সেকালের এক বিধবা মহিলার পক্ষে একাধারে বিদেশিনী ও খ্রিস্টান মেয়েকে স্বীকার করা এক কথায় কল্পনাতীত ছিল। তাই স্বামিজির মনে প্রচ্ছন্ন কৌতুহল ছিল, শ্রীমা তাঁকে কীভাবে নেন দেখার।

সেকালের এক বিধবা মহিলার পক্ষে একাধারে বিদেশিনী ও খ্রিস্টান মেয়েকে স্বীকার করা এক কথায় কল্পনাতীত ছিল। তাই স্বামিজির মনে প্রচ্ছন্ন কৌতুহল ছিল, শ্রীমা তাঁকে কীভাবে নেন দেখার।
শ্রীমা বলেছেন, ‘আমার চিরকালই গঙ্গাবাই’। তাই গঙ্গাতীরে তাঁর জন্য নতুন বাড়ি ‘উদ্বোধন’ তৈরি হয়। ঠাকুরের তিরোভাবের পর তাঁর সন্ন্যাসী সন্তানেরা যখন অসহায় ও দিশাহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তখন শ্রীমাই ঠাকুরের সন্ন্যাসী ও গৃহী ভক্তদের সঙ্ঘবদ্ধ করে রক্ষা করেছেন।
কৃষ্ণভামিনী দেবীর সনির্বন্ধ অনুরোধে শ্রীমাও তাঁর সঙ্গে কৈলোয়ারে যান। তাঁদের সঙ্গে গিয়েছিলেন কৃষ্ণভামিনী দেবীর মা, গোলাপমা, স্বামী যোগানন্দ, সারদানন্দ, ত্রিগুণাতীতানন্দ, যোগীন মহারাজের বাবা নবীনচন্দ্র চৌধুরী প্রমুখ।
যখন মা সারদা নীলাম্বরবাবুর বাড়িতে ছিলেন, তখন তাঁর এক অভিনব দর্শন হয়। তিনি দেখেন যে, ঠাকুর গঙ্গায় নামলেন, নামামাত্র তাঁর দেহ গঙ্গার জলে মিলিয়ে গেল।
ছেলেকে কোলে নিয়ে চোখের জলে কাঁপতে কাঁপতে গিরীশ ওপরে এসে শ্রীমাকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেন ও বলেন, ‘মা, এই ছেলে হতেই তোমার শ্রীচরণ দর্শন হল আমার’।
পুরীর পাণ্ডা গোবিন্দ শিঙ্গারী শ্রীমাকে শিবিকায় করে জগন্নাথমন্দিরে নিয়ে যেতে চাইলে মা সারদা বলেছিলেন, ‘না গোবিন্দ, তুমি আগে আগে পথ দেখিয়ে চলবে, আমি তোমার পেছনে পেছনে দীনহীন কাঙালিনীর মতো যাব’।
বৃন্দাবনে থাকার সময় মা সারদা এই খবর শুনে বলেন যে, ঠাকুরই যখন চলে গেলেন, তিনি টাকা নিয়ে কী করবেন। কামারপুকুরে মা সারদাকে রেখে স্বামী যোগানন্দ কলকাতায় গুরুভাইদের কাছে ফিরে আসেন। মা সারদার নিঃসঙ্গ জীবনের যাত্রা শুরু হল।
১৭ পৌষ, (৩ জানুয়ারি) পরমারাধ্যা সারদা মায়ের পূত জন্মতিথি। আমার আজকের লেখাটি শ্রীমায়ের পাদপদ্মে অর্পণ করলাম। বৃন্দাবনে যাওয়ার আগে মা সারদা ও তাঁর সাথীরা বৈদ্যনাথধাম দর্শন করেন।
বৃন্দাবনে সারদা অলৌকিকভাবে আবার ঠাকুরের দর্শন পান। ঠাকুরের হাতে যে ইষ্টকবচ ছিল, তা অসুস্থতার সময় শ্রীমাকে দিয়েছিলেন। সারদা তা সযত্নে নিজহাতে ধারণ করে পুজো করতেন।
অসুস্থতা নিয়েও সকলের সঙ্গে রসে-বশে ঠাকুর ভালোবোধ করতে লাগলেন। সারদা মা তাঁকে কাছে থেকে সেবা করে সবই লক্ষ্য করেন নীরবে। ডাক্তার মহেন্দ্রলালের চিকিৎসায় রোগ কিছুটা উপশম হলেও তা যে সম্পূর্ণ সারার নয়। সকল ভক্তের সঙ্গে শ্রীমাও তা বুঝতে পারেন।
১২৯১ সালে ঠাকুরের গলরোগ ধরা পড়ে। পাণিহাটির মহোৎসবে যোগদানের পর থেকে সেই রোগ ক্রমে বেড়ে যায়। ওষুধের সবরকম ব্যবস্থা করা হলেও তা বেড়েই চলে। ভাদ্রমাসে একদিন তাঁর গলা থেকে রক্ত বার হলে ভক্তরা চিন্তায় পড়েন।
শ্রীমা রসিকের কথা ঠাকুরকে বলেন, শুনে ঠাকুর হুঁ বলে সম্মতি দেন। তারপর একদিন ভাবের ঘোরে ঠাকুর যখন পঞ্চবটির দিকে যাচ্ছিলেন, রসিক সেখানে ঝাঁট দিচ্ছিল। ঠাকুর তাকে দেখে তার দিকে এগিয়ে যান।
সারদা মা পুজো করছিলেন, মহিলাটি তাঁকে প্রণাম করে সব জানালেন। শ্রীমা ঠাকুরের স্বভাব জানতেন। তিনি বললেন যে ঠাকুরই ঔষধজ্ঞ, তিনি কিছুই জানেন না।
সারদা মা যেন স্বয়ং মালক্ষ্মী। লক্ষ্মী যেমন সদা নারায়ণের পদসেবারতা, শ্রীমাও তেমনি ঠাকুরের বিশ্রামের সময় তাঁর পদসেবা করছেন। কখনও বা রন্ধনকর্মে ব্যস্ত থেকেছেন।
সারদা মায়ের যখন ছ’বছর বয়সে বিয়ে হয়, তখন তাঁর একমাত্র বোন কাদম্বিনী আর এক ভাই প্রসন্নকুমার খুবই ছোট ছিল। বাকি চার ভাই তখনও জন্মায়নি। আজ ভাইফোঁটার পর্বে মা সারদা ও তাঁর ভাইদের কথা শোনা যাক।