শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


নাটমন্দির। ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সাহিত্য, সংস্কৃতি, রুচি, ঐতিহ্যবোধ—এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার বৈচিত্রময় পারস্পরিক সম্পর্ক অটুট। বৈচিত্রময় ওপার বাংলায় অসংখ্য মসজিদ এবং মাজারের পাশাপাশি কিন্তু ইতিহাসপ্রসিদ্ধ কিছু ঐতিহ্যবাহী মন্দির এবং দেবী সতীর একান্ন পীঠের অন্যতম কয়েকটি পীঠও পড়ছে এখানকার কিছু অঞ্চলে। এই তীর্থক্ষেত্রগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মধ্যেকার পারস্পরিক ধর্মীয় বিশ্বাসের আদানপ্রদানগত সম্পর্কের বৈচিত্রময় কাহিনিই এবার উঠে আসবে পরিব্রাজক লেখক ও সাংবাদিক সুমন গুপ্ত-র কলমে। তার ধারাবাহিক ‘বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে’র মধ্য দিয়ে।

পর্ব – ৪

সন্ধ্যারতি শুরু হতে এখনও কিছুটা সময় রয়েছে দেখে নাটমন্দির থেকে বেরিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে এলাম৷ নাটমন্দির থেকে বেরোতেই একখণ্ড শ্বেতপাথরের ওপর লেখা—‘দেব মাতৃসমস্ত্বং হি সর্বতীর্থ ময়াস্তথা৷/ সর্বকাম প্রদো ভূত্বা শান্তিং মে কুরু তে নমঃ৷৷’ অচিরেই ভক্তমনে সাড়া মেলে এই মাতৃতীর্থেই সমস্ত তীর্থের পুণ্যফল অর্জন সম্ভব৷ পূর্ণ হয় মনস্কামনা৷ অপার শান্তিলাভ ঘটে৷ শ্রীশ্রীঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের পুনর্নির্মিত নাটমন্দির৷ ২০০৫ সালের ১৪ এপ্রিল নাটমন্দিরটি মাতৃদেবীকে উৎসর্গ করা হয়৷ পাবনা জেলার সুজানগর নিবাসী গারমেন্টস কোম্পানি ল্যান্ডমার্ক গ্রুপের স্বত্বাধিকারী শ্রীযুক্ত দীপক ভৌমিক এই নাটমন্দিরটি তৈরি করে দেন৷
ইতিপূর্বে এখানকার বহির্বাটিতে একটি শিবমন্দিরের কথা উল্লেখ করেছি৷ পুষ্করিণীর উত্তর-পূর্ব কোণে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর সারিবদ্ধ আরও চারটি মাঝারি আকৃতির একই রকমের দেখতে শিবমন্দির৷ এই মন্দিরগুলোর ভিত বেশ উঁচু৷ প্রতিটি মন্দিরেই ওঠার জন্য কয়েকটা সিঁড়ি৷ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ওই মন্দির চতুষ্টয়ের রং হালকা গোলাপি৷ প্রতিটি মন্দির উচ্চ-চূড়াবিশিষ্ট৷ গর্ভগৃহের ছাদে ৬টি স্তর, ক্রমশ বড় থেকে ছোট হয়েছে৷ প্রতিটি মন্দিরের শীর্ষদেশে রয়েছে পদ্মপাপড়ির ওপর কলস৷ মন্দিরগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা প্রায় সংযুক্ত৷ প্রতিটি মন্দিরের ভেতরে একটি করে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত৷

পাশাপাশি এরকম চারটি শিবমন্দির কেন নির্মাণ করা হল?
মহাদেব হলেন মঙ্গলপ্রদানকারী৷ শিবশক্তি ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ চতুর্বর্গ ফলপ্রদায়ক৷ শিব ও শক্তির মেলবন্ধন মানুষের অভীষ্টপূরণে প্রকৃত সহায়ক হয়ে উঠতে পারে৷ তবে তা একমাত্র নিবিড় সাধনার মধ্য দিয়েই সম্ভব৷ মানুষ সাধনার মাধ্যমে চতুর্বর্গ ফল লাভ করুক, এই লক্ষ্য নিয়েই শিবমন্দিরগুলো পাশাপাশি নির্মাণ করা হয়েছিল৷ জনশ্রুতি, ষোড়শ শতাব্দীতে এই চারটি শিবমন্দির অত্যন্ত যত্ন সহকারে নির্মাণ করেন মোগল সম্রাট আকবরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেনাপতি রাজা মানসিংহ৷ পরম শিবভক্ত ছিলেন মানসিংহ৷ তিনি নিজেও বিশ্বাস করতেন যে, শংকর ভগবানের আশীর্বাদেই তাঁর পক্ষে একের পর এক যুদ্ধজয় করা সম্ভব হয়েছে৷ শৈবক্ষেত্র বারাণসীতেও মানসিংহের অনেক কীর্তি আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে৷

একটি কাহিনি অনুযায়ী পূর্ব বাংলায় আফগান শক্তিকে বিধ্বস্ত করে মোগল শাসনব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে মানসিংহ উপস্থিত হন৷ আত্তিয়া পরগনার সেররীপুরে তুমুল যুদ্ধ শুরু হল৷ কোনও কোনও গবেষকের মতে জায়গাটির নাম শেরপুর৷ মরণের ডঙ্কা বেজে ওঠে৷ উভয়পক্ষের হতাহত বহু৷ অবশেষে মানসিংহের প্রবল পরাক্রমের কাছে পরাজয় স্বীকার করল আফগানরা৷ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রাণ নিয়ে পালাল অনেক আফগান সেনা৷ বাকিরা লড়াই করে মরল৷
শোনা যায়, আফগানদের পরাভূত করে ঢাকায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাছেই শিবির স্থাপন করেন মানসিংহ৷ ঢাকা সেসময়ই মসজিদ নগরী হিসেবে সুপরিচিত৷ মসজিদ নগরীর মধ্যে এরকম একটি প্রাচীন দুর্গামন্দির রয়েছে, একথা জানতে পেরে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন মানসিংহ৷

মন্দিরটি স্বচক্ষে দেখার পর মন ভেঙে যায় তাঁর৷ দশপ্রহরণধারিণী দেবী মন্দিরের এ কী করুণ অবস্থা! মন্দিরটি সংস্কার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন মানসিংহ৷ পুণ্যলাভের ইচ্ছাও কম ছিল না তাঁর৷ বহু অর্থ ব্যয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দির সংস্কারের সময়েই ওই চারটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন মানসিংহ৷ এই প্রসঙ্গে যথাসময়ে আরও কথা জানা যাবে৷
মূল ঢাকেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্যশিল্পে শিখর ও বাংলাদেশের চারচালা ঘরের চালের আকারের চমৎকার মিশ্রণ লক্ষ করা যায়৷ প্রতিদিন সন্ধ্যায় আলোকোজ্জ্বল মন্দিরটি যেন ইতিহাসের পাতা থেকে অনায়াসে উঠে আসে৷ সুদীর্ঘ সময়ের ব্যবধান নিমেষে ঘুচে যায়৷ এই মন্দির তার অবগুণ্ঠন সরিয়ে একবিংশ শতাব্দীর এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় আপন বৈভব ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে উপস্থিত হয়৷

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মূলকক্ষ তিনটির ওপর রয়েছে পিরামিড বা গম্বুজের আকারে নির্মিত তিনটি ছাদ বা শিখর৷ মন্দিরের নির্মাণশৈলী অনেকটাই বৌদ্ধ মঠের মতো৷ বাংলাদেশে অনেক হিন্দু মন্দিরের নির্মাণরীতিতেই বৌদ্ধ স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষণীয়৷
ঐতিহাসিকগণের মতে, এরকম সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে, বর্তমানে বেশ কয়েকটি হিন্দু মন্দির পূর্বে বৌদ্ধ মন্দির ছিল৷ একদা বৌদ্ধধর্মের পতনের পাশাপাশি হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান শুরু হয়৷ সেই সময় কিছু কিছু বৌদ্ধ মন্দির হিন্দু দেবালয়ে রূপান্তরিত হয়৷ আবার এই লেখক নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু শহরে গিয়ে হিন্দু মন্দিরের ওপর বৌদ্ধ মঠ গড়ে ওঠার প্রমাণও পেয়েছেন৷ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের নির্মাণশৈলী যেহেতু বৌদ্ধ মঠের মতো, ঐতিহাসিকদের অনুমান এই দুর্গাদেউলটি নির্মাণ করা হয়েছিল সম্ভবত দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে৷ তবে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠার সময় নিয়ে তাঁদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে৷

আবার এরকম একটি তথ্য থেকেই সেন বংশের প্রবল পরাক্রান্ত মহারাজা বল্লাল সেনের নাম এখানে উঠে আসে৷ তাঁর রাজত্বকাল (১১৫৯-১১৭৯ খ্রিস্টাব্দ) বঙ্গদেশের অন্যতম সু-সময় হিসেবে চিহ্নিত৷ পাল রাজবংশের হাত থেকে গৌড় ছিনিয়ে নেওয়ার পর বাংলার ব-দ্বীপ সহ এক বিস্তৃত ভূখণ্ডের অধীশ্বর হন তিনি৷ সিংহাসনে আরোহণের পর আজ থেকে প্রায় সাড়ে আটশো বছর আগে বল্লাল সেন এক জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে একটি মন্দির নির্মাণ করে সেখানে দুর্গামাতাকে প্রতিষ্ঠা করেন৷ কালক্রমে সেই দেবী ঢাকেশ্বরীরূপে পূজিত হয়ে আসছেন৷ কিন্তু এমন প্রশ্নও ওঠে যে, বল্লাল সেন রাজত্বের প্রথম দিকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন৷ তাঁর পক্ষে একটি দুর্গামন্দির নির্মাণ করা কতখানি বাস্তবসম্মত?

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ‘ইন্ট্রোডাকশন টু মডার্ন বৌদ্ধিজম’ গ্রন্থে বল্লাল সেনের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়ার কথা বলেছেন৷ ঐতিহাসিক যতীন্দ্রমোহন রায় কিন্তু তাঁর ‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন, রাজত্বের শুরুতে বল্লাল সেন শৈব ছিলেন৷ পরে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন৷ যতীন্দ্রমোহন মূলত ঢাকেশ্বরী মন্দিরের নির্মাণশৈলী ও এর ভাঙা ইটের টুকরো পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, মন্দিরটি প্রধানত বৌদ্ধ স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করেই নির্মিত হয়৷ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বল্লাল সেনের নামটিই অধিকাংশ গবেষকের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে৷ জনশ্রুতি, ঢাকেশ্বরী দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে হাতির পিঠে চড়ে সিংহদ্বার দিয়ে মন্দিরে আসতেন বল্লাল সেন৷ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কেন তিনি ঢাকেশ্বরী মন্দির নির্মাণ করেন? এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব৷ তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম নিয়েও যথাসময়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাবে৷

আবার ঢাকেশ্বরী ও ঢাকা এই দুটো নাম নিয়েও নানা মতামত রয়েছে৷ নামদুটো কি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত? কারও ধারণা ঢাকেশ্বরী দেবী এই নামটি থেকেই ঢাকার নামকরণ হয়েছে৷ কেউ বা মনে করেন ঢাকা থেকেই ঢাকেশ্বরী নামের উৎপত্তি৷ এই বিষয়টি নিয়েও আলোচনার অবকাশ রয়েছে৷ প্রাঙ্গণ থেকে মূল মন্দিরের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে যে, গর্ভগৃহের মূল কক্ষ অর্থাৎ যেখানে ঢাকেশ্বরী মাতা রয়েছেন, তার ছাদ বা শিখর পাশের দুটো ছাদ বা শিখর থেকে কিছুটা উঁচু৷ প্রতিটি ছাদই নীচ থেকে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে চারটি স্তর বা ধাপে নির্মিত৷ আর প্রতিটি ছাদের সবচেয়ে নীচের অংশ অনেকটা বাংলাদেশের চারচালা ঘরের আকারের৷ অবশ্য এর ওপরের তিনটি স্তরে চাঁদোয়ার আকৃতি৷ যা উত্তর ভারতের বিভিন্ন মন্দিরের নির্মাণশৈলীর বৈশিষ্ট্য৷

মূল কক্ষের শিখরের বিভিন্ন ধাপ মিলিয়ে মোট ৯টি চূড়া৷ প্যানেল সজ্জিত এই চূড়াগুলোর নির্মাণে যত্নের ছাপ স্পষ্ট৷ কার্নিসে ফুলের অলংকরণ আর পদ্মপাপড়ির অপূর্ব সহাবস্থান৷ পূর্বদিকে যে কক্ষটি রয়েছে তার ৫টি চূড়া৷ তাতে প্যানেল ও ফুলের কারুকাজ৷ অবশ্য পশ্চিমদিকের কক্ষটির শিখরে একটি চূড়া৷ এখানেও প্যানেল ও ফুলের অলংকরণ৷ মূল মন্দিরটি প্রায় ৫০ ফুট লম্বা৷ গর্ভগৃহের আয়তন কম-বেশি ৩০০ বর্গফুট৷ মূল মন্দির অনেকগুলো স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে৷ ধনুকাকৃতি তোরণশোভিত তিনটি খোলা কংক্রিটের প্রবেশপথ দিয়ে গর্ভগৃহের বারান্দায় আসতে হয়৷ গর্ভগৃহের সেগুন কাঠের কারুকার্য করা দরজা তিনটির বাইরে শক্তপোক্ত কোলাপসিবল গেট৷

প্রাচীন ঢাকেশ্বরী হল পঞ্চরত্ন মন্দির৷ তবে বিভিন্ন সময়ে সংস্কারের ফলে এই মন্দিরের প্রাচীন চেহারাটি ঠিক কেমন ছিল তা এখন আর বোঝা সম্ভব নয়৷ পুরোনো আমলের কিছু কিছু হিন্দু মন্দিরের মতো একসময় ঢাকেশ্বরী মন্দিরের গর্ভগৃহও অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল৷ দিনের বেলাও আলো না জ্বেলে দেবীমূর্তি দর্শন করা সম্ভব ছিল না৷ সময়ের ভারে জরাজীর্ণ ঢাকেশ্বরী মন্দির ভেঙে পড়ার উপক্রম হলে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ঢাকার নায়েব নাজিম এটি সংস্কার করেন৷ বিশ শতকের গোড়ায় ভাওয়ালের রাজা পুনরায় মন্দিরটির সংস্কারের কাজে হাত দেন৷ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সংস্কারের ব্যাপারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক হিন্দু এজেন্টের কথা শোনা যায়৷ ভাওয়ালের রাজা পুনঃসংস্কারের পাশাপাশি দেবালয়ের স্থায়ী পরিচর্যার জন্য প্রায় ২০ বিঘা সম্পত্তি এই মন্দিরের নামে দেবোত্তর করে দেন৷ কিন্তু এখন শুধু ৭ বিঘা জমির ওপর মন্দিরটির অবস্থান৷ বাকি জমি নানাভাবে বে-দখল হয়ে গিয়েছে৷ যা আর কোনওদিনই পুনরুদ্ধার করা হয়তো সম্ভব হবে না৷ এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদন করেও কোনও সুরাহা হয়নি৷ —চলবে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content