শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

ওয়েস্ট বেঙ্গল কলেজ সার্ভিস কমিশন-এর ইন্টারভিউ শুরু হয়েছে এবং আমরা জানি যে, প্রত্যেকটি বিষয়ে ধাপে ধাপে ইন্টারভিউ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে যাঁরা এই ইন্টারভিউতে অবতীর্ণ হতে চলেছেন, তাঁদের জন্য কিছু জরুরি পরামর্শ রাখছি। প্রথমেই মেনে নেওয়া ভালো যে, পাঁচ-সাত মিনিট একজন ছাত্র-ছাত্রীর জন্য বরাদ্দ, সেই ছোট পরিসরের মধ্যে ছাত্র বা ছাত্রীটি কতখানি যোগ্য তার সঠিক বিচার সম্ভব নয়। অথচ ওইটুকু সময়ের মধ্যেই নিজের সেরাটা বের করে আনার চেষ্টা প্রত্যেককেই করতে হয়। ঠিক এ কথা ভেবেই কতকগুলি বিষয়ে অধ্যাপক-পদপ্রার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

যে পোশাকে হবু অধ্যাপক-অধ্যাপিকা ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে উপস্থিত হবেন সেটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। মনে হতে পারে, যেখানে জ্ঞানের গভীরতাই বিচার্য, সেখানে পরিধেয়কে গুরুত্ব দিচ্ছি কেন? এর উত্তরে একটা চালু প্রবাদের কথা বলা চলে, ‘আগে দর্শনদারি পরে গুণ বিচারি’। প্রথম দর্শনেই একজন হবু অধ্যাপক-অধ্যাপিকা নির্বাচকদের মনে কতখানি দাগ কাটতে পারছে, সেটা অনেকটাই নির্ভর করে তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ এবং শরীরী ভাষার ওপর। তাই যে পোশাকে একজন বোর্ডের সামনে উপস্থিত হবে, তার মধ্যে জাঁকজমক না থাক, একটা আকর্ষণ অবশ্যই থাকবে। তাই অধিক সাজসজ্জা যেমন এড়িয়ে চলা দরকার, তেমনি পরিচ্ছন্ন শোভনসুন্দর পোশাক পরিধান কাম্য।

পোশাকের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হল নির্বাচকমণ্ডলীর সামনে নিজেকে উপস্থিত করার ধরন। হাঁটাচলা এবং দাঁড়ানোর মধ্যে একটা ছন্দ থাকা দরকার। খুব দ্রুত বা খুব বিলম্বিতলয়ে কক্ষে প্রবেশ করা এড়িয়ে চলতে হবে। প্রবেশের পূর্বে অনুমতি নিতে হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত নির্দেশ না আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত আসন গ্রহণ না করাই শ্রেয়। মোটকথা, আচরণে কোনও ঔদ্ধত্য প্রকাশ পাবে না বা এমন মনে হবে না যে, প্রার্থী একজন আলালের ঘরে দুলাল বা দুলালী। অথচ আচরণে একটা সপ্রতিভতা সবসময় বজায় থাকবে।

Viva-র ক্ষেত্রে বাচনভঙ্গি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকের খুব দ্রুত কথা বলার অভ্যাস আছে আবার অনেকের কথা বলার মধ্যে জড়তা আছে। তাই নিজের বাচনভঙ্গি উন্নত করা দরকার। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় ছাত্র বা ছাত্রীটি মেধাবী হলেও নিজের কথা গুছিয়ে বলতে ব্যর্থ হচ্ছেন। অথচ তুলনায় অনেক সাধারণ মানের একজন বাকচাতুর্যে এবং উপস্থাপনের নৈপুণ্যে বাজিমাত করে বেরিয়ে যাচ্ছেন। অবশ্য একথা ঠিকই, বাকচাতুর্য সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি নয়। কিন্তু নিজের কথা গুছিয়ে বলার অক্ষমতার কারণে বছরের পর বছর ব্যর্থ হতে দেখেছি অনেককেই। তাই উপস্থাপনকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন open discussion-এ অংশ নিয়ে নিজের প্রকাশ ক্ষমতার উন্নতি ঘটাতে হবে।

৪. যে ভাষায় একজন উত্তর দেবেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে একটা বিষয় কবুল করা দরকার যে, ইংরেজি বাদে কলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের একটি অংশ ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে না। আবার ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করলেও ইংরেজিতে কথা বলার দক্ষতা সকলের থাকে না। অথচ এটা প্রত্যাশিত যে, যাঁরা ইন্টারভিউ বোর্ডে আছেন, তাঁরা বাংলায় যেমন প্রশ্ন করতে পারেন, তেমনি ইংরেজিতেও প্রশ্ন করতে পারেন। আর ইংরেজিতে যে প্রশ্ন করা হয় তার উত্তর ইংরেজিতে দেওয়াই সমীচীন। অন্যদিকে বাংলায় জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর বাংলায় দেওয়াই যথাযথ। যাঁদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য অধ্যাপক-অধ্যাপিকার নিয়োগ সেই কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দিভাষী, ইংরেজিভাষী নানা রকমের ছাত্র-ছাত্রী থাকতে পারে। সুতরাং একজন হবু অধ্যাপক-অধ্যাপিকাকে অবশ্যই অন্তত দুটি ভাষায় দক্ষ হতে হবে—একটি বাংলা ও অন্যটি ইংরেজি।
এটা ঠিক যে, আমরা যাঁরা দৈনন্দিন কাজে ইংরেজি ব্যবহার করি না, তাঁদের মধ্যে ইংরেজি বলার ব্যাপারে একটা জড়তা থাকে। Group Discussion-এ অংশ নিয়ে এটা কাটিয়ে ফেলতে হবে।

যখন একজন প্রার্থী বোর্ডের সদস্যদের মুখোমুখি হন, তখন একই সঙ্গে অনেকগুলি প্রশ্ন তাঁর দিকে ধেয়ে আসে। এই যে, একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া এটা একটা কৌশল বা Strategy। চাপের মুখে মাথা ঠান্ডা রেখে একজন কতদূর পর্যন্ত প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে পারে, সেটা বুঝে নেবার চেষ্টা করেন প্রশ্নকর্তারা। এমতাবস্থায় চাকরিপ্রার্থীকে ঠান্ডা মাথায় বিরক্ত না হয়ে একে একে সব প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে হবে। অথচ উত্তর দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, উত্তর যেন সংক্ষিপ্ত হয়। যাতে সবার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অবকাশ থাকে।

অনেক সময় দেখা যায়, কোনও উত্তরদাতা সরাসরি জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অনেকটা ভূমিকা করে উত্তর দিচ্ছেন। সময় যেখানে সংক্ষিপ্ত, সেখানে একটা গৌরচন্দ্রিকা করে উত্তর দেওয়া কখনওই কাঙ্ক্ষিত নয়। তাই ইন্টারভিউতে সবসময় জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর সংক্ষেপে সহজ করে বলার চেষ্টা করা দরকার। তাছাড়া বড় করে উত্তর বলার ঝুঁকিও থাকে। সেই উত্তরের সঙ্গে যে অতিরিক্ত কথাগুলি বলা হচ্ছে সেখানে ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে। ফলে উত্তরটা সঠিক হলেও তার অতিরিক্ত কথা বলার মাশুল দিতে হতে পারে।

এ পর্যন্ত বোর্ডের সামনে একজন প্রার্থী নিজেকে কীভাবে উপস্থাপন করবে মূলত তারই টিপস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, সঠিক প্রস্তুতি। বছর কয়েক ধরে দেখা যাচ্ছে, ইন্টারভিউ বোর্ড প্রার্থীদের যাচাই করার দুটো উপায় অনুসরণ করছে। প্রথমটা হল—Demonstration. অর্থাৎ একটা বিষয়ের উপরে নিজের বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দেওয়া আর অন্যটা উত্তরদাতার পছন্দসই ক্ষেত্রের উপর তাকে প্রশ্ন করা। দুটো ব্যাপারেই প্রার্থীকে যত্নবান হতে হবে। Demonstration-এর জন্য এমন বিষয় নির্বাচন করা দরকার, যেখানে যুক্তির অবতারণার সুযোগ রয়েছে। আর এটাও মনে রাখা দরকার প্রশ্নকর্তারা সব ক্ষেত্রে উত্তরদাতাকে তাঁর পছন্দের ক্ষেত্র নির্বাচনের স্বাধীনতা দিতে নাও পারেন। তাই যেকোনও প্রশ্নের একটা মোটামুটি সদুত্তর তিনি যাতে দিতে পারেন, তার প্রস্তুতি থাকা দরকার। বিশেষ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্তরে যে সিলেবাস রয়েছে তার ওপর নজর দিয়ে পূর্বপ্রস্তুতি সেরে ফেলা দরকার।

প্রার্থী যে ক্ষেত্রটি নির্বাচন করছে সেটা যেন এমন হয়ে না দাঁড়ায়, যা প্রায় সব প্রার্থীর পছন্দের। ক্ষেত্র-নির্বাচনে অভিনবত্ব থাকা দরকার। যে বিষয় বহু চর্চিত, যে ক্ষেত্রের উপর প্রশ্ন করতে করতে নির্বাচকমণ্ডলী ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, সেটা সযত্নে এড়িয়ে যেতে হবে। কথাটা বিশেষ করে তাঁদের জন্য বলা, যাঁদের নাম তালিকার শেষের দিকে। ক্ষেত্র-নির্বাচনে মুনশিয়ানা দেখাতে হবে তাঁদের।

অনেক সময় এমন হয় যে, ছাত্র বা ছাত্রীটি প্রশ্নের উত্তরে যা বলছে তা সঠিক। কিন্তু প্রশ্নকর্তা যে উত্তরটা তাঁর কাছে আশা করছেন উত্তরটা সে অনুযায়ী হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে ছাত্র বা ছাত্রীর কোনও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করা চলবে না বরং বিনয়ের সঙ্গে যুক্তিজাল রচনা করে নিজেকে সমর্থনের চেষ্টা করতে হবে। চাপে পড়ে তিনি যেন ভুল উত্তর দিয়ে না ফেলেন।

১০

উত্তরকারীর আত্মপ্রত্যয় যেন তাঁর উত্তরে প্রতিফলিত হয়। তাঁর বক্তব্য যেমন আকর্ষণীয় হবে, তেমনি তার মধ্যে থাকবে বিশ্বাসের ছাপ। সেইসঙ্গে দেখতে হবে তার মধ্যে যেন কোনও নঞর্থক প্রবণতা মাথাচাড়া না দেয়। কঠিন প্রশ্নের উত্তরে সরাসরি ‘জানি না’ বা ‘পারব না’ এরকম প্রতিক্রিয়া না করে, ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখার অভ্যাস রপ্ত করতে হবে। সোজা কথায়, ঘাবড়ে গেলে চলবে না। দেখা গেছে, বোর্ডের সামনে যে প্রশ্নটির উত্তর দিতে প্রার্থী ব্যর্থ হয়েছে, কক্ষ থেকে বের হবার পরই তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছেন। তাই অজানা বা কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে ভেঙে পড়া চলবে না। যদি সত্যিই কোনও উত্তর মনে না আসে, তাহলে সে যেন এটুকু কবুল করে—’এ মুহূর্তে আমার উত্তরটা মনে পড়ছে না৷’


Skip to content