![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2022/02/Parna-Choudhury_3.jpg)
স্বস্তির নিশ্বাস : স্কুলে ফেরার আনন্দ।
১৬ ফেব্রুয়ারি, বুধবার, বেশ ভারাক্রান্ত মন নিয়েই স্কুলে ঢুকছিলাম। সংগীত জগতের দুই নক্ষত্রপতন ঘটেছে আগের দিন রাতে। লতা মঙ্গেশকর প্রয়াণের অতল শূন্যতায় তখনও নিমজ্জিত আপামর ভারতবাসী। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও দুটি নাম— সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও বাপি লাহিড়ি। বিষাদের ঘোরে আচ্ছন্ন ছিলাম, হয়তো বা একটু অন্যমনস্কই। হঠাৎ কচি কচি গলার কলরবে ঘোর কাটল। আজ থেকে তো প্রাথমিক বিভাগের বাচ্চাদের স্কুলের নিয়মে স্কুলে আসার কথা! সেই ২০২০-র মার্চের পরে আবার আজ ! আবার স্কুল ফিরেছে তার স্বাভাবিক ছন্দে। বাচ্চাদের কলকাকলিতে গমগম করছে স্কুল। স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে আমার পলকের জন্য মনে পড়ে গেল Oscar Wilde-এর বিখ্যাত ‘The Selfish Giant’ গল্পের সেই দৃশ্যটি—শিশুদের আগমনে স্বার্থপর দৈত্যের বাগানে অবশেষে বসন্তের আবির্ভাব! আমাদেরও তো তাই ! প্রায় দুই বছরের শূন্যতার ফলে মরচে ধরে যাওয়া, ধূলিধূসরিত, বিদ্যালয়ের নিষ্প্রাণ কাননে অবশেষে ঋতুরাজ এলেন! ক্যালেন্ডারের পাতায়ও তো আজ ৩ ফাল্গুন– বসন্ত তাহলে এসেই গেল!
যেন অতীতের পাতা থেকে ফিরে পাওয়া সেই পরিচিত দৃশ্যগুলোর উষ্ণতার ওম পোহাচ্ছিলাম আমি। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি বেশ কিছুদিন আগে থেকেই পুরোদমে ক্লাস শুরু করেছিল। স্কুল তখন খানিকটা প্রাণ ফিরে পেলেও কোথাও যেন একটা অসম্পূর্ণতা ছিল। ছোটদের দুষ্টুমির স্বাদ যে কী মিষ্টি সেটা আমরা যতটা উপভোগ করি, ততটা হয়তো ওদের বাড়ির লোকেরাও করেন না। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে তৃষিত বিদ্যালয়ও যেন এই কচিকাঁচাদের দস্যিপনা আকণ্ঠ পান করছিল! শূন্য ক্লাসঘরগুলোতে জমে থাকা অভিমান আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছিল। দুরন্ত পায়ের দৌড়ে যাওয়ার আওয়াজ বা উচ্ছ্বসিত কলতান আমাদের বহুদিনের উপোসি কানে যে কী সুধা বর্ষণ করছিল তা আমরাই জানি। তাই হয়তো শাসন করতে গিয়েও আজ সস্নেহ প্রশ্রয়ে থেমে গেছি। ওরা যে কত্তদিন পরে ওদের নতুন পোশাক পরে ওদের নতুন ক্লাসে এসে বসেছে! ওদের খিলখিল হাসি, কলকল কথার স্রোত আজ থামাতে মন চাইছে না! আজকে ওদের ‘গুড মর্নিং’ বলার মধ্যেও যেন একটা নতুন উদ্দীপনা রয়েছে। আজকের সকালটা সত্যিই যেন বিশেষভাবেই ভালো! লকডাউনের আগে যে পুঁচকেটা ক্লাস থ্রি বা ফোরে ছিল, এখন সে ফাইভ বা সিক্স– মেয়েরা টিউনিক থেকে স্কার্টে উত্তীর্ণ হয়েছে, আর ছেলেরা হাফ প্যান্ট থেকে ফুল প্যান্টের মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়েছে। সেভেনের ছেলেরা মাথায় এত লম্বা হয়ে গেছে যে চেনাই দুষ্কর! মেয়েদের ছোট্ট ঝুঁটিগুলো যেন কোন মায়াবলে লম্বা বিনুনিতে বাঁধা পড়েছে! আমরাও দু’চোখ ভরে দেখছি আর অবাক হয়ে বলছি ‘আরে তুই ক্লাস ফাইভের অমুক না? কত্ত লম্বা হয়ে গেছিস রে!’ কিংবা ‘তুই এত রোগা হয়ে গেছিস কেন রে? শরীর ভালো আছে তো তোর?’ হয়তো আমাদের মতো স্কুলবাড়ির দরজা, জানলা, করিডোর, হলঘর, বেঞ্চ, ব্ল্যাকবোর্ড– এরাও খুব খুশি– কচিকাঁচাদের প্রত্যাবর্তনে ওদের মনেও যে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। ওরাও তো ছাত্রছাত্রীদের অনুপস্থিতির যন্ত্রণা আমাদের চেয়ে কম কিছু অনুভব করেনি! ওরাও তো আমাদের মতোই সবকিছু নীরবে সহ্য করেছে!
সারাদিন স্কুলে দাপিয়ে বেড়িয়ে, পড়াশোনা আর দুষ্টুমি দুটোই চুটিয়ে করে, পেট ভরে গল্প করে এবং মিড-ডে মিল খেয়ে দিনের শেষে যখন রথী-মহারথীরা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেন, তখন কারও নতুন কাচা জামায় দস্যিপনার ছাপ আবার কারও জুতোর লেস গেছে খুলে, তো কারও ঝুঁটি গেছে আলগা হয়ে। কিন্তু কী অনাবিল হাসি সেই ঝলমলে মুখগুলোয়! আর সবকটা মুখেই যেন লেখা আছে, ‘কী মজা, আমাদের আর বাড়িতে বন্দি থাকতে হবে না, আমরা এখন রোজ স্কুলে আসব!’
ছবি ও ভিডিও ক্লিপ : লেখিকা
সারাদিন স্কুলে দাপিয়ে বেড়িয়ে, পড়াশোনা আর দুষ্টুমি দুটোই চুটিয়ে করে, পেট ভরে গল্প করে এবং মিড-ডে মিল খেয়ে দিনের শেষে যখন রথী-মহারথীরা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেন, তখন কারও নতুন কাচা জামায় দস্যিপনার ছাপ আবার কারও জুতোর লেস গেছে খুলে, তো কারও ঝুঁটি গেছে আলগা হয়ে। কিন্তু কী অনাবিল হাসি সেই ঝলমলে মুখগুলোয়! আর সবকটা মুখেই যেন লেখা আছে, ‘কী মজা, আমাদের আর বাড়িতে বন্দি থাকতে হবে না, আমরা এখন রোজ স্কুলে আসব!’
ছবি ও ভিডিও ক্লিপ : লেখিকা