রকাশক এটা করেন। আপনি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তাছাড়া আমাদের ঘর থেকে আপনার এই মেডিকেলের হ্যান্ডবুকগুলোই নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। একই লেখক দু-তিন ধরনের লেখা লিখলে পাঠক কনফিউজড হবে। বুঝলাম, সুধাংশুদা-কে রাজি করানো যাবে না। গিয়ে ধরলাম, আমার অগতির গতি, প্রাণের মানুষ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়কে। এবার আর সঞ্জীবদার অনুরোধ ফেলতে পারলেন না সুধাংশুদা। প্রকাশিত হল দে’জ-এর ঘরে আমার প্রথম নাটকের বই, ‘এক ডজন শ্রুতিনাটক’, ১৯৯৩ সালে। প্রায় তিন দশক পার হয়েও পাঠকপ্রিয়তায় এতটুকু ঘাটতি পড়েনি এই বইটির৷ চারটি এডিশনও হয়ে গেছে। বারোটির মধ্যে ছয়টি নাটক ছিল আমার মৌলিক রচনা, বাকি ছয়টি ছয় জন বিখ্যাত গল্পকারের গল্প অবলম্বনে। সে বছর একটি মেডিকেল হ্যান্ডবুকও যথারীতি প্রকাশিত হয়েছিল, ‘গৃহিণীরা শুনছেন’।
পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯২-এর বইমেলায় আমার দ্বিতীয় বই, ‘রোগটা যখন ক্যানসার’ প্রকাশিত হয়। এবার আমার খুব সাধ হল একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠান করার, কিন্তু সাধ্য ছিল না। এই সময় ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতি কর্ণধার এবং বিজ্ঞান লেখক প্রবীরকুমার ঘোষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। প্রবীরদা তখন লেখক হিসেবে হটকেক। ওঁর লেখা দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত, ‘লৌকিক না অলৌকিক’ তখন বেস্ট সেলার। প্রবীরদা আমার অভিপ্রায় শুনে বললেন, আমি তো প্রতিবছরই উদ্বোধন অনুষ্ঠান করি যুক্তিবাদী সমিতির পক্ষ থেকে। আপনি আমার সঙ্গে অনুষ্ঠান করুন। তাই করলাম। বেশ কিছু গুণীজনকে এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, তাঁরা এসেও ছিলেন। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের কর্ণধার সরোজ গুপ্ত, প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথ ভোলানাথ চক্রবর্তী, প্রখ্যাত ইএনটি বিশেষজ্ঞ ডাঃ আবিরলাল মুখোপাধ্যায়, চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ রণবীর মুখোপাধ্যায়ের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। তবে এই অনুষ্ঠানটি সার্বিকভাবেই ছিল প্রবীরদার অনুষ্ঠান।
পরপর দু’বছর স্বাস্থ্য বিষয়ক দুটি বই বের হল দে’জ পাবলিশিং থেকে। কিন্তু যেহেতু আমি নাটকের লোক এবং তখন আমার বেশ কিছু শ্রুতিনাটক প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, তাই সাধ হল, এগুলোর একটা সংকলন যদি বার করা যায়! আমার বাসনা জানালাম দে’জ-এর কর্ণধার সুধাংশুশেখর দে-কে। শুনে একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন, আপনি নাটক করেন নাকি! বললাম, শুধু করি না, আমার একটি নাটকের দলও আছে, টুকটাক নাটক লিখছিও। সুধাংশুদা বললেন, আমি বুদ্ধদেব বসুর কাব্যনাটক ছেপেছি ঠিকই, কিন্তু নিয়মিতভাবে নাটকের বই তো আমরা প্রকাশ করি না। কলেজ স্ট্রিটে দু-একজন প্রকাশক এটা করেন। আপনি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তাছাড়া আমাদের ঘর থেকে আপনার এই মেডিকেলের হ্যান্ডবুকগুলোই নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। একই লেখক দু-তিন ধরনের লেখা লিখলে পাঠক কনফিউজড হবে। বুঝলাম, সুধাংশুদা-কে রাজি করানো যাবে না। গিয়ে ধরলাম, আমার অগতির গতি, প্রাণের মানুষ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়কে। এবার আর সঞ্জীবদার অনুরোধ ফেলতে পারলেন না সুধাংশুদা। প্রকাশিত হল দে’জ-এর ঘরে আমার প্রথম নাটকের বই, ‘এক ডজন শ্রুতিনাটক’, ১৯৯৩ সালে। প্রায় তিন দশক পার হয়েও পাঠকপ্রিয়তায় এতটুকু ঘাটতি পড়েনি এই বইটির৷ চারটি এডিশনও হয়ে গেছে। বারোটির মধ্যে ছয়টি নাটক ছিল আমার মৌলিক রচনা, বাকি ছয়টি ছয় জন বিখ্যাত গল্পকারের গল্প অবলম্বনে। সে বছর একটি মেডিকেল হ্যান্ডবুকও যথারীতি প্রকাশিত হয়েছিল, ‘গৃহিণীরা শুনছেন’।
উদ্বোধনের পর আমার প্রথম বই উল্টেপাল্টে দেখছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়।
সেই সময় দে’জ পাবলিশিং নিজস্ব উদ্যোগে কোনও বই প্রকাশ অনুষ্ঠান করত না। তাছাড়া ওদের ঘরে তখনও আমার সেই জায়গাটা তৈরি হয়নি যে আমার মতো অখ্যাত লেখকের অনুরোধ তারা রাখবে। তবে আমার এই উদ্যোগকে ওঁরা সম্মান করতেন, আমার বই প্রকাশ অনুষ্ঠানের একটি বিজ্ঞাপন বর্তমান বা প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশও করতেন। ৯০ দশকের একজন বিপ্লবী নাট্যকারের নাম অমল রায়। থাকতেন আড়িয়াদহে। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতাল ছেড়ে দেবার পর আমি তখন আড়িয়াদহ শিশুমঙ্গল হাসপাতালে সপ্তাহে দু’দিন যেতাম সাইকেল করে আউটডোর করতে। অমলদা তখন একজন প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার। বেশ কয়েকটি নাটক সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে ওঁর। অমলদার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরে ওঁর উৎসাহে এবং তত্ত্বাবধানে আমি বেশ কয়েকটি শ্রুতিনাটক লিখে ফেলি এবং উনি সেগুলো অভিনয় পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। অমলদা প্রস্তাব দেন, আপনি অভিনয় পত্রিকার ব্যানারে বইমেলায় আপনার বই প্রকাশ অনুষ্ঠান করতে পারেন। আমরা কোনও খবরদারি করব না। আপনি যেভাবে করতে চান সেই ভাবেই করবেন। ১৯৯৩-এ বইমেলার ইউবিআই অডিটোরিয়ামে সেই প্রথম স্বাধীনভাবে অনুষ্ঠান করি আমি। সেই অনুষ্ঠানে জ্ঞানীগুণী জনের যেন হাট বসে ছিল। দু’ধরনের দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। একটি জনস্বাস্থ্যবিষয়ক ‘গৃহিণীরা শুনছেন’, আরেকটি ‘এক ডজন শ্রুতিনাটক’। আমার জীবনের এই প্রথম শ্রুতিনাটক সংকলনে মূল্যবান ভূমিকা লিখেছিলেন প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং প্রখ্যাত সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়।
‘গৃহিণীরা শুনছেন’ বইটি আমি আমার মা-কে উৎসর্গ করেছিলাম। আমার খুব ইচ্ছে ছিল আমার প্রিয় অভিনেত্রী মাধবী চক্রবর্তী বইটির ভূমিকা লিখুন। মাধবীদি’র সঙ্গে তখনও আমার কোনও পরিচয় ছিল না। ফোন নম্বর জোগাড় করে একদিন সকালে ফোন করে বসলাম। নিজের ঢাক সশব্দে বাজানোর পর আমার মনের ইচ্ছে দিদিকে জানালাম। উনি রাজি হলেন। একদিন ওঁর লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে আমাকে যেতে বললেন। গেলাম। ছোট্ট একটি ভূমিকা লিখিয়ে নিলাম এবং রাজি করালাম বইমেলার অনুষ্ঠানে এসে আমার এই বইটি উদ্বোধন করার। সেই যে মাধবীদি’র সঙ্গে আমার যোগাযোগ শুরু হল, আজও তা অটুট আছে। অনেক কথা বলার আছে দিদির সম্বন্ধে, পরে একসময় তা বলব। অভিনেত্রী মাধবী চক্রবর্তীর আড়ালে আমি একজন সহৃদয় পরোপকারী মাধবীদিকে প্রায় তিন দশক ধরে দেখে আসছি।
সে বছর বইমেলায় আমার বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে ইউবিআই অডিটোরিয়াম মঞ্চে যেন চাঁদের হাট বসে ছিল। বিভিন্ন জগতের সেলিব্রেটিরা মঞ্চে ছিলেন। শিক্ষাবিদ ও রবীন্দ্রভারতীর তৎকালীন উপাচার্য পবিত্র সরকার, শ্রুতি দম্পতি জগন্নাথ বসু এবং ঊর্মিমালা বসু, আবৃত্তিকার পার্থ ঘোষ, আকাশবাণীর বিখ্যাত ঘোষক এবং আবৃত্তিকার দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, চিকিৎসা জগতের আবিরলাল মুখোপাধ্যায়, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, রণবীর মুখোপাধ্যায়, মণীশ প্রধান, সাহিত্যিক দুলেন্দ্র ভৌমিক সহ অনেকেই। সব নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে এটা মনে আছে মঞ্চে সেদিন আর চেয়ার পাতার জায়গা ছিল না। মাধবীদি সেদিন প্রকাশ করেছিলেন ‘গৃহিণীরা শুনছেন’ বইটি এবং ‘এক ডজন শ্রুতিনাটক’-এর মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন সাহিত্যিক দুলেন্দ্র ভৌমিক। আসরে শ্রুতিনাটক পরিবেশন করেছিলেন জগন্নাথ-ঊর্মিমালা জুটি। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন নাট্যকার এবং অভিনয় পত্রিকার সম্পাদক অমল রায়। দে’জ-এর তরফে উপস্থিত ছিলেন সুধাংশুশেখর দে এবং সুভাষচন্দ্র দে। আরেকজন মানুষকে সেদিন মঞ্চে মাধবীদি’র পাশে বসাতে পেরে আমি খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। তিনি হলেন আমার মা সুরীতি ভট্টাচার্য। ‘চারুলতা’র সঙ্গে সেদিন আমার মা অনেক গল্প করছিলেন। বাড়ি থেকে ফ্লাক্সে করে চা এনে অতিথি আপ্যায়ন করেছিলেন আমার স্ত্রী ধৃতিকণা ভট্টাচার্য। সাহায্য করেছিল আমার চেম্বার অ্যাসিস্ট্যান্ট শুক্লা দাস এবং দে’জ-এর বঙ্কিমদা। দুজনই এখন প্রয়াত।
প্রায় তিন দশক আগের ঘটনা এসব। তবু স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে। কারণ আমার উদ্যোগে সেটিই ছিল কলকাতা বইমেলায় আমার বই প্রকাশের প্রথম অনুষ্ঠান। তখন বইমেলায় গান-বাজনার কোনও অনুষ্ঠান করা যেত না। বই বিষয়ক আলোচনা, শ্রুতিনাটক, আবৃত্তি পর্যন্ত চলত। মনে আছে প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী চিত্রলেখা চৌধুরি বইমেলায় আমার বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসে একবার রবীন্দ্রনাথের কোনও একটি গানের দু-চার কলি গেয়ে ফেলেছিলেন। রে রে করে উঠেছিলেন গিল্ডের এক তরুণ কর্মকর্তা। বছর তিনেক আগে সেই কর্মকর্তাকেই আমি দেখেছিলাম বইমেলা অডিটোরিয়ামে ঊষা উত্থুপের গানের সঙ্গে মাথা দোলাতে। অবশ্য তখন আর তিনি তরুণ ছিলেন না, পক্বকেশ বৃদ্ধ। সেই শুরু। তার পর থেকে প্রতিবছরই আমার বই প্রকাশ অনুষ্ঠান হতে থাকল বইমেলা অডিটোরিয়ামে। চলেছিল টানা ১৯ বছর। শেষ নয়-দশ বছর দে’জ পাবলিশিং-এর ব্যানারেই অনুষ্ঠান করতাম। কারণ ওদের ঘরে তখন আমার একটা পাকাপোক্ত জায়গা তৈরি হয়েছে এবং আমার এই অনুষ্ঠানের খরচখরচার কিছুটা তাঁরাও বহন করতেন।
‘গৃহিণীরা শুনছেন’ বইটি আমি আমার মা-কে উৎসর্গ করেছিলাম। আমার খুব ইচ্ছে ছিল আমার প্রিয় অভিনেত্রী মাধবী চক্রবর্তী বইটির ভূমিকা লিখুন। মাধবীদি’র সঙ্গে তখনও আমার কোনও পরিচয় ছিল না। ফোন নম্বর জোগাড় করে একদিন সকালে ফোন করে বসলাম। নিজের ঢাক সশব্দে বাজানোর পর আমার মনের ইচ্ছে দিদিকে জানালাম। উনি রাজি হলেন। একদিন ওঁর লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে আমাকে যেতে বললেন। গেলাম। ছোট্ট একটি ভূমিকা লিখিয়ে নিলাম এবং রাজি করালাম বইমেলার অনুষ্ঠানে এসে আমার এই বইটি উদ্বোধন করার। সেই যে মাধবীদি’র সঙ্গে আমার যোগাযোগ শুরু হল, আজও তা অটুট আছে। অনেক কথা বলার আছে দিদির সম্বন্ধে, পরে একসময় তা বলব। অভিনেত্রী মাধবী চক্রবর্তীর আড়ালে আমি একজন সহৃদয় পরোপকারী মাধবীদিকে প্রায় তিন দশক ধরে দেখে আসছি।
সে বছর বইমেলায় আমার বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে ইউবিআই অডিটোরিয়াম মঞ্চে যেন চাঁদের হাট বসে ছিল। বিভিন্ন জগতের সেলিব্রেটিরা মঞ্চে ছিলেন। শিক্ষাবিদ ও রবীন্দ্রভারতীর তৎকালীন উপাচার্য পবিত্র সরকার, শ্রুতি দম্পতি জগন্নাথ বসু এবং ঊর্মিমালা বসু, আবৃত্তিকার পার্থ ঘোষ, আকাশবাণীর বিখ্যাত ঘোষক এবং আবৃত্তিকার দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, চিকিৎসা জগতের আবিরলাল মুখোপাধ্যায়, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, রণবীর মুখোপাধ্যায়, মণীশ প্রধান, সাহিত্যিক দুলেন্দ্র ভৌমিক সহ অনেকেই। সব নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে এটা মনে আছে মঞ্চে সেদিন আর চেয়ার পাতার জায়গা ছিল না। মাধবীদি সেদিন প্রকাশ করেছিলেন ‘গৃহিণীরা শুনছেন’ বইটি এবং ‘এক ডজন শ্রুতিনাটক’-এর মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন সাহিত্যিক দুলেন্দ্র ভৌমিক। আসরে শ্রুতিনাটক পরিবেশন করেছিলেন জগন্নাথ-ঊর্মিমালা জুটি। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন নাট্যকার এবং অভিনয় পত্রিকার সম্পাদক অমল রায়। দে’জ-এর তরফে উপস্থিত ছিলেন সুধাংশুশেখর দে এবং সুভাষচন্দ্র দে। আরেকজন মানুষকে সেদিন মঞ্চে মাধবীদি’র পাশে বসাতে পেরে আমি খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। তিনি হলেন আমার মা সুরীতি ভট্টাচার্য। ‘চারুলতা’র সঙ্গে সেদিন আমার মা অনেক গল্প করছিলেন। বাড়ি থেকে ফ্লাক্সে করে চা এনে অতিথি আপ্যায়ন করেছিলেন আমার স্ত্রী ধৃতিকণা ভট্টাচার্য। সাহায্য করেছিল আমার চেম্বার অ্যাসিস্ট্যান্ট শুক্লা দাস এবং দে’জ-এর বঙ্কিমদা। দুজনই এখন প্রয়াত।
প্রায় তিন দশক আগের ঘটনা এসব। তবু স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে। কারণ আমার উদ্যোগে সেটিই ছিল কলকাতা বইমেলায় আমার বই প্রকাশের প্রথম অনুষ্ঠান। তখন বইমেলায় গান-বাজনার কোনও অনুষ্ঠান করা যেত না। বই বিষয়ক আলোচনা, শ্রুতিনাটক, আবৃত্তি পর্যন্ত চলত। মনে আছে প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী চিত্রলেখা চৌধুরি বইমেলায় আমার বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসে একবার রবীন্দ্রনাথের কোনও একটি গানের দু-চার কলি গেয়ে ফেলেছিলেন। রে রে করে উঠেছিলেন গিল্ডের এক তরুণ কর্মকর্তা। বছর তিনেক আগে সেই কর্মকর্তাকেই আমি দেখেছিলাম বইমেলা অডিটোরিয়ামে ঊষা উত্থুপের গানের সঙ্গে মাথা দোলাতে। অবশ্য তখন আর তিনি তরুণ ছিলেন না, পক্বকেশ বৃদ্ধ। সেই শুরু। তার পর থেকে প্রতিবছরই আমার বই প্রকাশ অনুষ্ঠান হতে থাকল বইমেলা অডিটোরিয়ামে। চলেছিল টানা ১৯ বছর। শেষ নয়-দশ বছর দে’জ পাবলিশিং-এর ব্যানারেই অনুষ্ঠান করতাম। কারণ ওদের ঘরে তখন আমার একটা পাকাপোক্ত জায়গা তৈরি হয়েছে এবং আমার এই অনুষ্ঠানের খরচখরচার কিছুটা তাঁরাও বহন করতেন।
বইমেলার মঞ্চে শ্রুতি নাটক পরিবেশন করছেন জগন্নাথ- উর্মিমালা। পাশে মাধবী-দি।
কত বিখ্যাত মানুষই যে এই অনুষ্ঠানে এসেছেন, সবার নাম হয়তো মনেও নেই। একাধিকবার এসেছেন আমার সাহিত্যগুরু সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, প্রিয় সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য, মাধবী চক্রবর্তী, শিক্ষাবিদ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র ও পবিত্র সরকার, ঊর্মিমালা বসু, শিক্ষক ডাঃ মণীশ প্রধান, ডাঃ সুনীল ঠাকুর, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, ডাঃ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মুখোপাধ্যায়। এসেছেন চিত্র পরিচালক সন্দীপ রায়, যীশু দাশগুপ্ত, সব্যসাচী চক্রবর্তী, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, নবেন্দু চট্টোপাধ্যায়, সুদেষ্ণা রায়, দেবদূত ঘোষ, সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার, সাংবাদিক পথিক গুহ, স্বাতী ভট্টাচার্য, বিপ্লবকেতন চক্রবর্তী, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, খেলার জগতের শৈলেন মান্না, পি কে ব্যানার্জি, সম্বরণ মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা জর্জ বেকার ও অর্পিতা বেকার, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, পি সি সরকার জুনিয়র ও আরও অনেকে। উদ্বোধন পর্বের পর আমি প্রতি বছরই একটি বিতর্কমূলক আলোচনার আসর রাখতাম। কয়েকটি শিরোনাম আজও মনে আছে। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার অধোগতির জন্যই বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার রমরমা, ভিআইপিদের মাথাব্যথা, আগের দিনের ডাক্তারবাবুরাই মহান ছিলেন…ইত্যাদি। আমন্ত্রিত অতিথিরা অংশ নিতেন। উপস্থিত শ্রোতা-দর্শকরাও তাদের মতামত দিতেন। এমনও হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের পরেও ১০-১৫ মিনিট অনুষ্ঠান চালাতে বাধ্য হয়েছি আমি। পুরো অনুষ্ঠান তদারকি এবং অতিথি আপ্যায়নে থাকতেন দে’জ-এর কর্ণধার সুধাংশুদা স্বয়ং। আর নিয়ম মেনে উপস্থিত থাকতেন আমার বন্ধু সুভাষচন্দ্র দে, আমাদের সবার প্রিয় দে’জ-এর বাবু। কালের নিয়ম মেনে একদিন এই অনুষ্ঠান আমি নিজেই বন্ধ করে দিলাম। এখন তো বইমেলা অডিটোরিয়ামে পাঁচমেশালি অনুষ্ঠান হয়, গান-বাজনাও বাদ যায় না। দে’জ পাবলিশিংও ৫০ বছরে পা দিল, ৩৩ বছর ওদের সঙ্গে ঘর করছি আমি, সম্পর্কটা এখন আর প্রকাশক লেখকের নয়, আত্মীয়তারও। পরবর্তী প্রজন্মের অপু-মুন্না-ঋদ্ধিও আন্তরিকতার সূত্রে বয়সের বাধা সরিয়ে আমার অসমবয়সি বন্ধু হয়ে উঠেছে। এখন আমরা সবাই মিলে একটি বৃহৎ সুখী পরিবার। তবে বলতে দ্বিধা নেই, এত কিছুর পরেও বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানগুলোকে ইদানীং ভীষণ মিস করি আমি।