মিত্রসম্প্ৰাপ্তি জগতের এইটাই নিয়ম। যখন কোনও দাবিতে গণ-অভ্যুত্থান বা রাষ্ট্র বিপ্লব শুরু হয় তখন বিক্ষুব্ধরা যতক্ষণ একসঙ্গে একাত্ম হয়ে বিদ্রোহ করেন ততক্ষণ বলবান শাসকওতাঁদেরকে ভয় পায়। কিন্তু যখনই তারা বিভিন্ন দাবি নিয়ে আলাদা হন, আলাদা আলাদা ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, তখনই সেই গণ-অভ্যুত্থান লঘু হতে শুরু করে। বিক্ষুব্ধরা যতই নিজেদের মধ্যে ভিন্নভিন্ন দাবিতে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করতে শুরু করেন শাসকের সুবিধা ততই বৃদ্ধি পায়। কোনও গণ-আন্দোলনের ক্ষেত্রে একদফা দাবি হলে শাসকের বিরুদ্ধে যে চাপ তৈরি হতে পারে, দাবি একাধিক হয়ে...
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি
পর্ব-৫৫: পতন আসন্ন হলেই সবার বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়
এ দিকে পায়রার দলটিকে জালে আটকে পড়তে দেখে সেই শিকারীটি তখন গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বড় একটা লাঠি নিয়ে এগিয়ে চললো তাদেরকে মারবার জন্যে। কপোতরাজ চিত্রগ্রীব তখন নিজেকে আর সেইসঙ্গে পরিবারের সকলকে জালে সেই শিকারীর জালে আটকে পড়তে দেখে সকলকে ডেকে বলল, “অহো ন ভেতব্যম্” —বন্ধুরা! আপনারা কেউ ভয় পাবেন না।
পর্ব-৫৪: স্বার্থান্বেষীকেও চিনতে শেখায় এই গ্রন্থ
নীতিজ্ঞরা বারে বারে এইরকম রাজাকে পরিত্যাগ করার কথা বলেছেন। মনের মধ্যে আপনার বেদনা বা পশ্চাত্তাপ থাকলেও সেটা সকলের কাছে প্রকাশ করাটা উচিত নয়। তাতে আপনার দুর্বলচিত্তের পরিচয় বাইরে সকলে জেনে যাবে। শত্রুরা সাহস পেয়ে যাবে।
পর্ব-৫৩: রাজনীতিতে উন্নতির জন্য নিন্দা বা প্রশংসা ব্যক্তিগত পরিসরে করাই শ্রেয়, সভায় নয়
সেই চোর ব্রাহ্মণটি মনের আনন্দে সেই বণিক ব্রাহ্মণদের সেবা করতে লাগল। কিছুদের মধ্যে সেই চোরটি তাঁদের খুবই বিশ্বস্ত হয়ে উঠল। সেই বণিক ব্রাহ্মণেরা তাঁদের সমস্ত পণ্য বিক্রি করে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার আগে সেই পত্তন থেকে অনেক বহুমূল্য রত্ন কিনল। তাঁরা সেগুলি সেই চোর ব্রাহ্মণের সামনেই তাঁদের জঙ্ঘার মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে স্বদেশে ফেরার উদ্যোগ নিল।
পর্ব-৫২: হিতকারী মূর্খ বন্ধুর থেকে একজন পণ্ডিত শত্রু থাকা ভালো
শ্রেষ্ঠী রেগে গিয়ে বলল, ওরে মিথ্যাবাদী! বাজপাখি কখনও এত বড় বাচ্চাকে অপহরণ করে আকাশে উড়তে পারে? আমাকে কি বোকা পেয়েছিস? যা বলবি তাই বিশ্বাস করবো? এখনই আমার বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দে না হলে রাজদরবারে যাব আমি তোর বিরুদ্ধে নালিশ করতে।
পর্ব-৫১: অকারণে প্রাপ্ত সম্মান খুব একটা সুখের হয় না
বুদ্ধিমান লোকেদের উচিত কোনও উপায় বা পরিকল্পনা চিন্তা করবার সময়েই সেক্ষেত্রে কী কী বিপদ হতে পারে সে সব চিন্তা করে রাখা। এমনকি বিপদ হলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসবার রাস্তা গুলোকেও ভেবে রাখা।না হলে সেই মূর্খ বকটির চোখের সামনেই তার বাচ্চাগুলোকে যেমন সেই বেজিটা খেয়ে নিয়েছিল ঠিক তেমন হবে।
পর্ব-৫০: পুত্রস্নেহে অন্ধ হলে পিতাকেও ধৃতরাষ্ট্রের মতো দুর্দশা ভোগ করতে হয়
সেই কথায় আছে না? চোরের মায়ের বড় গলা! পাপবুদ্ধির অবস্থাটা তাই। নিজে সবটাকা পয়সা সরিয়েছে; উল্টে ধর্মবুদ্ধিকে সে রাজার কাছে নালিশ জানানোর ভয় দেখাচ্ছে। ধর্মবুদ্ধি রেগে গিয়ে বলল, ওরে দুরাত্মা! ভুলে যাস না যে আমি ধর্মবুদ্ধি! কোনও রকম উঁচুনিচু কাজ আমি করি না। আমি ধর্ম মতে চলি, শাস্ত্রবচনকে উপেক্ষা করি না।
পর্ব-৪৯: হাতের কাছে টাকা-পয়সা দেখলে মুনি-ঋষিদের মনও চঞ্চল হয়
রাজা অমরশক্তির তিন পুত্রকে ছ’মাসের মধ্যে রাজনীতি-কূটনীতি বিষয়ে উপদেশ দিতেই বিষ্ণুশর্মা রচনা করেছিলেন ‘পঞ্চতন্ত্র’। কথামুখ অংশেই এ আলোচনা আমরা পূর্বেই করেছি। কিন্তু কোথায় কখন উপদেশ দিতে হয় এবং অপাত্রে উপদেশ দিলে কি অঘটন ঘটতে পারে সে কথাও তিনি পঞ্চতন্ত্রের বিভিন্ন কাহিনিতে বলে গিয়েছেন প্রচ্ছন্নভাবে।
পর্ব-৪৮: সর্বত্র জ্ঞান প্রয়োগ করলে বাস্তবে হিতে বিপরীত হয়
সামান্য পাখির কথাটা বানরদের বেশ গায়ে লাগলো। একটা ষণ্ডামার্কা বানর খেঁকিয়ে উঠে বলল, ওরে বেটা মূর্খ। অন্যের ব্যাপারে তোর এতো নাক গলানোর কিসের দরকার? ভাগ এখনই এখান থেকে।
পর্ব-৪৭: মূর্খকে উপদেশ দিলে সেটা তার রাগের কারণ হয়
শাস্ত্রকাররা বলেছেন, সর্বগুণসম্পন্ন রাজা যদি অনেক দান-ধ্যানও করেন তাহলেও তিনি যদি দুষ্ট মন্ত্রীদের কথায় চলেন তাহলে সে রাজাকে ত্যাগ করাই উচিত। যেমন কোনও জলাশয় পরিষ্কার সুমিষ্ট জলে পরিপূর্ণ হলেও সেখানে যদি কুমীর থাকে সেই জলাশয় যেমন পরিত্যাগ করা উচিত।
পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়
ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ক্রব্যমুখ পালিয়ে গেলেও বজ্রদংষ্ট্র এখনও পথের কাঁটা। উটের মাংসটা একা সমস্তটা ভোগ করতে গেলে সিংহ বজ্রদংষ্ট্রকে কি করে সরানো যায়—চতুরক যখন এইসব চিন্তা করছে, ঠিক সেই সময়েই একটা বড় উটের দল সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তার মধ্যে প্রথম উটটির গলায় একটা বড় ঘণ্টা বাঁধা ছিল।
পর্ব-৪৫: রাজনীতি স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বারে বারে টেনে আনে ধর্মকে, আর এতেই প্রাণ যায় ধর্মভীরু সাধারণদের
শৃগাল চতুরক তখন শঙ্কুকর্ণের কাছে গিয়ে বলল, ওহে শঙ্কুকর্ণ! স্বামী বজ্রদংষ্ট্রের অবস্থা তো খুব একটা সুবিধের বুঝছি না। এখনই কিছু একটা তাঁর অন্তত খাওয়া দরকার। না হলে খিদেয় মৃত্যু তাঁর একেবারে নিশ্চিত। আর তিনি মারা গেলে আমাদের অবস্থা আর দেখতে হবে না। উনি শিকার করেন বলেই আমরা খেয়ে পরে বেঁচে আছি।
পর্ব-৪৪: দুষ্টরা সুযোগ পেলেই যোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে অধিকার কায়েম করে
কোনও এক বনে বজ্রদংষ্ট্র নামে এক সিংহ বাস করতো। নাম শুনেই অনুমান করা যায় যে বজ্রের মতো কঠোর ছিল তার দাঁত কপাটি। একবার তার মুখে যে পড়তো তার আর নিস্তার নেই। সেই সিংহের চতুরক নামে এক শেয়াল আর ক্রব্যমুখ নামে এক নেকড়ে —এই দুই অনুগত ভৃত্য ছিল।
পর্ব-৪৩: ভৃত্য যদি কোনও অপরাধ করেন, তার দণ্ড প্রভুকেই পেতে হয়
ভগবান শ্রীনারায়ণকে রুক্মপুরে নিজের বাড়িতে দেখে গরুড় লজ্জায় একেবারে মুখ নিচু করে রইল। প্রণাম করে সে নারায়ণকে বললেন, হে ভগবন! আপনি সমুদ্রে মহাশয্যায় শেষনাগের উপর শুয়ে থাকেন আর সেই সমুদ্র আপনার আশ্রয় দিচ্ছে এই ভেবে একেবারে মদোন্মত্ত হয়ে গিয়েছে।
পর্ব-৪২: রাজকোষে সঞ্চিত সোনা-রূপা-ধান্যাদি সবই প্রজাবর্গের, রাজার ব্যক্তিগত নয়
মহাভারতের অনুশাসন পর্বে এক মারাত্মক কথা বলা হয়েছে। পিতামহ ভীষ্ম সেখানে যুধিষ্ঠিরকে রাজনীতির উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, যে রাজা প্রজাকুলকে রক্ষা করে না অথচ তাদের থেকে ধনসম্পত্তি হরণের পাশাপাশি তাদের অধিকারও খর্ব করে সে রাজা আসলে রাজা নয়, সে সাক্ষাৎ কলি।