শুক্রবার ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


শ্রীশ্রীরমনা কালীমন্দিরে দুর্গাপুজোয় আরতি৷

১৯৮৬ সালে রমনা কালীমন্দির পুনরুদ্ধারে নতুন করে আন্দোলনের কর্মসূচি নেয় পূজা উদযাপন পরিষদ৷ সেই আন্দোলন ক্রমশ তীব্রতর হয়ে ওঠে৷ সেই বছরের সবচেয়ে বড় ঘটনা হল, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ৫০০তম আবির্ভাব বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতীয় মহোৎসবের আয়োজন৷ এই উপলক্ষে ঢাকায় স্মরণকালের বৃহত্তম মিছিল বেরোয়৷

১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে নজিরবিহীন বন্যায় দুঃস্থ ও নিঃস্ব মানুষদের সেবায় মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি পুজোর ব্যয় ২০ শতাংশ কমিয়ে বন্যা ত্রাণ তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়৷ এছাড়া সারা দেশে পুজো উপলক্ষে আড়ম্বর ও সাজসজ্জা পরিহারেরও আহ্বান জানানো হয়৷ সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী আন্দোলনকে আরও সংগঠিত করার জন্য কমিটির সদস্যরা একাত্ম হয়ে কাজ করে চলেছেন৷
কাজলবাবু বললেন,—
আমাদের প্রথম স্লোগান ছিল—পূজা আমার উৎসব সবার৷
দ্বিতীয় স্লোগান ছিল—ধর্ম যার যার উৎসব সবার৷
এতদিনে এই দুটো স্লোগানের মূল অর্থে মোটামুটি পৌঁছেছি৷ মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেক মহিলা ও পুরুষই পূজা মণ্ডপে এসে প্রতিমা দর্শন করেন৷ উৎসবের আনন্দ উপভোগ করেন৷ আমরাও তাঁদের ইফতার পার্টিতে অংশগ্রহণ করি৷ দোকানে কোনও শাঁখাপরা মহিলা ক্রেতা দেখলে রোজা ভাঙার সময় মুসলমান দোকানদারও বলেন, দিদি একটু কিছু খাইয়া যান৷

আমাদের স্লোগানের এখন প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়াসহ বেশ কয়েকজন নেতা-নেত্রীর কণ্ঠে৷ শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকুন বা না থাকুন প্রতি বছর পূজায় মহানবমীর দিন ঢাকেশ্বরী মন্দির ও রামকৃষ্ণ মিশনে আসেন৷ আমাদের মণ্ডপে আরতি প্রতিযোগিতায় মুসলমান ছেলেরা প্রথম হয়েছে বেশ কয়েকবার৷ এমনকী আরতি শুরু করার আগে মা দুর্গার কাছে প্রাণ-মন সমর্পণ করে মনঃসংযোগের পর যেভাবে হাতে ধুনুচি তুলে নিতে হয়, মুসলমান ছেলেরা তেমনই করে৷ কিন্তু…৷’

কিন্তু কী? একথা জিজ্ঞাসা করতেই কাজলবাবু কিছুটা দুঃখের সঙ্গে বললেন, ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’—এ জায়গায় এখনও পৌঁছতে পারিনি৷ রাষ্ট্র সবার এরকম এক পরিবেশে পৌঁছতে হলে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় হিন্দুদের আরও বেশি অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে৷ চাই সমমর্যাদা ও সমানাধিকার৷ শুধু হিন্দু নয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এদেরও একইরকম সুযোগ দেওয়া দরকার৷ আদিবাসীদের কথাও ভাবা প্রয়োজন৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ম কিন্তু আমাদের চলার পথে কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি৷’

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬-তে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলন (স্বাধিকার আন্দোলন), ৬৯-এর গণ আন্দোলন কিংবা ৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায় নিজের নিজের ধর্ম ভুলে গিয়ে সংঘবদ্ধ হয়েছিল৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় একটু স্বস্তির পরিবেশ ফিরে আসতেই তখন বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে ভেদাভেদের চিন্তা শুরু হয়৷

কাজলবাবুর মুখে শুনলাম, বাংলাদেশের মাননীয় রাষ্ট্রপতি তাঁর বাসস্থান বঙ্গভবনে ঢাকা শহরের বিশিষ্ট হিন্দুদের বছরে দু’বার নেমন্তন্ন করেন৷ শুভ বিজয়া দশমীর দিন সকালে ও জন্মাষ্টমীর দিন৷ উকিল-ব্যারিস্টার, শিক্ষাবিদ্ সমাজসেবী প্রায় ৭০০-৮০০ পুরুষ ও মহিলা অতিথি৷ জন্মাষ্টমীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও হিন্দুদের নেমন্তন্ন করেন৷

জন্মাষ্টমী উপলক্ষেও সমগ্র বাংলাদেশে শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন দৃশ্যপট নিয়ে শোভাযাত্রা বেরোয়৷ ঢাকায় জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রাকে অনায়াসে ঐতিহাসিক আখ্যা দেওয়া যায়৷ আরেকটি ঐতিহাসিক মিছিল মহরমের৷

১৯৪৭ সালের পর মাত্র দু’বছর জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল৷ ৫০ সালের দাঙ্গার পর এই শোভাযাত্রা সরকার বন্ধ করে দেয়৷ দীর্ঘ ৩৫ বছর জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা পুরোপুরি বন্ধ ছিল৷ এতবড় অন্যায় হিন্দুরা মুখ বুজে সহ্য করেছিল৷ সুদীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হয় আটের দশকের শেষাশেষি সময়ে৷ বাংলাদেশ সরকার একরকম বাধ্য হয়েই জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রার ওপর থেকে ‘ব্যান’ তুলে নেয়৷ ঢাকা শহরে সেই বছর জন্মাষ্টমীর বিরাট শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে হিন্দুদের আনন্দের বাঁধ ভাঙে৷ ক্রমশ বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা ছড়িয়ে পড়ে৷

বাংলাদেশে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে ঘরে ঘরে শ্রীকৃষ্ণপুজো, উপবাস, অঞ্জলি, ব্রতকথা শোনা প্রভৃতি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়৷ ঢাকা মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি ও বাংলাদেশ পুজা উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় শ্রীশ্রীগীতাযজ্ঞ হয়৷

কীভাবে ঢাকায় শ্রীশ্রীজন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রার গোড়াপত্তন হয়েছিল? যতদূর জানা যায় ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে বংশালের এক সাধুর নেতৃত্বে সর্বপ্রথম জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা শুরু হয়৷ এর বাইশ বছর আগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর নরলীলা শেষ করেছেন৷ তখন এর নাম ছিল ‘শ্রীশ্রী রাধাষ্টমী’৷

১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে নবাবপুরের ধনী ব্যবসায়ী কৃষ্ণদাস বসাক ও অন্য ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে জাঁকজমক করে জন্মাষ্টমীর মিছিল বেরিয়েছিল৷ ১৭২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইসলামপুরের দুই ব্যবসায়ী গদাধর এবং বলাইচাঁদ বসাকের নেতৃত্বে আরও একটা জন্মাষ্টমীর মিছিল বের হতে শুরু করে৷ উভয়পক্ষের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়৷ তারপর দ্বন্দ্ব৷ তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার অবস্থার গুরুত্ব বিবেচনা করে দু’পক্ষকেই দু’দিন শোভাযাত্রা বের করার অনুমতি দেয়৷

আশ্চর্যের ব্যাপার, জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রায় হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানরাও পায়ে পা মেলাত৷ বিভিন্ন দৃশ্যপট ও নৃত্য-গীতের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের লীলা ও জীবনকাহিনি তুলে ধরা হত৷ ১৯৮৮ সালে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা আবার শুরু হয়৷ উল্লেখ্য, ঢাকার নির্বাচিত মেয়র মঙ্গলদীপ জ্বালিয়ে শোভাযাত্রার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করতেন৷

রাজ্যহারা রাজা সুরথ মেধস মুনির পরামর্শে বসন্তকালে শ্রীশ্রীচণ্ডীর পুজো করেন৷ মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবী চণ্ডীই হলেন দেবী দুর্গা যিনি কালক্রমে মহিষাসুরমর্দিনীরূপে পূজিতা৷ শ্রীরামচন্দ্র রাবণবধের জন্য অকালে দেবী দুর্গার পুজো করেছিলেন শরৎকালে৷ আশ্বিন অথবা কার্তিকের শুক্লপক্ষে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় মূলত অকালবোধনে শারদীয় দুর্গাপুজো করে থাকে৷ ঐতিহাসিকদের মতে, এই বঙ্গদেশে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ রায়৷ মতান্তরে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮২)৷

জীমূতবাহনের (১০৫০-১১৫০) দুর্গোৎসবনির্ণয়, বিদ্যাপতির (১৩৭৪-১৪৬০) দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী, শূলপাণির (১৩৭৫-১৪৬০) দুর্গোৎসববিবেক, কৃত্তিবাস ওঝার (১৩৮১-১৪৬১) রামায়ণ, বাচস্পতি মিশ্রের (১৪২৫-১৪৮০) ক্রিয়াচিন্তামণি, রঘুনন্দনের (১৫০০-১৬০০) তিথিতত্ত্ব প্রভৃতি গ্রন্থে দুর্গাপুজোর বিস্তৃত বর্ণনা থাকার জন্য সংগত কারণেই অনুমান করা হয় যে, বাংলায় দুর্গাপুজোর প্রচলন ছিল একাদশ শতকেই৷

একথা অনস্বীকার্য জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গাপুজোর প্রচলন রাজা কংসনারায়ণের আমলেই৷ এ তথ্যই বহুল প্রচলিত৷ দুর্গাপুজো একসময় রাজা, জমিদার ও সচ্ছল পরিবারেই হত৷ আয়োজক ছিলেন তাঁরাই৷ প্রজারা মেতে উঠত দুর্গাপুজোর আনন্দে৷ মায়ের সন্ধ্যারতির পর শুরু হত যাত্রাপালা, কবিগান, নর্তকী-বাইজির আকর্ষণীয় নাচ-গান, উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর কত কী! এসবের সঙ্গে বসত মেলা৷

ষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পাঁচদিন পুজো৷ কিন্তু উৎসব চলত মাসব্যাপী৷ পরবর্তী সময়ে বারোয়ারি পুজো শুরু৷ আজকের সর্বজনীন পুজোর তো আবার আলাদা চেহারা৷ সকলে চাঁদা তুলে দুর্গাপুজোর আয়োজন, হইচই, হাসি-আনন্দ, খাওয়া-দাওয়া কত কী! এত আলো, এত আনন্দের নীচেও কিন্তু চাপা পড়ে না কত শত মানুষের জীবনযন্ত্রণার ছবি৷ দারিদ্রের কষ্ট৷ তবুও এই দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে দরিদ্র মানুষরাও তাদের অভাব-অভিযোগ দিনকয়েকের জন্য হলেও ভুলে থাকতে চায়৷ —চলবে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content