মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

আজকের এই দ্রুততম সময়ে ফাস্ট ফুডের যুগে মানুষের জীবনের অন্যতম একটি সমস্যা হল ওজন বৃদ্ধি। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যয় করতে হবে না খুব বেশি সময়। অল্প সময় ব্যয় করেই কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন আপনার ওজনকে, জেনে নিন সেই সংক্রান্ত কিছু টিপস পিয়ারলেস হাসপাতালের চিফ ডায়েটিশিয়ান সুদেষ্ণা মৈত্র নাগ-এর কাছ থেকে।

বর্তমান প্রজন্মের সব মানুষই কম বেশি নিজের ওজন নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে কী না করছেন! উপকৃতও হচ্ছেন। কিন্তু যে যে পন্থা অবলম্বন করছেন সেই সমস্ত পন্থা আপনার শরীরে কোনও প্রতিকূল প্রভাব ফেলছে না তো? বর্তমান সময়ে যান্ত্রিক উন্নয়নের যুগে মানুষের ব্যস্ততা যত বেড়েছে ঠিক ততটাই কমেছে শারীরিক পরিশ্রম বা ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটস। কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর চক্করে মানুষের নিত্যকার হাঁটাচলা, সাধারণভাবে, স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে মানুষের যেসমস্ত শারীরিক ক্রিয়াকর্ম, পরিশ্রমের সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলেন সেই সমস্ত পরিশ্রম করার আর কোনও জায়গা নেই, পাশাপাশি কাজের চাপ বাড়ায় বাড়িতে রান্না করে খাওয়ার সময় নেই অধিকাংশ মানুষেরই৷ ফলত ভরসা বাইরের খাবার বা অনলাইন ফুড সেন্টার থেকে আনানো খাবার।

এহেন পরিস্থিতিতে ওজন যে বাড়বে সেটা খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। কিন্তু আপনার বহুদিন ধরে বেড়ে ওঠা ওজনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে আপনি চটজলদি যে সমস্ত পন্থা অবলম্বন করছেন সেই সমস্ত পন্থা অবলম্বন করার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো লাভবান হচ্ছেন কিন্তু আপনার অগোচরেই ঘটে আপনার শরীরের অভ্যন্তরে কোনও বড় পরিবর্তন যে পরিবর্তনের ঋণাত্মক প্রভাব হয়তো আপনি বুঝতে পারবেন আরও দশ বছর পরে গিয়ে। সঠিকভাবে ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং সুস্থ শরীর বজায় রাখতে কী করবেন এবং সবার আগে কী করবেন না, সেই বিষয়ে আমরা কথা বলেছিলাম চিফ ডায়েটিশিয়ান সুদেষ্ণা মৈত্র নাগের সঙ্গে। তিনি স্পষ্টতই জানান, ‘বিশেষজ্ঞ হিসাবে একজন মানুষকে কেবল রোগা করে তোলাটাই আমাদের কাজ নয়, তার আজীবন সুস্থ শরীর গড়ে তুলতে তাকে সাহায্য করাটাই আমাদের মূল দায়িত্ব।’ ফিটনেস শব্দের অর্থ বর্তমান সময়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে রোগা হওয়ার নামান্তর কিন্তু ফিটনেস অর্থে বোঝানো একজন মানুষের সামগ্রিকভাবে শারীরিক সুস্থতাকে যার মধ্যে যথাযথ উচ্চতার সঙ্গে যথাযথ শারীরিক ওজন নিয়ন্ত্রণকেও একটি অন্যতম অংশ হিসাবে ধরা হয়।
 

মূলত কী কারণে বিভিন্ন বয়সের মানুষের শারীরিক ওজন বাড়ে?

ডায়েটিশিয়ান জানান, মূলত অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণেই ওজন বেড়ে থাকে, যেমন ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটিসের অভাব, প্রতিদিন নিয়মমাফিক শরীরচর্চার ঘাটতি, সুষম খাদ্যাভ্যাস না থাকা, ঠিকমতো ঘুম না হওয়া এসব তো আছেই, পাশাপাশি থাইরয়েড, হরমোনাল ডিসব্যালেন্সি, লো মেটাবলিজম বা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশানের কারণেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওজন বেড়ে থাকে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে কন্ট্রাসেপটিভ পিল খাওয়ার অভ্যাস বা নিয়মিত মদ্যপানের অভ্যাসেও অনিয়মিতভাবে ওজন বাড়ে। ডায়েটিশিয়ানের বক্তব্য, আজকের দিনে মানুষ তার ব্যস্ততম জীবনে সবকিছুই চায় চটজলদি ও হাতের কাছে, রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমেই তার সমগ্র জীবনকে সে পরিচালিত করতে চায় যার ফলে প্রাকৃতিকভাবে যে সমস্ত কায়িক শ্রম এতকাল মানুষ করে এসেছেন সেই কায়িক শ্রমের অভাব তৈরি হচ্ছে। হাঁটার বদলে এখন মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে বাইক স্কুটি, চার চাকা বা ক্যাবের, কাপড় কাচা বা ডাস্টিং-এর মতন কাজগুলি অনায়াসেই হয়ে যাচ্ছে ওয়াশিং মেশিন এবং ভ্যাকুম ক্লিনারের দ্বারা, আবার নিজের কাজ নিজে না করার প্রবণতা বা অতিরিক্ত পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ার ফলেও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান সময়ে।
 

কী করবেন আর কী করবেন না?

ডু’স এবং ডোন্টসের তালিকা নির্ধারণ করার সময় আগে ডোন্টসের দিকে সচেতনতার পাল্লাটিকে বেশি ভারী রাখা উচিত, বিশেষত প্রশ্ন যেখানে স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক। ডায়েটিশিয়ান সুদেষ্ণা মৈত্র নাগের মতানুযায়ী, সবার আগে যেটা করা বন্ধ করতে হবে সেটি হল বাজারচলতি কোনও পন্থা অবলম্বন করে বা চটজলদি ফলপ্রাপ্তির আশায় ইন্টারনেট দেখে যেকোনও ডায়েট পদ্ধতি হঠাৎ করে অনুসরণ করা, কারণ আপনার শরীরের কম্পোজিশন আপনারই সবথেকে বেশি অজানা। মানুষের নিজের শরীরের থেকে রহস্যময়, অজানা বস্তু পৃথিবীতে আর দুটো নেই, আর আপনার শারীরিক কলকবজার রহস্যভেদ করতে পারেন কেবলমাত্র একজন বিশেষজ্ঞ। তাই নিজের শরীর সম্পর্কে যথাযথভাবে না জেনে, কেমন ডায়েট আপনার জন্য প্রযোজ্য তা না জেনে কখনওই কোনও পন্থা অবলম্বন করা উচিত না। আজকাল বাজারচলতি প্রচুর প্রসেসড ড্রিঙ্ক পাওয়া যায় যেগুলি মানুষ হরদম খাচ্ছেন অল্প সময়ের মধ্যে রোগা হওয়ার নেশায় পড়ে। সুদেষ্ণা মৈত্র নাগের মতে, ‘এতে সহজে মানুষ রোগা হয়তো হয়ে যাচ্ছেন কিন্তু চটজলদি যেকোনও পদ্ধতিই দীর্ঘকালের জন্য শরীরে প্রচুর সাইড এফেক্টস তৈরি করে, যা পরবর্তীকালে পর্যবসিত হয় কিডনি বা হার্টের অসুখের মতো ভয়ংকর অসুখে বা মহিলাদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব প্রকটতর হয়ে ওঠে সন্তাধারণের সময়।’ বাজারচলতি প্রসেসড ড্রিঙ্ক যেমন বিভিন্ন সাইড এফেক্টসের সৃষ্টি করে তেমনই বা হঠাৎ খাওয়া একেবারে কমিয়ে দিয়ে না খাওয়ার পর্যায়ে নিয়ে গেলে পরবর্তীকালে, মূলত পঁয়ত্রিশ বছরের পর থেকে হাড়ের ক্ষয় অবশ্যম্ভাবী।

বর্তমানে রোগা হওয়ার জন্য মানুষ আশ্রয় নিয়ে থাকেন কিটো ডায়েট বা ইন্টারমিডিয়েট ফাস্টিং-এর মতো ডায়েটের। ডায়েটিশিয়ান মতে, ‘এতে রোগা তো হয় অবশ্যই কিন্তু কিটো ডায়েট কখনওই সবার জন্য নয়। কিটো ডায়েট হল মূলত কার্বোহাইড্রেট খাবারের তালিকা থেকে পুরোপুরি বর্জন করে তার পরিবর্তে হাই প্রোটিন ও হাই ফ্যাটযুক্ত খাবার খাওয়া। ঘি, মাখন, চকোলেট, পেস্ট্রির মতো স্যাচুরেটেড ক্যালোরিযুক্ত খাবারই মূলত থাকে কিটো ডায়েটের তালিকায়। কিন্তু আপনি জানতেও পারেন না দীর্ঘদিন এই ধরনের ডায়েটের ফলে প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আপনার হার্ট ও কিডনি। হার্ট বা কিডনির সামান্য সমস্যা থাকলে সবসময় তা আগে থেকে মানুষের শরীর জানান দেয় না, সুতরাং যখনই আপনি এই জাতীয় ডায়েটে দীর্ঘদিন থাকেন তখনই একটা সময়ের পরে আপনার কিডনি ও হার্টের সমস্যা বড় আকার ধারণ করে। হার্ট ও কিডনির সমস্যায় সবসময়ই আমরা প্রেস্ক্রাইব করি লো ফ্যাট ডায়েট সেখানে এই ধরনের ডায়েট শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।’ ডায়েটিশিয়ান মৈত্র নাগ আরও বলেন, ‘কিটো ডায়েট মূলত তৈরি হয়েছিল নিউরো
পেশেন্টদের জন্য এবং এই নতুন পদ্ধতিগুলি এখনও গবেষণাধীন৷’ তাই যেকোনও ডায়েট করার আগেই শরীরের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হয়ে এবং অবশ্যই ডায়েটিশিয়ানদের পরামর্শ মেনে সেই ডায়েট করা উচিত কারণ আপনার শরীরের রহস্য আপনার থেকে ভালো জানেন আপনার ডাক্তার।

ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে যা যা করবেন সেগুলির মধ্যে প্রথমেই ডায়েটিশিয়ান যেটাকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সেটি হল সুষম খাদ্যাভ্যাস অর্থাৎ আপনার খাদ্যতালিকায় কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন সবকিছুই থাকবে সুষমভাবে এবং অবশ্যই প্রতিটি আলাদা বয়সি মানুষের জন্য এই বণ্টনের অনুপাত হবে আলাদা। এছাড়া প্রতিদিন নিয়মমাফিক যোগাসন করা। জিম বা সব ধরনের কার্ডিও এক্সারসাইজ সব বয়সের মানুষ করতে পারেন না কিন্তু যোগা সকলের জন্যই প্রযোজ্য। যোগাসনের মাধ্যমে আপনার হজম ক্ষমতা ঠিকঠাক থাকবে যার ফলে ওজন বাড়ার সম্ভাবনা কমবে। সময় যতই কম থাকুক না কেন চেষ্টা করুন বাড়িতে খাবার তৈরি করে খেতে। অনলাইন ফুড অ্যাপগুলির ওপর ভরসা যত কম করবেন ততই আপনার শরীর ও ওজন উভয়ের জন্যই ভালো। এছাড়া প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা কারণ পর্যাপ্ত জলই আপনার শরীরের মেটাবলিজম বৃদ্ধির সহায়ক হয়ে উঠতে পারে এবং আপনার ওজনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করতে পারে।

আপনার সুস্থ শরীর কিন্তু আপনার ভালো থাকার একমাত্র চাবিকাঠি, তাই অযথা হুজুগে মেতে তাকে নষ্ট হতে দেবেন না। নিজের স্বাস্থ্য যত্নে রাখলে স্বাস্থ্যও আপনার জীবনে ভালো থাকার সমস্ত পথ প্রশস্ত করে দেবে। তাই হুজুগে মেতে চটলজদি পদ্ধতির পেছনে ছোটা বন্ধ করে সময় দিন ও সময় নিন, তাতে আপনার জীবনের বাকি সময়টাও হয়ে উঠবে সুন্দর ও প্রাণবন্ত।

যোগাযোগ: ৯৪৩৩০৮৯৫৫২

 


Skip to content