মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

কম মনোযোগী শিশু যেমন অতি সক্রিয় হতে পারে, তেমনি আবার অটিস্টিক শিশুও কম মনোযোগী এবং অতি সক্রিয় (হাইপার অ্যাক্টিভ) হতে পারে। আবার কোনও কোনও শিশু শুধু অতিসক্রিয় বা হাইপার অ্যাক্টিভও হতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সমস্ত অবস্থার উপসর্গগুলি প্রায় একই রকম অথবা কারও কারও ক্ষেত্রে কম বেশি হয়। তবে এই সমস্ত শিশুদের বাড়িতে চিকিৎসা বা ব্যবস্থাপনা প্রায় একই রকম।
 

অটিজম ঠিক কী

অটিজম একটি বিকাশগত মানসিক প্রতিবন্ধকতা। এতে বিশেষ করে সামাজিক বিকাশ ও ভাবের আদান-প্রদান রুদ্ধ হয়ে যায়। শিশু সীমাবদ্ধ জীবনযাপন ও পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করে থাকে।

এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ নেই। বংশগতির অস্বাভাবিকতা, জন্মের সময় কোনও কারণে শিশুর মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ না হওয়া, জৈব-রসায়নিক অসাম্য — এই সমস্ত কারণের জন্য মস্তিষ্কের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং রোগের লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়। জন্ম পরবর্তী কোনও কারণের জন্য এই রোগের সৃষ্টি হয় না।
 

হাইপার অ্যাক্টিভিটি বা অতি সক্রিয়তা

হাইপার অ্যাক্টিভিটি বা অতি সক্রিয়তা হয় মস্তিষ্কের মোটর ডিজহিবিশনের জন্য। এটি শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের একটা অবস্থা, যেখানে মস্তিষ্কের উত্তেজনার প্রক্রিয়াগুলি সুস্থ শিশুদের তুলনায় বেশি সক্রিয়ভাবে ঘটে। অন্যকথায় মস্তিষ্কের কোষগুলি ক্রমাগত স্নায়ু আবেগ তৈরি করে, যা শিশুকে স্থির থাকতে দেয় না। একটি শিশুর মধ্যে অতি সক্রিয়তা যেকোনও বয়সেই শুরু হতে পারে। আর একটা জিনিস জানা দরকার, শিশুদের অতি সক্রিয়তা বা হাইবার অ্যাক্টিভিটি এবং কম মনোযোগী হাইপার অ্যাক্টিভিটি— দুটো এক জিনিস নয়। অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভ ডিজঅর্ডার —বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশি করে প্রকাশ পায়।
 

অটিজমের উপসর্গ কী কী

অটিস্টিক শিশু চোখে চোখ রেখে কথা বলে না।
অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে চায় না।
অনেক বয়সেও ঠিকমতো কথা বলতে শেখে না।
নাম করে ডাকলে উত্তর দেয় না।
নিজের মনে বিড়বিড় করে।
এই রোগে অতিচঞ্চলতা, মানসিক প্রতিবন্ধকতা, জেদি এবং আক্রমণাত্মক আচরণ, অহেতুক ভীতি, খিচুনি ইত্যাদি হতে পারে।

 

অটিজমের চিকিৎসা

পুরোপুরি সারিয়ে তোলার মতো কোনও জাদুকরী থেরাপি নেই। এইরূপ কোনও পরামর্শে অভিভাবকদের বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। তবে নিজেদেরকে অসহায় ভাবারও কোনও কারণ নেই। বিশেষ শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ, অভিভাবকদের যত্ন আর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও সহায়ক দলের পরামর্শে আপনার অটিস্টিক শিশুর প্রভুত বিকাশসাধন হতে পারে। চিকিৎসার উদ্দেশ্য হল— দুর্বলতা কমানো, সাবলম্বন এবং সম্ভাবনা বাড়ানো। এর জন্য নির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনা রয়েছে, যেগুলো যে যত তাড়াতাড়ি শুরু করবে ততই তাড়াতাড়ি সুফল মিলবে।
 

সমস্যার সমাধানে বাড়িতেও এই কর্মসূচিগুলি নেওয়া যায়

ভাষা বিকাশের জন্য ভাষা থেরাপি। এই থেরাপির উদ্দেশ্য হল মনের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা, বস্তুগুলির নাম বলা, অর্থপূর্ণ বাক্য গঠন করা এবং কণ্ঠস্বর ভালোভাবে ওঠানামা করতে শেখানো।
 

ভাষা থেরাপির জন্য কী কী করতে হবে

এক শিশুর সঙ্গে বাড়ির সকলকে বেশি বেশি কথা বলতে হবে।
শিশুকে আপনার চোখের দিকে তাকাতে এবং ঠোঁটের নড়াচড়া অনুসরণ করতে সাহায্য করুন।
শিশুকে ঈশরা ও ইঙ্গিতের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করা শেখাতে হবে।
শিশু স্বাভাবিকভাবে কোনও শব্দ উচ্চারণ করলে তাকে অর্থপূর্ণ শব্দে পরিণত করার চেষ্টা করতে হবে।
প্রাথমিকভাবে দরকারি কিছু সহজ ছোট ছোট শব্দ শেখানোর জন্য নির্ধারণ করুন। সেগুলো স্পষ্ট ও ধীরে ধীরে উচ্চারণ করা শেখাতে হবে।
শেখানো কথাগুলো প্রতিদিন পুনরাবৃত্তি করুন ও তার সঙ্গে নতুন শব্দ শেখানো চেষ্টা করুন।
ছবির বই, জিনিসপত্র ও শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখিয়ে কথা শেখাতে হবে।
শিশুকে কবিতা ও গানের অডিও, ক্যাসেট শোনাতে হবে।

 

সামাজিক বিকাশ

শিশুকে প্রয়োজনীয় সামাজিক আচরণগুলো শেখাতে হবে, যেমন— হাসির জবাবে হাসতে পারা, আদর করতে পারা, করমর্দন করা, সম্ভাষণ করা, বিদায় সূচক হাত নাড়া, আনন্দ প্রকাশ করতে পারা, শারীরিক স্পর্শ দ্বারা বন্ধুত্ব করা ইত্যাদি।

সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতে ও ভাবের আদান-প্রদান করা শেখানো। শিশুকে সকল ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে হবে। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীদের বাড়িতে, খেলার মাঠে, পার্কে, শপিং মলে নিয়ে যেতে হবে।

শিশুর সঙ্গে নিজেরা নিয়ম করে খেলতে হবে। প্রথমে সহজ আদান-প্রধানমূলক খেলা করতে হবে, যেমন বল ছড়া ও ধরা, লুকোচুরি খেলা ইত্যাদি। শিশুর পারদর্শিতা এবং পছন্দ অনুযায়ী খেলা এবং ক্রমান্বয়ে আরও গঠনমূলক খেলা শেখাতে হবে। সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বড়দের নজরদারিতে খেলতে দিতে হবে এবং খেলায় অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করতে হবে।
 

স্বাবলম্বীতার বিকাশ

শিশুকে তার বয়স বৃদ্ধির মান অনুযায়ী ব্যক্তিগত দক্ষতাগুলি শেখাতে হবে। যেমন যথাস্থানে প্রস্রাব, পায়খানা করা, নিজের হাতে খাওয়া, হাত-মুখ ধোয়া, দাঁত ব্রাশ করা, স্নান করা, চুল আঁচড়ানো, জামা-জুতো পরা, কলম দিয়ে আঁকিবুকি কারা, দরকারি জিনিসগুলো ব্যবহার করতে শেখা।
 

আচরণগত ব্যবস্থাপনা থেরাপি

এই থেরাপির দ্বারা কাঙ্ক্ষিত আচরণ শক্তিশালী করা হয় এবং অবাঞ্ছিত আচরণ কমানোর চেষ্টা করা হয়।
 

জ্ঞানমূলক আচরণ থেরাপি

এই থেরাপি শিশুদের অনুভূতিগুলি চেনাতে এবং উদ্বেগজনক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে শেখায়।

আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে: শিশুকে টনসিলের সমস্যা থেকে দূরে রাখতে চান? মেনে চলুন শিশু বিশেষজ্ঞের এই সব টিপস

হোমিওপ্যাথি: কনজাংটিভাইটিসের ভয়? মিথ ভুলে এই সব সতর্কতা মেনে চলুন

শীতের ছুটিতে আসছেন ‘ফেলুদা’ ইন্দ্রনীল, কবে মুক্তি পাচ্ছে সন্দীপ রায়ের ‘হত্যাপুরী’?

ইংলিশ টিংলিশ: One word expressions কী? জেনে নিন একঝলকে

 

যুগ্ম-মনোযোগ থেরাপি

এই থেরাপি ব্যক্তিগত মেলামেশা এবং পারস্পরিক ক্রিয়ার উপর মনোযোগ তৈরি করে। উদাহরণ— যোগাযোগ, ভাষা প্রয়োগ ইত্যাদি।
 

পেশাগত থেরাপি

এই পদ্ধতি শক্তি গড়ে তুলতে, দেহভঙ্গি উন্নত করতে এবং পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।
 

হাইপার অ্যাক্টিভ বা অতিসক্রিয় শিশুদের জেদি আচরণ দূর করার উপায়

জেদি আচরণের আগে ও পরে শিশুর কী অবস্থা হয় সেটা বিশ্লেষণ করতে হবে। প্রয়োজনে সেগুলো মনে বা লিখে রেখে শিশু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।

যৌক্তিক চাহিদা, হতাশা বা রাগের কারণে জেদি আচরণ করলে তা দূর করার চেষ্টা করতে হবে। তবে অন্যায় দাবি পূরণ করা উচিত নয়। এইরূপ দাবি পূরণের মাধ্যমে শিশুর জেদি আচরণ কমার পরিবর্তে ক্রমাগত বেড়ে যাবে।

অসঙ্গত জেদি আচরণ করলে শিশুর দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিন। জেদি আচরণ বন্ধ করলে ওর দিকে আবার মনোযোগ দিন।

শিশু কোনও ভালো কাজ করলে বা শিখলে তাকে পুরস্কৃত করুন। এরকম পুরস্কার, আদর করা, প্রশংসা সূচক কথা বলা, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে ওকে সব কথা শোনানো যাবে।

শিশুকে শেখানোর সময় ওর আগ্রহ, ইচ্ছা এবং পছন্দকে গুরুত্ব দিতে হবে। ঘরে সবসময় মমতাময় পরিবেশ তৈরি করুন।

আরও পড়ুন:

একঘেয়েমি কাটাতে পোলাও-এর স্বাদ বদল চাই? বানিয়ে ফেলুন সনাতনী ঝাল পোলাও

হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় ডার্ক চকোলেট, কী ভাবে?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪০: রবীন্দ্রনাথকে দারোয়ান ভেবে দৌড়ে পালিয়েছিল চোর

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-১৫: পুরা কথাই ভবিষ্যতের ভবিতব্য

 

কীভাবে ঝুঁকি এড়ানো যায়

গর্ভবতী মহিলাদের পর্যাপ্ত ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করতে হবে।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গর্ভবতী মহিলা কোনও ওষুধ খাবে না।
গর্ভাবস্থায় উপযুক্ত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে।
 

অভিভাবকদের কী করণীয়

অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।
বুঝতে হবে শিশু সচেতন ভাবে দুর্ব্যবহার করে না। তার স্নায়ুতন্ত্র এ ভাবেই তাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
যা কিছু ঘটে তাতে তার কোনও দোষ নেই। একজন দুষ্টু আবেগপ্রবণ শিশু কিন্তু তার মা-বাবা উভয়কেই পছন্দ করে ও ভালোবাসে।
শিশুদের মধ্যে অতি সক্রিয়তা তার ভবিষ্যতের শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে না।
মা-বাবা বিশেষ করে মাকে শিশুর সঙ্গে বেশি সময় দিতে হবে।
আক্রান্ত শিশুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় বড় বড় বাক্যের পরিবর্তে ছোট ছোট শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করতে হবে।
আক্রান্ত শিশুকে অন্য কারও সঙ্গে তুলনা করতে নেই।
আক্রান্ত শিশু রাগারাগি করলে তাকে বকুনি দেওয়ার পরিবর্তে তার সঙ্গে ভালোবেসে কথা বলে ভালো-মন্দ বোঝাতে হবে।
পরিবারের সামগ্রিক মানসিক পটভূমি শিশুর সহায়ক হওয়া প্রয়োজন।
শিশুর যে কোনও ধরনের শারীরিক সমস্যা হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

যোগাযোগ: ৯৮৩০২৯৪৯৩২


Skip to content