শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


বরিশালের প্রধান বাসস্ট্যান্ড নথুল্লাবাদের অদূরে চারণকবি মুকুন্দ দাস প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দির।

আবার ইচলাদি বাসস্ট্যান্ডে সাইকেল রিকশয় ফেরা৷ বেলা প্রায় পৌনে একটা৷ গ্রামের পথে সেই ঝিল্লিরব৷ সাংবাদিকতার কাজে পশ্চিমবঙ্গের অনেক গ্রামগঞ্জে গিয়েছি৷ কিন্তু ওপার বাংলার মতো ঝিঁঝিঁপোকার এমন ঐকতান কোথাও শুনিনি৷ যেন কয়েকশো ঝুমঝুমি একসঙ্গে বাজছে৷ গ্রামে না হয় ঘন গাছপালা, কিন্তু মফস্সল শহর ও হাইওয়েতে যে নিরবচ্ছিন্ন ঝিল্লিরব শুনেছি! এক অটোচালকের মুখে শুনেছিলাম, ছোট ছেলে-মেয়েরা নাকি খেলার ছলে ঝিঁঝিঁপোকা ধরে হাতের তালুতে রেখে তার ডাক শোনে৷ কচিকাঁচাদের কাছে এ এক মজার খেলাই বটে!

অনিমেষ সু-পরামর্শই দিল৷ আমরা রামকৃষ্ণ মিশনে ঢোকার আগে মুকুন্দ দাসের কালীমন্দির দেখে নেব৷ মন্দিরের মূল গেটে চারণকবি রচিত দুটো দেশাত্মবোধক গানের একাংশ৷ (১) ‘রাম রহিম না জুদা কর ভাই/মনটা খাঁটি রাখ জী৷’ (২) ‘বান এসেছে মরা গাঙে/খুলতে হবে নাও/তামরা এখনো ঘুমাও? এখনো ঘুমাও৷’ মন্দিরের গর্ভগৃহে দর্শনীয় কালীমূর্তি! মা সরস্বতী ও আরও দেবী-দেবীর ছোট মূর্তি প্রাঙ্গণের বিভিন্ন জায়গায়৷ চারণকবির একটি আবক্ষ মূর্তিও রয়েছে৷ মূল মন্দিরের একপাশে ভোগঘর৷ গরিব মানুষদের মধ্যে মাতৃভোগ বিতরণের ব্যবস্থা আছে৷ ইতিমধ্যে মধ্যাহ্ণের পুজো শেষ হয়েছে৷ পূজারি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শুনলাম, শ্যামাপুজোয় মন্দিরে খুব ধুমধাম হয়৷

সেদিন মিশনে ফিরতে বেশ বেলা হল৷ আজ নিরামিষ খাবার৷ গরম গরম খিচুড়ির সঙ্গে লাবরা৷ আলুভাজা, উচ্ছেভাজা৷ শেষপাতে টমেটোর চাটনি ও গুড়ের পায়েস৷ আশ্রমে বেশ ভিড়৷ অনেকেই প্রসাদ নিতে আসে৷ রামকৃষ্ণ মিশনে নিরামিষ রান্নার দারুণ স্বাদ!
খাওয়ার অপেক্ষায় আশ্রম অফিসের বাইরে একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসেছিলেন বরিশাল ঝাউতলা গুপ্তকন্যার বাসিন্দা অশীতিপর বিধবা আশারানি দাস৷ তাঁর পাশে আর এক বৃদ্ধা উষারানি দাস৷
আশারানিদেবীর মনে খুব দুঃখ, নিজের পেটের মেয়েটাই ভালো করে মাকে দেখে না৷ বললেন, ‘দুইটা নাতি৷ একজন ঢাকায় চাকরি করে, অন্য নাতিটার মুদি দোকান বাড়ির পাশে৷ ঢাকার নাতিটার বিরাট মন৷ আমার লাইগ্যা তার পরাণখান বাইরয় যায়৷ কী কমু সংসারের এইসব ছোট্ট কথা৷ আজ আবার মাংস রান্না হইছে৷ কী খামু কন তো? তাই আশ্রমে নিরামিষ প্রসাদ লইতে আসছি৷’ নরসিংদীতে শ্রীশ্রীনুকূল ঠাকুরের নাম নিয়েছেন আশারানি৷

উষারানিদেবীও বিধবা৷ বরিশাল নতুন বাজারে টালি ও দরমার বেড়ার ঘর৷ তাঁরও অভাবের সংসার৷
এবার আশারানি দাস আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—তুমি বাবা কোথা থিকা আইছ? কলকাতার কথা শোনামাত্রই দুখী দুখী মুখ করে বললেন, ‘কলকেতে? সেখানে আর যাইতে পারলাম কই?’ সঙ্গে সঙ্গে উষারানি বললেন,‘কলকেতা বুঝি খুব বড় শহর বাছা?’ বললাম, ‘তা একটু বড় তো বটেই!’

বিকেলে বেরবার সময় দেখলাম, মিশনের আউটডোরে মহিলা ও শিশুর ভিড়৷ অধিকাংশই গরিব মুসলমান৷ চিকিৎসককে দেখানোর জন্য প্রতিটি রোগীকে ১০ টাকার একটা টিকিট কাটতে হয়৷ চেম্বারে ডাঃ সঞ্জয় সাহার সঙ্গে কথাবার্তা হল৷ বরিশাল শহরে রামকৃষ্ণ মিশনের এই আউটডোর যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে বলে জানতে পারলাম৷ ডাঃ সাহা বললেন—সাধারণত ত্বকের নানা ধরনের সমস্যা, পেটের অসুখ, জ্বর, আর্থ্রাইটিস এসব নিয়েই গরিব পেশেন্টরা এখানে আসে৷ মিশন কর্তৃপক্ষ তাদের যথাসম্ভব পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করেন৷

বরিশাল রামকৃষ্ণ মিশনে একটা ছাত্রাবাস আছে৷ একশোর কাছাকাছি হিন্দু ছাত্র থাকে৷ সিটরেন্ট শ’চারেক টাকা, আর খাওয়া-দাওয়ার জন্য মাথাপিছু খরচ হাজার দেড়েক টাকা৷ অনিমেষ বলল, ‘চলুন, মহাত্মা অশ্বিনী দত্তের বসতবাড়ির দিকটা একটু ঘুরে আসি৷

সাইকেল-রিকশর মুখ ঘুরল কালীবাড়ি রোডের দিকে৷ অশ্বিনী দত্তের বসতবাড়ি এখন সরকারি বরিশাল কলেজ৷ ’৭১-এর পর কো-এডুকেশন কলেজ হয়েছে৷ তবে হস্টেলের ব্যবস্থা নেই৷ অশ্বিনী দত্তের নামে এই কলেজের নামকরণ হওয়া উচিত ছিল৷
আরও পড়ুন:

বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব ৩৮: শিবের বুকের ওপর দণ্ডায়মান দেবীর চারহাতে রয়েছে খেটক, খড়্গ, নীলপদ্ম ও নরকঙ্কালের খুলি

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৪: পাঠক, লেখক ও শুভাকাক্ষীদের অনুপ্রেরণায় দেশের সর্বত্র পৌঁছে যাচ্ছে বইয়ের জাহাজ বাতিঘর সম্রাজ্যের দীপ্তি

ফিল্ম রিভিউ: ‘হাওয়া’য় ভেসে গেল বাঙালি

বাইরে দূরে: ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-৬: গাড়ির সান রুফ খুলে চালিয়ে দিলাম ‘সুহানা সফর হ্যায় ইয়ে মৌসম হাসি, হামে ডর হ্যায় কে…’

শহরের ব্যস্ততম রাস্তা হল সদর রোড৷ কালীবাড়ি রোডের শুরু এই সদর রোড থেকে৷ শেষ হয়েছে শীতলা মন্দিরে (শীতলাখোলা)৷ প্রায় ১ কিমি লম্বা এই রাস্তার ওপরেই ব্রজমোহন সুকল ১৮৮৫ সালে শুরু হয়৷ ক্লাস থ্রি থেকে টেন, বয়েজ সুকল৷ কালীমন্দিরের জন্যই রাস্তাটির নাম কালীবাড়ি রোড৷ একে ছোট কালীমন্দির বলে৷ প্রতিদিন পুজো হয়৷ পূজারি মন্দিরেই থাকেন৷ চকের পোল থেকে বাঁদিকে নেমে বাজার রোডে বড় কালীমন্দির৷ জগদীশ সারস্বত গার্ল সুকল অ্যান্ড কলেজ ছোট কালীমন্দিরের কাছেই৷ বরিশাল গভর্নমেন্ট উইমেনস কলেজেরও যথেষ্ট নামডাক৷

সরকারি বরিশাল কলেজের উলটোদিকে সন্তু দাস ও দিলীপকুমার দাসের বড় স্টেশনারি দোকান ‘অর্পিতা স্টোর্স’৷ বিক্রিবাট্টা ভালোই৷ দু’ভাই-ই হাসিখুশি৷ বরিশাল শহরেই ওঁদের জন্ম৷ এখানেই পড়াশুনো৷ কাছাকাছি শ্রীনাথ চ্যাটার্জি লেনে ওঁরা বাড়ি করেছেন৷ শ্রীনাথ চ্যাটার্জি লেনের আশপাশে অনেক বাঙালি হিন্দুর বাড়িঘর আছে৷ হিন্দু পাড়াই বলা যায়৷ ৫০০-৭০০ হিন্দুর বাস৷

সন্তুবাবুই গল্প করতে করতে বললেন যে, একসময় এদিককার প্রচুর জমিজমা শ্রীনাথ চ্যাটার্জিদের ছিল৷ তাঁদের প্রচুর স্থাবর সম্পত্তি মুসলমানরা দখল করে নেয়৷ শ্রীনাথবাবুরা প্রায় ৫০ বছর আগে নিজেদের জমি-জায়গার মায়া ত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন৷ কলসকাঠির জমিদার বংশের অধীনেও এখানকার বেশ কিছু জমিজমা ছিল৷ বরিশাল থেকে কলসকাঠি ঘণ্টা কয়েকের পথ৷ আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় আসার পর হিন্দুদের নিরাপত্তা খানিকটা বেড়েছে৷ বরিশাল ডিভিসনের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে অনেক হিন্দু পরিবার এখন মাথা তুলে আছে বলে মন্তব্য করেন সন্তু দাস৷ তাঁর বাড়িতেও আমাকে নিয়ে গেলেন৷
আরও পড়ুন:

ইংলিশ টিংলিশ: Types of Sentences কাকে বলে জান কি?

কাজের চাপে হাঁসফাঁস অবস্থা? কী করে পরিস্থিতি সামলাবেন? জেনে নিন কিছু সহজ উপায়

খাই খাই: গরম দুধের গন্ধ ভালো লাগে না? রইল সহজ সমাধান

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৩: খালেবিলে, ধানখেতে, পুকুরে, নদীতে ঘুরে বেড়ানো ‘ম্যাজিশিয়ান’ জেব্রা ফিশ ভবিষ্যতে রোগ নিরাময়ে নতুন দিশা দেখাবে

অর্পিতা স্টোর্সে পরিচয় হল মহম্মদ জাহিদি আলম সুমনের সঙ্গে৷ বেশ লম্বা নাম৷ যুবকের নামের মধ্যে আমার নামটাও লুকিয়ে আছে দেখে আবার একটু মজাও লাগল! যুবক ব্যবসায়ী৷ চিন থেকে পটেটো চিপস আমদানি করেন৷ থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করেন মাশরুম, কারিপেস্ট, টুনাফিশ প্রভৃতি৷

পরিচয় দিয়ে বললাম,‘আমার নামও সুমন৷ পদবি গুপ্ত৷ নিজেকে লুকিয়ে রাখতেই একটু পছন্দ করি৷’ আমার কথা শুনে মহম্মদ জাহিদি, সন্তুবাবু ও দিলীপবাবু ‘হো হো’ করে হেসে ওঠেন৷ ঢাকায় সংসদ ভবনের পাশে মহম্মদ জাহিদির অফিস৷ গল্প করতে করতে বললেন, ‘ভারত থেকে পারফিউম আর চকোলেট আনাবার কথা ভাবতাছি৷’ ব্যাবসা যে ভালোই চলছে তাঁর কথাবার্তাতেই বোঝা গেল৷

বরিশাল শহরে এই যুবকের বাড়ি৷ এখানেই বড় হয়েছেন৷ জন্মস্থানের মায়া কাটাতে পারেননি মহম্মদ জাহিদি৷ মায়া কাটানো সম্ভবও নয়৷ পুরনো বন্ধু-বান্ধবের টান উপেক্ষা করা যায় না৷ তাই মাঝে মাঝেই বরিশাল শহরে দু-একদিন কাটিয়ে যান৷ বললেন, ‘সন্তুদা এবং দিলীপদা দুজনাই আমার খুব কাছের মানুষ৷’
বাংলাদেশের অনেক হিন্দুর মুখে এ কথাও শুনেছি, এই দেশের মুসলিম সমাজ যত শিক্ষিত হচ্ছে, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশ পালটাচ্ছে৷ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ব যে কতখানি তা অনুধাবন করতে পারছেন তাঁরা৷

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content