শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


দেবাঞ্জন বাসু নামকরা ফিল্ম এডিটর। একটু ইন্ট্রোভার্ট ধরনের। কম কথা বলে। এক কথায় কাজ পাগল মানুষ। তার বাইরেটা কঠোর। স্পষ্টবাদী। মুখে হাসি নেই ঠিকই, কিন্তু মনটা নরম ওর। অন্যের দুঃখ কষ্টে প্রাণ কেঁদে ওঠে। দেবাঞ্জনের সম্পাদনার গুণে এক একটি ছবি দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে। সেরা ফিল্ম এডিটর হিসেবে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার-সহ নানান অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। তবে দেবাঞ্জন এমনই মানুষ, এইসব পুরস্কার নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। বরং কীভাবে সম্পাদনার জাদুবিদ্যা যথাযথভাবে প্রয়োগ করে তার ছবিগুলিকে এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেবে তা নিয়েই বেশি চিন্তা ভাবনা করে।

প্রখ্যাত লেখক জিৎ সত্রাগ্নির ‘পূর্বা আসছে’ উপন্যাসটি হাতে পেয়েই বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। চলচ্চিত্র জগতের পটভূমিকায় কাহিনির বিস্তার। বইয়ের পাতা উল্টে ক্রমশ মুগ্ধতার আবেশ নিয়ে এগোতে লাগলাম। দেখতে পেলাম দেবাঞ্জন এডিটিং রুম থেকে হঠাৎ তড়িঘড়ি বেরিয়ে যায়। তার গাড়ি এসে দাঁড়ায় মেয়েদের একটি নামী স্কুলের সামনে। অল্পবয়সী একটি মেয়ে পরনে তার স্কুল ইউনিফর্ম। সে গুটি গুটি এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে। দেবাঞ্জন ও মেয়েটি সাবধানে রাস্তা পার হয়ে গাড়ির পিছনের সিটে এসে বসে। এরপর টিফিন ক্যারিয়ার খুলে মেয়েটিকে নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দেয় দেবাঞ্জন। মেয়েটি কে? সেই মুহূর্তে তার কোন পরিচয় না জানিয়ে পাঠকের আগ্রহকে আরও খানিকটা উসকে দিতে পেরেছেন লেখক। প্রসঙ্গত, উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিও নাটক লিখেছেন। মঞ্চনাটক লিখেছেন। টেলিভিশন ও ফিল্মের চিত্রনাট্য রচনা করেছেন। কোথায় কখন কতটুকু হাত খুললে পাঠকের উৎসাহ চতুর্গুণ হবে তা বিলক্ষণ জানেন জিৎ। অনেকটা সিনেমাটিক ফর্মে লেখা এই উপন্যাসের এমনই দুরন্ত গতি যে গোটা বইটা এক সিটিংয়েই পড়ে ফেলা যায়। ভীষণ টানটান।
আমরা কী দেখি? মেয়েটিকে খাওয়াতে খাওয়াতে দেবাঞ্জন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। যে মানুষটি এত কঠোর সে কেন এতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে? সেদিনের বাড়তি খাবারটুকু ফুটপাতবাসীদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দিতে পেরে আরও আনন্দ পায় দেবাঞ্জন। তার চোখে জল আসে। সে হঠাৎ হঠাৎ অন্যমনস্কই বা হয়ে যায় কেন? দু’চোখ ঝাপসা লাগে কেন? জীবনের কোন যন্ত্রণার অতীতে যেতে চাইছে মন? স্মৃতির পাতায় পাতায় কেন এত যন্ত্রণা আর অপমানের দিনলিপি? স্কুলছাত্রী ওই কিশোরী কে? দেবাঞ্জনের সঙ্গে মল্লিকার কী সম্পর্ক? এরকমই অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন জিৎ একজন সফল ঔপন্যাসিকের মতোই। আজকের দিনের মতো করেই স্মার্ট কথোপকথন আর মেদহীন ভাষা ব্যবহার করে উপন্যাস পাঠের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।

দেবাঞ্জনের জীবনটা নানান টানাপোড়েনে জেরবার। আজ একজন সফল ফিল্ম এডিটরের এত মান মর্যাদা পেলেও একসময় তাকে এক কঠিন জীবনযুদ্ধে নামতে হয়েছিল। ফুল বিক্রি করত। মাছের ব্যবসা করেছে। পেট্রোল ট্যাঙ্কারের ম্যানেজারিও করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে একটা লম্বা জার্নি। পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে এডিটিং-এ রেকর্ড নম্বর নিয়ে পাস করার পরেই ভাগ্যের চাকা পুরোপুরি ঘুরে যায় দেবাঞ্জনের।
আরও পড়ুন:

বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব-৫০: ব্রহ্মপুত্র নদে লাঙ্গলবন্দ উৎসব খুবই প্রসিদ্ধ

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-৮: ‘ঈশ্বর… অদ্ভুত ম্যাজিক করেন, চাহিদা যত বেশি তিনি ততো কৃপণতা করেন’

যেহেতু চলচ্চিত্র সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত দেবাঞ্জন এই চলচ্চিত্র সংক্রান্ত (দেশ-বিদেশের সিনেমা) অনেক তথ্য উঠে এসেছে উপন্যাসে। এমনকী ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল যাকে ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ হয়তো বলা যেতে পারে তারও উল্লেখ রয়েছে, জিৎ-এর কলমে। কত ডিগ্রিতে ক্যামেরা বসাতে হবে সেই সুলুকসন্ধানও দিয়েছেন লেখক অর্থাৎ সমস্ত খুঁটিনাটির দিকে নজর তাঁর। কাহিনির বৈচিত্র এই উপন্যাসের অন্যতম বড় গুণ।

দেবাঞ্জনের ঘরোয়া জীবনের ঘটনাবলি পাঠকের মন খারাপ করিয়ে দেয়। অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে মল্লিকার সঙ্গে বিয়ে হয় দেবাঞ্জনের। মল্লিকা বদমেজাজি। বড়লোকি দম্ভ আর ঔদ্ধত্য ছিল মল্লিকার। তাদের এক কন্যা সন্তান হয়। ওর নাম পূর্বা। স্কুলে গিয়ে টিফিনের সময় মেয়েকে খাইয়ে আসে দেবাঞ্জন। মল্লিকা দেবাঞ্জনের ডিভোর্সও হয়ে গিয়েছে বেশ কিছুদিন। খোরপোশ দিয়ে যাচ্ছে দেবাঞ্জন। মল্লিকা চায় না দেবাঞ্জনের সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ রাখুক পূর্বা। এটা নিয়েই মা ও মেয়ের মানসিক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত, যা একসময় চরম পর্যায়ে পৌঁছয়।
আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি: অস্ট্রিয়ার ক্রিস্টাল দুনিয়া— সোয়ার্ভস্কি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল

উপন্যাসের শেষ পর্যায় আরও ইন্টারেস্টিং। মাঝে মাঝে একাকিত্ব ঘিরে ধরে দেবাঞ্জনকে। গভীর রাত। বহুতল ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে ঘন অন্ধকার গম্ভীর আকাশের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে দেবাঞ্জন। তার চিন্তাচ্ছন্ন মনের গভীরে একটা একটা করে জীবনের পুরনো অ্যালবামের ছবি উল্টে যাচ্ছে স্মৃতির সরণি বেয়ে। এরপর জিৎ সত্রাগ্নির লেখা একটি অপূর্ব বাক্য পাঠকের প্রশংসা অবশ্য আদায় করে নেবে — ‘অন্ধকার আকাশের কালো জমিতে আলোসুতোর জরিকাজের চুমকিরা ঝিকমিক করছে…’। নিঃসন্দেহে চমৎকার শব্দচয়ন!

একদিন মা ও মেয়ের প্রচণ্ড মনোমালিন্য। পূর্বা চায় তার বাবার কাছে ফিরে যেতে। সঙ্গে মা-ও চলুক। তিনজনের নতুন করে সুখের সংসার গড়ে উঠুক। মল্লিকা অনমনীয় ক্ষোভে-দুঃখে ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় পূর্বা। তার জন্মদিনেই ঘটনাগুলো পরপর ঘটে যায়। দেবাঞ্জন ফুল আর কেক নিয়ে এসেছে মেয়ের জন্যে। না, বাবার ডাকেও পূর্বা সাড়া দেয়নি। বন্ধ দরজা খোলেনি। তালা ভাঙ্গা হয়েছিল। কী হল পূর্বার?
আরও পড়ুন:

দশভুজা: সেই ষোলো মিনিটের দূরত্ব কোনওদিন পূরণ হয়নি

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২: ‘আও টুইস্ট করে’ গানের জন্য পঞ্চমের সঙ্গে শচীনকর্তার বাক্যালাপও বন্ধ ছিল বেশ কিছুদিন

অনেকদিন পরের ঘটনা। পূর্বার জন্মদিন। তার স্কুলের সামনে এসে দেবাঞ্জনের গাড়ি দাঁড়ায়। স্কুলের টিফিন টাইম। স্কুলড্রেস পরে কিশোরী ছাত্রীরা বেরিয়ে আসছে। গাড়ি থেকে প্রৌঢ় দেবাঞ্জন এবং মল্লিকা নেমে আসে। তাদের গাড়ির পিছনে আরও দুটো বড় গাড়ি। ওই গাড়ি দুটোতে পূর্বা ফাউন্ডেশনের নাম লেখা। গাড়িতে প্রচুর লাঞ্চ প্যাকেট। স্কুলের ছাত্রীরা এবং বেশ কয়েকজন ফুটপাতবাসী দেবাঞ্জন ও মল্লিকাকে ঘিরে ধরে। তাদের মধ্যেই লাঞ্চ প্যাকেটগুলো বিলিয়ে দেওয়া হবে। দেবাঞ্জন তখন একটা ঘোরের মধ্যে। তার মনে হয় স্কুলের ছাত্রীরা যেন পূর্বার রূপ ধরে তার কাছে এগিয়ে আসছে। দেবাঞ্জন অস্ফুটে মল্লিকাকে বলে — ‘ওই দেখো পূর্বা আসছে! দেখো মল্লিকা পূর্বা আসছে!’

এত সুন্দর ব্যঞ্জনাময় বাক্যবন্ধনের সাহায্যে এই উপন্যাসের সমাপ্তি টেনেছেন জিৎ সত্রাগ্নি, যা বইটি সংগ্রহ করে পড়ার আগ্রহকে নিঃসন্দেহে আরও বাড়িয়ে দেবে। লিখতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনের বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে তাঁর। যার কিছু কিছু পরিচয় জনপ্রিয় ওয়েবসাইট www.samayupdates.in এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত জিৎ সত্রাগ্নি’র চলতি উপন্যাস ‘বসুন্ধরা এবং…’ এ দেদার পাচ্ছেন পাঠকেরা। আর একটা কথা। বাংলা বানানের ব্যাপারে লেখককে আরও একটু সতর্ক হতে হবে।
 

একঝলকে

উপন্যাস: পূর্বা আসছে
লেখক: জিৎ সত্রাগ্নি
প্রকাশক: ব্লু রোজ ওয়ান
মূল্য: ২৭৫ টাকা
পাওয়া যাচ্ছে:

https://amzn.eu/d/3jYBKjT

 

বিশিষ্টজনদের প্রতিক্রিয়া

 

রুমকি চট্টোপাধ্যায়, চিত্র ও মঞ্চের অভিনেত্রী

“বাবা মাকে কাছে আনতে তাকে এতদূর চলে যেতে হল কেন?”— উপন্যাসের শেষ থেকে শুরু করি। কেন? এই কেনর উত্তর খোঁজা হয়েছে কাহিনিতে।… মানবিক সম্পর্কের এক বিচিত্র গতিপথকে অপূর্ব দক্ষতায় রূপায়িত করেছেন কাহিনিকার এই ‘পূর্বা আসছে’ উপন্যাসে।
জিৎ সত্রাগ্নি টানটান এক গল্পের বুনোটে তার উপন্যাসটিকে বেঁধেছেন। প্রতিটি চরিত্র তাদের নিজের নিজের উপলব্ধি নিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে যেটি অভিনব তাহলে উপন্যাসের নামকরণ ‘পূর্বা আসছে!’ হ্যাঁ, পূর্বা এল এক বিরাট অপ্রত্যাশিত চমক নিয়ে যার জন্য উপন্যাসটি শেষ পর্যন্ত পড়ার আগ্রহ থেকেই যায়।
 

গৌতম ঘোষ, সংগীত পরিচালক, প্রাক্তন সহযোগী অধ্যাপক, যন্ত্রসঙ্গীত বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী

বইটার মলাট খুললাম, হাতে কাছেই ছিল সেটা। মজার বিষয় হল বইটা হাতের তালুতে ধরে যায় এমন তার আয়তন। হিপ পকেটেও পুরে ফেলা যায়। ছেলেবেলায় যে বিদেশী বই পড়তাম। পকেট সংস্করণ!
পড়তে পড়তে মন চলে গিয়েছে আমার এলাকা ছাড়িয়ে মেঘের প্রান্তর ভেদ করে উপন্যাসের চরিত্রের আবাসে। এর প্রোটাগনিস্ট এক মিডিয়াম্যান। জটিল আবর্তের মধ্যে সে উঠে আসে, মনে হল, এ তো আমার চেনা! যেন বারবার কথা হয়েছে। হয়তো বা কখনও কাজ করেছি একত্রে। এতটাই জীবন্ত, প্রাণচঞ্চল এ। সত্যিই এক জীবন্ত নাটক। কেউ যদি একে নিয়ে ছবি করেন তার মেটেরিয়াল পরতে পরতে সাজানো। নির্দেশক নিশ্চিন্ত হবেন। লেখককে অভিনন্দন।
 

গৌরীশংকর মুখোপাধ্যায়, নাট্যকর্মী ও পরিচালক

ভেবেছিলাম লেখাটা শুরু করব পূর্বা আসছে আসছে করে, অবশেষে এসেই গেল। কিন্তু এমন একটা ধাক্কা যে আসতে পারে সেটা কল্পনাতেও আসেনি। পূর্বার এই পশ্চিমে ঢলে পড়া মেনে নিতে কিছুতেই মন সায় দিচ্ছে না। লেখনীর গুণে চরিত্রগুলোর সঙ্গে কেমন যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছিল পাঠকচিত্ত। বিশেষ করে দেবাঞ্জন যেন হয়ে উঠেছিল নিজেরই বাঙ্ময়প্রতিরূপ। লিখিত চরিত্রদের এমন করে রক্তমাংসের চলমানতায় প্রতিষ্ঠিত করা, এমন উষ্ণতায় জারিত করা, এ বড় সহজ কাজ নয়। এ কাজ যে পারে সেই পারে। এই বিশেষ সামর্থ্যকে তাই কুর্নিশ জানাই। পূর্বাকে বুকে জড়িয়ে ধরেই এখন কাটবে কিছুক্ষণ…মানুষ কি এর থেকে কিছু শিক্ষা নেবে? আসলে মল্লিকাদের সম্বিত তখনই ফেরে যখন ফিরে আসার সকল পথই রুদ্ধ। সিনেমার অন্দরমহলের অনেক তথ্যই এই উপন্যাস পাঠের অতিরিক্ত পাওনা।
 

অঞ্জন মুখোপাধ্যায়, চলচ্চিত্র পরিচালক, ছন্নছাড়া, মানসী

এক নিঃশ্বাসেই শেষ করেছি ‘পূর্বা আসছে’! অবিশ্বাস্য পরিণতিতে চমকে গিয়েছি। মানতে পারিনি, পূর্বার জন্য খুব কষ্ট পেয়েছি। গলার ভেতরে যেন একরাশ কান্না দলা পাকিয়ে উঠলো। অবশ্য পরে মনে হয়েছে, এটাই স্বাভাবিক। এমনই তো ঘটে। আধুনিক মা-বাবার এই উপন্যাস পড়া উচিত। চলচ্চিত্র জগতে পর্দার পিছনের ঘটনাগুলো চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সৃষ্টিশীল মানুষরা যে কিছুটা স্বার্থপর নিজেরই সেটা নতুন করে উপলব্ধি হল। অসামান্য লেখা। আরও আরও লিখুন … আরও ভালো লিখুন।
 

দেবেশ রায় চৌধুরী, চিত্র ও মঞ্চের অভিনেতা, নাট্যকর্মী ও পরিচালক

লেখায় রয়েছে গতি। প্রায় একটানা পড়েছি। ক্লাইম্যাক্সের অভাবিত পরিণতি মনকে নাড়া দিয়ে যায়।


Skip to content