বুধবার ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অর্ক ঘোষ।

২০২১ সালে মাধ্যমিক হবে কিনা, এই ভাবনায় সকলেই যখন দোলাচলে, তখন রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে (আমি তখন ওই স্কুলে ছাত্র) জানুয়ারি মাসেই জেইই (JEE) এবং নিট (NEET)-এর কোচিং শুরু হয়ে গিয়েছিল। মূলত তারই ফলে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে আমি সুযোগ পাই, ভর্তিও হয়ে যাই। ক্লাস শুরু হয় অনলাইনে। আমার বিষয় ছিল—বাংলা, ইংরাজি, অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন এবং কম্পিউটার সায়েন্স। জীববিজ্ঞান যে নেবো না, তা আগেই স্থির করেছিলাম। প্রথম থেকেই জেইই-র জন্য পড়ব বলেই সমস্তটা শুরু করেছিলাম।

সেখানকার সবচেয়ে ভালো শিক্ষকরা আমাদের জেইই-র জন্য কোচিং দিতেন। অন্য সব বছরের মতো প্রথম থেকেই আমাদের জানানো হয়েছিল যে, উচ্চমাধ্যমিক নয় বরং সর্বভারতীয় এন্ট্রান্স পরীক্ষাটিই আমাদের মূল লক্ষ্য। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খুব যত্ন নিয়ে আমাদের প্রতিটি বিষয় পড়িয়েছেন। ক্লাসের সময়ের মধ্যে যতটুকু সম্ভব বোর্ড স্তরের বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্নের উত্তর লেখা শিখিয়েছেন।
ইংরাজি ও বাংলার কথা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। এই দুটি বিষয়কে স্কুলের ক্লাসে ও পরীক্ষার অব্যবহিত আগে ছাড়া আর কখনও আমি পড়িনি। তাই উচ্চমাধ্যমিকে বাংলায় ৯৬ আর ইংরাজিতে ৯৮-এর নেপথ্যে নরেন্দ্রপুরের বাংলা ও ইংরাজি বিভাগের স্যারদের ভূমিকাই প্রধান। পরীক্ষায় যেরকম প্রশ্ন আসে সে বিষয়ে তাঁরা আমাদের প্রথম থেকেই ওয়াকিবহাল করেছিলেন। ফলে সহায়িকা বইগুলোর অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন বা উত্তর দেখে আমরা বিভ্রান্ত হইনি। ইংরাজিতে ১০ নম্বরের রাইটিং স্কিলে কীভাবে পুরো নম্বর পাওয়া যায় এবং কেমনভাবে উত্তরপত্র সাজালে তা পরীক্ষকের মনযোগ আকর্ষণ করবে, তা ক্লাসে সবিস্তারে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন স্যারেরা‌।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩: পর্ব-৩: আত্মারামে কুটো বাঁধা আছে

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-২৯: প্রাণ ব্যাকুল হলে, ঈশ্বর দর্শন হবেই…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫: সুন্দরবন নামরহস্য

ক্লাসরুম: ইংরেজিতে ভালো নম্বরের জন্য Writing Skill Development-এ যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে

বছরের বেশিরভাগ সময়ই জেইই-র জন্য পড়তাম। শুধু স্কুলের পরীক্ষার আগে বোর্ড স্তরের বইগুলো থেকে প্রশ্নের প্রকৃত ধারণা তৈরি করতাম। এ বিষয় বন্ধুদের চেয়ে সহায়ক আর কেউ নয়। কোথাও আটকে গেলেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তার নিরশন করে নিতাম।

টেস্টে রেজাল্ট ভালো না হওয়ায় স্কুলের পক্ষ থেকে প্রতি বিষয়ের বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। স্যারেরা ধরে ধরে টেস্ট পেপার করিয়েছেন। রসায়নে ভালো নম্বর কোনও পরীক্ষায় পাইনি। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের আগের ওই ক্লাসগুলো যে কতটা ফলপ্রসু তা ৯৭ নম্বর থেকেই বোঝা যায়।

বাবা-মায়ের সঙ্গে অর্ক।

তবে আর যে বৈশিষ্ট্যটি অন্য স্কুলগুলোর থেকে নরেন্দ্রপুরকে পৃথক করে তা হল, সারাবছর নানা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, অনুষ্ঠান ও গঠনমূলক আলোচনাসভার আয়োজন। এ সব বিষয়ে আমারও উৎসাহ কম ছিল না। তাই বিতর্ক, বক্তৃতার মঞ্চে, রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে আমি অংশ নিয়েছি‌। ‘জেইই মেন’-এর সিজন-১ ছিল ২৫ জানুয়ারি। ১২ জানুয়ারি জাতীয় যুবদিবসে কমপক্ষে ২০০০ শ্রোতার সামনে বক্তৃতা দেওয়া কিংবা উচ্চমাধ্যমিকের কিছুদিন আগে বেলুড়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মতিথির অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়াতেও আমি আগ্রহী ছিলাম। এই সকল সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপকে নিতান্তই সময় নষ্ট মনে হলেও আমার তরুণ মনে এগুলো এক বিমল আনন্দের সূচনা করেছিল।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৭: কবিকন্যার সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও কবির সঙ্গে ঘটেনি

দশভুজা: আমি আর কখনওই ফিরে আসার প্রত্যাশা করি না…

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২০: পঞ্চমের সুর আর কিশোর-আশার অনবদ্য উপস্থাপনা, ‘এক ম্যায় অউর এক তু’ গানটি আজও সুপারহিট

আর যে বিষয়টি নরেন্দ্রপুরে আমার বিশেষ প্রাপ্তি তা হল, এর ঝকঝকে গাছপালা, বিশাল খোলা মাঠ, দিবারাত্র প্রকৃতি-সান্নিধ্য। যখনই পড়তে ভালো লাগত না, বিকেলে খেলার সময় চলে যেতাম মাঠে। মন অনেকটা হালকা হতো। মানসিক চাপের এমন সহজ নিরাময় বোধহয় আর কিছুতে নেই।

নরেন্দ্রপুরের রুটিন অনুযায়ী আমাদের পড়ার সময় ছিল সকাল সন্ধে ৭টা থেকে ৯টা এবং রাত্রে সাড়ে নটা দশটা থেকে ১২টা পর্যন্ত। মোট সাড়ে ছয় ঘণ্টা মতো। তবে টেস্টের পরে সারাদিনই পড়ার সময় থাকত। আমি যথাসম্ভব সময়ের সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। স্যারদের পড়ানোর পাশাপাশি প্র্যাকটিস বই থেকে পড়াশোনা করেছি। কখনও একঘেয়ে মনে হলে ডায়রি লিখেছি। তবে পড়ার সময়টা খুব বেশি ছিল না বলেই নষ্ট করতে ইচ্ছে করেনি। বন্ধুদের সঙ্গে হাসি, গল্প যা আবাসিক ছাত্রজীবনের মহামূল্য প্রাপ্তি, তাকে আমিও দু’ হাত ভরে গ্রহণ করেছি। যখন মনে হয়েছে ‘আর পারছি না’ বন্ধুরাই ‘মোটিভেশন’ হয়ে সামনে থেকেছে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক,

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৮: সাইনাস নাকি কখনওই সারে না?

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১০: ব্যস্ত পৃথিবী ছাড়িয়ে কোথায় যেন চলে এলাম উত্তরমেরুর জনমানবহীন এই জঙ্গলে, যেখানে এখন শুধুই রাত

আমার দু’ বছরের সুদীর্ঘ যাত্রায় বাবা-মায়ের যে মহতী ভূমিকা তা, ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। আমার পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি না থাকা সত্ত্বেও দাবি পূরণ করেছেন। যখনই হতাশা জেগেছে ওই মুখগুলো মনে করে প্রচণ্ড আশার আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছি। মনে হয়েছে ‘কিছু করতেই হবে’। উচ্চমাধ্যমিকে আমি সপ্তম হওয়ায় তাঁদের মুখে হাসি ফুটেছে—এ আমার বড় প্রাপ্তি।

মূলত জিইই-র প্রস্তুতি নিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে এক থেকে দশের মধ্যে স্থান করে নেওয়া নিতান্তই সহজ না হলেও নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ে প্রতি বছরই তা হয়ে আসছে। তাই এক থেকে দশের মধ্যে থাকব আশা করেছিলাম‌। বোর্ড সভাপতি নামটা ঘোষণা করার পরেই আনন্দিত হই, মনে হয়—কিছুটা অন্তত সাফল্য এল।
* অর্ক ঘোষ, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৭তম স্থান অধিকারী।

Skip to content