রবিবার ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

প্রতীক্ষার শেষ৷ অবশেষে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ঢাকে কাঠি পড়ল৷ পূজারির ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেলাম৷ আমার হাতঘড়িতে সন্ধ্যা ৭টা৷ প্রতিদিন প্রায় ঘড়ি ধরে এখানে সন্ধ্যারতি হয়৷ আমিও তাড়াতাড়ি নাটমন্দিরে এসে ভিড়ের মধ্যে একটু জায়গা করে নিলাম৷

ঢাকের শব্দে গোটা ঢাকেশ্বরী মন্দির তখন গমগম করছে৷ বেশিরভাগ দর্শনার্থীই করজোড়ে দাঁড়িয়ে৷ অনেক তরুণ-তরুণীকেও দেখলাম ভিড়ের মধ্যে৷ ধূপধুনোর ভালোলাগা গন্ধে নাটমন্দির জুড়ে এক পবিত্র পরিবেশ৷ এর মধ্যেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলাম৷ আমার হাতকয়েক তফাতে ঘোমটা-পরা এক মহিলা নাটমন্দিরের পশ্চিমদিকের একটা স্তম্ভে মাঝে মাঝে মাথা ঠুকছেন, আর বিড়বিড় করে কিছু বলছেন৷ আমারই মতো কেউ কেউ ওই মহিলার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন৷ ব্যাপারটা কী জানার জন্য ততক্ষণে আমার ধৈর্যের বাঁধ টুটেছে৷
ওই ভদ্রমহিলার পিঠে হাত বোলাচ্ছেন এক বয়স্ক মহিলা৷ সম্ভবত তাঁর বাড়ির কেউ৷ কয়েক পা এগিয়ে বয়স্ক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন উনি এরকম করছেন?’ ভদ্রমহিলার চোখে জল৷ ঢাকের শব্দে আমার কথা উনি শুনতে পেয়েছেন তো? আরেকবার জিজ্ঞাসা করতেই আঁচলে চোখ মুছে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এ হইল গিয়া আমার পোলার বউ৷ মায়ের এই মন্দিরে মানত রাখছে৷ এক মাস ধইরা সাঁঝবেলার আরতির সময় এহানে আইব৷ মায়ের সম্মুখে মাথা ঠুকব৷’
কেন এরকম মানত রেখেছেন ভদ্রমহিলার পুত্রবধূ? শুনলাম, বাড়িতে একমাত্র নাতনি খুব অসুস্থ৷ বেশ কিছুদিন হল বিছানায় শোয়া৷ নানারকম চিকিৎসা করিয়েও লাভ কিছু হয়নি৷ অগত্যা মেয়ের প্রাণভিক্ষা চেয়ে ঢাকেশ্বরী মায়ের কাছে মানত৷ ঘোমটার আড়ালে দুঃখিনী মায়ের বেদনার্ত মুখ একঝলক দেখতে পেয়েছিলাম৷ ভাবছিলাম, এক অসহায় মায়ের মনোবেদনা জগজ্জননী কবে শুনবেন?

একসময় সন্ধ্যারতি শেষ হল৷ শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনির হালকা প্রতিধ্বনি হতে থাকে নাটমন্দিরে৷ এরপর হারমোনিয়াম বাজিয়ে ভক্তিসংগীত পরিবেশন করা হবে৷ এসবের মধ্যেই মায়ের পুজো চলতে থাকবে৷ দর্শনার্থীদের আসা-যাওয়া অব্যাহত৷

রাত ৯টায় মন্দির বন্ধ হবে৷ অবশ্য তার আগে দুধ, মিষ্টি ও ফল সহযোগে মন্দিরের তরফে সেদিনের মায়ের পুজো সাঙ্গ হবে৷ মন্দির বন্ধের সময় গ্রীষ্মকালে মূর্তিগুলো কাপড় দিয়ে ঢাকা হয় না৷ শীতের সময়ই শুধু ঢেকে দেওয়া হয়৷
গরমের সময় মন্দির খোলে সকাল ৭টায়৷ টানা দুপুর ২টো পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে৷ এরপর বিকেল ৪টায় একপ্রস্থ ঢাক বাজিয়ে আবার মাতৃদর্শন শুরু৷ শীতকালে মন্দির খোলার সময়টাই শুধু আলাদা, সকাল সাড়ে ৭টায়৷ সকালে ঢাকেশ্বরীসহ দেব-দেবীদের চালকলা নৈবেদ্যদান৷ বাল্যভোগে ফল-ফলাদি৷ প্রতিদিন পঞ্চোপচারে পুজো৷

ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সকালে মঙ্গলারতি বলে কিছু নেই৷ দুপুরে মায়ের অন্নভোগ৷ ঢাকেশ্বরী মাতা ‘চিনিকুরা’ চালের (বাংলাদেশের এক ধরনের উৎকৃষ্ট চাল) অন্ন পছন্দ করেন৷ সঙ্গে নানারকমের ভাজা, তরি-তরকারি, মুগডাল, মিষ্টান্ন প্রভৃতি৷ কোনও ভক্ত মা-কে অন্নভোগ দিতে চাইলে সেবাইতের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে সেই ব্যবস্থা করতে পারেন৷ আবার কোনও দর্শনার্থী দুপুরে ঢাকেশ্বরীর প্রসাদ গ্রহণ করতে চাইলে সেবাইত বন্দোবস্ত করে দেবেন৷ অবশ্য তার জন্য সেই দর্শনার্থীকে সামান্য কিছু অর্থ দিয়ে কুপন সংগ্রহ করতে হয়৷

যশোরে থাকাকালীনই আমার মোবাইল ফোনে বাংলাদেশের সিম ভরে নিয়েছিলাম৷ যেহেতু লেখালেখির কাজে বাংলাদেশে কিছুদিন থাকতে হবে, এখানকার বিভিন্ন লোক ও সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা খুবই দরকার৷ বাংলাদেশের সিম ছাড়া আমি অসহায়৷ কারণ, বাংলাদেশে বসে কলকাতার সিমে ফোন করা মানে প্রতিটি কলের জন্য প্রতি মিনিটে আমাকে ভালোই আই.এস.ডি চার্জ গুনতে হবে৷
আমি তো বাংলাদেশের নাগরিক নই৷ এখানকার সিম পাব কেমন করে?

যশোরের রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সহৃদয় সন্ন্যাসী সুদেব মহারাজ আমার মুশকিল আসান করে দিলেন৷ তাঁর কাছে একটা বাড়তি সিম ছিল৷ উনি সেটা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনার কাজ মিটে গেলে ঢাকা থেকে দেশে ফেরার সময় সিমটা ঢাকায় আমাদের আশ্রমে দিয়ে গেলেই হবে৷ আমি ওটা পেয়ে যাব৷’ প্রসঙ্গক্রমে বলি, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনেই থেকেছি৷ এ ব্যাপারে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অন্যতম ভাইস প্রেসিডেন্ট মহারাজ শ্রদ্ধেয় স্বামী প্রভানন্দজির সেক্রেটারি আশিস মহারাজ আমাকে প্রভূত সাহায্য করেন৷

যশোরে এমন কথাও শুনেছি, একবার বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারলে মোবাইলের সিম জোগাড় করা কঠিন ব্যাপার নয়৷ দু’পয়সা খরচ করলেই নাকি বে-আইনিভাবে সিম মিলে যায়৷

হঠাৎ আমার মোবাইল বেজে উঠল৷ কাজল দেবনাথের ফোন৷ মন্দিরে ওঁর আসার খবর দিয়ে জানতে চাইলেন আমি কোথায়? একটু দূর থেকে দেখলাম, কাজলবাবু মন্দির প্রাঙ্গণেই রয়েছেন৷ দেখা হতেই হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মায়ের সন্ধ্যারতি কেমন লাগল?’ বললাম, ‘চমৎকার!’ বললেন, ‘চলুন আপনাকে আমাদের বারোয়ারি পুজোর পুজোমণ্ডপ দেখিয়ে আনি৷’

বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের দুর্গামণ্ডপটি বেশ বড়৷ সামনে অনেকখানি খোলা জায়গা৷ মাথার ওপর নক্ষত্রখচিত খোলা আকাশ৷ মণ্ডপে দেবী দশভুজার মৃন্ময়ী মূর্তি দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়৷ সবমিলিয়ে অন্যরকম পরিবেশ৷ একসময় দখল হয়ে যাওয়া এই জায়গাটি উদ্ধার করতে পূজা পরিষদকে যথেষ্ট ঝুঁকি নেওয়ার পাশাপাশি বিস্তর ঝঞ্ঝাট-ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে৷ কাজলবাবুর মুখে শুনলাম, বিজয়া দশমীর দিন মহানগর পূজা কমিটির দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় না৷ শুধু কলাবউ ও ঘট বিসর্জন হয়৷

ঢাকা শহরের বিভিন্ন বারোয়ারি পুজোর ৭০/৮০টি প্রতিমা এক জায়গায় একত্রিত করে বিজয়া দশমীর সেই আনন্দমুখর বিশাল শোভাযাত্রা শনৈঃ শনৈঃ এসে পৌঁছয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে৷ তারপর আরও পথ উজিয়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে অবশেষে বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন৷ ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের সমস্ত জেলা ও উপজেলায় দশমীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জন হয়৷ বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অনেকগুলো প্রতিমা একসঙ্গে নিয়ে শোভাযাত্রা করা হলে দৃষ্টিনন্দন হয়৷ গুরুত্বও বাড়ে৷

কেন সারাবছর পূজা উদ্যাপন পরিষদের প্রতিমা মণ্ডপে রাখার পর শুধু মহালয়ার দিনই বিসর্জন দেওয়া হয়?
একবার ঢাকার এক নামী হিন্দু আইনজীবী পরিষদকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণের লাগোয়া জায়গাটি পরিষদের নিজের দখলে রাখতে হলে মায়ের মণ্ডপটি কখনও খালি রাখা যাবে না৷ মণ্ডপে দুর্গামূর্তি থাকলে জায়গাটি পুনর্দখল করা অত সহজ হবে না৷

এরপর প্রয়াত ওই আইনজীবীর কথা মেনে নিয়ে মূর্তিহীন মণ্ডপ না রাখার সিদ্ধান্ত নেয় পরিষদ৷ মায়ের জায়গা স্বয়ং মা-ই রক্ষা করবেন৷ সারাবছর মাতৃমূর্তি মণ্ডপে থাকে৷ নিত্যপুজো হয়৷ যাঁরা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আসেন, পূজা উদ্যাপন পরিষদের মণ্ডপে এসে একবার প্রণাম করে যান৷

ঢাকার এক নামী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অ্যাসিস্ট্যান্ট মার্কেটিং ম্যানেজার দিলীপকুমার দাস সপরিবারে এসেছিলেন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে৷ মণ্ডপে প্রণাম করে বাড়ি ফিরবেন৷ সঙ্গে স্ত্রী শোভা, ছেলে-মেয়ে ও দুই আত্মীয়া লক্ষ্মী ও সরস্বতী৷ একটু আগেই তাঁরা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সন্ধ্যারতি দেখেছেন৷ পরিচয় হতেই মহিলারা প্রায় সমস্বরে বললেন, ‘আহা, ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আরতি দেখে মন ভরে যায়!’

লক্ষ্মী-সরস্বতী দু-বোনই সুন্দরী৷ হাসলে দু’জনের গালেই টোল পড়ে৷ আর ওঁরা বেশ সপ্রতিভ৷ সুন্দর কথা বলেন৷ দাস পরিবার সময় পেলেই প্রতি সপ্তাহে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আসেন৷ কথা বলতে বলতে মণ্ডপে প্রায় আনত ভঙ্গিমায় ধূপকাঠি ও প্রদীপ জ্বালাচ্ছিলেন লক্ষ্মী-সরস্বতী৷ —চলবে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content