বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


রবিবারের ভোর৷ চাঁদপুর কোর্ট স্টেশন থেকে সোয়া পাঁচটায় ট্রেন ছাড়ল৷ কোচ নম্বর বাংলায় লেখা৷ ‘ঘ’ কোচে ৮ নং সিট আমার৷ চেয়ার কার৷ উৎপল মহারাজের আন্তরিকতার কথা বলতে হয়৷ নিজে স্টেশনে এসে আমাকে ট্রেনে তুলে দিলেন৷ বিদায়ের মুহূর্তে বললেন, ‘আবার কখনো সময় পেলে চাঁদপুরে আমাদের আশ্রমে অবশ্যই আসবেন৷’

আমিও বললাম, ‘আপনি বেলুড় মঠে এলে যেন খবর পাই৷’
ট্রেন চলতে শুরু করল৷ জানালা দিয়ে দেখলাম, উৎপল মহারাজ তখনও প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন৷
পাশের সিটে একজন বয়স্ক মুসলমান ভদ্রলোক আমার সঙ্গে গল্প জুড়লেন৷

বাংলাদেশে এই প্রথম আমার ট্রেন-ভ্রমণ৷ আমার পরিচিত কয়েকজন মৈত্রী এক্সপ্রেসে কলকাতা থেকে ঢাকা গিয়েছেন৷ রেলপথে কলকাতা থেকে ঢাকার দূরত্ব ৩৭৫ কিমি৷ ব্রডগেজ৷ কোচগুলো যথেষ্ট উন্নতমানের৷ সপ্তাহে দুদিন সকালে যথাক্রমে কলকাতা স্টেশন ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রেন ছাড়ে৷ ১০/১১ ঘণ্টা সময় লাগে গন্তব্যে পৌঁছতে৷
কলকাতা স্টেশন থেকে গেদের দূরত্ব ১১৪ কিমি৷ আবার গেদে থেকে বাংলাদেশের দর্শনা ১৬ কিমি৷ এই গেদে ও দর্শনায় ইমিগ্রেশন ও ভিসার কাগজপত্র চেকিং হয়৷ এজন্যই ঘণ্টা চারেক সময় লাগে৷ ২০০৮ সালের ১৪ এপ্রিল মৈত্রী এক্সপ্রেস চালু হয়েছিল৷ মৈত্রী এক্সপ্রেস সপ্তাহে তিনদিন চালানো হবে বলে জানতে পারলাম৷
ওই ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—‘কেমন লাগতাছে আমাদের দ্যাশের ট্রেন?’ বললাম, ‘কোচ নম্বর, সিট নম্বর সবকিছুই বাংলায় লেখা৷ দারুণ ব্যাপার৷’

ভদ্রলোক এবার আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, ‘তাহলেই বোঝেন বাংলা ভাষারে কতটা গুরুত্ব দিই আমরা৷’ তারপরই দুখী দুখী মুখ করে বললেন, ‘জানেন দ্যাশটারে কেউ আর ভালোবাসে না৷ নেতা-নেত্রীরা ছিঁড়া-খুঁইড়া খাইতাছে৷’

চাঁদপুরের পর বড় স্টেশন ফেনি জংশন৷ বেশ ভালোই গতি ট্রেনের৷ হকার, ভিখারি সবরকমই আছে৷ ফেনির পর সীতাকুণ্ড, কৈবল্যধাম, পাহাড়তলি প্রভৃতি স্টেশন পেরিয়ে বেলা পৌনে ১১টা নাগাদ চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছলাম৷
আরও পড়ুন:

বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব-৪২: পয়লা বৈশাখে শ্রীশ্রীগোপাল জিউর আখড়ার অন্যতম বড় উৎসব গণেশপুজো

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৫: বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র— বইয়ের জন্য ভালোবাসা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৪: আশা-নিরাশা ও ভরসার সে এক অন্য ‘মনের ময়ূর’

চট্টগ্রামে এসে শুনলাম, এখানেও গতকাল রাতে ভালো বৃষ্টি হয়েছে৷ আনোয়ার হোসেনের রিকশয় আসকার দিঘির পশ্চিম পাড়ে রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমে ৪০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছলাম৷ দিঘি তেমন পরিষ্কার নয়৷ শুক্র ও শনি পর পর দু-দিন ছুটির পর রবিবার চট্টগ্রাম শহরের আরেকটা কর্মব্যস্ত দিন৷

বাংলাদেশে ঢাকার পরই চট্টগ্রামের গুরুত্ব৷ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলছিল বলে বিভিন্ন দেশের জাতীয় পতাকা রাস্তার কয়েক জায়গায় শোভা পাচ্ছে৷ ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে কয়েকটা ম্যাচ হয়েও গিয়েছে৷ টিভি খুললেই বিশ্বকাপের থিম সঙ্ শোনা যায়—‘চার ছক্কা হই হই/বল গড়াইয়া গেল কই…৷’ বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কাটআউট রাস্তার বিভিন্ন মোড়ে৷ বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহর চট্টগ্রাম৷ তবে যানজটে একবার আটকে গেলেই তার হাত থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া মুশকিল৷

এখানে সাইকেল-রিকশ ও সি এন জি অটোর সংখ্যা অগুনতি৷ বহুতল মার্কেট কমপ্লেক্স আর পশ রেসিডেন্সিয়াল এলাকা৷ শহরের কিছু এলাকা অনেকটা মুম্বইয়ের কোনো কোনো জায়গার মতো একটু উঁচুনিচু৷

রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের বড় মহারাজ স্বামী শক্তিনাথানন্দজি খুব স্নেহপ্রবণ৷ সেই দিনটা বিশ্রাম নিয়ে পরদিন ৫১ পীঠের অন্যতম সীতাকুণ্ডে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন৷ তবে পুরো দিনটা যাতে নষ্ট না হয় তাই বিকেলের দিকে বেরিয়ে পড়লাম কৈবল্যধামের উদ্দেশে৷
আরও পড়ুন:

বাইরে দূরে: পর্ব-৮ ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-৮: এখানে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা…আবার সূর্য ডুবলে বাড়ি ফিরে যাই

খাই খাই: শীতের সন্ধ্যায় অন্য রকমের কিছু চাই? তাহলে সহজে বানিয়ে ফেলুন নারকেলের সিঙারা

বাস্তুবিজ্ঞান, পর্ব-১৬: উচ্চমানের জমি বাছাইয়ে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ভূমির শ্রেণিবিভাগ জানা খুবই জরুরি /২

রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম থেকে শ্রীশ্রীরামঠাকুরের আশ্রম অটোরিকশয় প্রায় ৫ কিমি৷ ভাড়া ১০০ টাকা৷ রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের এক ভক্ত সমীরণ চৌধুরি আমার সঙ্গে যাবেন৷ চট্টগ্রামের অন্যতম পশ এলাকা খুলশি হয়ে কৈবল্যধামে পৌঁছলাম ঘণ্টাখানেকের মধ্যে৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় খুলশির একাংশ বধ্যভূমি ছিল৷ বহু লোককে হত্যা করে এখানে ফেলে রাখা হত৷ ডায়াবেটিক আই কেয়ারসহ অনেকগুলো হাসপাতাল রয়েছে এই অঞ্চলে৷ একটু পাহাড়ি কয়েক একর জায়গা নিয়ে আশ্রমটি গড়ে উঠেছে৷ স্থানটি বড়ই মনোরম৷ কত যে গাছপালা চারপাশে৷

শ্রীশ্রীরামঠাকুরের মন্দিরটিও বেশ বড়৷ সেই সময় নাটমন্দিরে বসে কেউ কেউ ধ্যান করছেন৷ সূর্য অস্তাচলে৷ ভোর ৫টায় মন্দির খোলে৷ এরপর মঙ্গলারতি৷ সকালে বাল্যভোগ৷ সকাল ১০টায় প্রথম পুজো৷ বেলা ১২টার মধ্যে পঞ্চব্যঞ্জনসহ অন্নভোগ৷ মন্দির বন্ধ ১টা থেকে ৩টে৷ আবার খোলার পর সন্ধ্যাপুজো৷ সন্ধ্যারতি৷ শীতলভোগ৷ রাত সাড়ে আটটায় মন্দির বন্ধ হয়৷ চারজন পূজারি৷ প্রধান পূজারি রঞ্জিত চক্রবর্তী৷ অন্য তিনজন পূজারি সঞ্জিত চক্রবর্তী, মৃদুল চক্রবর্তী এবং পরিমল চক্রবর্তী৷
আরও পড়ুন:

দশভুজা : তিনিই সারস্বত সাধনার প্রতিরূপা সত্যিকারের দশভুজা

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৬: ‘সত্যেরে লও সহজে’—রাজসুখ ছেড়ে কি তবে বনবাসী মন?

সেদিনের কোম্পানি বাগানই আজকের বোটানিক্যাল গার্ডেন

প্রতি শুক্রবার আট-দশ হাজার ভক্ত এখানে সমবেত হন৷ কৈবল্যধাম অফিসের দুই কর্মচারী বাবু সেনগুপ্ত এবং লালমোহন দে-র সঙ্গে কথাবার্তা হল৷ শুনলাম, শ্রীশ্রীরামঠাকুরের জন্মতিথি পালন ছাড়াও শারদীয়া দুর্গোৎসব এই আশ্রমের অন্যতম প্রধান উৎসব৷ প্রতিমা নয়, ঘট বসিয়ে দশভুজার পুজো হয়৷ তবে আশ্রমে ঢোকার মুখে বিশাল বটগাছের নীচে প্রতিমা গড়ে যে পুজো হয় তা মালিপাড়ার দুর্গাপুজো নামে পরিচিত৷

লালমোহনবাবুর মুখে এক ভয়াবহ ঘটনার কথা জানতে পারলাম৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় এই আশ্রমের তৃতীয় মহন্ত শ্রীযুক্ত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় শহিদ হন৷ খান সেনাদের বুলেটে মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তাঁর শরীর৷ আশ্রমবাসী আরও ১০ জনকে হত্যা করে তারা৷ তখন এই আশ্রমের চারপাশে (মূলত পূর্ব ও পশ্চিমে) বিহারী মুসলমানদের বসবাস৷ এমনকী আশ্রমের পবিত্র বটগাছটিকেও টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে তারা৷ অবশ্য পরে নতুন বটবৃক্ষ ডালপালা মেলে৷

সমীরণ চৌধুরি মানুষটি খুবই ভালো৷ আলাপীও৷ বাংলাদেশ ইলেকট্রিসিটিতে চাকরি করতেন৷ একবার ডিউটির সময় হঠাৎ ট্রান্সফরমার ফেটে তাঁর গায়ে আগুন লাগে৷ থার্ড ডিগ্রি বার্ন৷ সাংঘাতিক ইনজুরি৷ যমে-মানুষে টানাটানি৷ কপালের জোরে বেঁচেছেন৷ এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন৷ রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমেই সমীরণবাবুর বেশিরভাগ সময় কাটে৷ স্ত্রী মারা গিয়েছেন অনেকদিন৷

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content