শনিবার ৯ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

উদ্ভিদবিজ্ঞান

বিজ্ঞানের প্রাচীন শাখাগুলোর একটি হল উদ্ভিদবিজ্ঞান। আদিম মানুষ যখন খাদ্য উপযোগী, ঔষধিগুণ সম্পন্ন এবং বিষাক্ত উদ্ভিদ চিহ্নিত করতে শুরু করে, তখন থেকেই উদ্ভিদবিজ্ঞানের সূচনা। মানুষ সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে অক্সিজেন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা প্রভৃতি মৌলিক প্রয়োজনের জন্য উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। তাই উদ্ভিদ বিজ্ঞানের চর্চা ও অগ্রগতি মানব সভ্যতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা উদ্ভিদ ভালোবাসো, উদ্ভিদ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী এবং বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষায় এগোতে চাও, তাদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী বিষয় হতে পারে উদ্ভিদবিজ্ঞান। বিজ্ঞানের যে শাখায় পৃথিবীর সকল প্রকার উদ্ভিদের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ গঠন, প্রকৃতি, সালোকসংশ্লেষ, শ্বসন, পুষ্টি, বৃদ্ধি, জনন, বংশগতি, জীবনবৃত্তান্ত, অভিযোজন, অভিব্যক্তি, সংরক্ষণ, অর্থনৈতিক গুরুত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ, ব্যবহার, শনাক্তকরণ, শ্রেণিবিন্যাস, বাস্তুসংস্থান ইত্যাদি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়, তাকে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বা বটানি বলে।

 

উদ্ভিদবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব ও উপযোগিতা

উদ্ভিদবিজ্ঞান হল বিজ্ঞানের একটি অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম প্রাচীন শাখা। উদ্ভিদবিজ্ঞান পঠন-পাঠনে আমরা সমগ্র উদ্ভিদজগৎ সম্পর্কে সার্বিক জ্ঞান লাভ করতে পারি। পৃথিবীতে মানুষসহ সমগ্র প্রাণীজগতের অস্তিত্বই উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। একমাত্র সবুজ উদ্ভিদই সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়াকালে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে ও অক্সিজেন নির্গত করে পরিবেশকে জীবনধারণের উপযোগী রাখে। কেবলমাত্র সবুজ উদ্ভিদই সূর্যালোকের উপস্থিতিতে কার্বন ডাই অক্সাইড ও জলের সহায়তায় সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরি করতে সক্ষম। এই খাদ্যই মানুষসহ সমগ্র প্রাণীকুলের খাদ্য ও শক্তির উৎস।

উদ্ভিদবিজ্ঞানের উন্নতি ও ব্যবহারিক প্রয়োগের ফলে পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে খাদ্য উৎপাদনের সমতা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। মানুষের পরিধেয় উৎপাদনে ও তার উন্নয়নে উদ্ভিদবিজ্ঞান চর্চার ভূমিকা অনস্বীকার্য। রোগ নিরাময়ের জন্য মানুষ সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই বিভিন্ন উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল থেকেছে। উদ্ভিদবিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে আরও বেশি বেশি উদ্ভিদজাত ওষুধের আবিষ্কার হয়েছে।

বর্তমানে সারা পৃথিবীজুড়েই সিন্থেটিক ড্রাগের পরিবর্তে হার্বাল ড্রাগ অর্থাৎ ভেষজ ওষুধের ব্যবহার ও চাহিদা ক্রমবর্ধমান। পরিবেশ দূষণ রোধে, বিশ্বউষ্ণায়ন প্রতিরোধে এবং পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিহত করতে উদ্ভিদ ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের ভূমিকা অপরিসীম। এই সমস্ত কারণে বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই উদ্ভিদবিজ্ঞান অত্যন্ত আকর্ষণীয়, চাহিদাসম্পন্ন ও সম্ভাবনাময় উচ্চশিক্ষার বিষয়।

আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন

 

কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা ও পরবর্তী ধাপ

রাজ্যের ও দেশের অধিকাংশ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ে যথাক্রমে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ার সুযোগ আছে। বর্তমানে দেশের প্রায় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে UGC নির্দেশিত Choice Based Credit System (CBCS) Syllabus চালু হওয়ায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স চলাকালীন সহজেই কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তন করা সম্ভব। স্নাতক স্তরে নামী কলেজে ভর্তি হতে দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় সাধারণত বায়োলজিতে অন্তত ৮০-৮৫ শতাংশ নম্বর থাকা দরকার। আর অন্যান্য বিজ্ঞান বিষয়ে অন্তত ৭০-৭৫ শতাংশ নম্বর রাখতে হবে।

যদিও এটা পুরোটাই নির্ভর করে সেই বছর উচ্চমাধ্যমিক বা সমতুল পরীক্ষায় কী ধরনের নম্বর উঠছে তার উপর। কিছু কিছু কলেজে ভর্তির জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে হয়। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি হওয়া যায়। উদ্ভিদবিজ্ঞান বা বটানি অনার্সে জেনারেল সাবজেক্ট হিসেবে প্রাণীবিজ্ঞানের (Zoology) সঙ্গে মানব শারীরবিজ্ঞান (Human Physiology) বা রসায়ন (Chemistry) নিতে পারো। কোনও কোনও কলেজে নৃবিজ্ঞান (Anthropology) বা অণুজীববিজ্ঞান (Microbiology) জেনারেল সাবজেক্ট অপশন হিসাবে থাকে। CBCS বটানি অনার্স কোর্সে SEC (Skill Enhancement Courses) এবং DSE (Discipline Specific Elective Courses) পেপারগুলির অপশন ও কলেজের পরিকাঠামো অনুযায়ী আলাদা হতে পারে।

আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৫: অনন্যসাধারণ হরিপুরের হরিহর শিবমন্দির

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৭: আশাকে নিয়ে পঞ্চমের সব প্রশ্নের জবাব চিঠিতে জানিয়েছিলেন লতা

আমাদের রাজ্যে একাধিক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালু হওয়ায় ও অনেক কলেজে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু হওয়ায় উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আসনসংখ্যা অনেক বেড়েছে যা উচ্চশিক্ষায় আগ্রহীদের জন্য সুখবর। এছাড়া উদ্ভিদবিজ্ঞানে B.Sc. (Honours)-এর পর বিভিন্ন Allied Subjects যেমন Microbiology, Biotechnology, Genetics, Biochemistry, Agriculture, Horticulture, Forestry, Environmental Science, Marine Science প্রভৃতি বিষয়েও M.Sc. করার সুযোগ পাওয়া যায়। M.Sc. পড়ার সময় উদ্ভিদবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় স্পেশালাইজেশন করা যায়, যা পরবর্তীকালে গবেষণা বা চাকরির ক্ষেত্রে সহযোগী হয়। যেমন, প্লান্ট ট্যাক্সোনমি, সাইটোলজি, জেনেটিক্স, টিস্যু কালচার, প্লান্ট ফিজিয়োলজি অ্যান্ড বায়োকেমিস্ট্রি, মলিকিউলার বায়োলজি, মাইকোলজি অ্যান্ড প্লান্ট প্যাথোলজি, প্লান্ট বায়োটেকনোলজি, প্যালিওবটানি অ্যান্ড প্যালিনোলজি, ফাইকোলজি, টেরিডোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, প্লান্ট ইকলজি, ফার্মাকগনোসি ইত্যাদি।

M.Sc.-র পর GATE পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বায়োটেকনোলজি বিষয়ে M.Tech. পড়া যায় বিভিন্ন আইআইটিগুলিতে। NET পরীক্ষা দিয়ে ফেলোশিপ পেয়ে বা অন্যান্য ফেলোশিপ পেয়ে গবেষণায় যোগ দেওয়া যায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। এছাড়া স্নাতক বা স্নাতকোত্তরের পর মাশরুম চাষ, জৈব কৃষি, বায়োফার্টিলাইজার উৎপাদন, ভেষজ উদ্ভিদ চাষ প্রভৃতি নানা বৃত্তিমূলক ট্রেনিং ও সার্টিফিকেট কোর্স করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১২: সুন্দরবনের আর এক ব্যাঘ্রদেবতা বড় খাঁ গাজী

 

বিদেশে পড়াশোনা

উদ্ভিদবিজ্ঞানে M.Sc. করার পর বর্তমানে এখানকার অনেক ছাত্রছাত্রী আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চিন, জাপান, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে উচ্চশিক্ষা বা গবেষণার জন্য। এ জন্য বিভিন্ন স্কলারশিপ পাওয়ার সুযোগ আছে। আবার অনেকে পিএইচডি-র পরে পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চের জন্য স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে গিয়ে থাকে।
 

জীবিকা সহায়ক হিসাবে উদ্ভিদবিজ্ঞান

উদ্ভিদবিজ্ঞানের মতো সম্ভাবনাময় একটি বিষয় নিয়ে পড়ে পেশাগত জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল হওয়া যায়।
 

স্কুলে শিক্ষকতা

উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ে B.Sc. (Honours) বা M.Sc. করে B.Ed. করলে বা General Stream-এ উদ্ভিদবিজ্ঞান সহ B.Sc. ও B.Ed করলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারি স্কুলে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা যেমন Central Teacher Eligibility Test (CTET), State Level Teacher Eligibility Test (STET), Trained Graduate Teacher (TGT) exam, Post Graduate Teacher (PGT) exam ইত্যাদির মাধ্যমে উচ্চমাধ্যমিক, মাধ্যমিক বা উচ্চপ্রাথমিক স্তরে জীববিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতার সুযোগ পাওয়া যায়। এছাড়া বেসরকারি স্কুলগুলোতেও নিয়োগ পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৪: হাজরা মোড়ে নাম না জানা কচুরিখানা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১০: দশমহাবিদ্যা ও ঠাকুরের কালীভাবনা…

 

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা

CSIR-UGC National Eligibility Test (NET), State Eligibility Test (SET) প্রভৃতি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে বা পিএইচডি অর্জন করলে রাজ্যে বা দেশের যেকোনও সরকারি-বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগের সম্ভাবনা থাকে। দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের মূলধারার বিষয় হিসাবে উদ্ভিদবিজ্ঞানে শূন্যপদের সংখ্যা ও যথেষ্ট বেশি থাকে।
 

গবেষণা

গবেষণার বিষয় হিসেবে উদ্ভিদবিজ্ঞান সারা পৃথিবীতেই অত্যন্ত আকর্ষণীয়। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তরের পর এর বিভিন্ন শাখায় যেমন Phycology, Mycology, Plant Taxonomy, Cytology, Anatomy, Plant Physiology, Genetics, Palaeobotany, Palynology, Phyto-chemistry, Ethnobotany Bryology, Pteriodology, Plant Pathology, Plant Breeding, Pharmacognosy ইত্যাদি বা অন্যান্য Interdisciplinary বিষয় যেমন Microbiology, Biochemistry, Biotechnology, Molecular Biology, Agriculture, Horticulture, Floriculture, Forestry, Ecology, Environmental Science ইত্যাদি বহু বিষয়ে গবেষণা করার সুযোগ পাওয়া যায়। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটে গবেষণা করার সুযোগ মিলতে পারে। পরবর্তীতে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সায়েন্টিস্ট পদে নিয়োগের সম্ভাবনা থাকছে।

আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৪: আমার মন বলে চাই চাই

পাখি সব করে রব, পর্ব-৩: আচমকা বলরাম চেঁচিয়ে বলল, ‘বাপি, বাপি—ওই যে বাপি’

 

কৃষিবিদ ও উদ্যানবিদ

উদ্ভিদবিজ্ঞানে M.Sc. বা উদ্ভিদবিজ্ঞানে B.Sc. (Honours) এর পর কৃষিবিজ্ঞান বা উদ্যানবিজ্ঞানে M.Sc. করলে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় কৃষিবিদ ও উদ্যানবিদ হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
 

অন্যান্য চাকরি

শিক্ষকতা ও গবেষণায় অনেকে অনাগ্রহী থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস, ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস, ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস, ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট সার্ভিস, এগ্রিকালচারাল সার্ভিস-এর মতো বেশ কিছু সরকারি চাকরির পরীক্ষায় উদ্ভিদবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট বেশি থাকে। এছাড়া ব্যাংক, পোস্ট অফিস, রেল ইত্যাদি সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার চাকুরির সম্ভাবনা তো থাকছেই।
 

স্বনিযুক্তি ও স্বউদ্যোগ

উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষার পর মাশরুম চাষ, উদ্যানপালন, ভেষজ উদ্ভিদ চাষ, চারা তৈরি ও নার্শারি পালন, বায়োফার্টিলাইজার উৎপাদন, জৈব কৃষিকার্য, ফ্লোরিকালচার প্রভৃতি বিষয়ে স্বনিযুক্তি ও স্বউদ্যোগের মাধ্যমে প্রভূত সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।

* ড. মাধব নস্কর, সহকারী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, সোনারপুর মহাবিদ্যালয়।

Skip to content