কুটিরের মধ্যে ভরত দেখলেন, ঘাসে ঢাকা এক বেদীর উপর জটা-বল্কলধারী রাম, লক্ষ্মণ ও সীতার সঙ্গে বসে আছেন। ‘আর্য’ এই বলে শিশুর মতো উচ্ছ্বাসে আকুল হয়ে রামের পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন ভরত।

কুটিরের মধ্যে ভরত দেখলেন, ঘাসে ঢাকা এক বেদীর উপর জটা-বল্কলধারী রাম, লক্ষ্মণ ও সীতার সঙ্গে বসে আছেন। ‘আর্য’ এই বলে শিশুর মতো উচ্ছ্বাসে আকুল হয়ে রামের পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন ভরত।
মুনিবর তাঁদের পরামর্শ দিলেন, সেখান থেকে দশ ক্রোশ দূরে চিত্রকূট পর্বতের পাদদেশে এক রম্য বনভূমিতে বসবাস করার জন্য। সেই মতো তাঁরা যমুনা নদী অতিক্রম করে পৌঁছলেন চিত্রকূট সংলগ্ন সমতলভূমিতে।
রাজা দশরথের মৃত্যুর পরে অযোধ্যা অরাজক অবস্থায় রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। রাজসিংহাসন শূন্য পড়ে রয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে রাজ্যের।
ভরতের আর্তক্রন্দন পৌঁছল সুমিত্রানন্দন শত্রুঘ্নের কানে। ছুটে এলেন তিনি। এসে শুনলেন সব বৃত্তান্ত। ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল তাঁর মনেও। ঠিক তখনই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল কুব্জা মন্থরা।
দশরথ কিংবা রামের মুখে তাঁর সম্বন্ধে এ সব বিশেষণ শোনা গিয়েছে অনেকবার। কিন্তু মায়ের অপরিণামদর্শিতা, গর্বোন্মাদনা ভরতের অজ্ঞাতসারেই তাঁর জীবনে এঁকে দিয়েছে চিরস্থায়ী অযশের কালিমা।
শয্যায় শায়িত রাজার দেহ আজ যেন নির্বাপিত অগ্নিশিখা, শুকিয়ে যাওয়া গভীর, শূন্য সমুদ্রখাত। অস্তাচলগামী সূর্যের মতোই নিভে গিয়েছে তাঁর শৌর্য, বীর্য, অমিত বিক্রম। কৌশল্যা রাজার চরণে আছড়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন।
নির্বাসনের ষষ্ঠ দিন। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল রাজা দশরথের। রাতের আকাশে বিদ্যুতের ঝলকের মতো জেগে উঠল বহুদিন আগের এক শোকচিত্র।
নিষ্প্রভ রথ অযোধ্যার প্রবেশদুয়ার পার করে ঢুকছে দেখেই ছুটে গেল তার দিকে জনস্রোত। প্রজারা জানতে চায়, রামের খবর— কোথায় আছেন তিনি, কেমন আছেন তাঁরা সকলে।
অযোধ্যার রাজপুত্র, রাজবধূ আজ বিলাসী কোমল সুখশয্যায় নয়, নিদ্রা যাবেন কঠিন ভূমিতলে, পাতার বিছানায়। পান করবেন শুধু জল। লক্ষ্মণ আর সুমন্ত্র তৈরি করে দিলেন পর্ণশয্যা।
সীতা কৌশল্যাকে প্রণাম করে বললেন, “মা, স্ত্রীর ধর্ম, কর্তব্য আমি জানি। আপনি আমাকে সাধারণ নারীর মতো মনে করবেন না। আপনি আপনার পুত্রের মঙ্গল বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন
রামের পাশে অসহায়মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন সীতা। পরনে তাঁর হলুদ রেশমী বসন, হাতে কৈকেয়ীর দেওয়া দুটি চীরবস্ত্র, দুচোখে জল। অযোধ্যার রাজবধূ, জনকনন্দিনী সীতা জানেন না, কিভাবে পরতে হয় এই বল্কলবাস।
জনকনন্দিনী সীতা স্থির করে নিয়েছেন রামের সঙ্গে বনবাসে যাবেন তিনিও। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে রামের সম্মতিও পেয়েছেন। রাজ্যপ্রাসাদের সমস্ত সুখ, সম্পদ, বিলাসিতা ছেড়ে চলে যেতে হবে তাঁদের নির্বান্ধব, ভয়াল অরণ্যে। যাওয়ার আগে রামের নির্দেশে সাধু সজ্জন, আশ্রিত জন, ব্রাহ্মণদের সীতা দান করে দিলেন নিজের বহুমূল্য বসন, ভূষণ। বনবাসে যেতে হবে নিজের যা কিছু সম্পদ, সেসব ত্যাগ করে, দান করে, নিঃস্ব হয়ে। সীতার মনে এর জন্য খেদ নেই। দান শেষে হাসিমুখে, প্রসন্ন অন্তরে তিনি চললেন গুরুজনদের কাছ থেকে বিদায় নিতে। কিন্তু প্রাণের অধিক প্রিয়...
সীতা শুনলেন সব বৃত্তান্ত। কৌশল্যার মতো ভেঙে পড়লেন না। জীবনে যে ঝড় আসতে চলেছে, তাকে শান্ত মনে গ্রহণের চেষ্টা করলেন। দুঃখকে আত্মস্থ করেই যে জীবনের পথ চলা তাঁর।
রাম শান্ত ধীর পায়ে বেরিয়ে এলেন মায়ের ঘর থেকে। তাঁকে এবার বৈদেহীর মুখোমুখি হতে হবে যে। কি হবে তাঁর প্রতিক্রিয়া— এ ভাবনায় অধীর হল রামের মন।
কৈকেয়ীর পাষাণহৃদয় এতেও টলল না। বরং বাক্যবাণের তীব্রতা গেল বেড়ে — “এ কী মহারাজ! আপনি নিজে প্রতিজ্ঞা করে নিজেই অনুতপ্ত? সত্যে অবস্থান করা তো আপনার কর্তব্য! সত্যই তো পরম ধর্ম।