অচেনা মুখ অজানা কাহিনী বিকেলের আলো কমে এসেছে — তবে কি সন্ধ্যে হল? সুবর্ণকান্তি হাতের রোম দেখার চেষ্টা করে — নাঃ! স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না! চমকে ওঠে সুবর্ণকান্তি। এটা কোথায় পড়েছে সে?

অচেনা মুখ অজানা কাহিনী বিকেলের আলো কমে এসেছে — তবে কি সন্ধ্যে হল? সুবর্ণকান্তি হাতের রোম দেখার চেষ্টা করে — নাঃ! স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না! চমকে ওঠে সুবর্ণকান্তি। এটা কোথায় পড়েছে সে?
শুক্লাজি মণিকর্ণিকা ঘাটে বসে বিনয় দেখছে গঙ্গার স্রোত বয়ে চলেছে। সেই স্রোতে ভেসে যাচ্ছে ফুল বেলপাতা মালা। সেই স্রোতে বয়ে যাচ্ছে সময়।
মণিকর্ণিকা ঘাট নাকে অক্সিজেনের নল। হাতে স্যালাইনের বোতল থেকে লাগানো ছুঁচ! আর একটা স্ট্যান্ডে ঝোলানো অর্ধেক খালি একটা রক্তের বোতল। তার পাইপটা বন্ধ করে বোতলে ঝোলানো আছে।
সান্ধ্যসংগীত এ পর্যন্ত বিনয় জীবনে দুটো মৃত্যু দেখেছে। নলচিতিতে পিসিমাকে দেখেছিল। ফর্সা মুখটা নীল হয়ে আছে, চোখ দুটো যেন ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
জীবনের এমন একটা অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে বিনয়—এতদিন লক্ষ্য ছিল অন্য৷ মা এত কষ্ট করে তাকে মানুষ করেছে…
বিশ্বনাথধাম —হ্যাঁ। তোমার মা আজ ১৯ বছর পর তাঁর স্বামীকে পেয়েছেন। তাই ওঁর সামনে চিকিৎসার খুঁটিনাটি আলোচনা করতে আমি চাইনি। শ্যামসুন্দরবাবুর খুব কঠিন ধরনের ব্রংকিয়াল নিউমোনিয়া হয়েছে। তাই চিঠিতে আমি লিখেছিলাম, গুরুতর অসুস্থ। এখন কতদিন ওঁকে চিকিৎসাধীন থাকতে হবে আমরা কতটা সুস্থ করে তুলতে পারব সেটা এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আমি একটা হপ্তা আমাদের অতিথিশালায় তোমার আর তোমার মায়ের থাকার ব্যবস্থা করেছি। বাবার চিকিৎসা নিয়ে ভাবতে হবে না—যত দিন যা চিকিৎসা লাগবে সে ব্যবস্থা মঠের পক্ষ থেকে করা হবে। তবে তোমাদের যদি বেশি...
বাচ্চা মহারাজ বাচ্চা মহারাজ এসে মা-র দিকে তাকিয়ে বললেন, —আপনার মনের অবস্থা পুরোপুরি না পারলেও কিছুটা আমি আন্দাজ করতে পারছি মা। শ্যামসুন্দরবাবু এই ১৯টা বছরের অনেকটা সময় উত্তর ভারতের নানা তীর্থস্থানে কাটিয়েছেন। এই মঠের গেটে উনি জ্বরে বেহুঁশ অবস্থায় পড়েছিলেন। বেশ কিছুদিন কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তারপর সামান্য সুস্থ হতে—প্রতিদিন একটু একটু করে আমি ওঁর কথা শুনতাম। তাতে যা বুঝেছি—ভাইয়ের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর উনি খানিকটা উদ্ভ্রান্ত হয়ে আপনাদের ছেড়ে চলে আসেন। ওঁর মনে হয়েছিল জ্যোতিষীর অকাট্য ভবিষ্যদ্বাণীকে...
কাশী বসুন্ধরার ভয় ভয় করছিল। যতই হোক মাঝ রাস্তায় জানোয়ারের মাথা যদি বিগড়োয়—টাঙা উলটে যদি এই বয়সে হাত পা ভাঙে? —বিনয় টাঙাওয়ালাকে বলল যে, তার মা গাড়ি চড়তে ভয় পাচ্ছে। টাঙাওয়ালা বসুন্ধরাকে নিশ্চিন্ত করে বলল—এ ঘোড়াটি তার সন্তানের মতো। আজ ১২ বচ্ছর তার আর তার পরিবারের রুটিরুজি জোগাচ্ছে এই ফুলমণি—কক্ষনো বেইমানি করেনি। খেলনা ঘোড়ার মতোই সে অবাধ্য হয়নি। —আমরা ওকে আমাদের পরিবারের মানুষজনের মতোই যত্ন করি। মানুষের মতো জানোয়ারের তকলিফ হয়। তখন ওদের খাটালে ওদের দিমাগ খারাব হয়। না হলে জানোয়ার কখনও বেইমানি করে না।...
কাশীর পথে রেলযাত্রায় হঠাৎ করে যে একটা পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল এটা কি নিছকই একটা ঘটনা? নাকি জীবনের আঁকে-বাঁকে কোথাও এর কোনও সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়ে যাবে? এইসব আগডুম বাগডুম চিন্তার জন্য বিনয়ের নিজেরই হাসি পেল। একটু চোখটা লেগে এসেছিল। কোনও একটা স্টেশনের আগে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ট্রেনটা বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে। তন্দ্রা কেটে গেল। হাত ঘড়িতে দেখল রাত ২টো। তার মানে কোন স্টেশন? পকেটে একটা কাগজে সময় ধরে স্টেশনের নাম লেখা ছিল। তারাপদবাবু দিয়েছিলেন। সেটা বের করতে গিয়ে পকেট থেকে আবার স্বর্ণময়ীর হাতে ঠিকানা লেখা কাগজটা...
স্বর্ণময়ী মাঝবয়সি ভদ্রলোককে সিটে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে৷ ভদ্রলোক খুব ঘামছেন—আর বড় বড় শ্বাস নিচ্ছেন। আর মাঝে মাঝে বুকের বাঁ দিকে হাত দিচ্ছেন৷ বিনয় তার মায়ের দিকে তাকায়, বসুন্ধরাও ঘাবড়ে রয়েছে। বিনয় বাইরের দিকে তাকায়—তখনও প্ল্যাটফর্ম দেখা যাচ্ছে৷ —দেখুন রেল কিন্তু এখনও প্লাটফর্মেই আছে। আপনারা চাইলে এখুনি আমি চেন টেনে গাড়ি থামাতে পারি। এখনও ওঁর ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করানো যাবে। মেয়েটি এবং মেয়েটির মা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। মেয়েটি বগির দরজার কাছে গিয়ে বেতের ব্যাগ আর ছোট কিটব্যাগটা নিয়ে আসে৷ দ্রুত হাতে কিট...
হঠাৎ দেখা ভাগ্য ভালো দু'পা এগোতেই 'চায়ে-চা'! মাথায় লাল সালু মোড়া চুবড়িতে মাটির ভাঁড় আর হাতে রাক্ষুসে কেটলি নিয়ে চা-ওলা হাজির। চা খেয়ে ধীরে-সুস্থে মাকে নিয়ে রেলের কামরায় যেতে কোনও অসুবিধে হল না—ভাগ্য ভালো জানলার ধারে সিট—কিন্তু রেল যেদিকে যাবে তার উলটো মুখে বসা। চোখে রেল-পথের ধুলো লাগার ভয় কম। সুটকেস বেডিং সিটের তলায় ঠেলে ঢুকিয়ে দেওয়া গেল। তারাপদবাবু বলে দিয়েছিলেন তাই মালপত্তরে চেন লাগিয়ে তালা মেরে দেওয়া হল। চিঠি পাওয়ার চার দিনের মধ্যেই কাশী রওনা দেওয়া গেল। পিটারসন সাহেবের নির্দেশে তারাপদবাবু কাশীর...
ছুটির দরখাস্ত —আজ্ঞে কাশী যাবার আগে আমি চারটে দিন হাতে রাখছি৷ আমি দিনরাত গুদোমেই থাকব—দারোয়ান থাকবে মুটেরা থাকবে৷ এমন তো নয় যে দিনরাত মাল ওঠাতে নামাতে হবে৷ বাগান থেকে চায়ের পেটি এল তো ওরা নামিয়ে রাখল—তারপর খানিকটা বিশ্রাম করে নিল৷ যখন দরকার পাইকারের মাল তুলে দিল৷ আমি ভোর ভোর গঙ্গা স্নান করে নেব৷ কাজ গুছিয়ে ফেলেছি মনে হলে আপনাকে রেল টিকিটের জন্য বলব তারাপদবাবু৷ আমার কাশীতে যাওয়াকে যাওয়া হবে কোম্পানির কাজটাও আটকে থাকবে না৷ তারাপদবাবু এগোনোর পথ আছে—হ্যাঁ মানছি সে পথ পাথুরে—কষ্ট হবে—হোক! আমি তৈরি৷ এরপর থিয়েটার...
তেলিপাড়া লেন এই জিনিসগুলোর নাম মার কাছেই শুনেছে বিনয়৷ যতবার বিনয় আর বসুন্ধরা ছিন্নমূল হয়ে এক আশ্রয় থেকে পরের আশ্রয়ে গেছে ততবার বসুন্ধরা গুছিয়ে এই জিনিসগুলো নিয়ে গেছে তার সঙ্গে। মামাবাড়ি কোটালীপাড়া থেকে বাখুন্ডায় আসার সময় জানতে চেয়েছিল এগুলো কী? মা জিনিসগুলো আঁকড়ে ধরে বলেছিলেন এগুলো তাঁর এয়োতির চিহ্ন। কিন্তু আজ এত বছর মা কারও কাছে একবারের জন্যেও বাবার দেশান্তরি হবার জন্য আক্ষেপ করেননি। খুব চেনা আত্মীয়স্বজন এ প্রসঙ্গ তুললে খানিক চুপ করে থেকে বলতেন সবার ভাগ্য তো আর সমান নয়। কত মেয়ের স্বামী তো...
তেলিপাড়া লেন ঠাকুর বলছেন— ঈশ্বরের নাম গুণগান সর্বদা করতে হয় আর সৎসঙ্গ। ঈশ্বরের ভক্ত বা সাধু, এঁদের কাছে মাঝে মাঝে যেতে হয়। সংসারের ভিতর ও বিষয় কাজের ভিতর রাতদিন থাকলে ঈশ্বরে মন হয় না। মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে তাঁর চিন্তা করা বড় দরকার। প্রথম অবস্থায় মাঝে মাঝে নির্জন না হলে ঈশ্বরে মন রাখা বড়ই কঠিন। 'যখন চারাগাছ থাকে তখন তার চারদিকে বেড়া দিতে হয়, না দিলে ছাগল-গোরুতে খেয়ে ফেলে।' ‘ধ্যান করবে কোণে মনে ও বনে।' সেখানেই ঠাকুর বলেছেন গৃহস্থ সন্ন্যাস-এর কথা। শ্রীম জানতে চাইলেন সংসারে কীরকম করে থাকতে হবে? ঠাকুর...
চা-গুদামের কেরানি পকেট থেকে সাদা ধবধবে রুমাল বের করে চশমার কাচ মুছতে মুছতে টেবিলে রাখা চিত্তর চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বললেন— এটা বলেই শেষ করব। ফর্মুলা নম্বর এক হল, কাজ হাতে করার আগে আগাপাশতলা মাথায় করে ফেলবে। না হলে দেখবে কাজটা সুতলির জটের মতো জড়িয়ে যাচ্ছে—কিন্তু শেষ হচ্ছে না। আর দু'নম্বর হল, কেজো লোকের কাজ বেশি—কিন্তু কাজকে খবরদার কোমরের উঁচুতে উঠতে দিও না—কাজের ঢেউয়ের মধ্যে দম আটকে যাবে। আজকের কাজ আজ না করে রেখে দিলে—কাল সে কাজ ছোবল মারবে—পরশু তরশু তিন দিন পর সে কাজই তোমায় গোটা গিলে খাবে। বিনয় কথাগুলো শুনতে...