বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

গর্ভাবস্থায় যেহেতু মায়ের শরীরে আরও একজনের অবস্থান থাকে, তাই ভ্রূণের যথাযথ বৃদ্ধির জন্য মাকে নিয়মিত দেনিক স্বাভাবিকের থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ কিলোক্যালারি বেশি খাবার গ্রহণ করতে হবে। স্বাভাবিক অবস্থায় একজন মহিলার সাধারণত ২১৬০ কিলোক্যালরি খাবার গ্রহণ করা উচিত। গর্ভাবস্থায় মায়ের সাধারণত ১০ থেকে ১২ কেজি ওজন বৃদ্ধি হওয়া উচিত। তবে তৃতীয় ত্রৈমাসিক শেষে মায়ের ওজন ১০ কেজি বৃদ্ধি হলেই সেটা গর্ভের শিশুর জন্য যথেষ্ট বলে গণ্য করা হয়।
 

আদর্শ খাবার

গর্ভাবস্থায় ভারী মায়ের আলাদা কোনও খাবারের প্রয়োজন হয় না। তবে একটি সুষম স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করা অবশ্যই জরুরি। সুষম বলতে খাদ্যে যেন শর্করা, প্রোটিন, তেল জাতীয় খাবার এবং দুধ ও শাকসবজি পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকে।

দিনে শুরুটা একটা ভালো ব্রেকফাস্ট (সকালের খাবার) দিয়ে শুরু করতে হবে। অতিরিক্ত চিনি বা চর্বি জাতীয় খাবার কোনও সময়ই খাওয়া উচিত নয়। সকালের খাবারে রুটি সবজি, মাখন বা জেলি টোস্ট, তার সঙ্গে একটা ডিম সেটা সেদ্ধ বা ওমলেট হতে পারে। একটা পাকা কলা বা অন্য ফল যেটা মা পছন্দ করে সেটাও খেতে পারেন।
 

মধ্যাহ্নভোজ

মধ্যাহ্নভোজে ভাত, ডাল, সবজি, একটু ঘি বা মাখন, এক টুকরো মাছ, সপ্তাহে দুদিন অন্তত চিকেন খাওয়া ভালো। বিকেলে হালকা টিফিন খেয়ে চা বিস্কিট খাওয়া যেতে পারে। রাতের খাবারে ডাল রুটি বা ডাল ভাত তার সঙ্গে সবজি, যেকোনও এক টুকরো প্রোটিন জাতীয় খাবার এবং শেষে এক গ্লাস দুধ খাওয়া ভালো।

আমি আগেই বলেছি যে, তেল জাতীয় খাবার কম পরিমাণে খাওয়া ভালো। তবে শর্করা জাতীয় খাবার যেমন ভাত, রুটি, জোয়ার, রাগি, বজরা ইত্যাদি পেট ভরে খেতে হবে। তবে প্রোটিন অর্থাৎ মাছ, মাংস, ডিমের পরিমাণের একটা নিয়ম আছে—
প্রথম তিন মাসে দৈনিক ১ গ্রাম।
দ্বিতীয় তিন মাসে দৈনিক ৫ গ্রাম।
তৃতীয় তিন মাসে দৈনিক ২০ গ্রাম।
 

ভালো মানের প্রোটিনের উৎস

ভালো মানের প্রোটিনের উৎস হল ডিম, মাছ, মাংস, ডাল, সয়াবিন। তাছাড়া বাদাম থেকেও প্রোটিন পাওয়া যায়। আর একটা জিনিস মনে রাখবেন, প্রথম ত্রৈমাসিক থেকে শুরু করে গর্ভাবস্থা যত এগোবে খাদ্য গ্রহণের পরিমাণও সেইভাবে বাড়িয়ে দিতে হবে।

ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট গর্ভস্থ ভ্রুণের স্নায়ুতন্ত্রের বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যক। এটি জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধ করে। বাদাম ও সবুজ শাকসবজি ফলিক অ্যাসিডের উৎস। গর্ভবতী মাকে গর্ভ সঞ্চয়ের আগে এক মাস দৈনিক ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ও গর্ভকালে দৈনিক ৬০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড গ্রহণ করা উচিত।
এই সময় ক্যালসিয়াম পর্যাপ্ত গ্রহণ করা উচিত। দুধ, দই ও পনির ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস। ক্যালসিয়াম গর্ভস্থ শিশুর হাড় ও দাঁত গঠনে অপরিহার্য। গর্ভাবস্থায় মাকে দৈনিক ১ গ্রাম ক্যালসিয়াম খাওয়ানো উচিত। আয়রন ট্যাবলেটের সঙ্গে ক্যালসিয়াম খাওয়া উচিত নয়।

 

আয়রন

নিয়মিত আয়রন ট্যাবলেট খেলে মা ও গর্ভস্থ শিশু উভয়েই রক্তাল্পতা থেকে রেহাই পাবে। এটি শিশুর শারীরিক বিকাশও ত্বরান্বিত করে। গর্ভবতী মাকে রোজ ৩০ মিলিগ্রাম এলিমেন্টাল আয়রন খাওয়া উচিত।
 

ভিটামিন-সি

শরীরের মধ্যে লৌহ শোষণ করার জন্য ভিটামিন-সি প্রয়োজন। গর্ভবতী মায়ের দৈনিক ভিটামিন-সি প্রয়োজন ৬০ মিলিগ্রাম।
 

ভিটামিন-ডি

গর্ভস্থ শিশুর হাড় ও দাঁতের গঠনের জন্য যে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস প্রয়োজন, সেগুলো শোষণের জন্য প্রয়োজন ভিটামিন-ডি, যার অভাবে জন্মের পরে শিশুর রিকেট রোগ হতে পারে। গর্ভবতী মাকে সর্বোপরি গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ আলু, টাটকা সবুজ শাকসবজি, কাঁচা লঙ্কা, টক ফল, পাতিলেবু, কালো জাম, মাশরুম, বাদাম ইত্যাদি সময় ও সুযোগ মতো খেতে হবে। এগুলো গর্ভের শিশুর বৃদ্ধিতে বিশেষ সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
 

হবু মায়ের ব্যক্তিগত যত্ন

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আরামদায়ক, সহজে পরিধানযোগ্য ঢিলেঢালা পোশাক ও সঠিক মাপের নরম জুতো পড়তে হবে। হিল জুতো একদম চলবে না।
প্রথমবার গর্ভবতী হলে অনেক কুসংস্কার মায়ের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এরফলে শরীরের আসল যত্নের ব্যাপারটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
গর্ভধারণের পরপরই কোনও ডাক্তারের কাছে চেকআপের জন্য যাওয়া জরুরি। মা যদি গর্ভকালীন ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকে, তাহলে গর্ভকালীন কোনও জটিলতা দেখা দিলে, তার প্রতিরোধ ও চিকিৎসায়, মা ও গর্ভস্থ শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অনেকটা নিশ্চিত করা যায়। মায়ের কোনও শারীরিক সমস্যা না থাকলে তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ডাক্তারের কাছে গেলেও চলে।

 

যে সমস্ত খাবার গর্ভাবস্থায় খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া উচিত

যে সমস্ত খাবার গর্ভাবস্থায় বাদ দেওয়া উচিত সেগুলি হল—কাঁচা ডিম, কাঁচা দুধ, আধা সেদ্ধ মাংস, পেপে, আনারস, সামুদ্রিক মাছ যাতে প্রচুর মারকারি থাকে।
 

শরীরচর্চা

প্রথম গর্ভাবস্থা থেকে মাকে হালকা ব্যায়াম করতে হবে। প্রথম তিনমাস সব ধরনের ব্যায়াম করা যেতে পারে। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় তিন মাসে হাঁটা ও শুধু হালকা ব্যায়াম ও যোগাসন করা যেতে পারে। ভারসাম্যপূর্ণ ব্যায়াম মা ও শিশু দুজনের জন্যই উপকারী। গর্ভাবস্থায় যেকোনও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যায়াম করা উচিত নয়।
 

স্বামী-স্ত্রীর মেলামেশা

গর্ভাবস্থায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় মাসে স্বামী-স্ত্রী মেলামেশা করতে বাধা নেই। প্রথম ও তৃতীয় ত্রৈমাসিকে মেলামেশার ক্ষেত্রে খুব সাবধানতা প্রয়োজন। তবে গর্ভবতী মায়ের কোনও শারীরিক সমস্যা থাকলে গর্ভাবস্থায় যৌন মেলামেশা একদম নিষেধ।
 

ঘুম

দিনে দু’ঘণ্টা সহ মোট ১০ ঘন্টা ঘুমানো উচিত।
 

নেশা

মাকে নেশা জাতীয় দ্রব্য পরিহার করতে হবে। ধূমপান একেবারেই নয়। গর্ভবতী মায়ের সামনে অন্য কেউ ধূমপান করলেও গর্ভস্থ শিশুর জন্য তা ক্ষতিকর। ক্যাফেইন গ্রহণ করলে শুধু কম ওজনের শিশুরই জন্ম হয় না, গর্ভপাতও (মিসক্যারেজ) হয়ে যেতে পারে।
 

ওজন বৃদ্ধি

মায়ের ওজন বৃদ্ধি নিয়ে ডাক্তার যেমন যাচাই করবেন, মাকেও খেয়াল রাখতে হবে গর্ভাবস্থা এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে ওজন বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা।
 

মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য

গর্ভকালীন অবস্থায় মায়ের বিষণ্ণতা গর্ভস্থ শিশুর বিকাশে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং সাংসারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক মানসিক নৈকট্য গর্ভস্থ শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে সঠিক ভূমিকা নেয়।

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

যোগাযোগ: ৯৮৩০২৯৪৯৩২


Skip to content