শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সুমন গুপ্ত তাঁর দীর্ঘ লেখক ও সাংবাদিক জীবনে সান্নিধ্যলাভ করেছেন বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের। এবার তাঁদের সঙ্গে কাটানো কিছু বিশেষ মুহূর্ত টুকরো স্মৃতিকথা হিসেবে তিনি তাঁর ধারাবাহিক ‘বরণীয় মানুষের স্মরণীয় সঙ্গ’-তে আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেবেন।

‘বরণীয় মানুষের স্মরণীয় সঙ্গ’ ধারাবাহিকের গত পর্বে এক্সপ্লোরার্স ক্লাবের কথা অল্পস্বল্প বলেছিলাম। এবার দুই পর্ব জুড়ে কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী শ্রদ্ধেয় যামিনী রায় ও এক্সপ্লোরার্স ক্লাবের কথা আপনাদের বলব। প্রশ্ন উঠতেই পারে—যামিনী রায়ের সঙ্গে এক্সপ্লোরার্স ক্লাবের সম্পর্ক কী! আসলে ক্লাবের কর্মকাণ্ডের কারণেই দেশবরেণ্য বর্ষীয়ান চিত্রশিল্পীর সঙ্গে পরিচয়ের সৌভাগ্যলাভ করেছিলাম। কিন্তু কী এমন কর্মকাণ্ড যার ফলে যামিনী রায়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেলাম? গোটা ব্যাপারটাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। এক জীবনপণ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায়।

১৯৭০ সাল। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনসাধারণের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের লাগাতার শোষণ ও বাক স্বাধীনতায় অহেতুক হস্তক্ষেপ ক্রমশ খেপিয়ে তোলে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের। শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর রাজনৈতিক দল আওয়ামি লিগ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের অঙ্গুলিহেলনে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের তাঁবেদার সরকারের অত্যাচার চরম সীমায় পৌঁছয়। গর্জে ওঠেন শেখ মুজিবুর।

অবশ্য অনেক আগে থেকেই পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের বুকে ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছিল। ১৯৪৭ সালে অন্যায়ভাবে দেশবিভাগ। পূর্ববঙ্গের নয়া নামকরণ পূর্ব পাকিস্তান৷ যেভাবেই হোক বাঙালির স্বতন্ত্র পরিচয়কে মুছে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্তের খেলায় মেতে ওঠে উর্দুভাষাভাষী পশ্চিম পাকিস্তান৷ এমনকী উর্দুই রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয় পূর্ববঙ্গেও৷ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে প্রতিবাদে সরব হল পূর্ববঙ্গের কয়েক কোটি মানুষ৷ তারা বলল, উর্দু নয় বাংলাই হোক পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রীয় ভাষা৷ সরকারি স্তরে, স্কুল-কলেজে একমাত্র বাংলা ভাষাকেই প্রাধান্য দিতে হবে।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে বাঙালিদের কোণঠাসা করতে শুরু করে পাকিস্তানের শাসকরা৷ চাকরি-বাকরি থেকে শুরু করে সরকারি কাজকর্ম সবকিছুতেই ‘কোটা’ পদ্ধতি চালু করেছিলেন তাঁরা৷ বেকারের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী হতে লাগল পূর্ববঙ্গে৷ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেল বাঙালিদের৷ ১৯৫২ সাল৷ এদিকে বাংলাভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে সমগ্র পূর্ববাংলা জুড়ে মিছিল-মিটিং, নানান রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরু হয়ে গেল৷ গ্রেপ্তার হলেন বহু আন্দোলনকারী৷ ভাষা আন্দোলন দিনে দিনে আগুন জ্বালল বাঙালির মননে।

২১ ফেব্রুয়ারির সেই দিনটি! সকাল ন’টা-সাড়ে নটা৷ ১৪৪ ধারার বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে জড়ো হতে লাগল ছাত্ররা৷ ততক্ষণে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে সশস্ত্র পুলিশবাহিনী৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং অন্য পদাধিকারীরাও উপস্থিত সেখানে৷ ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে মুহুর্মুহু স্লোগান দিতে শুরু করল ছাত্ররা৷ ক্রমশ পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠতে লাগল৷ বেলা সওয়া ১১টা নাগাদ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে যেতেই পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করে৷ কাঁদানে গ্যাস থেকে বাঁচতে ছাত্রদের একাংশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে দৌড়ে যায়৷ বাকি ছাত্রদের ঘিরে ধরে পুলিশ৷ এরপর বহু ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়৷ এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ছাত্রসমাজ৷ এরই মধ্যে একদল ছাত্র বিধানসভা ভবন ঘেরাও করে৷ তারপর ন্যায্য বিচারের দাবিতে বিধানসভায় জোর করে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালায়৷ এ ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে পাঁচজন ছাত্রের মৃত্যু হয়৷ আহত হয় অনেকেই৷ মৃত ছাত্রদের নাম রফিকউদ্দিন আহমেদ, সফিউর রহমান, আব্দুল বরকত, আবদুল জব্বর এবং আবদুস সালাম৷ ভাষা আন্দোলনের বীর শহিদ তাঁরা৷ এই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে৷ বনধ, গণ-আন্দোলন, পুলিশের গুলিতে সাধারণ মানুষের মৃত্যু প্রভৃতি ঘটনায় অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে৷ পুলিশের ব্যাপক ধরপাকড় চলতে থাকে৷ এরই মধ্যে ছাত্রসমাজ শহিদ বেদি নির্মাণ করে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করে শহিদদের৷ এর পর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি ভাষা আন্দোলন দিবস এবং শহিদ দিবস হিসেবে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে৷ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পর ভাষা আন্দোলন ও শহিদ দিবস আরও মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়৷ প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি যে, প্রবল গণবিক্ষোভে দিশেহারা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকবর্গ পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে অবশেষে বাংলাকে মেনে নিতে বাধ্য হন।

ফিরে আসি বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের কথায়৷ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামি লিগ দল ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়৷ কিন্তু পূর্ববঙ্গের শাসনভার তাঁর হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান৷ এরপর ছয়দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন পূর্ববঙ্গবাসীর উদ্দেশে৷ এক বিশাল জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের ডাক দেন৷ তাঁর বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে ধ্বনিত হয়—এ হল আমাদের মুক্তির সংগ্রাম৷ স্বাধীনতার সংগ্রাম৷ জয় বাংলা৷ নয় মাস ধরে চলেছিল এই মুক্তির সংগ্রাম৷ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে রাখা হয়৷ এরপরই আক্ষরিক অর্থে পূর্ববঙ্গের কয়েক কোটি মানুষের স্বাধীনতার মরণপণ যুদ্ধ শুরু হল৷ তৈরি হল মুক্তিবাহিনী৷ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ভারত।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কীভাবে ওই দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায় সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করেন এক্সপ্লোরার্স ক্লাব অব ইন্ডিয়া-র চেয়ারম্যান শ্রীযুক্ত মিহির সেন৷ যাঁকে ‘ওয়ান্ডার অফ সেভেন সিজ’ বলা হত৷ অর্থাৎ ‘সাত সমুদ্রের বিস্ময়’৷ এক সন্ধ্যায় ক্লাব অফিসে মিটিং ডাকলেন মিহিরদা৷ বললেন, ‘ক্লাবের সমস্ত সদস্য ও সদস্যাকে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে৷ এ ব্যাপারে কিছু কর্মসূচি আমাদের নিতে হবে৷’ শ্রদ্ধেয় যামিনী রায়ের কথা মিহিরদার মুখে তখনই শুনলাম।

Skip to content