একদিন বিকেলের দিকে কাননদেবীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। ততদিনে দিদির স্নেহ-মমতা আমার ওপর বর্ষিত হয়েছিল অকৃপণভাবে। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছিল। সেদিন কথায় কথায় দিদিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনার সঙ্গে তো বহু বিশিষ্ট মানুষের আলাপ-পরিচয় হয়েছে, তাঁদের কথা যদি একটু বলেন।’
আমার মুখের কথা শেষ হয়নি। আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে দিদির মুখ। বললেন, ‘একবার হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানিতে গিয়েছিলাম গান রেকর্ডিং-এর জন্য। কবিগুরুকে সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল৷ প্রশান্ত মহলানবিশের (ভুলুদা) ভাই আমাকে বললেন, গুরুদেব এখানেই আছেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। রবীন্দ্রনাথের কথা শুনে বুঝতেই পারছ আমার মনের কী অবস্থা তখন! গলা শুকিয়ে এসেছিল। ক্ষণজন্মা পুরুষ। তাঁর সঙ্গে কথা বলব কেমন করে? আর কী কথাই বা বলব? কবিগুরুর দিকে পায়ে পায়ে এগোলাম। এত সুপুরুষ! যেন দাঁড়িয়ে আছেন একজন দেবদূত। জ্যোতি বেরোচ্ছে তাঁর শরীর থেকে। প্রণাম করলাম। আমার চিবুক ধরে মুখ তুলে অপূর্ব স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন, কী মিষ্টি মুখখানি গো তোমার! তুমি গান গাইতে পারো? ওখানেই কেউ একজন বলে উঠলেন, গুরুদেব, আপনার দু-একটি গান গেয়েই ও চারদিকে আলোড়ন তুলেছে। উনি হেসে বললেন, তাই নাকি? তারপর ভুলুদার ভাইকে বললেন, একে একবার শান্তিনিকেতনে নিয়ে যেও। খুব ভালো করে ভাব করে নেব তখন। সেই মুহূর্তে এক জ্যোতির্ময় মহাপুরুষের সস্নেহ চাউনির অমৃত-পরশ পেয়েছিলাম।’
সোদপুরের এক প্রার্থনাসভায় জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে দেখেছিলেন কাননদেবী। এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তাঁকে প্রণাম করতেই দুটো হাত আমার মাথার ওপর চেপে ধরলেন। আশীর্বাদ করলেন প্রাণভরে। মহাত্মার মুখে অপার্থিব হাসি। তাঁর প্রার্থনা সংগীত ‘সবকো সৎমতি দে ভগবান’-এর কথা ও সুর এক মন্ত্রের মতো আমাকেও ছুঁয়ে গেল।’
নিউ থিয়েটার্সে যোগদানের পর কাননদেবীর অভিনয় ও সংগীতপ্রতিভার উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটে। তাঁর নাম-যশ আরও ছড়িয়ে পড়ে। ‘মুক্তি’ ছবিতে কাজ করার সূত্রেই পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে পরিচয় কাননদেবীর। তাঁকে দিয়ে এ ছবিতে একটি রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ালেন পঙ্কজ মল্লিক। ‘আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে।’ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ গানটি শুনে খুশি হন। এই গান তখন সকলের মুখে মুখে ফিরত। ‘মুক্তি’ নিউ থিয়েটার্সের বাংলা-হিন্দি ডাবল ভার্সান ছবি। কাননদেবীর বিপরীতে ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। ‘মুক্তি’ সুপারহিট হয়েছিল। তিনের দশকে দেশের সামাজিক পরিবেশের তুলনায় এ ছবির কাহিনি ছিল যথেষ্ট আধুনিক। প্রমথেশ বড়ুয়া ও কাননদেবী দুজনের অভিনয়ই উচ্চ প্রশংসিত হয়।
রাইচাঁদ বড়ালের সুরে ‘সাথী’ ছবিতে কাননদেবীর গাওয়া ‘ঘর যে আমায় ডাক দিয়েছে হারিয়ে যাওয়া নাম ধরে’ দারুণ জনপ্রিয় হয়৷ এই ছবিরই বাবুল মোরা…’র ক্ষেত্রে একই কথা৷ ‘বিদ্যাপতি’ ছবিতে ‘অঙ্গনে আওয়ব যব রসিয়া’ প্রাণ ঢেলে গেয়েছিলেন কাননদেবী৷ কাজী নজরুলের সুরে ‘সাপুড়ে’ ছবির এই গানটার কথাও ভোলা যায় না— ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’ তুমুল সাড়া ফেলেছিল৷ দিদি আমাকে বলেছিলেন, ‘ফিল্মের গানের কথা যদি বলো সাথী আমার কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা৷’
‘সাথী’র নায়ক-নায়িকা কুন্দনলাল সায়গল এবং কাননদেবী৷ তাঁদের চরিত্র দুটোর নাম ভুলুয়া ও মঞ্জু৷ পরিচালনায় ফণী মজুমদার৷ এ ছবিরই হিন্দি ভার্সন ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’৷ রাইচাঁদ বড়াল একবার এক বন্ধুস্থানীয় সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘গানের কথা যদি বলো কাননের ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা৷’ তখনকার দিনে শ্যুটিংয়ের সময় গানের টেক করা হত৷ ‘সাথী’ ছবিতে কাননদেবী এবং সায়গল রাস্তা দিয়ে গান গাইতে গাইতে শ্যুটিং করছেন৷ বাদ্যযন্ত্রীরা ক্যামেরা রেঞ্জ-এর বাইরে৷ নানা ধরনের বাজনা বাজাতে বাজাতে ওঁদের পিছনে আসছেন৷ তার মধ্যে সায়গলের দুচারবার তালভঙ্গ হয়ে সুর কেটে গিয়েছে৷ কিন্তু কাননদেবীর গান একবারের জন্যও এদিক-ওদিক হয়নি৷ এতটাই পারফেকশন ছিল তাঁর৷
পঙ্কজ মল্লিক বলেছিলেন, ‘কানন হল জাত গায়িকা৷ অসাধারণ কণ্ঠমাধুর্য ওর৷ এত নামডাক কাননের, অথচ যখনই ওকে গান তোলাতে বসেছি, দেখে মনে হত যেন সদ্য গান শিখতে এসেছে৷ ওর বিনয়ই ওকে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে৷ প্রখ্যাত সুরকার কমল দাশগুপ্তও অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখতেন কাননদেবীকে৷ তাঁর সুরে কাননদেবীর গাওয়া ‘শেষ উত্তর’ ছবির ‘তুফান মেল যায়’, ‘আমি বনফুল গো’ কিংবা ‘যোগাযোগ’ ছবির ‘যদি ভালো না লাগে তো দিও না মন’ প্রভৃতি গান যে কতটা জনপ্রিয় হয়েছিল আজকের প্রজন্ম তা কল্পনাও করতে পারবে না৷ কমলবাবুর সুরারোপিত ‘চন্দ্রশেখর’ ছবিতে অশোককুমার এবং কাননদেবীর ডুয়েট ‘অনাদিকালের স্রোতে ভাসা মোরা দুটি প্রাণ’ দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল৷ ছবিও সুপারহিট৷ চারের দশকের ওই ছবিতে অভিনয়ের জন্য কাননদেবী এক লক্ষ টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন৷ সে যুগে ওই অঙ্কের টাকা বম্বের নামীদামি নায়ক-নায়িকারাও পেতেন না৷ দিদির গানের কদর শুধু বঙ্গদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল৷
এমন প্রশ্ন প্রায়শই উঠত, কাননদেবী নায়িকা না গায়িকা কোন হিসেবে বড়? এ প্রশ্নের মীমাংসা কোনওদিনই হয়নি৷ কেউই এর যথাযোগ্য উত্তর দিতে পারেনি৷ ‘মুক্তি’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘সাথী’ সহ বিভিন্ন ছবিতে তাঁর গান শ্রোতাদের যখন উদ্বেল করে তুলত তখন মনে হত গায়িকা হিসেবে তিনি বড়৷ আবার নিউ থিয়েটার্স-এর ‘পরিচয়’ কিংবা এম পি প্রোডাকশনের ‘শেষ উত্তর’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর বি এফ জে এ পুরস্কার পেলেন তখন মনে হত তিনি অভিনেত্রী হিসেবেই বড়। বি এফ জে এ পুরস্কারের মর্যাদাই তখন আলাদা।
সম্ভবত চারের দশকের মাঝামাঝি ব্যারিস্টার অশোক মৈত্রের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন কাননদেবী৷ কিন্তু সেই বিয়ে পরে ভেঙে যায়৷ ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল ড. কৈলাসনাথ কাটজুর এডিসি হরিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিয়ে হয় কাননদেবীর৷ হরিদাসবাবু অত্যন্ত সুদর্শন, সজ্জন ও স্পষ্টবাদী মানুষ ছিলেন৷ তাঁদের বিয়েও শেষ পর্যন্ত টেকেনি৷ শেষ বয়সে ভবানীপুরের এক বহুতল বাড়ির একটা অপরিসর ঘরে একা থাকতেন হরিদাসবাবু৷ নিজের হাতে রান্নাবান্না করে খেতেন৷ অবশ্য তাঁদের এই ছাড়াছাড়ির ব্যাপারে কাননদেবীকে কখনও কিছু জিজ্ঞাসা করিনি৷ তিনি বিব্রতবোধ করতে পারেন একথা ভেবে৷ যতটুকু জানি কাননদেবীর সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরেই রিজেন্ট গ্রোভের বাড়ি ছেড়ে চলে যান হরিদাস ভট্টাচার্য৷ পালিত পুত্র সিদ্ধার্থ ও পুত্রবধূ রুবির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন কাননদিদি।
ছবি প্রযোজনা করার ব্যাপারে বরাবরই ঝোঁক ছিল দিদির। এক শুভদিন দেখে প্রযোজনা সংস্থা খুলে ফেললেন৷ নাম ‘শ্রীমতী পিকচার্স’। এই ব্যানারের প্রথম ছবি ‘অনন্যা’ মুক্তি পেল ১৯৪৯ সালের মার্চে। কাননদেবীই ছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে। শ্রীমতী পিকচার্সের যে ছবিগুলোতে কাননদেবী অভিনয় করেন সেগুলি হল ‘মেজদিদি’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘নববিধান’, ‘দেবত্র’, ‘আশা’, ‘অন্নদাদিদি, শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ’ প্রভৃতি। অন্নদাদিদির ভূমিকায় অভিনয়ের পর ছায়াছবিতে আর দেখা যায়নি তাঁকে। শ্রীমতী পিকচার্সের বাকি ছবিগুলো এরকম: ‘বামুনের মেয়ে’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’, ‘আঁধারে আলো’ ইত্যাদি। শেষোক্ত ছবিটি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করে। কার্লোভিভ্যারি চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়। ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’-র নায়ক-নায়িকা উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন৷ মহানায়ক ও মহানায়িকা দুজনেরই অত্যন্ত শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন কাননদেবী৷ প্রথমদিকে দু-তিনটে ছবি ছাড়া পরবর্তীকালে শ্রীমতী পিকচার্সের সব ছবি হরিদাস ভট্টাচার্য পরিচালনা করেন। একবার সামনে বসে দিদির গান শুনেছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। ওই বয়সেও কী মিষ্টি গলা! একটা ভজন গেয়েছিলেন। আরেকদিন শুনেছিলাম রবীন্দ্রসংগীত। ছবির গান গাইতে চাননি। স্মিত হেসে শুধু বলেছিলেন, ‘আজকাল আর সিনেমা বা আমার গান নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছে করে না। দুবেলা আমার গোপালের সেবা করতে পারছি সেটাই আমার কাছে যথেষ্ট। বাকি সময়টা যেন ফুল তুলে মালা গেঁথে গোপালকে সাজাতে পারি।’
অভিনয় থেকে অবসর নিলেও কাননদেবী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেননি। ইন্ডাস্ট্রির নানা প্রয়োজনে সকলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। মূলত তাঁরই উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ‘মহিলা শিল্পীমহল’। একবার কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ‘প্রাইম মিনিস্টার্স রিলিফ ফান্ড’-এর জন্য টাকা তুলতে একটা প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয়। দুটো দল করে খেলা হয়। উদয়শঙ্কর, সত্যজিৎ রায়, কাননদেবী, অরুন্ধতীদেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, ক্রিকেটার মুস্তাক আলী—কে ছিলেন না ওই ম্যাচে! কাননদেবী তাঁর শাড়ির আঁচলের খানিকটা একটু ঝোলার মতো করে গোটা স্টেডিয়াম ঘুরে ঘুরে টাকা তুলেছিলেন। নানান সমাজসেবামূলক কাজে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।
১৯৬৮ সালে ভারত সরকার কাননদেবীকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে৷ ১৯৭৬ সালে পান চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে বড় সম্মান ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’। কোনও অপূর্ণ ইচ্ছে বা ক্ষোভ ছিল তাঁর? মৃদু হেসে প্রশ্ন এড়িয়ে যান দিদি। অস্ফুটে বলেছিলেন, ‘যা পেয়েছি যথেষ্ট।’
১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই৷ শুক্রবার রাত ১০টা বেজে ১৫ মিনিট। বেলভিউ নার্সিংহোমে ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি কাননদেবী ৭৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেই সময় তাঁর শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত ছিলেন পুত্র ও পুত্রবধূ। পরদিন বিকেলে নিতান্ত সাধারণভাবে কাননদেবীর শেষ যাত্রা শুরু হয় তাঁর সূর্যনগর রিজেন্ট গ্রোভের বাড়ি থেকে। তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ওই শেষ যাত্রায় আমিও সারাটা পথ দিদির সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, চলচ্চিত্র জগতের বিশেষ কাউকে দেখিনি এই যাত্রাপথে।
শনিবার রাত ঠিক ৭.৫৫ মিনিট। কেওড়াতলা মহাশ্মশানের কাঠের চুল্লিতেই মায়ের মুখাগ্নি করেন সিদ্ধার্থ। অসংখ্য অনুরাগীকে শোকসাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন এক বরণীয় ব্যক্তিত্ব। পঞ্চভূতে মিশে গেল দিদির নশ্বর দেহখানি। রেখে গেলেন তাঁর অমর কীর্তি।
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
আমার মুখের কথা শেষ হয়নি। আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে দিদির মুখ। বললেন, ‘একবার হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানিতে গিয়েছিলাম গান রেকর্ডিং-এর জন্য। কবিগুরুকে সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল৷ প্রশান্ত মহলানবিশের (ভুলুদা) ভাই আমাকে বললেন, গুরুদেব এখানেই আছেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। রবীন্দ্রনাথের কথা শুনে বুঝতেই পারছ আমার মনের কী অবস্থা তখন! গলা শুকিয়ে এসেছিল। ক্ষণজন্মা পুরুষ। তাঁর সঙ্গে কথা বলব কেমন করে? আর কী কথাই বা বলব? কবিগুরুর দিকে পায়ে পায়ে এগোলাম। এত সুপুরুষ! যেন দাঁড়িয়ে আছেন একজন দেবদূত। জ্যোতি বেরোচ্ছে তাঁর শরীর থেকে। প্রণাম করলাম। আমার চিবুক ধরে মুখ তুলে অপূর্ব স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন, কী মিষ্টি মুখখানি গো তোমার! তুমি গান গাইতে পারো? ওখানেই কেউ একজন বলে উঠলেন, গুরুদেব, আপনার দু-একটি গান গেয়েই ও চারদিকে আলোড়ন তুলেছে। উনি হেসে বললেন, তাই নাকি? তারপর ভুলুদার ভাইকে বললেন, একে একবার শান্তিনিকেতনে নিয়ে যেও। খুব ভালো করে ভাব করে নেব তখন। সেই মুহূর্তে এক জ্যোতির্ময় মহাপুরুষের সস্নেহ চাউনির অমৃত-পরশ পেয়েছিলাম।’
সোদপুরের এক প্রার্থনাসভায় জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে দেখেছিলেন কাননদেবী। এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তাঁকে প্রণাম করতেই দুটো হাত আমার মাথার ওপর চেপে ধরলেন। আশীর্বাদ করলেন প্রাণভরে। মহাত্মার মুখে অপার্থিব হাসি। তাঁর প্রার্থনা সংগীত ‘সবকো সৎমতি দে ভগবান’-এর কথা ও সুর এক মন্ত্রের মতো আমাকেও ছুঁয়ে গেল।’
নিউ থিয়েটার্সে যোগদানের পর কাননদেবীর অভিনয় ও সংগীতপ্রতিভার উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটে। তাঁর নাম-যশ আরও ছড়িয়ে পড়ে। ‘মুক্তি’ ছবিতে কাজ করার সূত্রেই পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে পরিচয় কাননদেবীর। তাঁকে দিয়ে এ ছবিতে একটি রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ালেন পঙ্কজ মল্লিক। ‘আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে।’ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ গানটি শুনে খুশি হন। এই গান তখন সকলের মুখে মুখে ফিরত। ‘মুক্তি’ নিউ থিয়েটার্সের বাংলা-হিন্দি ডাবল ভার্সান ছবি। কাননদেবীর বিপরীতে ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। ‘মুক্তি’ সুপারহিট হয়েছিল। তিনের দশকে দেশের সামাজিক পরিবেশের তুলনায় এ ছবির কাহিনি ছিল যথেষ্ট আধুনিক। প্রমথেশ বড়ুয়া ও কাননদেবী দুজনের অভিনয়ই উচ্চ প্রশংসিত হয়।
রাইচাঁদ বড়ালের সুরে ‘সাথী’ ছবিতে কাননদেবীর গাওয়া ‘ঘর যে আমায় ডাক দিয়েছে হারিয়ে যাওয়া নাম ধরে’ দারুণ জনপ্রিয় হয়৷ এই ছবিরই বাবুল মোরা…’র ক্ষেত্রে একই কথা৷ ‘বিদ্যাপতি’ ছবিতে ‘অঙ্গনে আওয়ব যব রসিয়া’ প্রাণ ঢেলে গেয়েছিলেন কাননদেবী৷ কাজী নজরুলের সুরে ‘সাপুড়ে’ ছবির এই গানটার কথাও ভোলা যায় না— ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’ তুমুল সাড়া ফেলেছিল৷ দিদি আমাকে বলেছিলেন, ‘ফিল্মের গানের কথা যদি বলো সাথী আমার কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা৷’
‘সাথী’র নায়ক-নায়িকা কুন্দনলাল সায়গল এবং কাননদেবী৷ তাঁদের চরিত্র দুটোর নাম ভুলুয়া ও মঞ্জু৷ পরিচালনায় ফণী মজুমদার৷ এ ছবিরই হিন্দি ভার্সন ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’৷ রাইচাঁদ বড়াল একবার এক বন্ধুস্থানীয় সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘গানের কথা যদি বলো কাননের ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা৷’ তখনকার দিনে শ্যুটিংয়ের সময় গানের টেক করা হত৷ ‘সাথী’ ছবিতে কাননদেবী এবং সায়গল রাস্তা দিয়ে গান গাইতে গাইতে শ্যুটিং করছেন৷ বাদ্যযন্ত্রীরা ক্যামেরা রেঞ্জ-এর বাইরে৷ নানা ধরনের বাজনা বাজাতে বাজাতে ওঁদের পিছনে আসছেন৷ তার মধ্যে সায়গলের দুচারবার তালভঙ্গ হয়ে সুর কেটে গিয়েছে৷ কিন্তু কাননদেবীর গান একবারের জন্যও এদিক-ওদিক হয়নি৷ এতটাই পারফেকশন ছিল তাঁর৷
পঙ্কজ মল্লিক বলেছিলেন, ‘কানন হল জাত গায়িকা৷ অসাধারণ কণ্ঠমাধুর্য ওর৷ এত নামডাক কাননের, অথচ যখনই ওকে গান তোলাতে বসেছি, দেখে মনে হত যেন সদ্য গান শিখতে এসেছে৷ ওর বিনয়ই ওকে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে৷ প্রখ্যাত সুরকার কমল দাশগুপ্তও অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখতেন কাননদেবীকে৷ তাঁর সুরে কাননদেবীর গাওয়া ‘শেষ উত্তর’ ছবির ‘তুফান মেল যায়’, ‘আমি বনফুল গো’ কিংবা ‘যোগাযোগ’ ছবির ‘যদি ভালো না লাগে তো দিও না মন’ প্রভৃতি গান যে কতটা জনপ্রিয় হয়েছিল আজকের প্রজন্ম তা কল্পনাও করতে পারবে না৷ কমলবাবুর সুরারোপিত ‘চন্দ্রশেখর’ ছবিতে অশোককুমার এবং কাননদেবীর ডুয়েট ‘অনাদিকালের স্রোতে ভাসা মোরা দুটি প্রাণ’ দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল৷ ছবিও সুপারহিট৷ চারের দশকের ওই ছবিতে অভিনয়ের জন্য কাননদেবী এক লক্ষ টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন৷ সে যুগে ওই অঙ্কের টাকা বম্বের নামীদামি নায়ক-নায়িকারাও পেতেন না৷ দিদির গানের কদর শুধু বঙ্গদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল৷
এমন প্রশ্ন প্রায়শই উঠত, কাননদেবী নায়িকা না গায়িকা কোন হিসেবে বড়? এ প্রশ্নের মীমাংসা কোনওদিনই হয়নি৷ কেউই এর যথাযোগ্য উত্তর দিতে পারেনি৷ ‘মুক্তি’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘সাথী’ সহ বিভিন্ন ছবিতে তাঁর গান শ্রোতাদের যখন উদ্বেল করে তুলত তখন মনে হত গায়িকা হিসেবে তিনি বড়৷ আবার নিউ থিয়েটার্স-এর ‘পরিচয়’ কিংবা এম পি প্রোডাকশনের ‘শেষ উত্তর’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর বি এফ জে এ পুরস্কার পেলেন তখন মনে হত তিনি অভিনেত্রী হিসেবেই বড়। বি এফ জে এ পুরস্কারের মর্যাদাই তখন আলাদা।
সম্ভবত চারের দশকের মাঝামাঝি ব্যারিস্টার অশোক মৈত্রের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন কাননদেবী৷ কিন্তু সেই বিয়ে পরে ভেঙে যায়৷ ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল ড. কৈলাসনাথ কাটজুর এডিসি হরিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিয়ে হয় কাননদেবীর৷ হরিদাসবাবু অত্যন্ত সুদর্শন, সজ্জন ও স্পষ্টবাদী মানুষ ছিলেন৷ তাঁদের বিয়েও শেষ পর্যন্ত টেকেনি৷ শেষ বয়সে ভবানীপুরের এক বহুতল বাড়ির একটা অপরিসর ঘরে একা থাকতেন হরিদাসবাবু৷ নিজের হাতে রান্নাবান্না করে খেতেন৷ অবশ্য তাঁদের এই ছাড়াছাড়ির ব্যাপারে কাননদেবীকে কখনও কিছু জিজ্ঞাসা করিনি৷ তিনি বিব্রতবোধ করতে পারেন একথা ভেবে৷ যতটুকু জানি কাননদেবীর সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরেই রিজেন্ট গ্রোভের বাড়ি ছেড়ে চলে যান হরিদাস ভট্টাচার্য৷ পালিত পুত্র সিদ্ধার্থ ও পুত্রবধূ রুবির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন কাননদিদি।
ছবি প্রযোজনা করার ব্যাপারে বরাবরই ঝোঁক ছিল দিদির। এক শুভদিন দেখে প্রযোজনা সংস্থা খুলে ফেললেন৷ নাম ‘শ্রীমতী পিকচার্স’। এই ব্যানারের প্রথম ছবি ‘অনন্যা’ মুক্তি পেল ১৯৪৯ সালের মার্চে। কাননদেবীই ছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে। শ্রীমতী পিকচার্সের যে ছবিগুলোতে কাননদেবী অভিনয় করেন সেগুলি হল ‘মেজদিদি’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘নববিধান’, ‘দেবত্র’, ‘আশা’, ‘অন্নদাদিদি, শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ’ প্রভৃতি। অন্নদাদিদির ভূমিকায় অভিনয়ের পর ছায়াছবিতে আর দেখা যায়নি তাঁকে। শ্রীমতী পিকচার্সের বাকি ছবিগুলো এরকম: ‘বামুনের মেয়ে’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’, ‘আঁধারে আলো’ ইত্যাদি। শেষোক্ত ছবিটি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করে। কার্লোভিভ্যারি চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়। ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’-র নায়ক-নায়িকা উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন৷ মহানায়ক ও মহানায়িকা দুজনেরই অত্যন্ত শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন কাননদেবী৷ প্রথমদিকে দু-তিনটে ছবি ছাড়া পরবর্তীকালে শ্রীমতী পিকচার্সের সব ছবি হরিদাস ভট্টাচার্য পরিচালনা করেন। একবার সামনে বসে দিদির গান শুনেছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। ওই বয়সেও কী মিষ্টি গলা! একটা ভজন গেয়েছিলেন। আরেকদিন শুনেছিলাম রবীন্দ্রসংগীত। ছবির গান গাইতে চাননি। স্মিত হেসে শুধু বলেছিলেন, ‘আজকাল আর সিনেমা বা আমার গান নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছে করে না। দুবেলা আমার গোপালের সেবা করতে পারছি সেটাই আমার কাছে যথেষ্ট। বাকি সময়টা যেন ফুল তুলে মালা গেঁথে গোপালকে সাজাতে পারি।’
অভিনয় থেকে অবসর নিলেও কাননদেবী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেননি। ইন্ডাস্ট্রির নানা প্রয়োজনে সকলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। মূলত তাঁরই উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ‘মহিলা শিল্পীমহল’। একবার কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ‘প্রাইম মিনিস্টার্স রিলিফ ফান্ড’-এর জন্য টাকা তুলতে একটা প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয়। দুটো দল করে খেলা হয়। উদয়শঙ্কর, সত্যজিৎ রায়, কাননদেবী, অরুন্ধতীদেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, ক্রিকেটার মুস্তাক আলী—কে ছিলেন না ওই ম্যাচে! কাননদেবী তাঁর শাড়ির আঁচলের খানিকটা একটু ঝোলার মতো করে গোটা স্টেডিয়াম ঘুরে ঘুরে টাকা তুলেছিলেন। নানান সমাজসেবামূলক কাজে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।
১৯৬৮ সালে ভারত সরকার কাননদেবীকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে৷ ১৯৭৬ সালে পান চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে বড় সম্মান ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’। কোনও অপূর্ণ ইচ্ছে বা ক্ষোভ ছিল তাঁর? মৃদু হেসে প্রশ্ন এড়িয়ে যান দিদি। অস্ফুটে বলেছিলেন, ‘যা পেয়েছি যথেষ্ট।’
১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই৷ শুক্রবার রাত ১০টা বেজে ১৫ মিনিট। বেলভিউ নার্সিংহোমে ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি কাননদেবী ৭৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেই সময় তাঁর শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত ছিলেন পুত্র ও পুত্রবধূ। পরদিন বিকেলে নিতান্ত সাধারণভাবে কাননদেবীর শেষ যাত্রা শুরু হয় তাঁর সূর্যনগর রিজেন্ট গ্রোভের বাড়ি থেকে। তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ওই শেষ যাত্রায় আমিও সারাটা পথ দিদির সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, চলচ্চিত্র জগতের বিশেষ কাউকে দেখিনি এই যাত্রাপথে।
শনিবার রাত ঠিক ৭.৫৫ মিনিট। কেওড়াতলা মহাশ্মশানের কাঠের চুল্লিতেই মায়ের মুখাগ্নি করেন সিদ্ধার্থ। অসংখ্য অনুরাগীকে শোকসাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন এক বরণীয় ব্যক্তিত্ব। পঞ্চভূতে মিশে গেল দিদির নশ্বর দেহখানি। রেখে গেলেন তাঁর অমর কীর্তি।
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।