শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


কাননদেবী।

কাননদেবী তাঁর আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’-তে তাঁর কৈশোর জীবনের দুঃখকষ্টের কথা অকপটে বলেছেন।—’হঠাৎ একদিন বাবাকে হারালাম। চারদিকে যেন অন্ধকার নেমে এল। সংসারে আমি, দিদি ও মা ছাড়া কেউ নেই। দিদির বিয়ে তার আগেই হয়ে গিয়েছে। ভালো করে জ্ঞান হওয়ার আগেই, শোক সামলে ওঠার মতো মানসিক অবস্থা তৈরি হওয়ার সুযোগ পেতে না পেতেই একটা প্রচণ্ড দায়িত্বের তাড়না যেন চাবুক মেরে অস্থির করে তুলেছিল। কী করে চলবে? আমার বাবা (রতনচন্দ্র দাস) মার্চেন্ট অফিসে কাজ করতেন। এছাড়া সোনার-রুপোর ছোটখাট একটা দোকানও ছিল। কিন্তু নানা কু-অভ্যাসের জন্য আয়ের চেয়ে তাঁর ব্যয়ের অঙ্কটাই বেশি ছিল। সে কারণেই আমাদের জন্য মোটা অঙ্কের ঋণ ছাড়া কিছুই রেখে যেতে পারেননি।’

চরম দারিদ্রে চোখের সামনে তখন শুধুই অন্ধকার মা ও মেয়ের। অনেক কাকুতিমিনতি করে এক আত্মীয়ের বাড়িতে তাঁরা মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছিলেন। কিন্তু লাঞ্ছনার হাত থেকে রেহাই মেলেনি। চিরদিন কারও সমান যায় না। ভগবান মুখ তুলে চাইলেন। হাওড়ার ঘোলাডাঙা বস্তির দশ-বারো বছরের কাননবালা নামে সুন্দরী বালিকার জীবনে হঠাৎই যেন দেবদূতের মতো এক ভদ্রলোকের আগমন হল। তাঁর নাম তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায়। ভদ্রলোককে কাকাবাবু বলে ডাকতেন কাননদেবী। কাননবালাকে ম্যাডান কোম্পানিতে নিয়ে যান তুলসীবাবু। সেটা ১৯২৬ সাল। জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত নির্বাক ছবি ‘জয়দেব’-এ শ্রীরাধার ভূমিকায় অভিনয় করেন কাননবালা। আশ্চর্যের ব্যাপার হলেও এটাই সত্যি, পুরো ছবিতে অভিনয়ের জন্যে তাঁর পারিশ্রমিক পাওয়ার কথা ছিল ২৫ টাকা। কিন্তু হাতে পেয়েছিলেন মাত্র পাঁচ টাকা! বাকি টাকাটা প্রণামি হিসেবে দিতে হয়েছিল কয়েক জায়গায়। এটাই বোধহয় মানুষের চিরাচরিত স্বভাব, দুর্বল ও অসহায়ের থেকে ছলে-বলে-কৌশলে কিছু-না-কিছু আদায় করে নিতে বিবেকে এতটুকুও বাধে না।

বছর পাঁচেক পর ১৯৩১ সালে ম্যাডান কোম্পানির ব্যানারেই ‘ঋষির প্রেম’ ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন কাননদেবী। সে বছরই ওই কোম্পানির ‘প্রহ্লাদ’ ও ‘জোরবরাত’ ছবি দুটির মধ্যে প্রথমটিতে নারদের ভূমিকায়, দ্বিতীয়টিতে নায়িকার চরিত্রে ছিলেন তিনি। মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে ম্যাডান কোম্পানিরই আরেকটি ছবি ‘বিষ্ণুমায়া’। এতে নারায়ণ এবং শ্রীকৃষ্ণ দুটি চরিত্রেই অভিনয় করেন কাননদেবী। ম্যাডান কোম্পানির হয়ে কাননদেবীর শেষ ছবি সম্ভবত কালীপ্রসাদ ঘোষ পরিচালিত ‘শংকরাচার্য’।

ছোট থেকেই সংগীতের প্রতি তীব্র আকর্ষণ কাননদির। শৈশবে মেয়ের গান শেখাবার ব্যবস্থা করেছিলেন বাবা রতনচন্দ্র দাস। মেয়ের কণ্ঠে ঈশ্বরদত্ত সুর ছিল। পরে তা আরও পরিশীলিত হয়েছিল নিউ থিয়েটার্সের দুই দিকপাল সংগীত পরিচালক পঙ্কজকুমার মল্লিক এবং রাইচাঁদ বড়ালের প্রত্যক্ষ সহায়তায়। ১৯৩২ সালের ডিসেম্বরে রাধা ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গে কাননদেবীর দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হয়। এই সংস্থার প্রথম ছবি ‘শ্রীগৌরাঙ্গ’য় বিষ্ণুপ্রিয়ার চরিত্রে তাঁর মর্মস্পর্শী অভিনয় সকলের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ‘মা’, ‘চার দরবেশ’ প্রভৃতি ছবিতেও কাননদেবীর কাজ প্রশংসিত হয়। তবে ‘বাসবদত্তা’ ছবিতে নিজের অভিনয়ের খোলাখুলি সমালোচনা নিজেই করেন। বলেছিলেন, ‘নিষ্প্রাণ ও জড়তাপূর্ণ ছিল আমার অভিনয়।’

বাংলা ছবিতে তখনও প্লে-ব্যাক চালু হয়নি। সিংগিং স্টারের তখন প্রচণ্ড চাহিদা। লখনউয়ের এক গুণী উস্তাদের কাছে তালিম নেওয়া শুরু করেন। ১৯৩৫ সালে মেগাফোন কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা জে এন ঘোষের আগ্রহে কাননদেবীর প্রথম গানের রেকর্ড প্রকাশিত হল। পরের বছরটা কাননদেবীর জীবনে স্মরণীয়৷ কারণ, তখনকার দিনের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাণ সংস্থা ‘নিউ থিয়েটার্স’-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। নিউ থিয়েটার্স-এর নাম তখন ভারতজোড়া। কাননদেবীর সঙ্গে এই সংস্থার চুক্তিবদ্ধ হওয়ার প্রসঙ্গে একটা কথা জানিয়ে রাখি। ‘দেবদাস’ ছবি শুরু করার আগে প্রমথেশ বড়ুয়া কাননদেবীকে পার্বতীর রোলটা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময় রাধা ফিল্মসের সঙ্গে কাননদেবী চুক্তিবদ্ধ ছিলেন বলে পার্বতীর রোলটা করা সম্ভব হয়নি। এই আফসোস তাঁর চিরটাকাল ছিল। অবশ্য পরে প্রমথেশ বড়ুয়ার পরিচালনায় তাঁরই বিপরীতে ‘মুক্তি’ ছবিতে কাজ করার সুযোগ পেয়ে খুশি হন কাননদেবী।

১৯৩৮ সালের ২ এপ্রিল ‘বিদ্যাপতি’ মুক্তি পেল। নামভূমিকায় পাহাড়ি সান্যাল। এ ছবিতে কাজী নজরুল ইসলাম কাননদেবী অভিনীত অনুরাধা চরিত্রটি সৃষ্টি করেন। বিদ্রোহী কবির সঙ্গে কাননদেবীর পরিচয় করিয়ে দেন মেগাফোনের জে এন ঘোষ। দিদি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি খুবই সৌভাগ্যবতী, কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হল। কবির পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। বাবরি চুল। ওর মুখের দিকে তাকাতে আমার ভয় করছিল। হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে সুর করছিলেন। আমাকে কিছুটা জড়োসড়ো দেখে সম্ভবত স্বাভাবিক করার জন্যই আমার কণ্ঠ ও চেহারার প্রশংসা করে হাসতে হাসতে গোটা রিহার্সাল রুম মাতিয়ে তোলেন। তারপর কবি খুবই বিনয়ের সঙ্গে জে এন ঘোষকে বললেন, আমার বড্ড খিদে পেয়েছে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে কাননেরও খিদে পেয়েছে। খাবার আসতেই প্রথমে আমার হাতে মিষ্টি তুলে দিয়ে তারপর নিজে খেতেন। খুব সুন্দর করে আস্তে আস্তে গুছিয়ে খেতেন। কবির দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। তিনি হাসিমুখে বলতেন, ডাগর চোখে দেখছ কী? আমি হলাম ঘটক, তা জানো? এক দেশে সুরের অতল সাগর। অন্য দেশে কথা-কাহিনির খাঁটি মাটি। এই দুই দেশের বর-কনেকে এক করতে হবে। কিন্তু দুটির হাত আলাদা হলেই বে-বনতি। বুঝলে কিছু?’

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

Skip to content