শুক্রবার ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন, ঢাকা

কাজল দেবনাথের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাত প্রায় সাড়ে ন’টা৷ ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণ তখন শুনশান৷ রাত দশটায় ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের গেট বন্ধ হয়ে যায়৷ ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে গোপীবাগে রামকৃষ্ণ মিশন রিকশয় প্রায় আধ ঘণ্টার পথ৷ আশ্রমে সময়মতো পৌঁছতে পারব তো? অবশ্য দিনের বেলা ঢাকা শহর যেরকম অসহনীয় যানজটে জেরবার, একটু রাতের দিকে মহানগরের রাস্তাঘাট কিছুটা ফাঁকা হয়৷ কাজলবাবু তাঁর প্রাইভেট কারে আমাকে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব দেন৷ ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলাম, ‘একটা সাইকেল রিকশ ধরে রামকৃষ্ণ মিশনে পৌঁছে যাব৷’

ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে বেরোতেই একটা ব্যাটারিচালিত সাইকেল-রিকশ পেয়ে গেলাম৷ ঢাকা শহরে কয়েক লক্ষ সাইকেল-রিকশ৷ এর অর্ধেকই ব্যাটারিচালিত ও বে-আইনি৷ এ ধরনের রিকশয় চালককে প্যাডেল করতে হয় না৷ অবশ্য চালকের দু’পা অদ্ভুত কায়দায় দুটো প্যাডেলের ওপরই থাকে৷ ব্যাটারিতে রিকশ বেশ জোরেই ছোটে৷ বে-আইনি হলেও পুলিশ এ ধরনের রিকশ কেন আটক করে না তা বলতে পারব না৷ আশপাশে আর কোনও রিকশ না পেয়ে নুরুল ইসলামের এরকম একটা অবৈধ যানেই আমাকে বাধ্য হয়ে উঠতে হল৷ তবে একটা কথা না মেনে উপায় নেই যে, বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকার অধিকাংশ রিকশই দেখতে বেশ ছিমছাম৷ তবে ভাড়াও মন্দ নয়৷

নুরুলের রিকশর পিছনে বাহারি হরফে লেখা কয়েকটি কথা—‘নিপুণ ভালোবাসার গুণ৷’ সে রিকশ চালাতে চালাতে বেশ গর্বের সঙ্গে বলল, ‘বাবু, এ হইল গিয়া আমাগো একখানা সিনেমার নাম৷ সোন্দর নাম, তাই না?’ আমিও ওর কথায় সায় দিলাম৷ বেশ ফুরফুরে মেজাজে কী একটা গান ধরল নুরুল—‘উইড়্যা যাইমু পাংখা মেইল্যা৷’… রিকশর হর্নও সুরেলা—‘টুই…টুই…টুই-ই৷’ আবার কখনও অ্যাম্বুলেন্সের হালকা সাইরেন বাজছে রিকশয়৷ সেই মুহূর্তে আমারও যেন মনে হল, নুরুলের জরিআঁটা ত্রিপলের ঘোমটা পরা রিকশ সত্যিই দু-পাশে দুটো পাখনা মেলে যেন উড়ছে৷ পাশ দিয়ে লাল-সবুজ দোতলা বাস হুসহাস শব্দ করে দৌড়চ্ছে৷ বাসগুলোর সামনে ‘অশোক লেল্যান্ড’ কোম্পানির ছাপ মারা৷ তার মানে এই বাসগুলো ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে৷ অনেকটা ট্রামের মতো দেখতে দু-চারটে ট্রলিবাসও চোখে পড়ল৷

বঙ্গবন্ধু মুজিব রোডের একপাশ দোকানদারদের দখলে৷ ডানহাতে রাজধানী হোটেল ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছি, কথায় কথায় জানতে পারলাম, নুরুলও প্রায় প্রতিদিনই ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যাওয়ার সওয়ারি পায়৷ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘শুনছি ঢাকেশ্বরী মা মানুষজনের মানতের কথা মন দিয়া শোনেন৷’

সেই মুহূর্তে ভাবছিলাম, বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ছোট-বড় দেবালয় রয়েছে বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই৷ দেশভাগের অব্যবহিত আগে ও পরে একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা ও হিন্দুদের দেশত্যাগ গোটা দেশ জুড়ে চরম বিপর্যয় ডেকে আনে৷ যার রেশ স্বাভাবিক নিয়মেই মন্দিরগুলোর ওপরও এসে পড়ে৷ হিন্দু সম্পত্তি জবরদখল, খুন-জখম, মন্দির ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে উপর্যুপরি হামলা, বিগ্রহ ভাঙচুর, ধর্ষণ ও দেশ থেকে চিরতরে বিতাড়নে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় চোখের জলে বুক ভাসিয়েছে৷ তাঁদের আশ্বস্ত করার মতো, নিরাপত্তা দেওয়ার মতো কাউকেই আশপাশে পাওয়া যায়নি৷

সাম্প্রদায়িক হামলা আরও ন্যক্কারজনক চেহারা নেয় ছয়ের দশকে আয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময়৷ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের মিলিত আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত ও মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল বহু মন্দির ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান৷ এর মধ্যে ঐতিহাসিক রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ীর আশ্রম অন্যতম৷ সাধারণ মানুষের পাশাপাশি নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল বহু সাধু-সন্ন্যাসীকেও৷

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে অনেক মন্দির ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নতুন করে আর নির্মাণ করা হয়নি৷ এমনকী আজও মন্দিরে আগুন লাগানো ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে চলেছে৷ বলা বাহুল্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ যাতে বিনষ্ট হয় সে চেষ্টাই লাগাতার চালিয়ে যাচ্ছে ধর্মান্ধ ও সমাজবিরোধী একটি শ্রেণি৷ মন্দির ও মসজিদ পাশাপাশি থাকুক চায় না তারা৷ এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম প্রথম শ্রেণির দৈনিক ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ প্রকাশিত একটি খবর এখানে তুলে ধরছি৷ সংবাদের শিরোনাম—‘বাগেরহাটে দুর্গামন্দিরে আগুন’৷ প্রতিবেদনটি এরকম—‘বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার নোয়াপাড়ার একটি দুর্গামন্দিরে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা৷ বৃহস্পতিবার গভীর রাতে দুর্বৃত্তরা মন্দিরটিতে আগুন দেয় বলে স্থানীয়রা জানায়৷ আগুনে কয়েকটি প্রতিমা পুড়ে ও ভেঙে যায়৷ এ নিয়ে গত এক বছরে এই মন্দিরটিতে তিনবার ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটল৷ ফকিরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ও.সি.) আনোয়ার হোসেন জানান, উপজেলার নোয়াপাড়া এলাকার পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির শৌনাল ঘোষের দুর্গামন্দিরে কে বা কারা রাতের আঁধারে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়৷ এতে মন্দিরের কয়েকটি মূর্তি আগুন লেগে পুড়ে যায় এবং পড়ে ভেঙে যায়৷ খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে৷ এ ব্যাপারে থানায় মামলা হয়েছে৷ একের পর এক একই মন্দিরে আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আটক করা হবে৷’

৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যার বিচারে কিন্তু হিন্দুরাই বেশি মারা পড়েছে৷ সাধারণ মানুষ তো বটেই, মুক্তিবাহিনীর হিন্দু সদস্যরাই মূলত পাকিস্তানি সেনার ‘টার্গেট’ হয়েছে৷ অথচ যে জন্মভূমির জন্য হিন্দুরা নিজেদের জীবন বিসর্জন দিল, সেই মাটি থেকে তাদের চিরবিদায় নিতে হয়েছে৷ আজও সেই বিতাড়ন সমানে চলেছে৷

এবার এমন একটা ঘটনার কথা শোনাব যা পাঠকদের রীতিমতো চমকে দেবে৷ এমনকী পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠলেও আশ্চর্য হব না৷ এরপর মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেওয়া কি সত্যিই সম্ভব? যাকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা সেই হিন্দু মুক্তিযোদ্ধার নামধাম ইচ্ছা করেই গোপন রাখলাম৷ তবে এটুকু জানিয়ে রাখি ভদ্রলোকের বাড়ি ছিল বরিশাল জেলার এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে৷ ভদ্রলোকের স্ত্রী মারা গিয়েছেন৷ তাঁদের একটিই মেয়ে কলেজে পড়ত৷ পরমাসুন্দরী৷ বাবা ও মেয়ের দিন কাটে সুখে-দুঃখে৷ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভদ্রলোক একটা সরকারি চাকরি করতেন৷ কিন্তু মেয়েকে একা বাড়িতে রেখে শহরে চাকরি করতে যেতে হয় বলে সেই কাজ ছেড়ে দেন তিনি৷ কিছু জমিজমা ছিল, লোক দিয়ে চাষবাস করাতেন৷ সংসার বলতে তো দু’জন৷ দিব্যি চলে যাচ্ছিল৷

মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা হয় ভদ্রলোকের৷ অথচ বিয়ের কথা শুনলে মেয়ে কান্নাকাটি করে৷ বাবাকে একা ফেলে শ্বশুরবাড়িতে যাবে না সে৷ কিন্তু ভদ্রলোকের চিন্তা অন্য কারণে৷ গ্রামে বিয়ের উপযুক্ত তেমন হিন্দু পাত্র নেই৷ এদিকে কলেজে যাতায়াতের পথে মাঝেমধ্যেই মেয়েটিকে বিরক্ত করে দু’চারজন মুসলমান ছেলে৷ ক্রমশ ছেলেগুলোর সাহস বাড়ে৷ পুলিশে ইভটিজিং-এর অভিযোগ জানিয়েছিলেন ভদ্রলোক৷ বদমাইশ ছেলেগুলোকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে বেশিদিন গারদে পুরে রাখতে পারেনি৷ ছেলেগুলো গ্রামে ফিরে এসে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াতে লাগল৷ আর ওই হিন্দু পরিবারটিকে নানাভাবে জ্বালাতন করত৷

বাংলাদেশের বেশিরভাগ গ্রামেই হিন্দু পরিবারগুলো অশান্তির ভয়ে মুসলমান প্রতিবেশীদের সঙ্গে অযথা ঝামেলায় জড়াতে চায় না৷ অনেক সময় অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করে৷ এড়িয়ে যেতে চায়৷ ওই মুক্তিযোদ্ধা ভদ্রলোক সিদ্ধান্ত নিলেন জমি-জায়গা বিক্রি করে ভিটা-মাটি ছেড়ে চলে যাবেন৷ নইলে মেয়েকে বাঁচাতে পারবেন না৷ কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল এক মর্মভেদী ঘটনা!

এক ঝড়-জলের রাতে মুখে কালো কাপড় বেঁধে কয়েকজন দুষ্কৃতী চড়াও হল ওই মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে৷ এতগুলো বদমাইশের বিরুদ্ধে একা কী করবেন তিনি৷ যুদ্ধক্ষেত্রে খান সেনাদের গুলি করে হত্যা করতে যাঁর একবারও হাত কাঁপেনি, সেই অকুতোভয় মানুষটিরও এবার বুক কেঁপে উঠল৷ কী ঘটতে চলেছে বুঝতে এতটুকুও বিলম্ব হল না তাঁর৷ এবার তিনি মেয়েকে বাঁচাবেন কী করে? তাঁর আর্ত চিৎকার এমন ভয়াল রাতে কার কানে পৌঁছবে?

নিষ্পাপ মেয়েটি যখন গণধর্ষণের শিকার হতে চলেছে, ওই নরপিশাচগুলোর সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে এক অসহায় পিতা অন্তত তাঁর মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করেছিলেন৷ কিন্তু ওই নরাধমগুলো তাতে কর্ণপাত করেনি৷ একবার গণধর্ষণের শিকার হলে মেয়েকে হয়তো আর বাঁচানো যাবে না৷ তখন মরমে মরে যাওয়া এক বাবা নিজের ভাগ্যকে ধিক্কার দিতে দিতে বুক চাপড়ে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠেন৷ ওই নরকীটগুলোকে এক এক করে মেয়ের ঘরে যাওয়ার অনুরোধ করেন৷ তাদের বলতেও শোনেন—থানায় গিয়া নালিশ কইরা আসন? দেখামু আইজ৷… এরপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত৷ পরদিন সকালে রক্তাক্ত, অচৈতন্য মেয়েকে দু’চারজন সহৃদয় গ্রামবাসীর সহায়তায় স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে কোনওমতে সুস্থ করে তোলেন পাগলপ্রায় ভদ্রলোক৷

আর সব হারিয়ে সেই মুহূর্তে মেয়েটির মানসিক অবস্থা যে কী তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ পুলিশি তদন্ত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু অপরাধীরা ধরা পড়েনি৷ এই ঘটনার পর গাঁ ছেড়ে ভদ্রলোক তাঁর হতভাগী মেয়েকে নিয়ে কোথায় গেলেন কেউ জানে না৷

গোটা ঘটনাটা শুনেছিলাম আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর মুখে৷ এর থেকে করুণ আর কী হতে পারে! বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে আজও হিন্দু মেয়েরা অনেক সময়ই কিছু কিছু চরিত্রহীন মুসলমান যুবকের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে প্রতারিত হয়৷ অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ঘটনাও কম নয়৷ তখন হয় গর্ভের সন্তান নষ্টের পর মাথা নিচু করে বাপের বাড়িতে আশ্রয়, নয় তো বাধ্য হয়ে মুসলিম ধর্ম নিয়ে স্বামীর সংসার করা৷ আর যাদের কোনও দিকেই গতি হয় না, শেষপর্যন্ত ঠাঁই হয় গণিকালয়ে কিংবা আত্মহত্যা৷

কাজল দেবনাথকে বরিশালের ঘটনাটির কথা বলেছিলাম৷ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘গ্রাম-গঞ্জের পরিবেশ কোথাও কোথাও সত্যিই বেশ খারাপ৷ বিশেষ করে হিন্দু মেয়েদের খুব সাবধানে থাকতে হয়৷ হিন্দু মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তার ব্যাপারটা নিয়ে ইতিমধ্যেই হাসিনা সরকারের সঙ্গে আমরা কথাবার্তা বলেছি৷ তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, এরকম ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে সে ব্যাপারে তাঁর সরকার সমুচিত পদক্ষেপ নেবে৷’
—আপনি কি সত্যিই মনে করেন বাংলাদেশের হিন্দু মেয়েরা ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচবে? হাসিনা সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারবে?
—মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া এই প্রতিশ্রুতির প্রতি আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে৷ তিনিও তো একজন মহিলা৷ নারীর দুঃখ-কষ্ট একজন নারীই ভালো বুঝতে পারেন৷

এরপর কাজলবাবু বললেন, ‘খুবই দুঃখের কথা আমাদের দেশে হিন্দু মেয়েদের প্রায়শই নানা বিপদের সম্মুখীন হতে হয়৷ সরকারের ওপর আমরা চাপ বাড়াচ্ছি৷ আস্থাও রাখছি৷’ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন হিন্দু মেয়েরা ধর্ষিতা হচ্ছে৷ এমনকী কিশোরীরাও লালসার শিকার৷ এই অনাচার দূর করতে কেন আপনারা জনমত গঠন করছেন না?’ কাজলবাবু বললেন, ‘ঠিক কথা৷ জনমত গঠনের পাশাপাশি আরও একটা কাজ আমাদের করতে হবে৷ এই যে প্রতিদিন মন্দির ও বিগ্রহ ভাঙা হচ্ছে, মন্দিরের সম্পত্তি জোর করে দখল করে নেওয়া হচ্ছে, এসবের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়াই করতে হবে৷ অপরাধীদের কোনও বিচার হচ্ছে না৷ এটাই দুর্ভাগ্যজনক ও দুঃখজনক ব্যাপার৷’

হাসিনা সরকারের কাছে কাজলবাবুদের কয়েকটি দাবি এরকম, যেগুলো তাঁরা শেখ হাসিনার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ডঃ গওহর রিজভিকেও জানিয়েছেন৷
যারা এইসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের দ্রুত বিচার করে দৃশ্যমান শাস্তি দিতে হবে৷
যে এলাকায় অত্যাচার হয়েছে সেই এলাকার এম পি-কে সতর্ক করা যাতে এরকম ঘটনা আর না ঘটে৷ প্রয়োজনে ওই জনপ্রতিনিধিকে শো-কজও করতে হবে৷
গত সাধারণ নির্বাচনে হিন্দুদের ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার হয়েছিল৷ এই ঘটনার প্রতিবাদে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন কমিটি বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় দুর্গাপুজোর জন্য সরকারের কোনওরকম আর্থিক সাহায্য নেবে না৷ চাল ও বস্ত্রও নেবে না যতদিন না পর্যন্ত সরকার এ ব্যাপারে কোনও কার্যকরী ভূমিকা নেয়৷
রাষ্ট্রযন্ত্রকে রামুর (বৌদ্ধ মন্দির) মডেলে সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু মন্দির যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সারিয়ে দিতে হবে৷
শেখ হাসিনা বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদকে সরকারিভাবে জানিয়েছেন যে, হিন্দু মন্দির ও হিন্দুদের যেসব বাড়িঘর ভেঙে দেওয়া হয়েছে সেগুলো সেনাবাহিনী আবার নতুন করে তৈরি করে দেবে৷ হিন্দুদের বিরুদ্ধে নানা অপরাধে অপরাধীদের দ্রুত বিচারের ব্যাপারেও সুপ্রিম কোর্টের কাছে তিনি আবেদন করেছেন৷

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকটি বৌদ্ধবিহার রয়েছে, যেগুলো নানাভাবে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের গুন্ডাবাহিনী ভেঙেচুরে মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বারবার৷ চাকমারা হল পার্বত্য চট্টগ্রামের সবথেকে বড় উপজাতি৷ একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামে হিন্দুর সংখ্যা ছিল ৩৬ হাজার৷ বৌদ্ধ ও মুসলমান যথাক্রমে ৮৩ হাজার ও ৫ হাজার৷ এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্রমশ হিন্দুর সংখ্যা কমেছে৷ এই অঞ্চল খাগড়াছারি, রাঙামাটি ও বান্দারবন তিন জেলায় বিভক্ত৷

সাতের ও আটের দশকে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার আওয়াজ তুলে পার্বত্য চট্টগ্রামে গেরিলা বাহিনীর জন্ম৷ এর নাম শান্তি বাহিনী৷ বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সরাসরি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে তারা৷ শেষপর্যন্ত ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয় শান্তি বাহিনীর৷ কিন্তু তাতেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও বিভিন্ন উপজাতি—চাকমা, মারমা, ত্রিপুরীর ওপর সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অত্যাচারের মাত্রা এতটুকুও কমেনি৷ বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দির বারবার ধ্বংস করা হয়৷ বহু নিরীহ চাকমাকে মুসলমান সম্প্রদায়ের ঘাতক বাহিনী হত্যা করে৷ সংখ্যালঘু মহিলারাও ধর্ষিতা হন৷ চাকমাসহ সংখ্যালঘু অনেককেই জোর করে ধর্মান্তরিত করার অভিযোগও উঠেছিল৷

এবার আসি রামুর প্রসঙ্গে৷ চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলার নাম ‘রামু’৷ কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০ কিমি৷ পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত এটি৷ সামনে দিগন্তবিস্তৃত বঙ্গোপসাগর৷ আর একদিকে ছোট-বড় পাহাড়৷ এরকম নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য বড় একটা দেখা যায় না৷ চট্টগ্রাম শহরের ১৫২ কিমি দক্ষিণে এই কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত৷ যাঁরা বাংলাদেশ ভ্রমণে যাবেন, কক্সবাজার অবশ্যই দেখবেন৷

‘রামু-মডেল’ কী?
রামু এমনই এক জায়গা যেখানে বিভিন্ন ধরনের বৌদ্ধ মন্দির, বহু বুদ্ধমূর্তি ও মন্যাস্ট্রি রয়েছে৷ এখানেই একটি ৬ ফুট উঁচু বেদির ওপর ১৩ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট বুদ্ধমূর্তিটি দর্শকদের আকর্ষণ করে৷ মন্যাস্ট্রির ভেতরের কাঠের কারুকার্য দৃষ্টিনন্দন৷
কক্সবাজার থেকে প্রায় ১৬ কিমি দূরে চট্টগ্রাম শহরে যাওয়ার পথে হাইওয়ের ধারে বৌদ্ধদের গ্রামের নামও ‘রামু’৷ এই গ্রামে সোনার এমন কয়েকটি বুদ্ধমূর্তি রয়েছে যেগুলো নানা দামি পাথরে খচিত৷ রামুর মন্যাস্ট্রি ও বৌদ্ধমন্দিরগুলো কিছুদিন আগে সাম্প্রদায়িক শক্তি ভেঙে তছনছ করে৷ এই ঘটনার পর স্থানীয় এলাকায় তো বটেই, গোটা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু মহলে ধিক্কার ওঠে৷

এমন কথাও শুনলাম, এরকম একটা সাংঘাতিক ঘটনার কথা জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানায় চিন৷ ওই দেশের সরকার নাকি এ মর্মে বাংলাদেশ সরকারকে হুঁশিয়ারি দেয় যে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে রামুর ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ মন্দিরগুলোকে সরকারি অর্থে পুনরায় আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে হবে৷ এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার যদি কোনও গড়িমসি করে তাহলে চিন-বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্কে তার আঁচ পড়বে৷

চিনের এই প্রচ্ছন্ন হুমকি শোনার পরই নাকি বাংলাদেশ সরকার তড়িঘড়ি সরকারি সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় যে, যত শীঘ্র সম্ভব রামুর ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধমঠ-মন্দিরগুলো পুনর্নির্মাণ করা হবে৷ আর সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্মাণ কাজও শুরু হয়৷
রামু-তে যে গুরুত্ব ও দ্রুততার সঙ্গে বৌদ্ধ মন্দিরগুলো পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে, সেই দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু মন্দিরগুলোকেও নতুন করে তৈরি করার দাবি তোলা হয়৷

‘বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ-’এর চট্টগ্রাম শাখার অন্যতম কর্মকর্তা তাপস হোড় ক্ষোভের সঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে বহু হিন্দু মন্দির ভেঙেচুরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ অথচ ভারত সরকার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দূরের কথা, এ ব্যাপারে ন্যূনতম সহানুভূতিও প্রকাশ করে না৷ আমরা তাহলে যাই কোথায় বলতে পারেন?’

রাত দশটা নাগাদ নুরুলের রিকশয় রামকৃষ্ণ মিশনে পৌঁছলাম৷ আশ্রমের সন্ন্যাসী শ্রদ্ধেয় অমল মহারাজ তখনও জেগে রয়েছেন৷ বেশ গরম পড়েছে৷ আশ্রমের মাঠে বসে কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন৷ আমাকে দেখে বললেন, ‘আজ এত দেরি?’ বললাম, ‘সোজা ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে আসছি৷’
—খাওয়াদাওয়া নিশ্চয়ই হয়নি?
আমি নিরুত্তর দেখে স্মিত হেসে বললেন, ‘আমি বলে দিচ্ছি, ডাইনিং হলে গিয়ে খেয়ে নিন৷’
অমল মহারাজ খাওয়ার ব্যবস্থা না করে দিলে সারারাত খিদের জ্বালায় কষ্ট পেতাম৷ অমল মহারাজের সহৃদয়তার কথা ভোলা যায় না। —চলবে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content