অযোধ্যা ত্যাগ করে আসার সময় রাম ছিলেন পঁচিশ বছরের পূর্ণ যুবা, আর সীতা নিজে ছিলেন অষ্টাদশী। জনকনন্দিনী বৈদেহী যুক্তিক্রম হারিয়ে ভুলে যান, অপরিচিতা নারীর দেহসৌন্দর্যের সকাম স্তুতি পরিব্রাজকের স্বভাব নয়।

অযোধ্যা ত্যাগ করে আসার সময় রাম ছিলেন পঁচিশ বছরের পূর্ণ যুবা, আর সীতা নিজে ছিলেন অষ্টাদশী। জনকনন্দিনী বৈদেহী যুক্তিক্রম হারিয়ে ভুলে যান, অপরিচিতা নারীর দেহসৌন্দর্যের সকাম স্তুতি পরিব্রাজকের স্বভাব নয়।
সোনার হরিণের মোহময় রূপ ভুলিয়েছিল সীতার মন। তার ইচ্ছা পূরণের উদ্দেশ্যে রাম একাই চললেন গভীর বনে। সঙ্গী তাঁর স্বর্ণভূষিত বিপুলকায় শরাসন, ধনু, তীক্ষ্ণ বাণ।
হিতাকাঙ্ক্ষী মারীচের এত কথা কিন্তু রাবণের কর্ণগোচর হল না। তার বহু চেষ্টা বিফলে গেল। সীতাহরণের বিষয়ে রাবণ নিজের সংকল্পে অবিচল থাকলেন। মারীচ নিজের আসন্ন মৃত্যুর চিন্তায় ডুব দিল এবারে।
রাতের অন্ধকারে যজ্ঞবেদীর চারপাশে মারীচ আর অন্যান্য রাক্ষসেরা যখন নিক্ষেপ করছে মাংসের টুকরো, রক্তে ভরে যাচ্ছে যজ্ঞবেদী, রামের হাতে জ্বলে উঠেছে তখন মানবাস্ত্র।
রামের সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত, নিহত হল খর, দূষণ, ত্রিশিরা সহ জনস্থানবাসী চোদ্দ হাজার রাক্ষস। শূর্পণখা আশায় বুক বেঁধেছিল যে, খর-দূষণের পরাক্রমের কাছে পরাভূত হবে রাম। রামের উষ্ণ রক্ত সে পান করবে।
শূর্পণখা মাটিতে পড়ে রয়েছে, রুধিরসিক্ত দেহ তার। তার আকাঙ্ক্ষা, সে পান করবে রাম-লক্ষ্মণ আর সীতার উষ্ণ রক্ত। শূর্পনখার দুর্দশা, শরীরের বিরূপতা দেখে খরের মনে জাগল তীব্র ক্ষোভ। ক্রোধে দুচোখ লাল হয়ে উঠল।
রামের বাক্য মনে ধরল রাক্ষসীর। বাক্যের মধ্যে নিহিত পরিহাসের তীক্ষ্ণ ঝলক সে উপলব্ধিও করতে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে রামকে পাওয়ার আশা ছেড়ে সে লক্ষ্মণের প্রতি মনোযোগ দিল।
রাম, লক্ষ্মণ, সীতা শেষে এসে পৌঁছলেন অগস্ত্য মুনির আশ্রমে। দণ্ডকারণ্যের বনরাজি যেন তার সমস্ত বৃক্ষসম্পদ একত্রিত করে বিরাজ করছে এই স্থানে। বিচিত্র সুন্দর বনজ গন্ধে ভরে আছে চারিদিক।
বাতাপি আর ইল্বল নামে দুই দুর্ধর্ষ পরাক্রমী অসুর বাস করত এই অরণ্যে। তারা যেমন শক্তিশালী, তেমনই নিষ্ঠুর ছিল। কত অসহায় ব্রাহ্মণের যে প্রাণ গিয়েছে তাদের হাতে, তার ইয়ত্তা নেই।
রাঘব, ক্ষত্রিয়ের জন্য ধনুর্বাণ হল আগুনের ইন্ধনের মতো। ক্ষত্রিয়ের কাছে অস্ত্র থাকলে তার স্বভাব এমনিতেই হিংস্র হয়ে ওঠে। সে ইচ্ছা না করলেও তার তেজ বেড়ে যায়। একটা প্রাচীন আখ্যান মনে পড়ছে। এক তপস্বী ছিলেন।
গভীর অরণ্যে ফুরোয় না পথ। রাম, লক্ষ্মণ, সীতা চলেছেন দুর্গম পথের বাধা বিপত্তি পার হয়ে সুতীক্ষ্ণ মুনির আশ্রমে। সঙ্গে চলেছেন রামের শরণাগত মুনিরা।
বিরাধ রাক্ষস তার মুক্তিকালে রামকে জানিয়ে গিয়েছিল, এই গভীর, ভয়াল দণ্ডকারণ্যে নিরাপদ, নির্ভয় আশ্রয়ের ঠিকানা — শরভঙ্গ মুনির আশ্রম। সেখান থেকে সার্ধ যোজন দূরত্ব তার।
দণ্ডকারণ্যের সুরম্য, ভয়াল অরণ্যানী। চলার পথ খুঁজে পাওয়া ভার। এ যেন ঘনঘোর মেঘমালায় ঢেকেছে দিনের আলো। আবার তার সৌন্দর্য দু’ চোখ ভরে পান করেও যেন তৃপ্তি হয় না।
মায়েদের রাজপ্রাসাদে রেখে স্থির করলেন ভরত, নন্দিগ্রামে থাকবেন তিনি। সেখানেই অপেক্ষা করবেন রামের জন্য। চোদ্দ বছর পর অগ্রজ ফিরে এলে তাঁকে রাজ্যভার সমর্পণ করে তবে শান্তি পাবেন তিনি।
পুরবাসীদের কথা শুনে রাম বললেন, “ভরত, প্রজাদের কথা শুনলে তো? এবার তোমার কঠিন ব্রত ত্যাগ করো।” কুশশয্যা ছেড়ে উঠে জলস্পর্শ করলেন ভরত।