‘ঢাকা’ নামটির সঙ্গে আরেকটি প্রবাদ জড়িয়ে আছে৷ একদা বঙ্গদেশের শাসনকর্তা ছিলেন ইসলাম খাঁ৷ একবার তিনি মহা সমস্যার মুখোমুখি হলেন৷ সমস্যা মগ-দস্যুদের নিয়ে৷ মগরা যখন-তখন তাঁর রাজ্য আক্রমণ করে একটা বিশৃঙ্খলার পরিবেশ তৈরি করতে চায়৷ পূর্ববঙ্গকে মগদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে স্থানান্তরিত করে মেঘনার উপকূলে কোনও এক নিরাপদ স্থানে আনতে চাইলেন ইসলাম খাঁ৷
তিনি বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শনের পর বুড়িগঙ্গার তীরে এসে উপস্থিত হলেন৷ এই স্থানটিকে রাজধানীর উপযুক্ত বলে মনে হল তাঁর৷ একদিন একদল বাদ্যকর ঢাক বাজিয়ে পুজো করছে দেখে ইসলাম খাঁ তাদের ডেকে পাঠালেন৷ এরপর তাঁর মনোনীত এক স্থানে তাদের ঢাক বাজাতে আদেশ করলেন৷ ঢাকের শব্দ পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তরপ্রান্তে যতদূর পর্যন্ত ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হল, ততদূর নয়া রাজধানীর সীমা নির্দিষ্ট হল৷ নবাব ইসলাম খাঁ এভাবে তাঁর রাজধানীর সীমা নিরূপণ করলেন বলে এর নাম হল ‘ঢাকা’৷
ঢাকা নামটি যে প্রাচীন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থটি সম্রাট আকবরের আমলের মোগল সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল৷ ঢাকার নাম ‘আইন-ই-আকবরী’-তে রয়েছে৷ এই গ্রন্থে ঢাকা বাজু নামে এক পরগনার উল্লেখ রয়েছে৷ এ থেকেই ঢাকা শব্দের সৃষ্টি বলে কোনও কোনও গবেষকের ধারণা৷
১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে আকবরের অর্থবিষয়ক অন্যতম বিশ্বস্ত মন্ত্রী টোডরমল ঢাকা বাজুর (পরগনা) বন্দোবস্ত করেন৷ তৎকালীন সময়ে বুড়িগঙ্গার উত্তরপ্রান্তের তীরভূমি ঢাকা বাজু নামে পরিচিত ছিল৷ ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে এখানেই নতুন রাজধানী স্থাপন করেন ইসলাম খাঁ৷ আর পরগনার নামানুসারে রাজধানীর নামকরণ করা হয়৷ তখন এই পরগনার আয়তন এখনকার থেকে কম করেও ৬ গুণ বেশি ছিল৷ পরবর্তীকালে পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলা তৈরি হওয়ার ফলে ঢাকা পরগনার আয়তন অনেকটাই কমে যায়৷
বেশ অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার, ‘আইন-ই-আকবরী’-তে কিন্তু সুবা বাংলার বিখ্যাত এই ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কোনও উল্লেখ নেই৷ দু’চারজন গবেষকের মতে, ‘আইন-ই-আকবরী’ রচনার আগে অথবা গ্রন্থ রচনার সময়েও যদি এই মন্দিরের অস্তিত্ব থাকত তাহলে আবুল ফজল অবশ্যই তার উল্লেখ করতেন৷ কারণ, এই গ্রন্থের একটি অধ্যায়ে তিনি হিন্দু প্রজাদের মন্দির ও তীর্থস্থান, অন্য কীর্তিসমূহ, তাদের আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি নিয়ে অনেক কথা লিখে গিয়েছেন৷
তাহলে কি ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সঙ্গে মহারাজা বল্লাল সেনের আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই? মন্দিরটি দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়নি? নাকি কোনও বিশেষ কারণবশত ‘আইন-ই-আকবরী’-তে ঢাকেশ্বরী মন্দির অনুল্লিখিত থেকে গিয়েছে? উত্তরগুলো আজ পর্যন্ত কোনও গবেষকই একশো ভাগ নিশ্চিত হয়ে দিতে পারেননি৷
আবার শুধু ‘বিক্রমপুর সাময়িকী’-তে ঢাকেশ্বরী মন্দির ও বল্লাল সেন সম্পর্কে অন্য ধরনের তথ্য দেওয়া হয়েছে৷ স্থাপত্য শিল্পের প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়েছে যে, মহারাজা বল্লাল সেনের সময়ে অর্থাৎ দ্বাদশ শতাব্দীর আশপাশে মন্দির, মঠ অথবা অট্টালিকার নির্মাণ পদ্ধতিতে চুন-বালি ও জলের মিশ্রণে মর্টারের ব্যবহার ছিল না৷ তখন এ ধরনের নির্মাণে ইট ও কাদার গাঁথুনিই সমধিক প্রচলিত ছিল৷
এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ডঃ আহমদ হাসান দানি বলেছেন যে, ঢাকেশ্বরী মন্দির চুন-বালির গাঁথুনিতে নির্মাণ করা হয়েছিল৷ যার ফলে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও মন্দিরটির বিরাট কোনও ক্ষতি হয়নি৷ এই মন্দিরের গম্বুজ আকৃতির তিনটি ছাদ, খিলানসমৃদ্ধ তিনটি প্রবেশপথ ও পলেস্তরা করা দেওয়াল এ সাক্ষ্যই বহন করে যে, এই অপূর্ব কীর্তিটি বাংলার মোগল স্থাপত্যের আদলেই গড়ে ওঠে৷ অতএব এসব তথ্য থেকে স্পষ্টই প্রমাণ মেলে যে, মন্দিরটি বাংলার সেন রাজবংশের প্রতাপশালী শাসক বল্লাল সেনের আমলে তৈরি হয়নি৷ হয়েছে কয়েক শতাব্দী পরে মুসলিম আমলে৷
গবেষকদের একাংশ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের নির্মাতা হিসেবে আরেক বল্লাল সেনের কথা বলেছেন৷ বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁকে ২য় বল্লাল সেন নামে উল্লেখ করা হয়েছে৷ এই বল্লাল সেন ছিলেন সূর্যবংশীয়৷ আদিশূরের বংশধর ও তান্ত্রিক ধর্মের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক৷ আনন্দ ভট্টের ‘বল্লাল চরিত’ থেকে জানা যায় যে, এই বল্লাল সেন ছিলেন মলহনের পুত্র৷
মলহন ছিলেন আরাকানের রাজা৷ ১৬১২ থেকে ১৬২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর রাজত্বকাল৷ মজার ব্যাপার, তিনি হুসেন শাহ নামেও পরিচিত ছিলেন৷ কেন মুসলিম নাম নেওয়া? শোনা যায়, একসময় মগ রাজারা প্রত্যেকেই তাঁদের বর্মি নামের সঙ্গে একটি করে মুসলিম নাম গ্রহণ করতেন৷ পূর্ববঙ্গের কিছু কিছু অঞ্চলে অরাজকতা সৃষ্টি এই রাজাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল৷ পূর্ববঙ্গ বরাবরই মুসলমান অধ্যুষিত৷ তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ এই লেখকের অনুমান, মুসলিম নামের আড়ালে এইসব অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করা আরাকান রাজাদের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল৷
মলহনের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীসুধর্ম আরাকানের সিংহাসনে বসলেন৷ তিনি ১৬২২ থেকে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ মোট ১৬ বছর রাজত্ব করেন৷ তাঁর পাটরানি নাৎসিমনি সুন্দরী৷ তাঁর যৌন আবেদনও ছিল যথেষ্ট৷ নরপতি নামে রাজার এক আত্মীয় মন্ত্রী ছিলেন৷ এরপর হল কী, যে রানিকে এত ভালোবাসতেন শ্রীসুধর্ম, সেই নারীই চরম বিশ্বাসঘাতকতা করলেন স্বামীর সঙ্গে৷ নরপতির সঙ্গে ছিল নাৎসিমনির গোপন প্রেম৷
এদিকে শ্রীসুধর্ম-নাৎসিমনির একটি পুত্রসন্তানও ছিল৷ ছোট্ট সেই ছেলেটির নাম মিনসানি৷ কোনও নারী যখন ষড়যন্ত্রের জাল বিছান তা হয় আরও নিখুঁত ও ভয়ংকর৷ আর সেই ষড়যন্ত্রের ফলাফল যে কী হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ শুধু শ্রীসুধর্ম নন, বালক মিনসানিও নিহত হল৷ একজন মা হয়ে কী করে নাৎসিমনি পারলেন তাঁর সন্তানকে হত্যা করতে! প্রেম কি মাতৃত্বের চেয়েও বড় হয়ে উঠতে পারে?
আরাকানের সিংহাসনে বসলেন নরপতি৷ এরপর নাৎসিমনির গোপন নির্দেশে শ্রীসুধর্মের জ্ঞাতিদের নির্মমভাবে হত্যা করা হল৷ নিষ্ঠুরতার আর এক নাম হয়ে উঠলেন এই বিধবা রানি৷ অবশ্য পরে তিনি প্রেমিককে বিয়ে করেছিলেন কি না ইতিহাস এ ব্যাপারে নীরব৷
শ্রীসুধর্মের ছোটভাই ধরমসা বা মঙ্গত রায় ছিলেন চাটগাঁ-য় অর্থাৎ চট্টগ্রামে৷ স্বাধীনতা ঘোষণা করার পাশাপাশি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্রের হত্যাকারীদের আরাকানের রাজসিংহাসন থেকে উৎখাত করার জন্য যুদ্ধযাত্রা করলেন মঙ্গত রায়৷ কিন্তু নাৎসিমনির সৈন্যদলের কাছে পরাজিত হয়ে সোজা ঢাকায় পালিয়ে এলেন৷ সেই সময় দিল্লির সম্রাট শাহজাহান৷ মোগল সুবেদার ইসলাম খান মাশহাদি আশ্রয় দিলেন মঙ্গত রায়কে৷ সেইসঙ্গে মসনদ ও জায়গির প্রদান করেন৷
মঙ্গত রায় নিজেকে শাহজাহানের করদ রাজা বলে ঘোষণা করেন৷ মঙ্গত ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের থাকবার ব্যবস্থা হয় তৎকালীন ঢাকা নগরের ৩ মাইল উত্তরে এক জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে৷ এই জায়গাটিই পরবর্তীকালে মগবাজার নামে পরিচিত হয়৷ ‘বিক্রমপুর সাময়িকী’-তে এমন কথাও বলা হয়েছে যে, মঙ্গত রায় তাঁর পূর্বপুরুষদের ধারা অনুসরণ করে মীর আবুল কাশেম নাম নেন৷ ক্রমশ আবুল নামটিই উচ্চারণ দোষে বুলা, বলা বা বল্লাল হয়ে যায়৷ আরাকানি ভাষায় ‘রাজা’-র অর্থ হল, সিন বা সেন৷ অতএব মঙ্গত রায়ই একসময় বল্লাল সেন নামে অভিহিত হন৷ আরাকান রাজাদের দেব-দেবীরাও নাকি অর্ধেক হিন্দু ও অর্ধেক মুসলমান জ্ঞানে পূজিত হতেন৷ এমনকী মঙ্গত রায়ের আমলে মিশ্রধর্ম ও মিশ্র স্থাপত্যরীতির চর্চা বহুল পরিমাণে শুরু হয়৷ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান স্থাপত্যরীতির অনুসরণে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের নির্মাণ হওয়া অস্বাভাবিক নয়৷ মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত চতুরঙ্গ দেবমূর্তি ও দশভুজা দেবীমূর্তি আদতে আরাকানিদের উপাস্য যুগল দেবতারই মূর্তি, তেমনই ইঙ্গিত রয়েছে ‘বিক্রমপুর সাময়িকী’-তে৷
গত শতকের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দশকে কেমন ছিল ঢাকেশ্বরী মন্দির? নাজির হোসেন নামে এক ব্যক্তি তার স্মৃতিচারণ করে গিয়েছেন৷ এই বর্ণনা থেকে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের একটি অন্যরকম ছবি ফুটে ওঠে৷ (গ্রন্থসূত্র : ‘ঢাকেশ্বরী মন্দির অতীত ও বর্তমান’)৷
‘আগের দিনে চৈত্র মাসে এ ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে বিরাট মেলা বসতো৷ বহু রঙ-বেরঙের দোকানে এ স্থান সরগরম হয়ে উঠতো৷ আগমন-পুণ্যার্থী এখানে এসে মন্দির দর্শন করে পুণ্য সঞ্চয় করে বাড়ি ফিরে যেতো৷ হিন্দুধর্ম বিশ্বাসী লক্ষ লক্ষ মানুষ ব্রহ্মার পদতলে আশ্রয় ও পাপক্ষালনের আশায় চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমীতে লাঙ্গলবন্দে মিলিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান করে চির মোক্ষলাভ করতো৷ আর একই প্রেরণায় দেবী দুর্গার আশীর্বাদ লাভকল্পে পুণ্যার্থীরা সারাদিন পিপীলিকার সারির মতো বিভিন্ন পথ ধরে নানাদিক থেকে ত্রস্তপদে এগিয়ে আসত ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দিকে৷ এটি ছিল তাঁদের কাছে সারা বছরের সেরা পর্ব৷
বহু আশা-প্রত্যাশা নিয়ে ঘর থেকে বের হতো পুণ্যার্থীরা৷ চোখে-মুখে ফুটে উঠে তাঁদের প্রাণের ব্যাকুলতা, পাপমোচন করে ফেলার ঐকান্তিক আগ্রহ, আনত মস্তকে তাঁরা ভগবানের ধ্যান করতে করতে নীরবে এগিয়ে চলতেন মন্দিরের দিকে৷ কোনো দিকে তাঁদের মন নেই, আহার, নিদ্রা, পায়ের ক্লান্তির প্রতি ভ্রুক্ষেপ নেই৷ মনে তাঁদের প্রবল বিশ্বাস—সিদ্ধিলাভ হবেই৷ এসব তীর্থযাত্রী এক একটি ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত, প্রতি দলে দশ থেকে বিশজন৷ দলের সবাই স্ত্রীলোক৷ তাঁদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এক একজন মাত্র পুরুষ, গ্রামের মুরুব্বি ধরনের লোক৷
বহু দূর-দূরান্ত থেকে এমনিভাবে দল বেঁধে আসেন তাঁরা৷ অতি বৃদ্ধ দুর্বল লোলচর্ম, বয়সের ভারে ন্যুব্জ এরকম বৃদ্ধ-বৃদ্ধারও সমাবেশ ঘটে৷ মন্দিরের নিকটতম ও শহরের বিভিন্ন মহল্লা হতে যুবকরা আসে স্বেচ্ছাসেবকরূপে কাজ করার জন্য পুণ্যার্থীর৷ একান্ত নিবিষ্ট মনে স্ব স্ব আকুতি ও প্রার্থনা নিবেদন করে এবং মাঝে মাঝে ওম ঢাকা ঈশ্বরী বলে প্রণাম জানায়৷ আস্তে আস্তে দিন শেষ হয়ে যায়৷ তীর্থযাত্রীরা গৃহাভিমুখে রওনা দেন৷ এছাড়া দুর্গাপূজায় ভিড় হতো অনেক৷ এ সকল পূজায় প্রায়ই পাঁঠাবলি দেয়া হতো৷’
১৯৬৯ সালে ইস্ট পাকিস্তান ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে (ভৌগোলিক অভিধান) ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কথা রয়েছে৷ ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের এস এইচ এইচ রিজভি নামে এক ভদ্রলোকের নাম এই গেজেটিয়ার-এর জেনারেল এডিটর হিসেবে রয়েছে৷ ওই গেজেটিয়ারে বলা হয়েছে—
‘It lies beside the Dhakeswari Road near the Dhakeswari Government quarters. The Goddess Dhakeswari is regarded by the Hindus as the presiding deity of Dacca. The exact date of its construction is not known. The construction of this temple was taken up by Raja Mansingh and the style Suggests it to be of 17th century origin.’
একটা কথা জানিয়ে রাখি৷ ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মতান্তর কোনওভাবেই এর গুরুত্বকে খাটো করে না৷ বরং পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি-তর্ককে স্বাগত জানিয়ে এই মন্দির আরও বেশি মহিমামণ্ডিত হয়ে ওঠে৷ পাশাপাশি হিন্দুধর্মের উদারতার রূপই আরও একবার আমাদের চোখে ধরা দেয়৷
—চলবে
সৌজন্যে দীপ প্রকাশন
তিনি বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শনের পর বুড়িগঙ্গার তীরে এসে উপস্থিত হলেন৷ এই স্থানটিকে রাজধানীর উপযুক্ত বলে মনে হল তাঁর৷ একদিন একদল বাদ্যকর ঢাক বাজিয়ে পুজো করছে দেখে ইসলাম খাঁ তাদের ডেকে পাঠালেন৷ এরপর তাঁর মনোনীত এক স্থানে তাদের ঢাক বাজাতে আদেশ করলেন৷ ঢাকের শব্দ পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তরপ্রান্তে যতদূর পর্যন্ত ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হল, ততদূর নয়া রাজধানীর সীমা নির্দিষ্ট হল৷ নবাব ইসলাম খাঁ এভাবে তাঁর রাজধানীর সীমা নিরূপণ করলেন বলে এর নাম হল ‘ঢাকা’৷
ঢাকা নামটি যে প্রাচীন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থটি সম্রাট আকবরের আমলের মোগল সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল৷ ঢাকার নাম ‘আইন-ই-আকবরী’-তে রয়েছে৷ এই গ্রন্থে ঢাকা বাজু নামে এক পরগনার উল্লেখ রয়েছে৷ এ থেকেই ঢাকা শব্দের সৃষ্টি বলে কোনও কোনও গবেষকের ধারণা৷
১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে আকবরের অর্থবিষয়ক অন্যতম বিশ্বস্ত মন্ত্রী টোডরমল ঢাকা বাজুর (পরগনা) বন্দোবস্ত করেন৷ তৎকালীন সময়ে বুড়িগঙ্গার উত্তরপ্রান্তের তীরভূমি ঢাকা বাজু নামে পরিচিত ছিল৷ ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে এখানেই নতুন রাজধানী স্থাপন করেন ইসলাম খাঁ৷ আর পরগনার নামানুসারে রাজধানীর নামকরণ করা হয়৷ তখন এই পরগনার আয়তন এখনকার থেকে কম করেও ৬ গুণ বেশি ছিল৷ পরবর্তীকালে পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলা তৈরি হওয়ার ফলে ঢাকা পরগনার আয়তন অনেকটাই কমে যায়৷
বেশ অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার, ‘আইন-ই-আকবরী’-তে কিন্তু সুবা বাংলার বিখ্যাত এই ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কোনও উল্লেখ নেই৷ দু’চারজন গবেষকের মতে, ‘আইন-ই-আকবরী’ রচনার আগে অথবা গ্রন্থ রচনার সময়েও যদি এই মন্দিরের অস্তিত্ব থাকত তাহলে আবুল ফজল অবশ্যই তার উল্লেখ করতেন৷ কারণ, এই গ্রন্থের একটি অধ্যায়ে তিনি হিন্দু প্রজাদের মন্দির ও তীর্থস্থান, অন্য কীর্তিসমূহ, তাদের আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি নিয়ে অনেক কথা লিখে গিয়েছেন৷
তাহলে কি ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সঙ্গে মহারাজা বল্লাল সেনের আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই? মন্দিরটি দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়নি? নাকি কোনও বিশেষ কারণবশত ‘আইন-ই-আকবরী’-তে ঢাকেশ্বরী মন্দির অনুল্লিখিত থেকে গিয়েছে? উত্তরগুলো আজ পর্যন্ত কোনও গবেষকই একশো ভাগ নিশ্চিত হয়ে দিতে পারেননি৷
আবার শুধু ‘বিক্রমপুর সাময়িকী’-তে ঢাকেশ্বরী মন্দির ও বল্লাল সেন সম্পর্কে অন্য ধরনের তথ্য দেওয়া হয়েছে৷ স্থাপত্য শিল্পের প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়েছে যে, মহারাজা বল্লাল সেনের সময়ে অর্থাৎ দ্বাদশ শতাব্দীর আশপাশে মন্দির, মঠ অথবা অট্টালিকার নির্মাণ পদ্ধতিতে চুন-বালি ও জলের মিশ্রণে মর্টারের ব্যবহার ছিল না৷ তখন এ ধরনের নির্মাণে ইট ও কাদার গাঁথুনিই সমধিক প্রচলিত ছিল৷
এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ডঃ আহমদ হাসান দানি বলেছেন যে, ঢাকেশ্বরী মন্দির চুন-বালির গাঁথুনিতে নির্মাণ করা হয়েছিল৷ যার ফলে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও মন্দিরটির বিরাট কোনও ক্ষতি হয়নি৷ এই মন্দিরের গম্বুজ আকৃতির তিনটি ছাদ, খিলানসমৃদ্ধ তিনটি প্রবেশপথ ও পলেস্তরা করা দেওয়াল এ সাক্ষ্যই বহন করে যে, এই অপূর্ব কীর্তিটি বাংলার মোগল স্থাপত্যের আদলেই গড়ে ওঠে৷ অতএব এসব তথ্য থেকে স্পষ্টই প্রমাণ মেলে যে, মন্দিরটি বাংলার সেন রাজবংশের প্রতাপশালী শাসক বল্লাল সেনের আমলে তৈরি হয়নি৷ হয়েছে কয়েক শতাব্দী পরে মুসলিম আমলে৷
গবেষকদের একাংশ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের নির্মাতা হিসেবে আরেক বল্লাল সেনের কথা বলেছেন৷ বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁকে ২য় বল্লাল সেন নামে উল্লেখ করা হয়েছে৷ এই বল্লাল সেন ছিলেন সূর্যবংশীয়৷ আদিশূরের বংশধর ও তান্ত্রিক ধর্মের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক৷ আনন্দ ভট্টের ‘বল্লাল চরিত’ থেকে জানা যায় যে, এই বল্লাল সেন ছিলেন মলহনের পুত্র৷
মলহন ছিলেন আরাকানের রাজা৷ ১৬১২ থেকে ১৬২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর রাজত্বকাল৷ মজার ব্যাপার, তিনি হুসেন শাহ নামেও পরিচিত ছিলেন৷ কেন মুসলিম নাম নেওয়া? শোনা যায়, একসময় মগ রাজারা প্রত্যেকেই তাঁদের বর্মি নামের সঙ্গে একটি করে মুসলিম নাম গ্রহণ করতেন৷ পূর্ববঙ্গের কিছু কিছু অঞ্চলে অরাজকতা সৃষ্টি এই রাজাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল৷ পূর্ববঙ্গ বরাবরই মুসলমান অধ্যুষিত৷ তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ এই লেখকের অনুমান, মুসলিম নামের আড়ালে এইসব অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করা আরাকান রাজাদের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল৷
মলহনের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীসুধর্ম আরাকানের সিংহাসনে বসলেন৷ তিনি ১৬২২ থেকে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ মোট ১৬ বছর রাজত্ব করেন৷ তাঁর পাটরানি নাৎসিমনি সুন্দরী৷ তাঁর যৌন আবেদনও ছিল যথেষ্ট৷ নরপতি নামে রাজার এক আত্মীয় মন্ত্রী ছিলেন৷ এরপর হল কী, যে রানিকে এত ভালোবাসতেন শ্রীসুধর্ম, সেই নারীই চরম বিশ্বাসঘাতকতা করলেন স্বামীর সঙ্গে৷ নরপতির সঙ্গে ছিল নাৎসিমনির গোপন প্রেম৷
এদিকে শ্রীসুধর্ম-নাৎসিমনির একটি পুত্রসন্তানও ছিল৷ ছোট্ট সেই ছেলেটির নাম মিনসানি৷ কোনও নারী যখন ষড়যন্ত্রের জাল বিছান তা হয় আরও নিখুঁত ও ভয়ংকর৷ আর সেই ষড়যন্ত্রের ফলাফল যে কী হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ শুধু শ্রীসুধর্ম নন, বালক মিনসানিও নিহত হল৷ একজন মা হয়ে কী করে নাৎসিমনি পারলেন তাঁর সন্তানকে হত্যা করতে! প্রেম কি মাতৃত্বের চেয়েও বড় হয়ে উঠতে পারে?
আরাকানের সিংহাসনে বসলেন নরপতি৷ এরপর নাৎসিমনির গোপন নির্দেশে শ্রীসুধর্মের জ্ঞাতিদের নির্মমভাবে হত্যা করা হল৷ নিষ্ঠুরতার আর এক নাম হয়ে উঠলেন এই বিধবা রানি৷ অবশ্য পরে তিনি প্রেমিককে বিয়ে করেছিলেন কি না ইতিহাস এ ব্যাপারে নীরব৷
শ্রীসুধর্মের ছোটভাই ধরমসা বা মঙ্গত রায় ছিলেন চাটগাঁ-য় অর্থাৎ চট্টগ্রামে৷ স্বাধীনতা ঘোষণা করার পাশাপাশি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্রের হত্যাকারীদের আরাকানের রাজসিংহাসন থেকে উৎখাত করার জন্য যুদ্ধযাত্রা করলেন মঙ্গত রায়৷ কিন্তু নাৎসিমনির সৈন্যদলের কাছে পরাজিত হয়ে সোজা ঢাকায় পালিয়ে এলেন৷ সেই সময় দিল্লির সম্রাট শাহজাহান৷ মোগল সুবেদার ইসলাম খান মাশহাদি আশ্রয় দিলেন মঙ্গত রায়কে৷ সেইসঙ্গে মসনদ ও জায়গির প্রদান করেন৷
মঙ্গত রায় নিজেকে শাহজাহানের করদ রাজা বলে ঘোষণা করেন৷ মঙ্গত ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের থাকবার ব্যবস্থা হয় তৎকালীন ঢাকা নগরের ৩ মাইল উত্তরে এক জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে৷ এই জায়গাটিই পরবর্তীকালে মগবাজার নামে পরিচিত হয়৷ ‘বিক্রমপুর সাময়িকী’-তে এমন কথাও বলা হয়েছে যে, মঙ্গত রায় তাঁর পূর্বপুরুষদের ধারা অনুসরণ করে মীর আবুল কাশেম নাম নেন৷ ক্রমশ আবুল নামটিই উচ্চারণ দোষে বুলা, বলা বা বল্লাল হয়ে যায়৷ আরাকানি ভাষায় ‘রাজা’-র অর্থ হল, সিন বা সেন৷ অতএব মঙ্গত রায়ই একসময় বল্লাল সেন নামে অভিহিত হন৷ আরাকান রাজাদের দেব-দেবীরাও নাকি অর্ধেক হিন্দু ও অর্ধেক মুসলমান জ্ঞানে পূজিত হতেন৷ এমনকী মঙ্গত রায়ের আমলে মিশ্রধর্ম ও মিশ্র স্থাপত্যরীতির চর্চা বহুল পরিমাণে শুরু হয়৷ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান স্থাপত্যরীতির অনুসরণে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের নির্মাণ হওয়া অস্বাভাবিক নয়৷ মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত চতুরঙ্গ দেবমূর্তি ও দশভুজা দেবীমূর্তি আদতে আরাকানিদের উপাস্য যুগল দেবতারই মূর্তি, তেমনই ইঙ্গিত রয়েছে ‘বিক্রমপুর সাময়িকী’-তে৷
গত শতকের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দশকে কেমন ছিল ঢাকেশ্বরী মন্দির? নাজির হোসেন নামে এক ব্যক্তি তার স্মৃতিচারণ করে গিয়েছেন৷ এই বর্ণনা থেকে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের একটি অন্যরকম ছবি ফুটে ওঠে৷ (গ্রন্থসূত্র : ‘ঢাকেশ্বরী মন্দির অতীত ও বর্তমান’)৷
‘আগের দিনে চৈত্র মাসে এ ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে বিরাট মেলা বসতো৷ বহু রঙ-বেরঙের দোকানে এ স্থান সরগরম হয়ে উঠতো৷ আগমন-পুণ্যার্থী এখানে এসে মন্দির দর্শন করে পুণ্য সঞ্চয় করে বাড়ি ফিরে যেতো৷ হিন্দুধর্ম বিশ্বাসী লক্ষ লক্ষ মানুষ ব্রহ্মার পদতলে আশ্রয় ও পাপক্ষালনের আশায় চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমীতে লাঙ্গলবন্দে মিলিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান করে চির মোক্ষলাভ করতো৷ আর একই প্রেরণায় দেবী দুর্গার আশীর্বাদ লাভকল্পে পুণ্যার্থীরা সারাদিন পিপীলিকার সারির মতো বিভিন্ন পথ ধরে নানাদিক থেকে ত্রস্তপদে এগিয়ে আসত ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দিকে৷ এটি ছিল তাঁদের কাছে সারা বছরের সেরা পর্ব৷
বহু আশা-প্রত্যাশা নিয়ে ঘর থেকে বের হতো পুণ্যার্থীরা৷ চোখে-মুখে ফুটে উঠে তাঁদের প্রাণের ব্যাকুলতা, পাপমোচন করে ফেলার ঐকান্তিক আগ্রহ, আনত মস্তকে তাঁরা ভগবানের ধ্যান করতে করতে নীরবে এগিয়ে চলতেন মন্দিরের দিকে৷ কোনো দিকে তাঁদের মন নেই, আহার, নিদ্রা, পায়ের ক্লান্তির প্রতি ভ্রুক্ষেপ নেই৷ মনে তাঁদের প্রবল বিশ্বাস—সিদ্ধিলাভ হবেই৷ এসব তীর্থযাত্রী এক একটি ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত, প্রতি দলে দশ থেকে বিশজন৷ দলের সবাই স্ত্রীলোক৷ তাঁদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এক একজন মাত্র পুরুষ, গ্রামের মুরুব্বি ধরনের লোক৷
বহু দূর-দূরান্ত থেকে এমনিভাবে দল বেঁধে আসেন তাঁরা৷ অতি বৃদ্ধ দুর্বল লোলচর্ম, বয়সের ভারে ন্যুব্জ এরকম বৃদ্ধ-বৃদ্ধারও সমাবেশ ঘটে৷ মন্দিরের নিকটতম ও শহরের বিভিন্ন মহল্লা হতে যুবকরা আসে স্বেচ্ছাসেবকরূপে কাজ করার জন্য পুণ্যার্থীর৷ একান্ত নিবিষ্ট মনে স্ব স্ব আকুতি ও প্রার্থনা নিবেদন করে এবং মাঝে মাঝে ওম ঢাকা ঈশ্বরী বলে প্রণাম জানায়৷ আস্তে আস্তে দিন শেষ হয়ে যায়৷ তীর্থযাত্রীরা গৃহাভিমুখে রওনা দেন৷ এছাড়া দুর্গাপূজায় ভিড় হতো অনেক৷ এ সকল পূজায় প্রায়ই পাঁঠাবলি দেয়া হতো৷’
১৯৬৯ সালে ইস্ট পাকিস্তান ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে (ভৌগোলিক অভিধান) ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কথা রয়েছে৷ ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের এস এইচ এইচ রিজভি নামে এক ভদ্রলোকের নাম এই গেজেটিয়ার-এর জেনারেল এডিটর হিসেবে রয়েছে৷ ওই গেজেটিয়ারে বলা হয়েছে—
‘It lies beside the Dhakeswari Road near the Dhakeswari Government quarters. The Goddess Dhakeswari is regarded by the Hindus as the presiding deity of Dacca. The exact date of its construction is not known. The construction of this temple was taken up by Raja Mansingh and the style Suggests it to be of 17th century origin.’
একটা কথা জানিয়ে রাখি৷ ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মতান্তর কোনওভাবেই এর গুরুত্বকে খাটো করে না৷ বরং পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি-তর্ককে স্বাগত জানিয়ে এই মন্দির আরও বেশি মহিমামণ্ডিত হয়ে ওঠে৷ পাশাপাশি হিন্দুধর্মের উদারতার রূপই আরও একবার আমাদের চোখে ধরা দেয়৷
—চলবে
সৌজন্যে দীপ প্রকাশন