শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


কাননদেবী। ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা কাননদেবীর সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগের কারণটা ছিল একটু অন্যরকম। হলিউডের আরেক কিংবদন্তি নায়িকা গ্রেটা গার্বো মারা যান। যে কাগজের অফিসে কাজ করতাম তার সম্পাদকীয় দপ্তর সিদ্ধান্ত নেয় গ্রেটা গার্বোকে নিয়ে রোববারের পাতা হবে। গ্রেটা গার্বোর গুণমুগ্ধ কাননদেবী। তাই তাঁর একটা এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ পেলে ভালো হয়। আর এই কঠিন দায়িত্ব আমাকে সঁপেছিলেন কাগজের সম্পাদক।

প্রায় ৩২ বছর আগের কথা। ১৯৯০ সালের ১৬ এপ্রিল। বেলা বারোটা নাগাদ কাননদেবীকে বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছিলাম। যিনি ফোন তুললেন শান্ত গলায় বললেন, ‘কাকে চান?’ এমন মধুঝরা কণ্ঠস্বর আমি বিশেষ শুনিনি। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বলেছিলাম, ‘দিদির একটা সাক্ষাৎকার চাই। গ্রেটা গার্বো মারা গিয়েছেন। শুনেছি তার বড় ফ্যান দিদি।’ ফোনের অন্য প্রান্তে এবার জলতরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ল মহিলার কণ্ঠস্বর৷ ‘হ্যাঁ, আমি কাননদেবী বলছি। গ্রেটা গার্বোর কথা যখন বলছেন তাঁর সম্পর্কে আমি নিশ্চয়ই বলব। আপনি আগামীকাল সকাল দশটা নাগাদ টালিগঞ্জে আমার রিজেন্ট গ্রোভের বাড়িতে আসতে পারবেন? বাড়িটা চিনতে পারবেন তো?’

বললাম, ‘আপনার বাড়ির লোকেশন মোটামুটি জানি। আমি ঠিক খুঁজে নেব।’ ফোন নামিয়ে রেখে ভাবছিলাম, এতবড় একজন অভিনেত্রী, গায়িকা, প্রযোজকের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি নিজেই ফোন ধরলেন৷ ভদ্রমহিলার এতটুকুও অহংকার আছে বলে তো মনে হল না। বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বললেন।

পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে গেলাম রিজেন্ট গ্রোভের বাড়িতে। বাড়ি তো নয়, অট্টালিকা। লোহার বড় গেটটা খুলতেই নানান রকমের ফুলগাছ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। নানা জাতের গোলাপ আর সূর্যমুখী। একতলার বারান্দার সামনে এসে সিমেন্ট বাঁধানো চওড়া উঠোনে দাঁড়াতেই দেখলাম, কিংবদন্তি অভিনেত্রীকে। চেয়ারে বসে রয়েছেন। পরনে লাল পাড় তাঁতের শাড়ি। মাথায় ঘোমটা৷ কোলের ওপর ফুলের সাজি। তাতে প্রচুর সাদা ফুল। গুনগুন করে গান গাইছেন আর আপনমনে মালা গাঁথছেন। আমার পরিচয় পেয়ে বসতে বললেন।

কাননদেবীকে অবাক হয়ে দেখছিলাম। তখনই তাঁর ৭৫ বছর বয়স৷ গৌরবর্ণা। মুখে মৃদু হাসি। মুখমণ্ডলে প্রশান্তির ছাপ। এ বয়সেও এই অনন্য নায়িকার সৌন্দর্যের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের এহেন মিশেল তাঁকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। তাঁর ভদ্রতাবোধের কথা বলতে হয়। বললেন, ‘আপনি অনেকটা পথ এসেছেন। গরমও পড়েছে। আগে একটু ঠান্ডা শরবত খান। তারপর কথাবার্তা হবে।’ আমার বয়োজ্যেষ্ঠ এক সাংবাদিকের মুখে শুনেছিলাম, কাননদেবী অত্যন্ত অতিথিপরায়ণা।

কাননদেবী এভাবেই প্রতিদিন নিজে ফুল তুলে মালা গাঁথতেন তাঁর ইষ্টদেবতা গোপালের জন্য। সেই মালা গোপালের গলায় পরিয়ে পুজো করতেন। কাননদেবী বিশ্বাস করতেন যে, ইষ্টদেবতার আশীর্বাদেই প্রচুর ঝড়-তুফান পেরিয়ে আজ এ জায়গায় পৌঁছেছেন। তাঁর শোয়ার ঘরে মাথার কাছে থাকত গোপালের অষ্টধাতুর মূর্তি। যাতে সবসময় ইষ্টদেবতা তাঁর চোখের সামনে থাকেন।
সেদিন গ্রেটা গার্বোর প্রসঙ্গ উঠতেই কাননদেবী শ্রদ্ধাবনত হয়ে বলেছিলেন, ‘যে দুজন শিল্পী সবসময় আমাকে অনুপ্রাণিত করেন তাঁদের একজন হলেন চ্যার্লি চ্যাপলিন৷ অন্যজন গার্বো৷ গ্রেটা গার্বোর সব ছবি দেখেছি৷ কতবড় অভিনেত্রী! আমি ফিল্মে এসেছিলাম ১৯২৬ সালে৷ তখনই উনি খ্যাতির মধ্যগগনে৷ ওঁর ছবি দেখে বাড়ি ফিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওঁকে অনুকরণ করতাম৷

১৯৪৭ সালের আগস্টে হলিউডে বেড়াতে গিয়েছিলেন কাননদেবী। কয়েকদিন ঘুরেফিরে স্টুডিওগুলো দেখলেন। দেখা হয়েছিল ক্লার্ক গ্যাবল, ভিভিয়েন লে, স্পেন্সার ট্রেসি, ক্যাথারিন হেপবার্ন, মিরনা লয়, চার্লস বয়ার প্রমুখের সঙ্গে৷ প্রত্যেকেই তখন তাবড় তাবড় স্টার। জগৎজোড়া নাম তাঁদের। কাননদেবী সেইসব সুখস্মৃতির কথা বললেও রীতিমতো হতাশ হন তাঁর স্বপ্নের নায়িকা গ্রেটা গার্বোর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি বলে। ওই স্টারদের কাছেই জেনেছিলেন যে, গ্রেটা গার্বো কারওর সঙ্গে দেখা করেন না। একা থাকতেই ভালোবাসেন।

কাননদেবী আমাকে বলেছিলেন, ‘সেবার বিদেশে ট্যুর করতে গিয়ে বিশেষ করে দুটো দিনের স্মৃতি আজও ভুলতে পারিনি৷ সেই সময় লন্ডনে ভারতের হাইকমিশনার শ্রীকৃষ্ণ মেনন। তিনি আমার সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেন। সেইসঙ্গে ১৫ আগস্ট ভারতের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গান গাইবার আমন্ত্রণ। অন্যটি গ্রামোফোন কোম্পানির সম্মাননা অনুষ্ঠান। ১৫ আগস্ট ‘ইন্ডিয়া হাউস’-এ স্বাধীন ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উড়ল। আমি গেয়েছিলাম, ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু…৷’ সারা জীবন ধরে অনেক গান গেয়েছি। কিন্তু স্বাধীন ভারতের একজন নাগরিক হিসেবে সেদিন গান গাইবার অনুভূতি আমার কাছে একেবারে আলাদা ছিল। গান গাইতে গাইতে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। এ কান্না যুগপৎ আনন্দ ও বিষাদের। আনন্দ অবশেষে আমরা স্বাধীন হয়েছি বলে। আর ভারতের বীর সন্তানদের প্রতি পরম কৃতজ্ঞতায় আমার দুচোখ ভরে জল এসেছিল, যাঁদের আত্মবলিদান ব্যতীত স্বাধীনতা পেতাম না আমরা।’

সেদিনের পর মাত্র বছর দুয়েক৷ কাননদেবীর সঙ্গে কয়েকবার আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। তাঁর মুখেই সরাসরি তাঁর জীবনের অনেক কথা জেনেছি। তিনি আমাকে ‘দিদি’ বলার অধিকার দিয়েছিলেন। আজও মনে মনে ভাবি দিদি আরও কয়েকটা বছর বেঁচে থাকলে আরও কত কী জানার ছিল৷ যখনই তাঁর বাড়িতে গিয়েছি, কিছু-না-কিছু না খাইয়ে ছাড়তেন না। এই স্নেহের পরশ আমার সম্পদ।

দিদির ছোটবেলা নিদারুণ কষ্টের মধ্য দিয়ে কেটেছে। দারিদ্রকে দিনের পর দিন সইতে হয়েছে মুখ বুজে। সেই অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে কাননবালা দাস কীভাবে একদিন সারা দেশের মানুষের কাছে কাননদেবীরূপে শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত হলেন তা এক আশ্চর্য ঘটনাই বটে! নায়িকা ও গায়িকা হিসেবে তিনি ছিলেন ঈর্ষণীয় সাফল্যের অধিকারিণী৷ এক্ষেত্রে একটা কথা মনে রাখা দরকার, আজ থেকে প্রায় ৯০ বছর আগে যখন সিনেমার দর্শক অল্পসংখ্যক, তখন চলচ্চিত্রবিষয়ক অজস্র পত্র-পত্রিকা, টিভি চ্যানেল এসবও ছিল না শিল্পীদের জনপ্রিয়তা তৈরি করার জন্য। সিনেমা ও সিনেমার অভিনেত্রী নিয়ে তখন সমাজে শুচিবাইয়ের অন্ত ছিল না। সেই যুগে কাননদেবীর ‘ক্রেজ’ আজকের দিনের পাঠকদের বোঝানো সম্ভব নয়।

১৯৩৫ সালের মে মাসে ‘রাধা ফিল্মস লিমিটেড’ প্রযোজিত ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবিটি রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল। এ ছবিতে নীহারিকার চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন কাননদেবী। তাঁর অভিনয় দেখে ও গান শুনে দর্শকরা পাগলের মতো হয়ে গিয়ে পর্দার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত স্পর্শ পাওয়ার জন্য। রূপবাণীতে টানা ১০ সপ্তাহ হাউসফুল। এরপর পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহেও ছবিটি রমরম করে চলেছিল। ছবির কাহিনি কিছুটা কৌতুক রসাশ্রিত হলেও মূলত নারী জাগরণের কথা বলা হয়েছে। ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ থেকে নায়িকা এবং গায়িকারূপে কাননদেবীর শুধুই এগিয়ে চলা। এখানে আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার। ১৯৪৬ সালে নির্মিত ‘চন্দ্রশেখর’ ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য তিনি পেয়েছিলেন এক লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। এ ছবির নায়ক ছিলেন অশোককুমার। তিনের দশকের শেষভাগ থেকে চারের দশক পর্যন্ত বাংলা ছবি তো বটেই, ভারতীয় ছবিতেও কাননদেবী ছিলেন গ্ল্যামার-কুইন৷ যুবকদের হার্টথ্রব। চারের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বম্বের বিশিষ্ট প্রযোজক চন্দুলাল শাহ তাঁকে মাস মাইনে দিতে চেয়েছিলেন ৫ লক্ষ টাকা। কাননদেবী তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমি কলকাতা ছেড়ে বম্বে যাব না৷ যাঁরা আমাকে কাননদেবী বানিয়েছেন তাঁদের প্রতি আমার তো একটা কর্তব্য আছে৷ আপনি যদি কলকাতায়
এসে ছবি করতে পারেন তাহলেই আপনার প্রস্তাবের কথা ভেবে দেখব৷’

এই জনপ্রিয় নায়িকাকে এক পলক দেখার জন্য তাঁর বাড়ির সামনে কাতারে কাতারে লোক দাঁড়িয়ে থেকেছেন। এমন ঘটনাও নাকি ঘটেছে তাঁর জন্য আত্মঘাতীও হয়েছেন দু’একজন ফ্যান। তবে কাননদেবীর চলার পথ যে সবসময় কুসুমাস্তীর্ণ ছিল এমন নয়। রূপ, ব্যক্তিত্ব আর গুণের এমন ত্রিবেণী সঙ্গম কজন ভারতীয় অভিনেত্রীর মধ্যে দেখা গিয়েছে, তা আমার চট করে মনে পড়ে না।

দিদির আশ্চর্য জীবন চার পর্যায়ে বিভক্ত। অভিনয় জীবন, সংগীত জীবন, প্রযোজিকার জীবন এবং সমাজসেবিকার জীবন। প্রতিটি পর্যায়েই সাফল্যের ধারাবাহিকতা অটুট ছিল৷ এসব নিয়ে আলোকপাত করার আগে কাননদেবীর ছোটবেলার কথায় একটু ফিরে যাই। দিদি একবার গল্প করতে করতে আমাকে বলেছিলেন, ‘ছোটবেলায় অভাব-অনটন ছিল আমার আর মায়ের নিত্যসঙ্গী। এমনও হয়েছে অনেক দিনই একবেলা খেয়েছি। রাতে কী খাব জানি না। মা আর আমার গায়ে জীর্ণ বস্ত্র। সে যে কী ভয়ানক দিন গিয়েছে আমাদের! এখনও ভাবলে শিউরে উঠি। কিন্তু আমি ভেঙে পড়িনি। হয়তো সেই অল্প বয়সে এত আঘাত পাওয়ার দরুন ভেতরে ভেতরে শক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। —চলবে

Skip to content