রবি ঘোষ।
হীরক রাজার রাজকোষে সিন্দুক ভরা হিরে। সেই হিরের বেশ কিছুটা বার করে আনতে হবে গুপি বাঘাকে। কারণ পেয়াদাদের ঘুষ দিতে হবে। দুষ্টু রাজাকে গদি থেকে নামানো চাই। গুপী বাঘা রাজকোষের সামনে হাজির হয়। সেখানে প্রহরী টহল দিচ্ছে। গুপী বাঘা গান গেয়ে তাকে বশ করে দড়ি দিয়ে হাত-পা, গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে, তার ট্যাক থেকে চাবি নিয়ে ঢাউস তালা খুলে তো রাজকোষে ঢোকে। তাদের ধারণা ছিল আর বোধহয় কোনও বাধা নেই।
এ বার সিন্দুক খুলে হিরে বাইরে বার করলেই হল। কিন্তু সিন্দুকের তিনটে তালা তিনটে চাবি। পাহারা দেয়ার জন্য যে বাঘ মামা বসে আছেন রাজ কোষের ভেতরে সেটা তারা জানবে কি করে? অবশ্যই বাঘকেও গান গেয়ে বশ করা যায়। কিন্তু গুপির গলা যে শুকিয়ে কাঠ। গান বেরোবে কি করে? অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত বেরোলো গান “পায়ে পড়ি বাঘ মামা কোরো নাকো রাগ মামা তুমি যে এই ঘরে কে তা জানতো?”
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৪৪: বাংলায় জীবনীমূলক ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে কালীপ্রসাদ ঘোষ এক স্মরণীয় নাম
পরিযায়ী মন, পর্ব-১৬: ঐতিহ্যবাহী বাড়ির শহর মধুপুর
এই দৃশ্যের শুটিং করতে মাদ্রাজে হাজির হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় সদল বলে। ছবির নাম হীরক রাজার দেশে। বাঘকে দেখে সত্যজিৎ রায়ের মন চোখ জুড়িয়ে গেল। যে বাক্তিকে নিয়েই শুটিং করা হয়েছিল সেই ট্রেনারটিও দেখবার মতো। নাম টাইগার গোবিন্দ রাজন। তিনি সত্যজিৎ রায়ের কাছে জানতে চাইলেন যে, তার বাঘকে নিয়ে কি কাজ করাতে হবে? তখন সত্যজিৎ রায় বললেন “খুবই সহজ ব্যাপার। একজন গান গাইবে। বাঘ একটা ঘরের কোণায় চুপচাপ বসে সেই গান শুনবে।” শুনে ট্রেনার গোবিন্দ রাজন বললেন, “এতে আমার কোনও দরকার হবে না। যা দরকার, যা করবার আমার স্ত্রী করবেন”।
শুটিংয়ের দিন সকলে নটার মধ্যে স্টুডিয়োতে হাজির হয়ে গেলেন। বাঘাকে নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল দশটার সময়। গাড়ির উপর স্পেশাল খাঁচায় বাঘ মশাই হাজির হয়ে গেলেন। ঠিক টাইম মাফিক খাঁচার তলায় চাকা লাগানো বাঘ-শুদ্ধ খাঁচাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে ঠেলে নিয়ে গিয়ে হাজির করা হল একেবারে রাজকোষের দরজার সামনে। খাঁচা থেকে বেরিয়ে তার যে ঘরে থাকার কথা সেই ঘরে নিয়ে গিয়ে হাজির করা হল। সঙ্গে ট্রেনার গিন্নী। আরেকটি তরুণ বয়সের ছেলে।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫২: সব ঘরই ‘তাসের ঘর’
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৩: সুন্দরবনে কুমিরের দেবতা কালু রায়
বাঘার ভূমিকায় যিনি অভিনয় করছেন তিনি হলেন রবি ঘোষ। রবি ঘোষের জীবনে এটি একটি মার্কামারা দিনও বটে। অভিনয়ের সঙ্গে তাঁর সাহসের পরীক্ষা হতে চলেছে সেই দিনে। তাঁকেই যে বাঘের সবচেয়ে বেশি কাছে যেতে হবে। প্রথমে বাঘের একার কতগুলি শট নেওয়ার ব্যবস্থা করা হল। ক্যামেরা বাঘের থেকে দশ হাত দূরে দাঁড় করিয়ে তাতে চোখ লাগিয়ে পরিচালক অপেক্ষা করতেন। যেই বাঘ ছটফটানি বন্ধ করে, ক্যামেরা অন করে তার শুটিং করা হল। বাঘের ততক্ষণে ছবি উঠেছে। গোলমালে শটগুলো সত্যজিৎ রায় আগে নিলেন।
এ বার শুরু হল বাঘাকে নিয়ে শুটিং। তিনি রবি ঘোষকে বললেন, “এ বার তুমি তৈরি হও”। ট্রেনারকে কাজের শুরুতেই বলে রেখেছিলেন আমাদের একজন অভিনেতাকে বাঘের খুব কাছাকাছি যেতে হবে। তাতে কোনও গোলমাল হবে না তো? ট্রেনার বললেন, “বাঘের নাম উমা, যিনি বাঘের কাছে যাবেন তিনি যেন সেই সময় নামটা বলতে বলতে যান। বাঘ তাহলে ভাববে চেনা লোকই আসছে। আর তাহলেই সে কোনও গন্ডগোল করবে না”।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৪: মুশকিল ঘরে, মুশকিল বাইরে, মুশকিল বিশ্বময়!
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৮: বাবা, ‘পিতা নোহসি’ বলো — এই কথাটি ঘুরেফিরেই কবির কানে বেজে উঠত
রবি ঘোষ সেই মতো অনেকবার উমা উমা বলতে বলতে বাঘের কাছে এগিয়ে গিয়ে নিজের সাহসের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছিলেন। দৃশ্যটা যাতে আরও জমে, তাই বাঘাকে দিয়ে শুধু বাঘের উপর থেকে চাবি নিতে দেখানো হয়নি, কাজটা করতে গিয়ে ওকে টাল হারিয়ে দেওয়ালের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখানো হয়েছিল। তাঁর শরীরটা বাঘের উপর দিয়ে ধনুকের মতো বাঁকা। তাঁর হাত যেন দেওয়ালে আটকে গিয়েছে। সে চেষ্টা করেও নিজেকে সোজা করে পিছিয়ে আসতে পারছে না।
সত্যজিৎ রায়।
এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য গুপিকে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে গিয়ে বাঘার কোমর ধরে টেনে আনতে দেখানো হয়েছিল। এই দৃশ্যগ্রহণে ট্রেনার গিন্নির ধমকানি আর অন্য ছেলেটির আপ্রাণ চেষ্টার ফলে বাঘ মোটামুটি ভদ্র ব্যবহারই করেছিল।
এই অসাধারণ কাজ করেছিলেন বাঘা রূপী রবি ঘোষ। আজ রবি ঘোষের জন্মদিন এই ঘটনার সূত্র ধরে রবি ঘোষের জন্মদিনে তাঁকে জানাই আমার শ্রদ্ধা।
এই অসাধারণ কাজ করেছিলেন বাঘা রূপী রবি ঘোষ। আজ রবি ঘোষের জন্মদিন এই ঘটনার সূত্র ধরে রবি ঘোষের জন্মদিনে তাঁকে জানাই আমার শ্রদ্ধা।
* পর্দার আড়ালে (Behind the scenes) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।