ছায়া দেবী, সমরেশ বসু ও তপন সিংহ।
তপন সিংহ তখন বিখ্যাত পরিচালক। তিনি একটি পর একটি ছবি দর্শকদের উপহার দিচ্ছেন, সেগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করছে। সেই সময় তিনি কালকূটের (সমরেশ বসুর ছদ্মনাম) ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ পড়ে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন, তা নিয়ে ছবি করবেন বলে সমরেশ বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। কিন্তু সেই সময় ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’র চিত্রস্বত্ব কিনে রেখেছিলেন বম্বের বিখ্যাত পরিচালক বিমল রায়। কথা ছিল যে, তিনি পাঁচ বছরের মধ্যে যদি ছবিটি করে উঠতে না পারেন তাহলে সেই স্বত্ব আবার ফিরে আসবে লেখকের কাছে।
এরকম পরিস্থিতিতে সমরেশ বসুই তপন সিংহকে পরামর্শ দিলেন যে তাঁর লেখা ‘নির্জন সৈকতে’ উপন্যাসটি পড়ে দেখার জন্য। তপন সিংহ উপন্যাসটি মন দিয়ে পড়লেন। পড়ে মুগ্ধ হলেন এবং তখন তিনি এই নির্জন সৈকতের চিত্রস্বত্ব কিনলেন। এর চিত্রনাট্য তৈরি করতে তপনবাবু তাঁর নিজের মা এবং সমরেশ বসুকে নিয়ে পুরীতে চলে গেলেন। চিত্রনাট্য লেখার পর ছবির কাজ শুরু হল।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৪৭: জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্য বাড়ি থেকে স্ট্যু বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন কানন দেবী
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী
সেখানে প্রধান যে চারটি বিধবার চরিত্র রয়েছে সেই চারটি চরিত্রের জন্য তপন সিংহ নিলেন ছায়া দেবী, ভারতী দেবী, রেনুকা রায় এবং রুমা গুহ ঠাকুরতাকে। নায়ক নায়িকার চরিত্রে নিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায় এবং শর্মিলা ঠাকুরকে। আর একটি বিশিষ্ট ভূমিকায় পান্ডার চরিত্রে নিলেন রবি ঘোষকে। এই ছবিটিতেই প্রথম ছায়া দেবী ঢুকছেন তপন সিংহের ছবির মধ্যে। পরে তপনবাবু তাঁর নিজের অধিকাংশ ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় নিয়েছেন এই ছায়া দেবীকে।
আরও পড়ুন:
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫০: আরডি শুধু সঙ্গীত পরিচালক নন, ভারতীয় সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র জগতের এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব
এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৫: সুন্দরবনের নদীবাঁধের অতীত
পুরীর আউটডোরে একটা মজাদার ঘটনা ঘটল। সেইদিন চার চারটি দৃশ্য পুরীর সমুদ্র সৈকতে শুটিং করা হবে। ছায়া দেবী যখন হোটেল থেকে সমুদ্র সৈকতের শুটিংয়ের জায়গায় এলেন তখন দেখা গেল বেশ বড়সড় লাগছে ছায়া দেবীর চেহারাটা। এই দেখে তপন বাবু ছায়া দেবীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ছায়াদি পুরীর জল হাওয়া লেগে আপনার শরীর কি একটু ভারী হয়ে উঠেছে?” ছায়া দেবী বললেন” না না তার জন্য নয়। তুমি আজকে চার চারটে দৃশ্যের শুটিং করবে। এখানে চারবার করে শাড়ি বদলাতে যেতে হবে হোটেলে। সে এক ধকল। তার জন্য একসঙ্গে চারটি শাড়ি পড়ে নিয়েছি। এক একটা দৃশ্য শেষ হবে, এক একটা শাড়ি খুলে ফেলব।” ছায়া দেবীর এই অকপট স্বীকারোক্তি শুনে শুধু তপন সিংহই নন, ওই শুটিং জোনে যাঁরা যাঁরা ছিলেন সবাই তখন হেসে খুন। ভাবছিলেন ছায়া দেবীর মাথাতে এইসব ব্যাপারে থাকেও বটে।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৩: সারদা মায়ের দার্শনিক দৃষ্টি
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৯: কবির ভালোবাসার পশুপাখি
শুধু ছায়া দেবী নন, বাকি তিনজন বিধবা চরিত্রের অভিনেত্রী অর্থাৎ ভারতী দেবী রেণুকা রায় রুমা গুহঠাকুরতা— এই চারজনে মিলে ১৯৬৩সালে ভারতের চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ নায়িকার পুরস্কারটা পেয়েছিলেন। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৩ সালের ১৭ মে মিনার, বিজলী, ছবিঘর এই চেইনে। ছবিটি খুব সাড়া জাগিয়েছিল দর্শক মনে। এই ছবির কাহিনিকার সমরেশ বসুর জন্মের শতবর্ষ চলছে। ১৯২৪ সালের ১১ডিসেম্বর এই লেখকের জন্ম হয়েছিল। এই লেখার মধ্য দিয়ে সেই বরেণ্য লেখকের উদ্দেশে রইল আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।
* পর্দার আড়ালে (Behind the scenes) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।