ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের নিয়ে কথা বলছি কয়েকদিন ধরে। আজ বলব এমন এক মেয়ের কথা যিনি শুধু বিদুষী নন, স্পষ্টবক্তাও ছিলেন। রবি ঠাকুরের ভাগ্নি সরলাদেবীর কথা। সেই সময়কার ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের বিয়ে করে অনেক ব্রাহ্মণ যুবকদের ত্যাজ্যপুত্র হতে হয়েছিল।

ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের নিয়ে কথা বলছি কয়েকদিন ধরে। আজ বলব এমন এক মেয়ের কথা যিনি শুধু বিদুষী নন, স্পষ্টবক্তাও ছিলেন। রবি ঠাকুরের ভাগ্নি সরলাদেবীর কথা। সেই সময়কার ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের বিয়ে করে অনেক ব্রাহ্মণ যুবকদের ত্যাজ্যপুত্র হতে হয়েছিল।
একটি মেয়ের গল্প না বললে সরস্বতীর লীলাকমল বিভাগটি অসম্পূর্ণ। আসলে প্রতিমাদেবী ছিলেন আদতেই রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী। বিশ শতকের মেয়েদের আধুনিক করতে তাঁর অবদান ছিল অসীম। লেখালিখির চেয়ে অনেক বেশি কর্মমুখর ছিল তাঁর জীবন। তবু তাঁর লেখনিও বিশ শতকের সম্বল। প্রতিমা নামের মেয়েটির তখন এগারো বছর বয়স।
কেমন লাগছে বলুন তো সরস্বতীর লীলাকমল? উনিশ বিশ শতকের পর্দানশীন মেয়েদের লেখক হওয়ার গল্প তো চলছে। আজ বলি ভারতীয় স্বামীকে বিয়ে করে আসা বিদেশিনী এক বধূর কলমের কথা। তাঁর চোখ দিয়ে ভারতবর্ষকে দেখার সুযোগ নেহাত কম কথা নয়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রতিটি সদস্যই প্রতিভার হিরকদ্যুতি। দেশে বিদেশে তাঁরা স্বমহিমায় আকৃষ্ট করতেন সকলকে।
অল্পবয়সী সংজ্ঞাকে লেখাপড়া শেখাতে লরেটো থেকে বিদেশি শিক্ষয়িত্রী। সুরেন্দ্রনাথ নিজেও পড়াতেন সংজ্ঞাকে। সুরেন্দ্রনাথ ইংরেজি বই খুলে একটুও না থেমে গল্প বলে যেতেন বাংলায়। একবার শিলাইদহে জমিদারি পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি ইংরেজি ভাষায় একটি গল্প পড়েছিলেন।
উনিশ বিশ শতক বেশ দুমুখো। একদিকে মেয়েরা পর্দার আড়ালটিকেই নিজেদের জীবন মনে করে মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার দোলাচলে কাটিয়ে দিত গোটা জীবন। অন্যদিকে আরেক দল মেয়ে ঠিক যেন রক্তকরবীর নন্দিনী। প্রশ্ন আর যুক্তির শানিত দীপ্তি মেয়েদের জীবনকে ঠেলে নিয়ে চলেছিল আলোর পথে।
সে এক সময়। নারীবাহিনী দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলেছে। সাহিত্যে নারীরাও পিছিয়ে নেই। পুরুষ গোয়েন্দা চরিত্রদের পাশাপাশি বেশ সন্তর্পণে বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে মুখ আর মন নিয়ে হাজির হলেন মহিলা গোয়েন্দা চরিত্ররা। বাংলা সাহিত্যে প্রথম গোয়েন্দা চরিত্র হল কৃষ্ণা।
সরস্বতীর লীলাকমল বিভাগে আজ লিখছি পুণ্যলতা রাওকে নিয়ে। সুখলতা রাও-য়ের বোন। তিনিও ছোটদের নিয়ে কাজ করেছেন, সুখলতা রাও-এর মতোই। কিন্তু সেইভাবে তাঁর চর্চা হয়নি। পূণ্যলতা জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯০ সালে।
সরস্বতীর লীলাকমল বিভাগে লেখা চলছে, উনিশ শতকের মেয়েদের বিদ্যাচর্চার প্রসঙ্গ আসবে, অথচ জ্ঞানদানন্দিনীর প্রসঙ্গ আসবে না— এ হতে পারে না। উনিশ শতকের আধুনিক মনের মহিলাদের অগ্রদূত ছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী।
কথা চলছে মহিলা সাহিত্যিকদের নিয়ে। আজ বলছি নারী সম্পাদিত প্রথম সাময়িক পত্রিকার সম্পাদক মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায়ের কথা। নামটি একালে সকলের কাছে সুপরিচিত না হলেও একটা সময় তিনি মহিলা মহলে লেখালিখির ক্ষেত্রে বেশ নামযশ অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ‘বঙ্গমহিলা’ পত্রিকার প্রথম মহিলা সম্পাদক।
জীবনানন্দ, অশোকানন্দ — দুই ছেলের স্মৃতিচারণেই কুসুমকুমারী এক আলোর দীপশিখার মতো। সারাদিন গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত থেকেও কীভাবে যশস্বী কবি হয়ে উঠলেন তাঁদের মা, সন্তানদের কাছে এ ছিল এক বিস্ময়।
একটা মজা ছিল। উনিশ শতকে মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয় থেকে পড়ুয়া মেয়েদের গতিবিধি সব নিয়ন্ত্রণ করতেন পুরুষরা। এও পুরুষতন্ত্রের এক আশ্চর্য প্রকাশ। কেউ কেউ আবার স্ত্রী স্বাধীনতাকে নিজের মতো সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করতেন। যেমন ‘পরিচারিকা’ পত্রিকার কার্তিক ১২৮৭ বঙ্গাব্দে কোনও এক পুরুষ লেখক স্ত্রী স্বাধীনতার এক অভিনব ব্যাখ্যা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ অপরাজিতা দেবী ছদ্মনামে লেখা রাধারাণীর লেখা পড়ে ভেবেছিলেন পুরুষ সাহিত্যিকের লেখা। শরৎচন্দ্রের খুব স্নেহধন্যা ছিলেন এই মহিলা সাহিত্যিক। নবনীতার নাম শরৎচন্দ্র রেখেছিলেন অনুরাধা। রাধারাণী মেয়েকে মনের মতো করে মানুষ করেছিলেন তিনি।
আজ বলব সেই সময়ের এক বহুভাষাবিদ মহিলা কবি তরু দত্তের কথা। কথার টানে আসবে তাঁর মা ক্ষেত্রমোহিনী দেবী আর বোন অরু দত্তের কথা। তাঁরাও ছিলেন বিদুষী নারী। তবে কবি হিসেবে তরু দত্ত একটু বেশিই খ্যাতি পেয়েছিলেন। লিখেছেন ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক ও লেখক।
একটি বাচ্চা মেয়ে অকারণ রেগে উঠত। নিজের বয়সীদের সঙ্গে মিশতে পারতো না। উৎকন্ঠিত মা নিয়ে এসেছিলেন। বাচ্চাটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশে জানা গেল বাবা মায়ের নিত্য ঝগড়া ঝাটির জন্য তার সমস্যা। ‘অঞ্জলি’র কর্মী এই মেয়েটি তখন বাবা-মা কে নিয়ে একসঙ্গে বসে তাদের বোঝালেন।
সরলার সাহিত্যের রুচিও তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। থিয়োসফি চর্চায় খুব উৎসাহ ছিল সরলার। অতিলৌকিক সব কিছুই বারবার আকৃষ্ট করেছে সরলাকে। সেই কারণেই ব্রাহ্মদের মতো সম্পূর্ণ নিরাকারবাদী হতে পারেননি তিনি। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীতগুলি কেবলমাত্র নিরাকার ব্রহ্মকে ভেবেই লেখা কিনা, এই বিষয়েও প্রশ্ন করেছিলেন তিনি।