শনিবার ৯ নভেম্বর, ২০২৪


মহাষ্টমীর অঞ্জলি৷

কাজল দেবনাথের সঙ্গে একবার গল্প করতে বসলে সময় কোথা দিয়ে চলে যায় বোঝা যায় না৷ জিজ্ঞাসা করলাম, ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা মিলিয়ে অনেকগুলো সর্বজনীন পুজো-কমিটি রয়েছে৷ প্রতিটি পুজোই ধুমধাম করে হয়৷ তাহলে আলাদা করে মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি গঠনের প্রয়োজন হল কেন? বরং এতে হিন্দুদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা বেশি৷

কাজলবাবু বললেন, ‘ঢাকা শহরে অনেক পূজা কমিটি থাকলেও মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি একটু ব্যতিক্রমধর্মী৷ বৃহত্তর ঢাকা মহানগরের যে কেউ এই কমিটির সদস্য হতে পারেন৷ ভুল বোঝাবুঝি হবে কেন? মহানগরের সমস্ত পূজা-কমিটির মধ্যে সমন্বয় সাধনই আমাদের মূল লক্ষ্য৷’

কাজলবাবু গল্পের মতো বলছিলেন, ‘বাংলা ১৩৮৫ (১৯৭৮ ইং)৷ তখন বর্ষার শেষ৷ শরতের শুরু৷ টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল৷ সেদিন বিকেলে দীপুদা (জয়ন্ত সেন) আর আমি মোটর সাইকেলে তোপখানা সড়ক ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম৷ কথা হচ্ছিল আসন্ন দুর্গাপূজা নিয়ে৷ হঠাৎ দীপুদা বলে উঠল, নতুন ঢাকায় সবাই মিলে একটা বারোয়ারি পূজা করলে কেমন হয়? ব্যস, আলোচনার পরই ঢাকার কয়েকজন বিখ্যাত মানুষকে নিয়ে আমাদের দুর্গাপূজার প্রথম মিটিং হল ইঞ্জিনিয়ার প্রফুল্লকুমার হালদারের বাড়িতে৷

এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়ে মিটিঙে যোগদান করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, পাকিস্তান সরকারের প্রাক্তন যুগ্মসচিব কমলভূষণ রায়চৌধুরি (কে. বি. রায়চৌধুরি), মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল চিত্তরঞ্জন দত্ত (বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত), আইনজীবী, সাংসদ ও প্রাক্তন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর অসিতকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, বাংলাদেশ বিমানের তৎকালীন কর্মকর্তা চিত্তরঞ্জন সরকার, সুধাংশুশেখর হালদার, অনিলচন্দ্র নাথ প্রমুখ৷ এমনকী আমাদের মাসিমা, কাকিমা, বউদি ও দিদিরাও পিছিয়ে থাকেননি৷ পূজার ব্যাপারে প্রচণ্ড উৎসাহ দিলেন আমাদের৷’

মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির প্রথম বছরের বাজেট ছিল ১০ হাজার টাকা৷ কিন্তু শেষপর্যন্ত খরচ গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৪২ হাজার টাকায়৷ প্রতিমার দামই ছিল সাত হাজার টাকা৷ পুজো হয়েছিল ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে শিবমন্দিরের সামনে৷ শুধু পুজোর জন্য পুজোর আয়োজন নয়, বাংলাদেশে হঠাৎ সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানে সেই সময় প্রমাদ গুনেছিল সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়৷

এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ৷ তাঁরা মনে করেছিলেন শারদীয়া দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করেই সেই লক্ষ্যে ধীরে ধীরে এগোনো সম্ভব৷ স্বাধীনতালাভের কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি কীভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তা নিয়েও আলোকপাত করা হবে৷

মহানগর পূজা কমিটির সাজানো-গোছানো অফিসে কাজলবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছিল৷ বললেন, ‘সেই ৭৮ সালের পূজার দিন ঘনিয়ে এল৷ সমস্ত আয়োজন প্রায় শেষ৷ দুর্গতিনাশিনী মায়ের প্রতিমা স্থাপিত হয়েছে দেশের সমস্ত পূজামণ্ডপে৷ এরই মধ্যে বিপদ ঘটল৷ হঠাৎ খবর এল—ঢাকার সদর ঘাটের মোড়ে ভি.আই.পি. স্টোরের পূজামণ্ডপটি প্রশাসনের কিছু লোক ভেঙে দিয়েছে৷ এর ফলে পুরোনো ঢাকার ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও উত্তেজনা৷ কারও কারও দাবি প্রতিবাদস্বরূপ ঢাকার সমস্ত পূজা বন্ধ করে দেওয়া হোক৷

এদিকে বেশিরভাগ হিন্দুর মনে হল, সেরকম কিছু করলে যারা আমাদের পূজা বন্ধ করতে চায় তারা আরও সাহসী হয়ে উঠবে৷ আমাদের নেতৃবৃন্দ তাড়াতাড়ি প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্যার সমাধান করে ফেললেন৷ ঢাকার সমস্ত পুজোমণ্ডপে আমাদের কমিটি থেকে ফোন গেল—আমরা কেউ পুজো বন্ধ করব না৷

না, নিশ্চিন্তে থাকার উপায় ছিল না৷ সুদূর পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই বাঁধের কাছে এক পূজা-কমিটির লোকজন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দুঃসংবাদ দিলেন—বাঁধ কর্তৃপক্ষ তাঁদের এবার পূজা করতে দেবেন না৷ আবার মহানগর সর্বজনীন পূজা-কমিটির নেতৃবৃন্দ ছুটলেন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে৷ এরপর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওই পূজা-কমিটি পূজা করার অনুমতি পেল৷ সেবার ঢাকাসহ সারা দেশের আরও কিছু পূজামণ্ডপের সমস্যার খবর আসে আমাদের কাছে৷ আমাদের কমিটি তা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে৷’

৩৬ বছর আগে মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির যে পুজো শুরু হয়েছিল আজ তা রীতিমতো দর্শনীয় হয়ে উঠেছে৷ শুধু পুজোনুষ্ঠানই নয়, বাংলাদেশের হিন্দুদের সার্বিক ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানাবিধ সমস্যা নিয়ে একটি সংগঠিত নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশে, যা থেকে ১৯৮২ সালে ঢাকেশ্বরী মন্দির অঙ্গনেই জন্ম হয় বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের৷ সারা দেশের অগুনতি পুজো কমিটির কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই পরিষদের কর্মকাণ্ড এখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে৷

১৯৮৩ সালে ঢাকেশ্বরী মন্দির বিদ্যাপীঠ ও ঢাকেশ্বরী মন্দিরে দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপিত হয়৷ পরের বছরেই বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ বাংলাদেশ সরকারের কাছে অন্যান্য দাবির পাশাপাশি ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে জাতীয় মন্দির হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রসঙ্গ তোলে৷ এরপরই গঠিত হল ‘বাংলাদেশ হিন্দু কল্যাণ ফাউন্ডেশন’৷ সে বছরেই অশালীন ‘রাধাকৃষ্ণ’ ছায়াছবির প্রদর্শন বন্ধের দাবিতে হিন্দুরা সারা দেশ জুড়ে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে৷ হিন্দুজাতির ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দেওয়ার অপচেষ্টা হয়৷ রাধা-কৃষ্ণের স্বর্গীয় প্রেমের অপব্যাখ্যা করা হয় ছবিতে, যা কোনওভাবেই বরদাস্ত করা যায় না৷ শেষপর্যন্ত সরকার এই দাবির কাছে নতিস্বীকার করে ছবিটির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করেছিল৷

১৯৮৫-তে মহানগর পূজা কমিটি দুর্গাপুজোর সবরকম আনুষ্ঠানিকতা বর্জন ও শোকপালনের সিদ্ধান্ত নেয়৷ ঢাকার অন্যান্য পুজো কমিটির প্রতিও অনুরূপ আহ্বান জানানো হয়৷ কারণ, সেই বছর ১৫ অক্টোবর শারদীয়া দুর্গোৎসবের প্রাক্কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ৩৯ জন মারা যান৷ জগন্নাথ হলের অ্যাসেম্বলি বিল্ডিংয়ের ছাদ হঠাৎ ভেঙে পড়ে৷ জখম ৪০০ জনেরও বেশি৷ আজও ওই দিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শোকদিবস হিসেবে পালন করা হয়৷

সেই বছরেই দুর্গাপুজো উপলক্ষে প্রথম বাণী প্রদান করেন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মহম্মদ এরশাদ৷ তিনি ঢাকেশ্বরী মন্দিরেও আসেন৷ মন্দিরের প্রথম দফা উন্নয়নের কাজ হাতে নেওয়া হয়৷ হিন্দু কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সরকারি রেজিস্ট্রেশন লাভ ওই বছরেই৷ —চলবে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content