শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


স্ত্রী বিজয়া রায়ের সঙ্গে।

মাধবী মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ—
‘মানিকদা একদিন ফোন করে বললেন, কবিগুরুর নষ্টনীড় গল্পটা পাঠাচ্ছি৷ পড়ে দেখো৷ বলেছিলাম, আমার পড়া৷ উনি বললেন, আবার পড়ো৷ পরে হাতে লেখা স্ক্রিপ্ট পাঠিয়ে দিলেন৷ ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে ‘চারুলতা’ হবে৷ আর সেই ছবির নায়িকা আমি! ভাবতেও পারছিলাম না৷ উনিশ শতকের (১৮৭০) কলকাতার সম্ভ্রান্ত এক গৃহবধূ চারুকে তার স্বামী ভূপতির (শৈলেন মুখোপাধ্যায়) অন্যমনস্কতা একাকিত্বের দিকে ঠেলে দেয়৷ স্বামীর দূর সম্পর্কের আত্মীয় অমলের (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) তার প্রতি মনস্কতা চারুকে নতুনভাবে বাঁচার প্রেরণা জোগায়৷ অমলের প্রতি ধীরে ধীরে আকর্ষণবোধ করে চারুলতা৷ অনেকেই বলেছেন, চারুর চরিত্রে অভিনেত্রী হিসেবে আমি নাকি পরিপূর্ণতালাভ করেছি৷ সত্যজিতের ‘কাপুরুষ’-এ অভিনয় না করলেও চলত৷ এর উত্তর আমার কাছে নেই৷ ‘অপেরা গ্লাস’ হাতে চারু৷ চলমান জীবনের ছবি দেখে একাকিত্ব কাটে তার৷ দৃশ্যটি নিঃসন্দেহে ভারতীয় সিনেমার অন্যতম সেরা সিকোয়েন্স৷

‘চারুলতা’র শ্যুটিং হয়েছিল টালিগঞ্জের নিউ থিয়েটার্স এক নম্বর স্টুডিওয়৷ প্রখ্যাত শিল্প নির্দেশক বংশীচন্দ্র গুপ্ত এমন সেট তৈরি করেছিলেন মনে হত আসল বাড়ি৷ শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে দোলনার দৃশ্যটি চিত্রায়িত হয়, যা ভারতীয় চলচ্চিত্রে ক্যামেরার ভাষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল৷ সেটে শিল্পীদের পুরোপুরি স্বাধীনতা দিতেন মানিকদা৷ ওঁর মতো শিল্পীদের পালস বোঝার ক্ষমতা কারও ছিল না৷ শ্যুটিংয়ের সময় মনে হত একেবারে কাছের একজন পরিচালকের ছবিতে কাজ করছি৷ ‘কাপুরুষ’-এ আমার চরিত্রের নাম করুণা৷ তার স্বামী বিমল গুপ্ত (হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়)৷ একসময় অমিতাভর (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) বান্ধবী ছিল করুণা৷ বহুদিন বাদে তাদের আবার দেখা৷ মানিকদা আমার নির্বাক অভিনয়ের প্রতি জোর দেন৷

শ্যুটিংয়ে দৃশ্য বোঝাচ্ছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়কে

‘কাপুরুষ’-এর পর কেন মানিকদার ছবিতে কাজ করলাম না তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন থাকতে পারে৷ আসলে আমাকে কেন্দ্র করে মানিকদার ইউনিটে পলিটিক্স শুরু হয়ে গেল৷ তার সঙ্গে জুড়ে গেল সাংসারিক পলিটিক্স৷ এত নোংরা পলিটিক্স যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না৷ এসব নিয়ে মানিকদার মনেও খুব অশান্তি ছিল৷ কিন্তু উনি প্রকাশ করতেন না৷ ‘কাপুরুষ’-এর পর ‘নায়ক’, ‘অশনি সংকেত’ ও ‘ঘরে বাইরে’ ওঁর এই তিনটে ছবিতেও আমাকে চেয়েছিলেন৷ মানিকদাকে আমিই ফিরিয়ে দিয়েছিলাম৷ প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক সেবাব্রত গুপ্তর সঙ্গে আমার অত্যন্ত সুমধুর সম্পর্ক ছিল৷ দাদা আর বোনের মতো৷ মানিকদা একবার সেবাদাকে বলেছিলেন, মাধবীকে রাজি করান না৷ যদি ‘ঘরে-বাইরে’-তে বিমলার চরিত্রটা করে৷ সেই অনুরোধও আমি রাখতে পারিনি৷ আমার ‘না’ মানে ‘না’৷ নিজের আদর্শকে বিসর্জন দিইনি৷ কোনও প্রলোভনের কাছে কখনও মাথা নত করিনি৷ মানিকদাকে ফিরিয়ে দিয়ে জানি না ভুল করেছি কি না৷ তবে আজ আমি অনুতপ্ত৷ দুঃখিতও বটে৷ কখনও কখনও মনে হয় মানিকদার সঙ্গে ন্যায়বিচার করিনি৷ আমার আচরণে তিনি হয়তো কষ্ট পেয়েছেন৷

গতবছর মানিকদার জন্মশতবর্ষ পালিত হল৷ ২০২১-এর ২ মে৷ আরও কয়েকজন বরেণ্য মানুষের জন্মশতবর্ষ হয়ে গিয়েছে৷ প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সন্তোষকুমার ঘোষ, সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সংগীত শিল্পী ও সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ৷ দুঃখের বিষয়, করোনা আবহে গত দেড়-দুবছর কারও শতবর্ষই সেভাবে পালন করা সম্ভব হয়নি৷ মানিকদার ছবিতে আমার কাজের অভিজ্ঞতার কথাও অনেকে জানতে চান৷ ওঁর কথা কী আর বলব! সাগর সমান প্রতিভা যাঁর, হিমালয়ের মতো উঁচু যাঁর সাফল্যের ইতিহাস, আমার মতো এক সাধারণ অভিনেত্রীর তাঁর সম্পর্কে কিছু বলা কি শোভা পায়? তাও যদি শুনতে চান তো একটা কথাই বলব, উনি আমার ভেতরে বাইরে সবকিছু একেবারে বদলে দিয়েছিলেন৷ অভিনয় মানে যে অভিনয় নয়, এটা উনিই আমাকে শিখিয়েছিলেন৷’ তখন আমার (এই নিবন্ধকার) সাংবাদিক জীবন শুরু হয়েছে৷ এক নামী দৈনিক পত্রিকায় চাকরি করছি৷ বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ কান্তিভূষণ বক্সীর পরিবারের সঙ্গে আমার বহুদিনের পরিচয়৷ তখন আমি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র৷ ডাঃ বক্সী শুধু একজন ধন্বন্তরি চিকিৎসক নন, মানুষ হিসেবেও খুব বড় মাপের৷ তাঁর সুযোগ্যা সহধর্মিণী প্রয়াত সুনন্দা বক্সীও ছিলেন একজন বড় মনের মানুষ৷ অত্যন্ত স্নেহপ্রবণা৷ তাঁকে ‘মাসিমা’ বলতাম৷ তাঁর স্নেহের কথা আজও ভুলতে পারি না৷

ডাঃ বক্সীকে আমি ‘ডাক্তারবাবু’ বলে সম্বোধন করি৷ বর্তমানে ডাক্তারবাবুর বয়স ৯৫ বছর৷ এখনও প্রখর স্মৃতিশক্তি তাঁর৷ সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ডাক্তারবাবুই আবার নতুন করে আমার পরিচয় করিয়ে দেন৷ দীর্ঘ ১০ বছর সত্যজিতের চিকিৎসার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন ডাঃ বক্সী৷ শুধু তা-ই নয়. পরবর্তীকালে বিজয়া রায়েরও চিকিৎসার ভার নিজের হাতে নিয়েছিলেন ডাঃ বক্সী৷

বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ কান্তিভূষণ বক্সীর সঙ্গে

একবার কথায় কথায় সত্যজিৎ রায়ের শ্যুটিং দেখার অভিজ্ঞতার কথা ডাক্তারবাবুকে বলেছিলাম৷ আবদার করেছিলাম যদি কখনও সম্ভব হয় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার একটু আলাপ করিয়ে দেন৷ এবারে বলি, সত্যজিতের সঙ্গে ডাঃ বক্সীর যোগাযোগ কীভাবে হল? ডাক্তারবাবুর মুখেই সবটা শোনা৷ সত্যজিতের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন ভীষ্ম মল্লিক৷ এটা মোটামুটি ১৯৮০-৮১ সালের কথা৷ বেলভিউ নার্সিংহোমের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ছিলেন ডাঃ বক্সী৷ তিনিই এই নার্সিংহোমের আইসিসিইউ ঢেলে সাজান৷ তাঁর সুযোগ্য পরিচালনায় বেলভিউয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের সুনাম ক্রমশ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে৷

সম্ভবত আটের দশকের গোড়াতেই সত্যজিতের হার্টের অসুখ ধরা পড়ে৷ তিনি মাঝে মাঝে বেলভিউয়ে রুটিন চেকআপের জন্য আসতেন৷ তখন থেকেই সত্যজিতের চিকিৎসা শুরু করেন ডাঃ বক্সী৷ ১৯৮৩ সালে হার্ট অ্যাটাক হল সত্যজিতের৷ বেলভিউয়ে ভর্তি ছিলেন৷ ধীরে ধীরে সুস্থ হলেন৷ পরের বছর আরেকটা হার্ট অ্যাটাক৷ সেবারেও ডাক্তারবাবু ও তাঁর মেডিকেল টিমের তত্ত্বাবধানে সুস্থ হয়ে উঠলেন সত্যজিৎ রায়৷

সম্প্রতি ‘পথিক আমি’ নামে ডাঃ বক্সীর আত্মজীবনীমূলক সংগ্রহযোগ্য একটি বই প্রকাশিত হয়েছে৷ তাতে সত্যজিতের চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে৷ ডাক্তারবাবু লিখছেন, ‘সত্যজিৎ (রায়) বাবু হার্ট অ্যাটাক নিয়ে বেলভিউ ক্লিনিকে ভর্তি ছিলেন৷ এখন তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে এবং তিনি বাড়িতেই আমার চিকিৎসায় আছেন৷ ভাবলাম এবার করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করে পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির করা দরকার৷ সম্ভবত বাইপাস অপারেশন করতে হবে৷’ ডাক্তারবাবুর মুখে শুনেছিলাম, সত্যজিতের এতগুলো ব্লকেজ ছিল হার্টটা খুব ড্যামেজ হয়ে গিয়েছিল৷ তিনি লিখছেন, ‘এই বিষয়ে পশ্চিমবাংলার সরকারের পক্ষ থেকে মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাশয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্তও নেওয়া হয় যে এটা বিদেশের কোনও বিখ্যাত হার্ট হাসপাতালে করতে হবে৷

সত্যজিৎবাবুর অন্তরঙ্গ শুভানুধ্যায়ী অনুজপ্রতিম শ্রীযুক্ত নির্মাল্য আচার্য মহাশয় মধ্যস্থতা করেছিলেন৷ আমি আমেরিকার হিউস্টনের টেক্সাস হার্ট ইনস্টিটিউটের বিশ্ববিখ্যাত হার্ট সার্জেন ডাঃ ডেন্টন কুলি এবং কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ ভি এস মাথুরের (দুজনেই আমার বিশেষ পরিচিত এবং বন্ধুস্থানীয় ছিলেন) কাছে প্রস্তাব রাখতেই তাঁরা সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন৷

রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তার অনুমোদনও পাওয়া গেল৷ আমি ডাঃ কুলি এবং ডাঃ মাথুরের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করে ফেললাম৷ ঠিক হল যে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে যেতে হবে৷ এটাও ঠিক হল যে ওই সময় আমাকে টেক্সাস হার্ট ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে নিয়োগ করা হবে এবং আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে৷ এরই মধ্যে একদিন মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সকালে আমার গড়িয়াহাটের বাড়িতে এসে হাজির সশরীরে৷ তাঁকে নিয়ে এলেন নির্মাল্যবাবু৷ আলোচ্য বিষয় অবশ্যই সত্যজিৎবাবুর চিকিৎসার্থে বিদেশযাত্রা৷ নির্মাল্যবাবু একটা বিশালকায় বাক্স নিয়ে এলেন গাড়ি থেকে৷ উনি বললেন যে সত্যজিৎবাবু আমার স্ত্রী সুনন্দার জন্য এই টিভি সেটটি পাঠিয়েছেন৷ সুনন্দা এটি গ্রহণ করলে উনি খুশি হবেন৷ আনন্দঘন শ্রদ্ধা সহকারে উপহারটি আমার স্ত্রী গ্রহণ করেছিল৷’

সত্যজিৎ রায়ের বাইপাস অপারেশন সফল হল৷ সুস্থ হয়ে মাসখানেক পর দেশে ফিরলেন৷ অবশ্য দেশে ফেরার পথে লন্ডনে এক বন্ধুর বাড়িতে কয়েকদিন ছিলেন৷ সত্যজিৎ রায় সুস্থ হওয়ার পরই হিউস্টন থেকে কলকাতায় ফেরেন ডাঃ বক্সী৷ চলচ্চিত্রস্রষ্টার সঙ্গে এই নিবন্ধকারের এক সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে ডাঃ বক্সীর জন্যেই৷ চিকিৎসক হিসেবে শুধু ভরসা করা নয়, সত্যজিৎ রায় নিজের পরিবারেরই একজন বলে মনে করতেন ডাঃ কান্তিভূষণ বক্সীকে৷

একটা ঘটনার কথা বলি৷ সেদিন ছিল সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন৷ ডাঃ বক্সী যথারীতি চেম্বারে বসে রুগি দেখছেন৷ হঠাৎ সত্যজিৎবাবু ফোন করে বললেন, ‘কী করছেন আপনি?’ ডাঃ বক্সী বললেন, ‘এই চেম্বারে আছি, রুগি দেখছি৷’ সত্যজিৎবাবু বললেন, ‘আপনি চলে আসুন৷’ ‘কোথায়? আজকে তো আপনার জন্মদিন৷ আজ তো আপনি বাড়িতে থাকেন না সাধারণত!’ সত্যজিৎবাবু বললেন, ‘না না, বাড়ি নয়, আপনি তাজ হোটেলে চলে আসুন৷’

সেবার সত্যজিৎ রায় সপরিবারে তাজ হোটেলে জন্মদিন পালন করেন৷ ডাঃ বক্সী তাজে ঢুকতেই তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলেন সত্যজিৎ রায়৷ এরকমই ছিল তাঁদের দুজনের সম্পর্ক৷

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

Skip to content