জগৎ বরেণ্য আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু৷ ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
সুমন গুপ্ত তাঁর দীর্ঘ লেখক ও সাংবাদিক জীবনে সান্নিধ্যলাভ করেছেন বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের। এবার তাঁদের সঙ্গে কাটানো কিছু বিশেষ মুহূর্ত টুকরো স্মৃতিকথা হিসেবে তিনি তাঁর ধারাবাহিক ‘বরণীয় মানুষের স্মরণীয় সঙ্গ’-তে আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেবেন।
জগৎ বরেণ্য গণিতজ্ঞ এবং পদার্থবিজ্ঞানী আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু-র সঙ্গে আমার পরিচয় অদ্ভুতভাবে৷ সাতের দশকের গোড়ায় যে ক’বছর তাঁর সঙ্গলাভের সুযোগ পেয়েছিলাম এককথায় অনবদ্য৷ সপ্তসিন্ধু বিজয়ী সাঁতারু মিহির সেন প্রতিষ্ঠিত এক্সপ্লোরার্স ক্লাব অব ইন্ডিয়ার অর্গানাইজিং সেক্রেটারি ছিলাম আমি৷ মিহিরদা ছিলেন চেয়ারম্যান৷ কীভাবে এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হলাম সে এক লম্বা ইতিহাস, যা যথাসময়ে আপনাদের সবিস্তারে জানাব৷ আশা করি, হয়তো তাতে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে না।
আমাদের ক্লাবের সক্রিয় সদস্য ছিল রামগোপাল নন্দী৷ উত্তর কলকাতায় সম্ভবত ডানলপের ওদিকে বাড়ি ছিল ওর৷ গরিব ঘরের ছেলে৷ পুরনো একটা সাইকেল ছিল। সেই সাইকেল চালিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ক্লাবে আসত৷ রামগোপালের বাড়ি থেকে মধ্য কলকাতায় কারনানি এস্টেটে ক্লাবের প্রধান কার্যালয়ের দূরত্ব কম করেও কুড়ি-পঁচিশ কিলোমিটার৷ এই দীর্ঘ পথ রোদজলঝড় সহ্য করে আসতেও পেছপা ছিল না রামগোপাল৷ সৎ আর প্রচণ্ড মনের জোর ছিল ওর৷ রামগোপালের স্বপ্ন ছিল সাইকেলে ওয়ার্ল্ড ট্যুর করবে৷ কিছুটা বোহেমিয়ান গোছের ছিল৷ দারিদ্র আর শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে একদিন তার স্বপ্ন সফল করতে পেরেছিল৷ টানা দশ বছর ধরে সাইকেলে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত চষে বেড়িয়েছে সে আর এক প্রসঙ্গ।
রামগোপাল মাঝে মাঝে একটু রহস্য করে আমাকে বলত, ‘তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব৷ আমার সঙ্গে যাবে?’ প্রথম প্রথম ওর কথায় তেমন আমল দিইনি৷ যখন দেখলাম, ব্যাপারটা নিয়ে সে একদম নাছোড় জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলছ? সেটা আগে একটু খোলসা করে বলো?’ রামগোপাল হাসিমুখে বলেছিল, ‘সে না হয় পরে জানলে, আমার সঙ্গে একদিন চলোই না।’
একদিন বিকেলে রামগোপাল ক্লাবে হাজির৷ সাইকেল ক্লাবঘরে ঢুকিয়েই বলল, ‘চলো আমার সেই জায়গায় এবার তোমাকে নিয়ে যাই৷’ আর আপত্তি না করে তার সঙ্গী হলাম৷ সেই সময় আমাদের হাতে পয়সা কোথায় যে ট্যাক্সি চাপব? ক্লাব থেকে সামান্য হেঁটে আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস রোডে কলামন্দির স্টপেজ৷ সেখান থেকে বাসে মানিকতলা পেরিয়ে গোয়াবাগানে নামলাম৷ খানিকটা হেঁটে একটা বাড়িতে এলাম৷ আর সেখানে যাঁকে দেখলাম, তিনি আর কেউ নন জীবন্ত কিংবদন্তি বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু৷ সাদা চাদরে ঢাকা বিছানায় আধশোয়া৷ আমাদের দুজনকে দেখে উঠে বসলেন৷ পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি৷ রামগোপালকে হাসিমুখে বললেন, ‘সেই যে তুমি দু’দিন পর আসছি বলে চলে গেলে এতদিনে আসার সময় পেলে!’ রামগোপাল হাতজোড় করে মার্জনা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘স্যার, আপনি তো জানেন সাঁতারু মিহির সেনের এক্সপ্লোরার্স ক্লাবের মেম্বার আমি৷ উত্তরবঙ্গে দিন কয়েকের জন্য একটা সাইকেল ট্যুর দিয়ে এলাম৷ তাই আপনাকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারিনি৷’ এক হাত তুলে রামগোপালকে থামিয়ে আচার্য বললেন, ‘বুঝতে পারলাম তুমি অ্যাডভেঞ্চার করে এলে৷ তাই তোমার আসতে এত বিলম্ব হল৷’ এরপর স্নেহের সুরে বললেন, ‘তোমরা এবার বোসো তো বাবারা৷ কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে?’ বিজ্ঞানাচার্যকে প্রণাম করে কাঠের চেয়ার টেনে দুজনে বসলাম।
আচার্য আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই রামগোপাল বলল, ‘স্যার ও আমাদের ক্লাবের একটা বড় দায়িত্বে রয়েছে৷ আপনার সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে এলাম৷’ রামগোপালের কথা শুনছিলাম আর বিজ্ঞানাচার্যের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবছি—এই তাহলে রামগোপালের রহস্যের আসল উত্তর! এতবড় চমক! আমি কল্পনাও করিনি৷ এরকম একজন নামী মানুষ আমাদের ‘বাবা বাছা’ বলে সম্বোধন করছেন এটাও আমাকে রীতিমতো আকর্ষণ করে৷ তাঁর সহজ-সরল কথাবার্তা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম৷ এও বুঝতে পেরেছিলাম যে, কিংবদন্তি বিজ্ঞানী রামগোপালকে যথেষ্ট স্নেহের চোখে দেখেন৷ সেই সন্ধ্যায় আমাদের মুড়ি-শসা, গরম রসগোল্লা আর চা খাইয়েছিলেন আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু৷ নিজেও খেলেন৷ বলেছিলেন, ‘মুড়ি আর শসা খেতে আমার খুব ভালো লাগে৷ শরীর ভালো থাকে৷ তোমরাও খাবে, কেমন।’
আচার্য যখন রামগোপালকে তার সাইকেল অভিযানের ব্যাপারে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন, আমি চুপ করে বসে অন্য কথা ভেবে চলেছি৷ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, সারদাপ্রসন্ন দাস, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো কিংবদন্তিদের প্রিয় ছাত্র আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু কত সহজে মিশে যেতে পারেন আমাদের মতো স্বল্প মেধার সাধারণ মানুষের সঙ্গে! অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, মেরি ক্যুরির সঙ্গে ইউরোপের ল্যাবরেটরিতে সরাসরি গবেষণা করার অভিজ্ঞতা যাঁর, সেই মানুষটিকে দুই হাত দূরে বিছানার ওপর কোলবালিশ কোলে বসে জমিয়ে গল্প করতে দেখে সেদিন সত্যিই বিস্ময়াবিভূত হয়েছিলাম! এঁরাই হলেন ক্ষণজন্মা!
সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করছে কলেজের এরকম দু-চারজন মেধাবী বন্ধুর মুখে গল্পচ্ছলে শুনেছিলাম, বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু-র অবদানের কথা৷ ‘বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স’, ‘বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট’, ‘বোস-আইনস্টাইন কো-রিলেশন’, ‘বোস-আইনস্টাইন ডিস্ট্রিবিউশন’ প্রভৃতি একের পর এক আবিষ্কার বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়৷ অথচ এই মহান ভারতীয় বাঙালি ‘নোবেল পুরস্কার’ পাননি৷ আশ্চর্যের ব্যাপার, আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অমূল্য থিওরির সাহায্য নিয়ে গবেষণা করে পরবর্তীকালে ‘নোবেল’ পেয়েছেন কয়েকজন৷ এ ব্যাপারে পরে কথা বলে দেখেছি, নিরভিমানী ছিলেন ‘ফেলো অব রয়াল সোসাইটি’র এই মনীষী বিজ্ঞানী। আচার্যের সঙ্গে সেই যে আমার যোগাযোগ গড়ে ওঠে, তা এই মাটির ভুবন থেকে তাঁর মহানিষ্ক্রমণের আগে পর্যন্ত অটুট ছিল।
মাঝে মাঝেই আচার্যকে ল্যান্ডলাইনে ফোন করে চলে যেতাম তাঁর বাড়িতে৷ আরেকটা কথা ভেবেও আশ্চর্য হয়ে যাই যে, দুনিয়াজোড়া নাম যাঁর, কোনওদিন ব্যস্ততা দেখিয়ে আমাকে বলেননি, ‘আজ এসো না৷’ উদার মানুষ ছিলেন৷ একটা শিশুমন ছিল তাঁর ভেতরে৷ একদিন সন্ধ্যায় আচার্যের বাড়িতে গিয়েছিলাম৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন নামী অধ্যাপক স্যারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন৷ আমি বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছিলাম৷ খানিকক্ষণ পর তাঁরা চলে যেতেই স্যারের ডাক এল৷ বিজ্ঞানাচার্যকে আমিও ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতাম৷ তিনি আমাকে অনুমতি দিয়েছিলেন।
সেদিন বিকেল থেকেই আকাশের মুখ ভার৷ মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল৷ একটু স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া৷ স্যার বিছানায় বসে৷ একটা পাতলা চাদর গায়ে৷ এক্সপ্লোরার্স ক্লাবের অভিযানসংক্রান্ত কাজকর্ম সম্পর্কে আরেকটু বিশদভাবে আমার কাছে জানতে চাইলেন৷ ইতিমধ্যে দু-বাটি মুড়ি দিয়ে গেল বাড়ির কাজের লোক৷ সঙ্গে ছোলাভাজা৷ স্যার বললেন, ‘মুড়িতে কিন্তু তৈলাক্ত কিছু নেই৷ গরম কড়াতে একটু টেলে নেওয়া হয়েছে৷ খেয়ে দেখো, বেশ মুচমুচে লাগবে৷’ গরম মুড়িতে ছোলাভাজা মিশিয়ে ভালোই লাগছিল খেতে৷ লক্ষ করলাম, বাটি থেকে ছোলামেশানো মুড়ি যত্ন করে খাচ্ছেন স্যার৷ এক্সপ্লোরার্স ক্লাব থেকে তিন প্রতিবন্ধী যুবক সাইকেলে কলকাতা থেকে কাশ্মীর গিয়েছেন শুনে তিনি রীতিমতো অবাক৷ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পাহাড়িপথে সাইকেল চালিয়ে ওরা গেল কীভাবে?’ তারপর নিজেই বললেন, ‘মনের জোর থাকলে যেকোনও কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যায়৷ কত উদাহরণ আছে এরকম৷ আমার জীবনটাও তো তাই৷ এ বয়সেও যথেষ্ট মনের জোর আমার।’
এক্সপ্লোরার্স ক্লাবের মহিলা সদস্যরা পিঠে রুকস্যাক চাপিয়ে দেশ-বিদেশের নানান জায়গায় কখনও সাইকেলে, কখনও পায়ে হেঁটে কখনও-বা ‘হিচহাইক’ করে একের পর এক অভিযানে শামিল হয়েছে—একথা জেনে আরও অবাক হলেন আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ‘হিচহাইক’ কথার সঠিক অর্থ কী জানতে চাইলেন৷ বললাম, ‘বাংলায় এর আক্ষরিক মানে হল ‘লাফা যাত্রা’৷ অর্থাৎ কখনও হাঁটাপথে, কখনও যেরকম যানবাহন পাবে তাতে সওয়ারি হয়ে অভিযানের পথে এগিয়ে চলা৷’ স্যার এবার খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘তাহলেই দেখো আমাদের ঘরের মেয়েরাও কত সাহস করে অভিযানে নেমে পড়েছে৷ স্বামী বিবেকানন্দ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নারীশক্তি, নারী-স্বাধীনতার যে কথা বারবার বলেছেন তা আজ সফল হয়েছে৷ তোমাদের ক্লাবের কথা শুনে ভালো লাগছে৷ তবে আমার ভয় হয় এ ধরনের কষ্টসাধ্য অভিযানে মেয়েরা কোনও বিপদের মুখে পড়বে না তো?’ বললাম, ‘স্যার, মেয়েদের এ ধরনের অভিযান ইতিমধ্যেই চারদিকে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে৷ এখনও পর্যন্ত তাঁরা কোনও বিপদের মুখে পড়েননি৷ বরং যেসব অঞ্চলের ভেতর দিয়ে তাঁরা যান সেখানকার মানুষজন নানানভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন৷’ এ কথা শুনে আশ্বস্ত বোধ করেন বিজ্ঞানাচার্য।
এতক্ষণ ঝিরঝিরে বৃষ্টি ছিল৷ বৃষ্টি আরও বাড়ল৷ এদিকে আমার ক্লাবে ফেরার তাড়াও ছিল৷ ক্লাবের লাগোয়া একটা ছোট্ট ঘরে থাকতাম৷ নিজেই রান্নাবান্না করে খেতাম৷ ভাবছিলাম, রাত হয়ে গেলে ফেরার পথে কোনও হোটেলে খেয়ে নেব৷ কিন্তু সেই রাতে স্যার আমাকে রাতের খাবার খাইয়ে তবে যেতে দিলেন৷ তাঁর এই মমতার কথা আজও ভুলিনি।
একদিন গল্প করতে করতে বিজ্ঞানাচার্যকে অনুরোধ করেছিলাম, কত দেশবরেণ্য মানুষের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা৷ রাজ্যসভায় মনোনীত সদস্য ছিলেন টানা আট বছর৷ কত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে কাছ থেকে দেখেছেন৷ কারও কারও কথা যদি একটু বলেন৷ এমনকী যে দুজন কিংবদন্তি রবীন্দ্রনাথ এবং নেতাজি অত্যন্ত স্নেহ করতেন তাঁকে, তাঁদের কথাও সেভাবে কখনও বলতে চাননি আচার্য৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ‘বাংলার বাঘ’ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়েরও স্নেহের পাত্র ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ৷ শুধু বলেছিলেন, ‘এত বড় সব নাম! নিজেদের কীর্তিতে তাঁরা অমর হয়ে আছেন৷ তাঁদের নিয়ে যে অমূল্য স্মৃতি আমার মনে রয়েছে সেসব নিয়ে নতুন করে নাড়াচাড়া করতে আজকাল আর ইচ্ছা করে না৷’ তবে বিজ্ঞানাচার্যের মুখে তাঁর ছেলেবেলার কথা, বাবা-মার কথা কিছু কিছু শুনেছি৷ নদীয়া জেলার বড়জাগুলিয়ায় পৈতৃক বাড়ি ছিল সত্যেন্দ্রনাথের৷ ১৮৯৪ সালের পয়লা জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন।
শুধু গণিত কিংবা পদার্থবিদ্যা নয়, রসায়ন, দর্শন, বায়োলজি, ধাতুবিদ্যা, সাহিত্য ও সংগীতেও অপরিসীম আগ্রহ ছিল জাতীয় অধ্যাপক ‘পদ্মবিভূষণ’ সত্যেন্দ্রনাথের৷ নিজেও ভালো এস্রাজ বাজাতেন৷ তাঁর এস্রাজ শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল৷ সুরের মূর্ছনায় ভেসে গিয়েছিলাম৷ যেভাবে তন্ময় হয়ে বাজাচ্ছিলেন, আমার মনে হয়েছিল, একজন সুরস্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিতে বিভোর হয়ে আছেন।
বিজ্ঞানাচার্যের জন্মদিনে সকালের দিকে তাঁকে প্রণাম করতে গিয়েছিলাম৷ ঘরে ঢুকে দেখলাম, ধুতি শার্ট পরা এক ভদ্রলোক উলটোদিকে মুখ করে বসে৷ বিজ্ঞানাচার্য কথা বলছেন তাঁর সঙ্গে৷ ভদ্রলোক হঠাৎ ঘাড় ঘোরাতেই চিনতে পারলাম—বিখ্যাত অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। স্যার ভানুবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘প্রতিবছর জন্মদিনে ভানু আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে৷ প্রণাম করে শুভেচ্ছা জানিয়ে যায়৷ শুধু জন্মদিনই বা বলি কেন, ভানু মাঝে মাঝেই আমার খোঁজখবর নিয়ে যায়৷ ও আমার খুব প্রিয় ছাত্র৷’ প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি যে, আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন অধ্যাপনা করতেন সেই সময় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ছাত্র ছিলেন৷ পরম গুরুর প্রতি এক সত্যনিষ্ঠ শিষ্যের যেরকম অসীম ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকে, তেমনই স্যারের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিজ্ঞানাচার্য চিরতরে বিদায় নেন ১৯৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি৷ মানব কল্যাণে সদা নিবেদিত এক মৃত্যুহীন প্রাণের বিদায়বার্তা আকাশে-বাতাসে সকরুণ সুরে ধ্বনিত হল।
আমাদের ক্লাবের সক্রিয় সদস্য ছিল রামগোপাল নন্দী৷ উত্তর কলকাতায় সম্ভবত ডানলপের ওদিকে বাড়ি ছিল ওর৷ গরিব ঘরের ছেলে৷ পুরনো একটা সাইকেল ছিল। সেই সাইকেল চালিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ক্লাবে আসত৷ রামগোপালের বাড়ি থেকে মধ্য কলকাতায় কারনানি এস্টেটে ক্লাবের প্রধান কার্যালয়ের দূরত্ব কম করেও কুড়ি-পঁচিশ কিলোমিটার৷ এই দীর্ঘ পথ রোদজলঝড় সহ্য করে আসতেও পেছপা ছিল না রামগোপাল৷ সৎ আর প্রচণ্ড মনের জোর ছিল ওর৷ রামগোপালের স্বপ্ন ছিল সাইকেলে ওয়ার্ল্ড ট্যুর করবে৷ কিছুটা বোহেমিয়ান গোছের ছিল৷ দারিদ্র আর শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে একদিন তার স্বপ্ন সফল করতে পেরেছিল৷ টানা দশ বছর ধরে সাইকেলে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত চষে বেড়িয়েছে সে আর এক প্রসঙ্গ।
রামগোপাল মাঝে মাঝে একটু রহস্য করে আমাকে বলত, ‘তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব৷ আমার সঙ্গে যাবে?’ প্রথম প্রথম ওর কথায় তেমন আমল দিইনি৷ যখন দেখলাম, ব্যাপারটা নিয়ে সে একদম নাছোড় জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলছ? সেটা আগে একটু খোলসা করে বলো?’ রামগোপাল হাসিমুখে বলেছিল, ‘সে না হয় পরে জানলে, আমার সঙ্গে একদিন চলোই না।’
একদিন বিকেলে রামগোপাল ক্লাবে হাজির৷ সাইকেল ক্লাবঘরে ঢুকিয়েই বলল, ‘চলো আমার সেই জায়গায় এবার তোমাকে নিয়ে যাই৷’ আর আপত্তি না করে তার সঙ্গী হলাম৷ সেই সময় আমাদের হাতে পয়সা কোথায় যে ট্যাক্সি চাপব? ক্লাব থেকে সামান্য হেঁটে আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস রোডে কলামন্দির স্টপেজ৷ সেখান থেকে বাসে মানিকতলা পেরিয়ে গোয়াবাগানে নামলাম৷ খানিকটা হেঁটে একটা বাড়িতে এলাম৷ আর সেখানে যাঁকে দেখলাম, তিনি আর কেউ নন জীবন্ত কিংবদন্তি বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু৷ সাদা চাদরে ঢাকা বিছানায় আধশোয়া৷ আমাদের দুজনকে দেখে উঠে বসলেন৷ পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি৷ রামগোপালকে হাসিমুখে বললেন, ‘সেই যে তুমি দু’দিন পর আসছি বলে চলে গেলে এতদিনে আসার সময় পেলে!’ রামগোপাল হাতজোড় করে মার্জনা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘স্যার, আপনি তো জানেন সাঁতারু মিহির সেনের এক্সপ্লোরার্স ক্লাবের মেম্বার আমি৷ উত্তরবঙ্গে দিন কয়েকের জন্য একটা সাইকেল ট্যুর দিয়ে এলাম৷ তাই আপনাকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারিনি৷’ এক হাত তুলে রামগোপালকে থামিয়ে আচার্য বললেন, ‘বুঝতে পারলাম তুমি অ্যাডভেঞ্চার করে এলে৷ তাই তোমার আসতে এত বিলম্ব হল৷’ এরপর স্নেহের সুরে বললেন, ‘তোমরা এবার বোসো তো বাবারা৷ কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে?’ বিজ্ঞানাচার্যকে প্রণাম করে কাঠের চেয়ার টেনে দুজনে বসলাম।
আচার্য আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই রামগোপাল বলল, ‘স্যার ও আমাদের ক্লাবের একটা বড় দায়িত্বে রয়েছে৷ আপনার সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে এলাম৷’ রামগোপালের কথা শুনছিলাম আর বিজ্ঞানাচার্যের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবছি—এই তাহলে রামগোপালের রহস্যের আসল উত্তর! এতবড় চমক! আমি কল্পনাও করিনি৷ এরকম একজন নামী মানুষ আমাদের ‘বাবা বাছা’ বলে সম্বোধন করছেন এটাও আমাকে রীতিমতো আকর্ষণ করে৷ তাঁর সহজ-সরল কথাবার্তা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম৷ এও বুঝতে পেরেছিলাম যে, কিংবদন্তি বিজ্ঞানী রামগোপালকে যথেষ্ট স্নেহের চোখে দেখেন৷ সেই সন্ধ্যায় আমাদের মুড়ি-শসা, গরম রসগোল্লা আর চা খাইয়েছিলেন আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু৷ নিজেও খেলেন৷ বলেছিলেন, ‘মুড়ি আর শসা খেতে আমার খুব ভালো লাগে৷ শরীর ভালো থাকে৷ তোমরাও খাবে, কেমন।’
আচার্য যখন রামগোপালকে তার সাইকেল অভিযানের ব্যাপারে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন, আমি চুপ করে বসে অন্য কথা ভেবে চলেছি৷ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, সারদাপ্রসন্ন দাস, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো কিংবদন্তিদের প্রিয় ছাত্র আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু কত সহজে মিশে যেতে পারেন আমাদের মতো স্বল্প মেধার সাধারণ মানুষের সঙ্গে! অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, মেরি ক্যুরির সঙ্গে ইউরোপের ল্যাবরেটরিতে সরাসরি গবেষণা করার অভিজ্ঞতা যাঁর, সেই মানুষটিকে দুই হাত দূরে বিছানার ওপর কোলবালিশ কোলে বসে জমিয়ে গল্প করতে দেখে সেদিন সত্যিই বিস্ময়াবিভূত হয়েছিলাম! এঁরাই হলেন ক্ষণজন্মা!
সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করছে কলেজের এরকম দু-চারজন মেধাবী বন্ধুর মুখে গল্পচ্ছলে শুনেছিলাম, বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু-র অবদানের কথা৷ ‘বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স’, ‘বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট’, ‘বোস-আইনস্টাইন কো-রিলেশন’, ‘বোস-আইনস্টাইন ডিস্ট্রিবিউশন’ প্রভৃতি একের পর এক আবিষ্কার বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়৷ অথচ এই মহান ভারতীয় বাঙালি ‘নোবেল পুরস্কার’ পাননি৷ আশ্চর্যের ব্যাপার, আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অমূল্য থিওরির সাহায্য নিয়ে গবেষণা করে পরবর্তীকালে ‘নোবেল’ পেয়েছেন কয়েকজন৷ এ ব্যাপারে পরে কথা বলে দেখেছি, নিরভিমানী ছিলেন ‘ফেলো অব রয়াল সোসাইটি’র এই মনীষী বিজ্ঞানী। আচার্যের সঙ্গে সেই যে আমার যোগাযোগ গড়ে ওঠে, তা এই মাটির ভুবন থেকে তাঁর মহানিষ্ক্রমণের আগে পর্যন্ত অটুট ছিল।
মাঝে মাঝেই আচার্যকে ল্যান্ডলাইনে ফোন করে চলে যেতাম তাঁর বাড়িতে৷ আরেকটা কথা ভেবেও আশ্চর্য হয়ে যাই যে, দুনিয়াজোড়া নাম যাঁর, কোনওদিন ব্যস্ততা দেখিয়ে আমাকে বলেননি, ‘আজ এসো না৷’ উদার মানুষ ছিলেন৷ একটা শিশুমন ছিল তাঁর ভেতরে৷ একদিন সন্ধ্যায় আচার্যের বাড়িতে গিয়েছিলাম৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন নামী অধ্যাপক স্যারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন৷ আমি বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছিলাম৷ খানিকক্ষণ পর তাঁরা চলে যেতেই স্যারের ডাক এল৷ বিজ্ঞানাচার্যকে আমিও ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতাম৷ তিনি আমাকে অনুমতি দিয়েছিলেন।
সেদিন বিকেল থেকেই আকাশের মুখ ভার৷ মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল৷ একটু স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া৷ স্যার বিছানায় বসে৷ একটা পাতলা চাদর গায়ে৷ এক্সপ্লোরার্স ক্লাবের অভিযানসংক্রান্ত কাজকর্ম সম্পর্কে আরেকটু বিশদভাবে আমার কাছে জানতে চাইলেন৷ ইতিমধ্যে দু-বাটি মুড়ি দিয়ে গেল বাড়ির কাজের লোক৷ সঙ্গে ছোলাভাজা৷ স্যার বললেন, ‘মুড়িতে কিন্তু তৈলাক্ত কিছু নেই৷ গরম কড়াতে একটু টেলে নেওয়া হয়েছে৷ খেয়ে দেখো, বেশ মুচমুচে লাগবে৷’ গরম মুড়িতে ছোলাভাজা মিশিয়ে ভালোই লাগছিল খেতে৷ লক্ষ করলাম, বাটি থেকে ছোলামেশানো মুড়ি যত্ন করে খাচ্ছেন স্যার৷ এক্সপ্লোরার্স ক্লাব থেকে তিন প্রতিবন্ধী যুবক সাইকেলে কলকাতা থেকে কাশ্মীর গিয়েছেন শুনে তিনি রীতিমতো অবাক৷ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পাহাড়িপথে সাইকেল চালিয়ে ওরা গেল কীভাবে?’ তারপর নিজেই বললেন, ‘মনের জোর থাকলে যেকোনও কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যায়৷ কত উদাহরণ আছে এরকম৷ আমার জীবনটাও তো তাই৷ এ বয়সেও যথেষ্ট মনের জোর আমার।’
এক্সপ্লোরার্স ক্লাবের মহিলা সদস্যরা পিঠে রুকস্যাক চাপিয়ে দেশ-বিদেশের নানান জায়গায় কখনও সাইকেলে, কখনও পায়ে হেঁটে কখনও-বা ‘হিচহাইক’ করে একের পর এক অভিযানে শামিল হয়েছে—একথা জেনে আরও অবাক হলেন আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ‘হিচহাইক’ কথার সঠিক অর্থ কী জানতে চাইলেন৷ বললাম, ‘বাংলায় এর আক্ষরিক মানে হল ‘লাফা যাত্রা’৷ অর্থাৎ কখনও হাঁটাপথে, কখনও যেরকম যানবাহন পাবে তাতে সওয়ারি হয়ে অভিযানের পথে এগিয়ে চলা৷’ স্যার এবার খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘তাহলেই দেখো আমাদের ঘরের মেয়েরাও কত সাহস করে অভিযানে নেমে পড়েছে৷ স্বামী বিবেকানন্দ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নারীশক্তি, নারী-স্বাধীনতার যে কথা বারবার বলেছেন তা আজ সফল হয়েছে৷ তোমাদের ক্লাবের কথা শুনে ভালো লাগছে৷ তবে আমার ভয় হয় এ ধরনের কষ্টসাধ্য অভিযানে মেয়েরা কোনও বিপদের মুখে পড়বে না তো?’ বললাম, ‘স্যার, মেয়েদের এ ধরনের অভিযান ইতিমধ্যেই চারদিকে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে৷ এখনও পর্যন্ত তাঁরা কোনও বিপদের মুখে পড়েননি৷ বরং যেসব অঞ্চলের ভেতর দিয়ে তাঁরা যান সেখানকার মানুষজন নানানভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন৷’ এ কথা শুনে আশ্বস্ত বোধ করেন বিজ্ঞানাচার্য।
এতক্ষণ ঝিরঝিরে বৃষ্টি ছিল৷ বৃষ্টি আরও বাড়ল৷ এদিকে আমার ক্লাবে ফেরার তাড়াও ছিল৷ ক্লাবের লাগোয়া একটা ছোট্ট ঘরে থাকতাম৷ নিজেই রান্নাবান্না করে খেতাম৷ ভাবছিলাম, রাত হয়ে গেলে ফেরার পথে কোনও হোটেলে খেয়ে নেব৷ কিন্তু সেই রাতে স্যার আমাকে রাতের খাবার খাইয়ে তবে যেতে দিলেন৷ তাঁর এই মমতার কথা আজও ভুলিনি।
একদিন গল্প করতে করতে বিজ্ঞানাচার্যকে অনুরোধ করেছিলাম, কত দেশবরেণ্য মানুষের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা৷ রাজ্যসভায় মনোনীত সদস্য ছিলেন টানা আট বছর৷ কত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে কাছ থেকে দেখেছেন৷ কারও কারও কথা যদি একটু বলেন৷ এমনকী যে দুজন কিংবদন্তি রবীন্দ্রনাথ এবং নেতাজি অত্যন্ত স্নেহ করতেন তাঁকে, তাঁদের কথাও সেভাবে কখনও বলতে চাননি আচার্য৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ‘বাংলার বাঘ’ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়েরও স্নেহের পাত্র ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ৷ শুধু বলেছিলেন, ‘এত বড় সব নাম! নিজেদের কীর্তিতে তাঁরা অমর হয়ে আছেন৷ তাঁদের নিয়ে যে অমূল্য স্মৃতি আমার মনে রয়েছে সেসব নিয়ে নতুন করে নাড়াচাড়া করতে আজকাল আর ইচ্ছা করে না৷’ তবে বিজ্ঞানাচার্যের মুখে তাঁর ছেলেবেলার কথা, বাবা-মার কথা কিছু কিছু শুনেছি৷ নদীয়া জেলার বড়জাগুলিয়ায় পৈতৃক বাড়ি ছিল সত্যেন্দ্রনাথের৷ ১৮৯৪ সালের পয়লা জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন।
শুধু গণিত কিংবা পদার্থবিদ্যা নয়, রসায়ন, দর্শন, বায়োলজি, ধাতুবিদ্যা, সাহিত্য ও সংগীতেও অপরিসীম আগ্রহ ছিল জাতীয় অধ্যাপক ‘পদ্মবিভূষণ’ সত্যেন্দ্রনাথের৷ নিজেও ভালো এস্রাজ বাজাতেন৷ তাঁর এস্রাজ শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল৷ সুরের মূর্ছনায় ভেসে গিয়েছিলাম৷ যেভাবে তন্ময় হয়ে বাজাচ্ছিলেন, আমার মনে হয়েছিল, একজন সুরস্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিতে বিভোর হয়ে আছেন।
বিজ্ঞানাচার্যের জন্মদিনে সকালের দিকে তাঁকে প্রণাম করতে গিয়েছিলাম৷ ঘরে ঢুকে দেখলাম, ধুতি শার্ট পরা এক ভদ্রলোক উলটোদিকে মুখ করে বসে৷ বিজ্ঞানাচার্য কথা বলছেন তাঁর সঙ্গে৷ ভদ্রলোক হঠাৎ ঘাড় ঘোরাতেই চিনতে পারলাম—বিখ্যাত অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। স্যার ভানুবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘প্রতিবছর জন্মদিনে ভানু আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে৷ প্রণাম করে শুভেচ্ছা জানিয়ে যায়৷ শুধু জন্মদিনই বা বলি কেন, ভানু মাঝে মাঝেই আমার খোঁজখবর নিয়ে যায়৷ ও আমার খুব প্রিয় ছাত্র৷’ প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি যে, আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন অধ্যাপনা করতেন সেই সময় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ছাত্র ছিলেন৷ পরম গুরুর প্রতি এক সত্যনিষ্ঠ শিষ্যের যেরকম অসীম ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকে, তেমনই স্যারের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিজ্ঞানাচার্য চিরতরে বিদায় নেন ১৯৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি৷ মানব কল্যাণে সদা নিবেদিত এক মৃত্যুহীন প্রাণের বিদায়বার্তা আকাশে-বাতাসে সকরুণ সুরে ধ্বনিত হল।