সুচিত্রা সেন। ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
ছবি নির্মাণ পর্বে বহু ঘটনা ঘটে থাকে যা আমজনতার জানার কথা নয়। তেমন আকর্ষণীয় সব তথ্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরছেন অধ্যাপক অভিনেতা ড. শঙ্কর ঘোষ।
বিবাদের মধ্যে দিয়েই শুরু হল একটি ছবির কাজ। বিবাদটা মূলত প্রযোজক ও পরিচালকের মধ্যে। ছবির নাম অগ্নিপরীক্ষা। ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক। একটি স্টুডিও ছিল সাউথ সিঁথির মোড়ে। নাম ন্যাশনাল সাউন্ড স্টুডিও। পরে সেটি লিজ নেন মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়। তিনি একসময়ের ডাকসাইটে প্রযোজক। স্টুডিওর নাম দিলেন এমপি স্টুডিও। প্রযোজক সংস্থার নাম দিলেন এমপি প্রোডাকশন। মাস মাইনে দিয়ে তিনি ওই স্টুডিওতে শিল্পী কলাকুশলীদের রেখেছিলেন। এখানে নির্মিত বিখ্যাত ছবিগুলির মধ্যে আছে শেষ উত্তর, যোগাযোগ, স্বপ্ন ও সাধনা, বিদ্যাসাগর, বসু পরিবার, সাড়ে চুয়াত্তর প্রভৃতি। এখানে চাকরি করতেন অগ্রদূত গোষ্ঠীর প্রধান বিভূতি লাহা। ডাকনাম খোকা। মুরলীবাবুর সঙ্গে খোকাবাবুর সম্পর্ক ছিল মধুর। তাছাড়া বিভূতি লাহা একসঙ্গে সামলাতেন পরিচালনা, ক্যামেরা ও চিত্রনাট্যের কাজ। খোকাবাবু একদিন বিকেলে একটি সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস পড়ার জন্য দিলেন মুরলীবাবুকে। সেটি আশাপূর্ণা দেবীর অগ্নিপরীক্ষা। কয়েকদিনের মধ্যেই উপন্যাসটি পড়ে উঠে মুরলীবাবু তাঁর অফিস ঘরে ডেকে পাঠালেন খোকাবাবুকে। তিনি জানালেন, ‘গল্পের রাইট কিনে ফেলুন, স্ক্রিপ্ট তৈরি করুন। কোন কোন শিল্পীকে নেবেন তার লিস্ট করে ফেলুন।’ সব কাজ বিভূতি লাহাই সুষ্ঠুমতো করলেন।
এক বিকেলে মুরলীবাবুর অফিসঘরে বিভূতি লাহা স্ক্রিপ্ট নিয়ে হাজির হলেন। অবধারিতভাবে শিল্পী নির্বাচনের প্রসঙ্গটি এল। বিভূতি লাহা জানালেন, ‘নায়িকার বাবা মায়ের চরিত্রে কমল মিত্র চন্দ্রাবতী দেবী। ঠাকুমার চরিত্রে সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়। নায়কের ঠাকুরদার চরিত্রে জহর গঙ্গোপাধ্যায়। নায়ক কিরীটীর চরিত্রে উত্তমকুমার আর নায়িকা তাপসীর চরিত্রে সুচিত্রা সেন।’ এতক্ষণ সব ঠিকই ছিল। নায়ক-নায়িকার জন্য শিল্পীদের নাম শুনে ঠিক থাকতে পারলেন না মুরলীবাবু। তিনি স্পষ্ট করে বললেন, ‘উত্তম আমার প্রোডাকশন হাউজের শিল্পী। ওকে নায়ক করে সহযাত্রী নষ্টনীড় সঞ্জীবনী ছবিগুলোর ভরাডুবি হয়েছে। ওকে দর্শকেরা ডাকে ফ্লপ মাস্টার জেনারেল হিসেবে। আর সুচিত্রার সুন্দর মুখ ছাড়া কীই বা আছে।’ ব্যাপারটা অন্য দিকে চলে যাচ্ছে দেখে তিনি বিভূতি লাহাকে পরামর্শ দিলেন, ‘কিরীটী চরিত্রে বিকাশ রায়কে নিন আর তাপসীর চরিত্রে অনুভা গুপ্তাকে নিন। দেখবেন ছবি জমে গিয়েছে।’ কথাটা বিভূতি লাহার মনঃপূত হল না। তিনি স্পষ্ট করেই বলে দিলেন, ‘উত্তম-সুচিত্রাকে যদি নেন তবে এই ছবি আমি করব নতুবা নয়। আপনি বরং অন্য পরিচালক দেখে নিন।’ মুরলীবাবু অসন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু তিনি ঘাঁটালেন না। কারণ বিভূতি লাহা এমপি প্রোডাকশনের অ্যাসেট। তাঁর পরিচালনায় বাবলা ছবি বিদেশের বাজারে কার্লোভিভ্যারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃত প্রথম বাংলা ছবি। ফলে মুরলীবাবু সম্মতি দিলেন বিষয়টিতে। কিন্তু শুটিং চলাকালীন তিনি একদিনও ফ্লোরে গেলেন না। এমনকী ছবি যখন পুরো তৈরি, ফাইনাল প্রোজেকশন দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে ওরিয়েন্ট সিনেমা হলে সেখানেও তিনি গেলেন না। তারপর এল অগ্নিপরীক্ষা ছবির মুক্তির দিন ১৯৫৪ সালের তেসরা সেপ্টেম্বর ছবি মুক্তি পেল উত্তরা-পূরবী-উজ্জ্বলা এই চেইনে। শুরু থেকে হাউসফুল। হাউসফুল-এর বোর্ড আর নামেই না। উত্তম সুচিত্রা জুটি পূর্বে সাড়ে চুয়াত্তর, সদানন্দের মেলা, ওরা থাকে ওধারে প্রভৃতি ছবিতে দুজনে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু রোমান্টিক জুটি হিসেবে তারা প্রতিষ্ঠা পেলেন অগ্নিপরীক্ষা ছবি থেকে। বিশেষ করে ছবির শেষে সেই রাধাগোবিন্দ মন্দির চত্বরে উত্তম-সুচিত্রার আলিঙ্গনবদ্ধ দৃশ্য দেখতে দর্শকের ঢল নামল প্রেক্ষাগৃহগুলোতে। পরবর্তীকালে গরিষ্ঠ সংখ্যক পরিচালক উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ছবির শেষ দৃশ্যে এমনই আলিঙ্গনাবদ্ধ দৃশ্য অপরিহার্য মনে করেছিলেন দর্শকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে।
উত্তমকুমার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই। সুচিত্রা সেন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি। দিনটি ছিল শুক্রবার। ২৪ ডিসেম্বর থেকেই হাসপাতালে ছিলেন তিনি। সেই লড়াই থেমে গেল ১৭ জানুয়ারি সকালে। তিনি নিজেকে অন্তরালে রাখার লড়াইয়ে জিতেই গেলেন। শেষ ছবি প্রণয়পাশা (১৯৭৮)। তারপর দর্শকেরা আর নতুন কোনও ছবিতে মহানায়িকাকে দেখেননি। সত্তরের দশকের শেষ থেকেই তিনি ছিলেন অন্তরালবর্তিনী। তবু তিনি ছিলেন আমাদের মধ্যেই। সেই মানুষটি চলে গেলেন। বাঙালি চাননি যে তিনি থাকবেন না। যেমন ভাবেননি মৃত্যুর পরেও সরবে না তাঁর মুখের অবগুণ্ঠন। বরাবর রহস্যময়ী। নিজের ইচ্ছায় নিজেকে ঘিরে রহস্য, সেই দীপশিখা জ্বালিয়ে রেখে তিনি চলে গেলেন। ডাক্তার সুব্রত মৈত্র চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি। তবু হার মানতেই হল শুক্রবার সকাল ৮:২৫ মিনিটে সবশেষ। সুচিত্রা বলে কথা। মহানায়িকার মৃত্যু নেই। তিনি ছিলেন, তিনি আছেন, তিনি থাকবেন। তাঁর এই পথ চলা কোনওদিন শেষ হবে না।
এক বিকেলে মুরলীবাবুর অফিসঘরে বিভূতি লাহা স্ক্রিপ্ট নিয়ে হাজির হলেন। অবধারিতভাবে শিল্পী নির্বাচনের প্রসঙ্গটি এল। বিভূতি লাহা জানালেন, ‘নায়িকার বাবা মায়ের চরিত্রে কমল মিত্র চন্দ্রাবতী দেবী। ঠাকুমার চরিত্রে সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়। নায়কের ঠাকুরদার চরিত্রে জহর গঙ্গোপাধ্যায়। নায়ক কিরীটীর চরিত্রে উত্তমকুমার আর নায়িকা তাপসীর চরিত্রে সুচিত্রা সেন।’ এতক্ষণ সব ঠিকই ছিল। নায়ক-নায়িকার জন্য শিল্পীদের নাম শুনে ঠিক থাকতে পারলেন না মুরলীবাবু। তিনি স্পষ্ট করে বললেন, ‘উত্তম আমার প্রোডাকশন হাউজের শিল্পী। ওকে নায়ক করে সহযাত্রী নষ্টনীড় সঞ্জীবনী ছবিগুলোর ভরাডুবি হয়েছে। ওকে দর্শকেরা ডাকে ফ্লপ মাস্টার জেনারেল হিসেবে। আর সুচিত্রার সুন্দর মুখ ছাড়া কীই বা আছে।’ ব্যাপারটা অন্য দিকে চলে যাচ্ছে দেখে তিনি বিভূতি লাহাকে পরামর্শ দিলেন, ‘কিরীটী চরিত্রে বিকাশ রায়কে নিন আর তাপসীর চরিত্রে অনুভা গুপ্তাকে নিন। দেখবেন ছবি জমে গিয়েছে।’ কথাটা বিভূতি লাহার মনঃপূত হল না। তিনি স্পষ্ট করেই বলে দিলেন, ‘উত্তম-সুচিত্রাকে যদি নেন তবে এই ছবি আমি করব নতুবা নয়। আপনি বরং অন্য পরিচালক দেখে নিন।’ মুরলীবাবু অসন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু তিনি ঘাঁটালেন না। কারণ বিভূতি লাহা এমপি প্রোডাকশনের অ্যাসেট। তাঁর পরিচালনায় বাবলা ছবি বিদেশের বাজারে কার্লোভিভ্যারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃত প্রথম বাংলা ছবি। ফলে মুরলীবাবু সম্মতি দিলেন বিষয়টিতে। কিন্তু শুটিং চলাকালীন তিনি একদিনও ফ্লোরে গেলেন না। এমনকী ছবি যখন পুরো তৈরি, ফাইনাল প্রোজেকশন দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে ওরিয়েন্ট সিনেমা হলে সেখানেও তিনি গেলেন না। তারপর এল অগ্নিপরীক্ষা ছবির মুক্তির দিন ১৯৫৪ সালের তেসরা সেপ্টেম্বর ছবি মুক্তি পেল উত্তরা-পূরবী-উজ্জ্বলা এই চেইনে। শুরু থেকে হাউসফুল। হাউসফুল-এর বোর্ড আর নামেই না। উত্তম সুচিত্রা জুটি পূর্বে সাড়ে চুয়াত্তর, সদানন্দের মেলা, ওরা থাকে ওধারে প্রভৃতি ছবিতে দুজনে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু রোমান্টিক জুটি হিসেবে তারা প্রতিষ্ঠা পেলেন অগ্নিপরীক্ষা ছবি থেকে। বিশেষ করে ছবির শেষে সেই রাধাগোবিন্দ মন্দির চত্বরে উত্তম-সুচিত্রার আলিঙ্গনবদ্ধ দৃশ্য দেখতে দর্শকের ঢল নামল প্রেক্ষাগৃহগুলোতে। পরবর্তীকালে গরিষ্ঠ সংখ্যক পরিচালক উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ছবির শেষ দৃশ্যে এমনই আলিঙ্গনাবদ্ধ দৃশ্য অপরিহার্য মনে করেছিলেন দর্শকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে।
উত্তমকুমার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই। সুচিত্রা সেন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি। দিনটি ছিল শুক্রবার। ২৪ ডিসেম্বর থেকেই হাসপাতালে ছিলেন তিনি। সেই লড়াই থেমে গেল ১৭ জানুয়ারি সকালে। তিনি নিজেকে অন্তরালে রাখার লড়াইয়ে জিতেই গেলেন। শেষ ছবি প্রণয়পাশা (১৯৭৮)। তারপর দর্শকেরা আর নতুন কোনও ছবিতে মহানায়িকাকে দেখেননি। সত্তরের দশকের শেষ থেকেই তিনি ছিলেন অন্তরালবর্তিনী। তবু তিনি ছিলেন আমাদের মধ্যেই। সেই মানুষটি চলে গেলেন। বাঙালি চাননি যে তিনি থাকবেন না। যেমন ভাবেননি মৃত্যুর পরেও সরবে না তাঁর মুখের অবগুণ্ঠন। বরাবর রহস্যময়ী। নিজের ইচ্ছায় নিজেকে ঘিরে রহস্য, সেই দীপশিখা জ্বালিয়ে রেখে তিনি চলে গেলেন। ডাক্তার সুব্রত মৈত্র চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি। তবু হার মানতেই হল শুক্রবার সকাল ৮:২৫ মিনিটে সবশেষ। সুচিত্রা বলে কথা। মহানায়িকার মৃত্যু নেই। তিনি ছিলেন, তিনি আছেন, তিনি থাকবেন। তাঁর এই পথ চলা কোনওদিন শেষ হবে না।