বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

● ভাষাতত্ত্ব কী?
যেহেতু ভাষাতত্ত্ব বিষয়টি আমাদের দেশীয় পাঠ্যক্রমে বহুল প্রচলিত নয়, তাই ভাষাতত্ত্ব কেন পড়ব এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে ভাষাতত্ত্বে আসলে কী পড়ানো হয়, সেই কথা জানা জরুরি। ভাষাতত্ত্বের মূল কাণ্ডারি ভাষা। ভাষার বহুবিধ গতিবিধি সম্পর্কে আলোচনা করা হয় এই ভাষাতত্ত্বে। মানুষের সঙ্গে ভাষার সম্পর্কের প্রাবল্য অস্বীকার করার ক্ষমতা বোধ হয় কারুরই নেই। কারণ প্রতিটা মুহূর্ত ভাষাতেই বসবাস করি আমরা, উচ্চারিত হোক বা অনুচ্চারিত। খেয়াল করে দেখুন জন্মের পর থেকেই শিশুর সঙ্গে বাহ্যিক জগতের যে যোগাযোগ ঘটে তার প্রধান মাধ্যম অবশ্যই ভাষা। যদিও এখানে ভাষার খেলাটা একটু অন্যরকম। শিশুটির তরফে অন্তত প্রথম ছয়-সাত মাস কোনও নির্দিষ্ট ভাষার বাকধ্বনির ব্যবহার থাকে না ঠিকই, কিন্তু অপরপক্ষ কিন্তু শিশুটির সঙ্গে বিভিন্ন কথোপকথন চালিয়ে যায় কোনও একটি নির্দিষ্ট ভাষায়। এবং সেই অপর পক্ষ ধরে নেয় যে শিশুটি সেই ভাষা বুঝছে এবং সাড়া দিচ্ছে। শিশুটি নেহাতই অপারগ এবং কোনও ভাষা নিয়েই সে যেহেতু জন্মগ্রহণ করে না, তাই সে ধীরে ধীরে তার মস্তিষ্কে অবস্থিত Language acquisition device-এর সাহায্যে তার পারিপার্শ্বিক চালু ভাষাটি আয়ত্ত করতে শেখে। প্রথমে কথা বলায় এবং অনেকটা পরে গিয়ে লেখার কায়দায়। আবার বহু শিশু লেখার সঙ্গে পরিচিত হতেই পারে না। ফলে বহু মানুষের কথা বলার ভাষা রপ্ত হলেও তাঁরা লিখতে পারেন না বা লেখা পড়তে পারেন না। সেই বিষয়ের সঙ্গে অবশ্য আর্থ-সামাজিক যোগ থাকে। যা-ই হোক, যে ভাবে একটা বাচ্চার অন্যান্য growth হয়, সেই ভাবেই তার ভাষাও আস্তে আস্তে বলিষ্ঠ হয়। এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু যদি শিশুটি কথা বলতে না শেখে, কোনও শারীরিক সমস্যা থেকে থাকে, সে ক্ষেত্রে তার ভাষাজনিত সমস্যা ডাক্তারি শাস্ত্রের অধীনে চলে যায়। সেখানে বহু ভাষার বিভিন্নতা নির্বিশেষে শুধু মাত্র ‘শারীরিক’ পরিচয় অবলম্বনে ভাষার চিকিৎসা চলে।

ভাষা শেখার পর্ব মিলে, অর্থাৎ শিশু ভাষার ব্যাকরণের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করলে ভাষার সামাজিক দিক নিয়ে শেখানো পড়ানো শুরু হয়। বা বলা যেতে পারে, আয়ত্ত করে নিতে শুরু করে। কে কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলবে, কখন কোন কথা বলতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাষা তো সমাজেরই বিভিন্ন উপাদানের উপর নির্ভরশীল। আর শুধু সমাজই বা বলি কেন, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক সবরকম উপাদানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভাষার চলন। কিন্তু ভাষা মানুষের এমনই এক সহজাত সহচর এবং অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে থাকা এমনই একটি বিষয় যার গুরুত্ব অপরিসীম এবং অনিবার্য অথচ ভাষাকে পড়াশোনার পাঠ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতে বিশেষ উৎসাহ চোখে পড়ে না। ছোটবেলায় ব্যাকরণ শিক্ষার পর্বটুকু কোনওরকমে মিটিয়ে দিতে পারলেই ভাষার পাঠ শেষ। বহু ভাষার সাহিত্য স্কুল কলেজের পাঠ্যক্রমে বহু বছর ধরে জায়গা করে নিলেও সেই ভাষার তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক চর্চা সম্পর্কিত পাঠের আবশ্যিকতা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে ভাবনা চিন্তার বিশেষ কোনও তৎপরতা দেখা যায় না।

● ভাষাতত্ত্ব পাঠ কেন দরকার?
ভাষার সংজ্ঞা যেমনভাবে শুধুমাত্র ‘যোগাযোগের মাধ্যম’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, ভাষাকে যোগাযোগের মাধ্যম বলতে গেলে যে দুই ভাষীর মধ্যে যোগাযোগ ঘটছে, তাদের পারস্পারিক ভাষাগত বোঝাপড়া থাকা দরকার, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে শেখায় ভাষাতত্ত্ব। দুই ভিন্ন ভাষীর মধ্যে ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম হতে পারে না যদি না তারা পরস্পরের ভাষা বুঝতে পারে। ভাষা একটি জাতির পরিচায়ক, ভাষা রাষ্ট্রনীতির দ্বারা নির্ধারিত। ভাষা শুধু ব্যাকরণের নিয়ম নয়, সমাজের বিধিবদ্ধ নিয়মও মেনে চলে। যখন সেই নিয়ম মানে না বা মানতে পারে না, তখন ভাষা ‘অপ্রীতিকর’ হয়ে যায়। ভাষা প্রেস্টিজও বটে। ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সম্মান-অসম্মান, মান-অভিমানের প্রশ্ন। ভাষার সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্ক এবং মননের সম্পৃ্ক্ত সংযোগ রয়েছে। একটি শিশুর ভাষিক বিকাশে সেই সংযোগের ভূমিকা ঠিক কতখানি, তার আলোচনাও চলে ভাষাতত্ত্বের আধারে। মানুষের ভাষা অর্থে শুধুমাত্র কয়েকটি শব্দের অর্থপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ নয়, ভাষার ব্যাপ্তি বিশাল। এমনকী চলচ্চিত্র-নাটকেও শুধু সংলাপে নয়, আবহ নির্মাণেও মূল কাণ্ডারি ভাষা। অভিধান তৈরি হয় ভাষাতত্ত্বের বিশেষ কৌশল মাথায় রেখে। ভাষার ইতিহাস এক বিরাট চর্চার জায়গা। এর পাশাপাশি পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর অবস্থান, ভাষার বংশপরিচয়, ভাষিক বৈচিত্র, ভাষার বিবর্তন, ভাষার ব্যাকরণ, লিপির পরিচয় নিয়ে আলোচনা তো আছেই। মানব প্রজাতির বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানব ভাষার বিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়।

এহেন কর্মযজ্ঞ যে বিষয়ের অন্দরে চলতে থাকে, তাকে পাঠ্যক্রম থেকে বঞ্চিত করে রাখার সংগঠিত প্রয়াস বা অবহেলা কীভাবে দিনের পর দিন চলে আসছে, সেটাই আশ্চর্যের বিষয়। যে ভাষার সঙ্গে আজন্ম-আমৃত্যু বোঝাপড়া চলে, সেই ভাষাকে নিয়ে পড়াশোনার স্বতন্ত্র বিষয় করতেই প্রবল অনীহা। একটাই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে বেড়ায়—কী হবে ভাষাতত্ত্ব পড়ে? কে বুঝবে ভাষাতত্ত্ব? কলেজের সহকর্মীদের আড্ডার মাঝে যখন ভাষাতত্ত্বের বিভাগ খোলার কথা ওঠে, অন্য বিষয়ের জনৈক অধ্যাপক অবলীলায় বলে বসেন, কে আসবে পড়তে? কেউ তো বুঝবেই না। তাঁর এই স্থূল অবজ্ঞা দেখে বলে উঠতে ইচ্ছে করে, আপনার বিষয়টাও ভাষাহীন অবয়বে পড়িয়ে দেখুন তো! যদি পারেন তো, মেনে নেব আপনার কথা। আর না পারলে আপনার অপারগতাই হবে এই প্রতিষ্ঠানে ভাষাতত্ত্বের ছাত্রছাত্রীদের প্রথম ক্লাস।

বর্তমান অবস্থায় দাঁড়িয়ে এটুকু বলতে পারি, স্কুলের পাঠ্যক্রম থেকেই ভাষাতত্ত্ব পড়ানো উচিত। যেমন ভাবে নির্দিষ্ট এবং বাধ্যতামূলকভাবে অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান পড়ানো হয়। এই বিষয়গুলি পড়ানোর জন্য যেভাবে কার্যকারণ, যুক্তি বাঁধা হয়, ভাষাতত্ত্বের জন্যও সেই সেই যুক্তি, বরং তার চেয়ে বেশি জোরালো দাবি জানানো যায় কারণ ভাষা মানুষের অন্তর্জগতের সঙ্গে বহির্জগতের অবিচ্ছেদ্য এবং অনিবার্য সেতু।

● ভাষাতত্ত্বের বর্তমান পাঠ্যক্রম
এখনের পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রম রয়েছে। কলকাতা এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর এবং গবেষণার সুযোগ রয়েছে। ভাষাতত্ত্ব পড়ে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার ধরন অনুযায়ী পেশার ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের অভিজ্ঞ করে তুলতে কম্পিউটেশনাল লিঙ্গুইস্টিক্স, ফিল্ড লিঙ্গুইস্টিক্স ইত্যাদি বিষয় মূল পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি যুক্ত করা হয়েছে।

● গবেষণা ও অধ্যাপনা
ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করে ভবিষ্যতে দেশে-বিদেশে গবেষণা করার সুযোগ রয়েছে। সর্বভারতীয় পরীক্ষায় (নেট) ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পাশ করলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সুযোগ আছে। বেশ কিছু আইআইটি (খড়গপুর, কানপুর, রোপার)-তে ভাষা ও প্রযুক্তির সম্মিলিত কাজের পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভাষাতত্ত্ব নিয়ে কাজের সুবিধা আছে।

● প্রকল্প ভিত্তিক কাজ
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও বৈদ্যুতিন বিভাগের অন্তর্গত ভাষা প্রযুক্তি ও গবেষণা পরিষদে, এশিয়াটিক সোসাইটিতে ভাষাতত্ত্ব নিয়ে বিভিন্ন কাজের পরিকাঠামো রয়েছে। ভাষা বিষয়ক বিভিন্ন প্রকল্পে (সরকারী ও বেসরকারি) যোগ দেওয়ার সুযোগ আছে।

● আইটি সংস্থা
কম্পিউটেশনাল লিঙ্গুস্টিক্সের চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ছে। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স এবং ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং (NLP) নিয়ে বহু আইটি সংস্থায় কাজের সুযোগ রয়েছে।

● প্রকাশনা সংস্থা
ভাষাতত্ত্বের এমন কিছু উপাদান আছে যা গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার কাজে। যে কোনও ভাষার প্রকাশনা সংস্থায় সেই ভাষার ভাষাজ্ঞান বিশেষ ভাবে দরকারি। এবং সেটা শুধুমাত্র সাহিত্য বোধ বা ব্যাকরণের পরিমিত জ্ঞান দিয়ে নয়, ভাষার প্রয়োগমূলক চর্চার ব্যবহার সেখানে জরুরি। বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থায় ভাষা তাত্ত্বিকদের নিয়োগের বড় সুযোগ রয়েছে।

● অভিধান সংকলক
ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করে অভিধান সংকলনের কাজের সুযোগ আছে। কারণ ভাষা তত্ত্বের একটি নির্দিষ্ট শাখা অভিধান চর্চা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করে। ফলে একজন ভাষাতত্ত্বের ছাত্রের কাছে বিষয়টি অনেক বেশি সহজ এবং সাবলীল হয়। অভিধানবাদের কাজে তাই ভাষাতত্ত্বের গুরুত্ব অনেক বেশি।

● ভাষাতত্ত্বের ভবিষ্যৎ ভাবনা
যে প্রশ্নটা এখন চারদিকে উঠে আসে, ভাষাতত্ত্ব পড়ে রোজগারের বন্দোবস্ত কী হবে, তার প্রভূত সমাধান হয়ে যাবে যদি স্কুলস্তর থেকে বিষয়টির চর্চা চলে। তার মূল কারণ স্কুলে পড়ানোর একটা ব্যাপক সুযোগ থাকবে। স্কুল স্তর থেকে বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত হতে থাকলে কলেজেও অনায়াসে বিষয়টি পাঠ্যক্রমে স্থান করে নিতে পারে। সেখানেও ভবিষ্যতে কলেজে শিক্ষকতা করার সুযোগ পেতে পারে ছেলেমেয়েরা। তার পরের ধাপে বিশ্ববিদ্যালয় তো আছেই। সবচেয়ে বেশি জরুরি ভাষাতত্ত্বের প্রচার এবং এই বিষয়ের গুরুত্ব এবং ব্যাপ্তি সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের ওয়াকিবহাল করা, যাতে এই বিষয়ের জনপ্রিয়তা এবং তাৎপর্য শুধুমাত্র কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না থেকে সার্বিক শিক্ষা সমাজে গ্রহণ যোগ্য হয়ে ওঠে। সেই স্তর অব্দি পৌঁছাতে পারলে ভাষাতত্ত্বের ছাত্রছাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক কাজের কোনও ঘটতি থাকবে না।

Skip to content