মহানায়ক। ছবি: সংগৃহীত।
ছবির নাম ‘ওগো বধূ সুন্দরী’। পরিচালক সলিল দত্ত উত্তমকুমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। নাটকীয় দৃশ্যের শুটিং চলছে। দাড়িতে সাবান ঘষতে ঘষতে দাম্ভিক স্ত্রীকে যা খুশি বলে চলেছেন। সেই মতো ফ্লোর এর মধ্যে তৈরি সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, উপরে উঠছেন। শরীর অসুস্থ হলে কী হবে, মানসিক যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হলে কী হবে, চরিত্র চিত্রন করতে হবে নিখুঁত। এখানে তিনি উত্তমকুমার নন, এখানে তিনি অধ্যাপক গগন সেন। বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ। সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী চিত্রা (সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়)। বার কয়েক দৃশ্যটির রিহার্সাল দিলেন। টেকিংয়ের পরে উত্তমকুমার বুঝলেন তাঁর শরীর আজ রীতিমত অসুস্থ।
এই দিন শুটিংয়ে বেরোনোর সময় প্রাত্যহিক রুটিনের মতো সুপ্রিয়া দেবীর গেটে দাঁড়ানোর কথা। মহানায়ক গাড়িতে উঠে চলে গেলে তিনি বাড়ির ভেতরে ঢুকে যান। এ দিন তাও হয়নি। কারণ সুপ্রিয়া দেবী নিজেই তখন নার্সিং হোমে অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি হয়ে ছিলেন। মহানায়ক গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখেন তাঁর দীর্ঘদিনের সাধের টেপ রেকর্ডারটা গাড়ির মধ্যেই নেই। কী হল? চুরি হয়ে গেল? অত্যন্ত বিমর্ষ হলেন। কারণ এই টেপ রেকর্ডারটা তাঁর আজকের নয়। এই মন নিয়ে তিনি শুটিং করতে এসেছেন। সেই বিখ্যাত ডায়ালগ, “আমিও দেখে নেব। আমার নাম গগন সেন। যাওয়া আসার দরজা খোলাই রয়েছে।” এই ছিল উত্তম কুমারের জীবনের শেষ দিনে শুটিং।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩৬: কানন দেবী বললেন, ‘মনটা বড্ড খারাপ ছিল, অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসেনি’, ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল ‘আমারও’
বিচিত্রের বৈচিত্র: তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম…
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৩: কোন কাননের ফুল ‘শ্যামলী’
শুটিং সেরে প্রযোজক বন্ধু দেবেশ ঘোষের বাড়িতে তিনি নিমন্ত্রিত ছিলেন। সেখানে হইহুল্লোড়, খানাপিনা চলল অনেক রাত পর্যন্ত। সেই ধকল মহানায়ক নিতেই পারলেন না। ২৩ জুলাই ভর্তি করা হল বেলভিউ নার্সিংহোমে। যমে মানুষে টানাটানি। ডাঃ মণি ছেত্রী, ডাঃ এবি মুখোপাধ্যায়, ডাঃ সুনীল সেন, বাল্যবন্ধু ডাঃ লালমোহন মুখোপাধ্যায়, ডাঃ চোপড়া, ডাঃ বিশ্বাস সবাই সাধ্যমতো চেষ্টা করতে শুরু করলেন উত্তমকুমারকে সুস্থ করে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু সকলের সব চেষ্টাই বিফলে গেল। শেষ রক্ষা হল না। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই রাত নটা বত্রিশ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন মহানায়ক উত্তম কুমার।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৯: ডায়াবেটিসে কি আলু একদম বন্ধ?
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৮: ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার
তখন তো সংবাদ মাধ্যমের এত দাপাদাপি ছিল না। তাই পরের দিন সবকটি পত্রিকার মূল সংবাদটাই ছিল “মহানায়ক আর নেই”। আজ মৃত্যুর এতগুলো বছর পরেও তাঁর ছবি যখন বিভিন্ন চ্যানেলে প্রদর্শিত হয় এ প্রজন্মের দর্শকেরাও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখেন সেই ছবি। তাঁকে নিয়েই আলোচনা চলতে থাকে। সার্থক অর্থেই তিনি অনন্য অতুলনীয়।
আরও পড়ুন:
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২০: পঞ্চমের সুর আর কিশোর-আশার অনবদ্য উপস্থাপনা, ‘এক ম্যায় অউর এক তু’ গানটি আজও সুপারহিট
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫: সুন্দরবন নামরহস্য
শুধু ফুলের মালায় আর ধুপের ধোঁয়ায় তাঁকে আমরা আচ্ছন্ন করে রেখেছি। মনে রেখেছি শুধু ২৪ জুলাই মৃত্যুর দিন, আর ৩ সেপ্টেম্বর জন্মদিনের কথা। তাঁর পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন কি আজও হয়েছে? এই কথাগুলো লিখতে বসে তাঁর ভুবন ভুলানো হাসি আর সস্নেহ চাহনির কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। আর দু’ চোখ জলে ভরে যাচ্ছে। আসছে সোমবার সেই ২৪জুলাই। চোখের জলে তাঁকে প্রণাম জানাই। তিনি ছিলেন। তিনি থাকবেন। এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে আছি আজও এই একবিংশ শতাব্দীতে।
* পর্দার আড়ালে (Behind the scenes) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।