সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অত রাতে চাঁদপুরের শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রমের প্রধান স্বামী সেবাময়ানন্দ (উৎপল মহারাজ) স্টিমার ঘাটে আমার আসার অপেক্ষায় ছিলেন৷ হাসিখুশি মানুষ৷ স্টিমার ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই মোটামুটি কটা নাগাদ চাঁদপুরে পৌঁছতে পারি, উৎপল মহারাজকে মোবাইলে জানিয়ে রেখেছিলাম৷ ১৯২০ সালে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়৷
স্টিমারঘাট থেকে সাইকেল-রিকশয় আশ্রমে পৌঁছলাম রাত ২টো নাগাদ৷ যাওয়ার পথেই সেদিন সকালের প্রোগ্রাম উৎপল মহারাজের সঙ্গে আলোচনা করে ফাইনাল করে ফেললাম৷ যাব শ্রীশ্রীমেহার কালীবাড়ি৷ মহারাজ বললেন, তিনি আশ্রমের একটি ছেলেকে আমার সঙ্গে দেবেন৷ ছেলেটি আমার গাইড৷

সকাল ১০টা৷ রাতে জোর এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় রোদের তাপ তেমন মালুম হচ্ছে না৷ বিকাশ সূত্রধর আমার সঙ্গী৷ ওর বাড়ি চাঁদপুর থেকে ১০ কিমি উত্তর-পূর্বে রাজারগাঁও নামে এক জায়গায়৷ বাসে যেতে যেতে বিকাশের গল্প শুনছিলাম৷ ওর বাবা রিটায়ার্ড সুকল-টিচার৷ ইংরেজি পড়াতেন৷ বিকাশের দেড় বছর বয়সে ওর মা মারা যান৷ ওরা চার ভাই৷ এক দাদা দুবাইতে চাকরি করেন৷ আর এক দাদা চট্টগ্রাম রামকৃষ্ণ মিশনে রয়েছেন৷ তাঁর নাম সূর্য ব্রহ্মচারী৷
চাঁদপুর থেকে শ্রীশ্রীমেহার কালীবাড়ি প্রায় ৩৫ কিমি৷ চাঁদপুর জেলা৷ শাহরাস্তি উপজেলা৷ এই উপজেলার অন্তর্গত মেহার নামে এক গ্রামে দশমহাবিদ্যা সিদ্ধ পীঠস্থান৷ জাগ্রত শক্তিপীঠ৷ চাঁদপুর থেকে মেহারপুর যাওয়ার পথে মহামায়া দেবীর মন্দির৷ হাজিগঞ্জ হয়ে হাইওয়ের ওপর শাহরাস্তি গেটে নামতে হয়৷ সেখান থেকে সি এন জি ধরে আড়াই কিমি দূরে মিটারগেজ ট্রেনের লেভেল ক্রসিং পেরলেই এই শক্তিপীঠ৷

বাস ও অটো মিলিয়ে চাঁদপুর থেকে মেহার কালীবাড়ি মাথাপিছু যাতায়াত ভাড়া মোটামুটি আড়াইশো টাকা৷ সেদিন আবার শনিবার৷ শনি-মঙ্গল এখানে ভক্তদের ভিড় হয়৷ মেঘনার একটা অংশ মেহার গ্রামের পাশ দিয়ে খাল হয়ে বয়ে গিয়েছে৷ অনেক আগে যখন যাতায়াতের অসুবিধা ছিল, তীর্থযাত্রীরা রাতে এই খাল বেয়ে নৌকায় করে মেহার কালীবাড়িতে ভোরে পৌঁছত৷ খালের নাব্যতাও ছিল৷
আরও পড়ুন:

বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব-৪০: কীর্তনখোলা নদীর তীরে সন্ধ্যার বরিশালের অন্য আকর্ষণ

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৫: বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র— বইয়ের জন্য ভালোবাসা

আমরা সি এন জি ধরে বেলা সাড়ে এগারোটার মধ্যে কালীবাড়িতে পৌঁছে গেলাম৷
কালীবাড়ি হলেও এখানে কোনো কালীমূর্তি পুজো করা হয় না৷ বট, অশ্বত্থ ও জীনবৃক্ষকেই মা কালীর থান হিসাবে পুজো করা হয়৷ গোলাকৃতি অনেকখানি জায়গা নিয়ে এই বৃক্ষগুলো রয়েছে৷ বৃক্ষগুলোর নীচের অংশ সিঁদুরে রাঙানো৷ কিংবদন্তি, ১৪২৬ খ্রিস্টাব্দের পৌষ সংক্রান্তি শুক্রবার অমাবস্যা রজনীর শেষার্ধে পুণ্যাত্মা সর্বানন্দ এখানে সিদ্ধিলাভ করেন৷ অলৌকিক ব্যাপার! সাধন সিদ্ধকালে সর্বানন্দ বিস্ময়াভূত হয়ে লক্ষ করেন জীনবৃক্ষের প্রতি পাতায় দশমহাবিদ্যার নাম৷

ঢাক বাজছে৷ পুজো হচ্ছে দু-তিন জায়গায়৷ আমিও মোমবাতি ও ধূপকাঠি জ্বেলে পুজো দিলাম শ্রীশ্রীমেহার কালীমাতাকে৷ পেড়া ও রক্তজবা দিয়ে নৈবেদ্য৷ পূজারি সন্তোষ ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথাবার্তা হল৷ তাঁকে নিয়ে চার-পাঁচজন পূজারি এখানে৷ মায়ের পূজা হয় তন্ত্রমতে৷ শুনলাম, শ্রীশ্রীমেহার কালীমাতাকে মুসলমান সম্প্রদায়ও খুব মান্য করে৷ তাঁদের অনেকেই মানত রাখেন৷ মায়ের থানের চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করেন৷

উৎপল মহারাজের কাছে শুনেছিলাম, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দুই প্রয়াত প্রেসিডেন্ট মহারাজ যথাক্রমে স্বামী গহনানন্দজি এবং স্বামী ভূতেশানন্দজি মেহার কালীমন্দিরে দু-দুবার এসেছেন, পুজো দিয়েছেন৷ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট মহারাজ স্বামী প্রভানন্দজিও এই তীর্থস্থানে এসেছেন৷ তিনি একসময় চাঁদপুরের সুকলে পড়াশুনোও করেছেন৷ মেহার কালীবাড়ির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শ্রীযুক্ত পরিতোষ দেব বললেন, ‘বিশেষ বিশেষ উৎসবে ইন্ডিয়া থেকে অনেক সাধু-সন্ন্যাসী এখানে আসেন৷ জীনবৃক্ষের নীচে বসে দশমহাবিদ্যার সাধনা করেন৷’
আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে: সন্তান কম মনোযোগী কিন্তু অতি সক্রিয়? সহজ উপায়ে বাড়িতেই এর চিকিৎসা সম্ভব

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন: ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মেনে চললে বাড়িতেই ডেঙ্গির চিকিৎসা করা সম্ভব

মায়ের বাড়ির পূর্বদিকে পুকুরের উত্তর-পশ্চিম কোনে শ্মশানেশ্বর শিবের মন্দির৷ পুকুরের পূর্বপাড়ে অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে হরিসভা৷ এই হরিসভার মন্দিরের ভেতরে শ্রীরাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি শোভা পাচ্ছে৷ মন্দিরের সামনে বিশাল নাটমন্দির৷ নিত্য রাধা-কৃষ্ণের ভোগরাগ, সেবা-পুজো হয়৷

প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ও প্রতি বাংলা মাসের পয়লা তারিখ স্থানীয় ভক্তরা সন্ধ্যা থেকে এখানে মৃদঙ্গ ও করতাল বাজিয়ে তারক ব্রহ্মনাম কীর্তন করেন৷ তার আগে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত ও ভাগবত পাঠ হয়৷ শ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা এখানে বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়৷ মহা সমারোহে জন্মাষ্টমী উৎসব পালিত হয়৷ দূর্গাপুজোয় দর্শনার্থীর ভিড়ে পুজোমণ্ডপ উপচে পড়ে৷ পরিতোষবাবুর মুখে শুনলাম, ভজন, শ্রীকৃষ্ণের লীলাকীর্তন, শ্রীশ্রীহরিনাম যজ্ঞে ভক্তরা অত্যন্ত আনন্দলাভ করেন৷ চতুর্দিকে হরিবোল আর উলুধ্বনির সমন্বয়ে মন্দিরে এক ভক্তিভাবের পরিবেশ রচিত হয়৷

পরিচয় হল, রমেন কুমার বণিকের সঙ্গে৷ ঢাকা বিক্রমপুর থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে এই তীর্থে এসেছেন৷ স্ত্রী, দুই ছেলে, বিবাহিত মেয়ে-জামাই, বড় বোন৷ ‘এবার বেশ বড় টিম নিয়াই এখানে আসছি—’ বললেন রমেনবাবু৷ ওঁরা সময় পেলেই এখানে আসেন৷ রমেনবাবুর মেয়ে সুবর্ণা দাস খুব হাসিখুশি৷ দেখতেও মিষ্টি৷ পলিটিক্যাল সায়েন্সে মাস্টার্স করছেন৷ বললেন, ‘মেহার কালীবাড়িকে আমরা খুব মান্যি করি৷’
হঠাৎ আমার নজর গেল পুকুরের এক কোনে৷ একটু দূর থেকে হলেও ঠিক চিনতে পারলাম তাঁকে—শ্যামা ভৈরবী৷ পায়ে পায়ে এগোলাম সেদিকে৷ চোখ বুজে ধ্যানে বসেছেন৷ এ সময় তাঁকে বিরক্ত করার মানে হয় না৷ তাই যেভাবে নিভৃতে এসেছিলাম, ফিরে গেলাম সেভাবেই৷
আরও পড়ুন:

‘ওগো তুমি যে আমার…’— আজও তাঁর জায়গা কেউ নিতে পারেনি/২

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১২: সে এক ‘বউঠাকুরাণীর হাট’ [১০/০৭/১৯৫৩]

ফেরার পথে হাজিগঞ্জ বাজারে হাজিগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ দেখে ভীষণ ভালো লেগেছিল৷ দর্শনীয় এই বিরাট মসজিদের গায়ে কী সুন্দর কারুকার্য! এটি ওয়াকফ সম্পত্তি৷ দুপুরের কড়া রোদ্দুরে মসজিদটি ঝকঝক করছিল৷

পশ্চিমবঙ্গের এক সময়ের বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভার প্রয়াত পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তীর বাড়ি ছিল হাজিগঞ্জ উপজেলার ‘তামমোহন’ নামে এক জায়গায়৷ তিনি একবার দেশের বাড়ি দেখতে এসেছিলেন৷
বাসে শ্রীমতী পারুল সরকারের সঙ্গে পরিচয়৷ স্বামীর সঙ্গে বেয়াই বাড়ি গিয়েছিলেন৷ হাজিগঞ্জের উত্তরে পদুয়া গ্রামে বাড়ি পারুলদেবীর৷ জিজ্ঞাসা করলেন—চাঁদপুরে এসে সেখানকার ক্ষীর আমি খেয়েছি কি না৷ চাঁদপুর জেলার ‘মতলব’ নামে এক জায়গার ক্ষীর নাকি সারা বাংলাদেশে বিখ্যাত৷ পারুল সরকার এবার ছড়া কেটে বললেন, ‘মতলইব্বার ক্ষীরা/ফদুয়ার চিঁড়া/কুমিল্লার রসমালাই/বগুড়ার দই৷’ একেকটা জিনিসের জন্য একেক জায়গার পরিচিতি৷
আরও পড়ুন:

বাইরে দূরে: ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-৭: রঙের খেলা আর উইসকনসিনের আঁকাবাঁকা ফাঁকা রাস্তা—জীবনীশক্তিকে আরও উসকে দেয়

খাই খাই: গরম দুধের গন্ধ ভালো লাগে না? রইল সহজ সমাধান

পারুল সরকারের স্বামী হরেকৃষ্ণ সরকার সুকলে পড়াতেন৷ অবসর নিয়েছেন৷ তাঁদের চার ছেলে৷ দুই ছেলে দুবাইতে থাকেন৷
—ছেলেরা আপনাদের দেখাশোনা করে?
‘তা দেখে তো বটেই! তয় জানা কথা পোলাদের চাইতে মাইয়াদের সাংসারিক কাজকামে দক্ষতা বেশি৷’ বললেন পারুলদেবী৷
—বাংলাদেশের গ্রামের মেয়েদের সামাজিক অবস্থা কেমন?
‘আমাগোই তো ঘরের সব কামকাজ করতি হয়৷ মাইয়াদের খাটুনিও খুব৷’
বললাম, ‘পুরুষরা বুঝি অর্ডার দিয়েই ক্ষান্ত!’
পারুলদেবী বললেন, ‘তই (তাই তো)!’

তাঁর গ্রামে তুলসীমঞ্চে প্রদীপ দেওয়া, শাঁখ বাজানোয় কোনো অসুবিধা হয় না বলে জানালেন পারুলদেবী৷
‘আপনার গ্রামে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক কেমন?’
পারুলদেবী বললেন, ‘আমাগো গাঁয়ে হিন্দু-মুসলমানের মইধ্যে মিলমিশ আছে৷ তয় রাজনীতির অস্থিরতার লাইগা গণ্ডগোল ঘটে মাঝে মাঝে৷’

শুনলাম, এবারের শিব চতুর্দশীতে চট্টগ্রামের ৫১ পীঠের অন্যতম ‘সীতাকুণ্ড’-এ সপরিবারে গিয়েছিলেন পারুলদেবী৷ বললেন, ‘পাহাড়ের উপর পীঠ৷ উৎসবের কারণে বড্ড ভিড়৷ না স্নানের জায়গা, না পূজার৷ তয় অন্য সময় যাইতে পারলে ভালোই লাগব৷’
হাজিগঞ্জে স্বামীকে নিয়ে নেমে গেলেন পারুল সরকার৷
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content