কী অদ্ভুত ব্যাপার! ১৯৯২ সালে আবারও সাম্প্রদায়িকতার কালো মেঘে ঢাকা পড়ে বাংলাদেশের সুনীল আকাশ৷ হামলা, লুটপাট, আগুন লাগানোর ঘটনা৷ সারা দেশে কয়েক হাজার মন্দির ধ্বংস হয়৷

কী অদ্ভুত ব্যাপার! ১৯৯২ সালে আবারও সাম্প্রদায়িকতার কালো মেঘে ঢাকা পড়ে বাংলাদেশের সুনীল আকাশ৷ হামলা, লুটপাট, আগুন লাগানোর ঘটনা৷ সারা দেশে কয়েক হাজার মন্দির ধ্বংস হয়৷
রমনা কালীমন্দির থেকে আমার গন্তব্য ঢাকেশ্বরী মন্দির৷ সেদিন শনিবার৷ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সেবাইত প্রদীপকুমার চক্রবর্তী আমাকে আগেই বলেছিলেন, আপনি আমাদের মন্দিরে এসে দুপুরের প্রসাদ নেবেন৷
রমনা কালীমন্দিরে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজছিল৷ আমি তখন মন্দির প্রাঙ্গণেই ছিলাম৷ কালীমন্দিরের পাশেই দুর্গাদেউল৷ বড়সড় পাকা দালান৷ পাথরের বেদির ওপর নয়ন ভোলানো দুর্গাপ্রতিমা।
পাক সেনারা রমনা ত্যাগ করার আগে বলে যায়, যাদের বাঁচিয়ে রাখা হল, তারা যেন পরদিনই ভারতে চলে যায়৷
এই মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে বাংলাদেশের মহান বিজয় ১৬ ডিসেম্বরের মধুর স্মৃতি৷ কারণ, রমনা মন্দিরের পাশেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিল৷
সাতের দশকের গোড়ায় ধ্বংসের আগে কেমন ছিল মূল মন্দির? এককথায় রমনা কালীমন্দির ছিল অতীব মনোহর৷ পুরো মন্দির প্রাঙ্গণ ছিল উঁচু ইটের দেওয়ালে ঘেরা৷ মন্দিরে প্রবেশের জন্য দক্ষিণ দিকে একটা দরজা৷ ভেতরে ঢুকে বাঁদিকে চতুষ্কোণ এক নির্মাণের কেন্দ্রস্থলে একটি বেদি৷ এখানেই ছিল প্রাচীন মন্দিরটি৷ বেদির ওপর প্রতিষ্ঠিতা মাতা ভদ্রকালী৷ মন্দিরের ছাদ চারচালা৷ বাঙালি হিন্দু স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করেই মন্দিরটির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়৷ তবে এর নির্মাণশৈলীতে মোগল স্থাপত্যরীতিরও কিছুটা প্রভাব পড়েছিল৷ মূল মন্দিরের চূড়া ছিল ১২০ ফুট৷ যা বহুদূর থেকে...
বড় রাস্তা থেকে খানিকটা হেঁটে এসে রমনা কালীবাড়ির তোরণ৷ তবে এটি কোনও পাকা নির্মাণ নয়, কাপড়ের তৈরি৷ সাদা টাইলসে বাঁধানো গোটা চত্বর৷ প্রথমেই কালীমন্দির৷ পাথরের বেদির ওপর শ্রীশ্রীভদ্রকালীর সু-উচ্চ প্রতিমা৷ চতুর্ভুজা মাতৃমূর্তি মহাদেবের শয়ান মূর্তির ওপর দণ্ডায়মান৷ দু’পাশে ডাকিনী-যোগিনী৷ ভদ্রকালিকা দেবীর কণ্ঠে মুণ্ডমালা৷ লাল জবা ফুলের মালা৷ তিনি লালবস্ত্র পরিহিতা৷ বাংলাদেশে যত কালীমূর্তি আমি দর্শন করেছি, প্রতিটি প্রতিমাই দামি বস্ত্রে আবীতা৷ দিগম্বরী নন৷ এপার আর ওপার বাংলার কালীমূর্তিগুলির মধ্যে এই পার্থক্যটুকু...
ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের যা কিছু উন্নতি সব স্বামী অক্ষরানন্দজির (কালীপদ মহারাজ) চেষ্টাতেই হয়েছে বলে জানতে পারলাম৷ আশ্রমের বয়েজ স্কুলের সামনে বিরাট বকুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে অমল মহারাজ গল্প করতে করতে আমাকে বলেছিলেন, ‘আজও আমাদের মনে হয়, প্রয়াত পরম শ্রদ্ধেয় অক্ষরানন্দজি মহারাজ যেন অলক্ষ্যে এই আশ্রমের সবকিছু দেখছেন৷’ আশ্রমের আউটডোর চিকিৎসা ব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়েছিলেন অক্ষরানন্দজিই৷ যার সুফল হিন্দু-মুসলমানসহ ঢাকার সমস্ত সম্প্রদায়ের অসুস্থ মানুষই এখন পাচ্ছেন৷ অক্ষরানন্দজিকে মুসলমানরাও বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখত৷ এমনকী...
গতকাল সারাদিন একটানা ঘোরাঘুরির ফলে ইচ্ছা থাকলেও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারিনি৷ দোতলার খোলা জানালা দিয়ে একঝলক রোদ্দুর চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙল৷ সকাল সাড়ে সাতটা৷ জানালার সামনে দাঁড়ালে আশ্রমের মন্দির অনেকটাই দেখা যায়৷ মন্দিরের একপাশে সবুজ লন৷ প্রতি বছর এই মাঠে ম্যারাপ বেঁধে খুব বড় করে দুর্গাপুজো হয়৷ কুমারীপুজো দেখার জন্য ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ আশ্রমে আসেন৷ প্রায় ৩ একর জায়গার ওপর ঢাকার রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন৷ বেলুড় মঠের অনুমোদন পায় ১৯১৪ সালে৷ দেখতে দেখতে একশো বছর হয়ে গেল৷ অবশ্য পুরোনো ঢাকার ফরাসগঞ্জে ঊনবিংশ শতকের...
‘ঢাকা’ নামটির সঙ্গে আরেকটি প্রবাদ জড়িয়ে আছে৷ একদা বঙ্গদেশের শাসনকর্তা ছিলেন ইসলাম খাঁ৷ একবার তিনি মহা সমস্যার মুখোমুখি হলেন৷ সমস্যা মগ-দস্যুদের নিয়ে৷ মগরা যখন-তখন তাঁর রাজ্য আক্রমণ করে একটা বিশৃঙ্খলার পরিবেশ তৈরি করতে চায়৷ পূর্ববঙ্গকে মগদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে স্থানান্তরিত করে মেঘনার উপকূলে কোনও এক নিরাপদ স্থানে আনতে চাইলেন ইসলাম খাঁ৷ তিনি বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শনের পর বুড়িগঙ্গার তীরে এসে উপস্থিত হলেন৷ এই স্থানটিকে রাজধানীর উপযুক্ত বলে মনে হল তাঁর৷ একদিন একদল বাদ্যকর ঢাক বাজিয়ে পুজো...
এক কিংবদন্তি অনুযায়ী রাজা বিজয় সেনের পত্নীর মনে ভারী দুঃখ৷ এত বড় এক স্বাধীন ও সমৃদ্ধিশালী রাজ্যের রানি হয়েও এক হাহাকারবোধ প্রতিনিয়তই অসুখী করে তোলে তাঁকে৷ দেবদ্বিজে প্রচণ্ড ভক্তি রানির৷ কিন্তু কোনও পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে পারেননি তিনি৷ এ নিয়ে স্বয়ং বিজয় সেনের মনেও শান্তি নেই৷ প্রিয় পত্নীর মানসিক অবস্থা দেখে রাজা নিদারুণ ব্যথিত৷ কিন্তু তাঁর পর এই বিশাল রাজ্যের রাজা কে হবেন সেই ভাবনায় বিজয় সেন বড়ই চিন্তান্বিত৷ মাঝে মাঝে রাজকার্যে যেন কিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারেন না৷ প্রতি বছর নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে তীর্থযাত্রা...
কাজল দেবনাথের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাত প্রায় সাড়ে ন’টা৷ ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণ তখন শুনশান৷ রাত দশটায় ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের গেট বন্ধ হয়ে যায়৷ ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে গোপীবাগে রামকৃষ্ণ মিশন রিকশয় প্রায় আধ ঘণ্টার পথ৷ আশ্রমে সময়মতো পৌঁছতে পারব তো? অবশ্য দিনের বেলা ঢাকা শহর যেরকম অসহনীয় যানজটে জেরবার, একটু রাতের দিকে মহানগরের রাস্তাঘাট কিছুটা ফাঁকা হয়৷ কাজলবাবু তাঁর প্রাইভেট কারে আমাকে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব দেন৷ ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলাম, ‘একটা সাইকেল রিকশ ধরে রামকৃষ্ণ মিশনে পৌঁছে যাব৷’ ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে বেরোতেই একটা...
১৯৮৬ সালে রমনা কালীমন্দির পুনরুদ্ধারে নতুন করে আন্দোলনের কর্মসূচি নেয় পূজা উদযাপন পরিষদ৷ সেই আন্দোলন ক্রমশ তীব্রতর হয়ে ওঠে৷ সেই বছরের সবচেয়ে বড় ঘটনা হল, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ৫০০তম আবির্ভাব বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতীয় মহোৎসবের আয়োজন৷ এই উপলক্ষে ঢাকায় স্মরণকালের বৃহত্তম মিছিল বেরোয়৷ ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে নজিরবিহীন বন্যায় দুঃস্থ ও নিঃস্ব মানুষদের সেবায় মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি পুজোর ব্যয় ২০ শতাংশ কমিয়ে বন্যা ত্রাণ তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়৷ এছাড়া সারা দেশে পুজো উপলক্ষে আড়ম্বর ও সাজসজ্জা পরিহারেরও আহ্বান জানানো হয়৷...
কাজল দেবনাথের সঙ্গে একবার গল্প করতে বসলে সময় কোথা দিয়ে চলে যায় বোঝা যায় না৷ জিজ্ঞাসা করলাম, ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা মিলিয়ে অনেকগুলো সর্বজনীন পুজো-কমিটি রয়েছে৷ প্রতিটি পুজোই ধুমধাম করে হয়৷ তাহলে আলাদা করে মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি গঠনের প্রয়োজন হল কেন? বরং এতে হিন্দুদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা বেশি৷ কাজলবাবু বললেন, ‘ঢাকা শহরে অনেক পূজা কমিটি থাকলেও মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি একটু ব্যতিক্রমধর্মী৷ বৃহত্তর ঢাকা মহানগরের যে কেউ এই কমিটির সদস্য হতে পারেন৷ ভুল বোঝাবুঝি হবে কেন? মহানগরের সমস্ত পূজা-কমিটির মধ্যে...
প্রতীক্ষার শেষ৷ অবশেষে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ঢাকে কাঠি পড়ল৷ পূজারির ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেলাম৷ আমার হাতঘড়িতে সন্ধ্যা ৭টা৷ প্রতিদিন প্রায় ঘড়ি ধরে এখানে সন্ধ্যারতি হয়৷ আমিও তাড়াতাড়ি নাটমন্দিরে এসে ভিড়ের মধ্যে একটু জায়গা করে নিলাম৷ ঢাকের শব্দে গোটা ঢাকেশ্বরী মন্দির তখন গমগম করছে৷ বেশিরভাগ দর্শনার্থীই করজোড়ে দাঁড়িয়ে৷ অনেক তরুণ-তরুণীকেও দেখলাম ভিড়ের মধ্যে৷ ধূপধুনোর ভালোলাগা গন্ধে নাটমন্দির জুড়ে এক পবিত্র পরিবেশ৷ এর মধ্যেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলাম৷ আমার হাতকয়েক তফাতে ঘোমটা-পরা এক মহিলা নাটমন্দিরের পশ্চিমদিকের একটা...