সকাল সকালই বেরলাম ৫১ পীঠের অন্যতম উগ্রতারা মন্দিরের উদ্দেশে৷ বরিশাল শহর থেকে বাসে ১৩ কিমি উত্তরে এই মন্দির৷ আমার সঙ্গে অনিমেষ৷ যেতে যেতে আলাপ হল, আবদুল রজ্জাকের সঙ্গে৷ বাংলাদেশের ল্যান্ড রেভিনিউ বিভাগে চাকরি করেন৷ ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য একসময় তাঁকে কিছুদিন কলকাতার ঠাকুরপুকুরে থাকতে হয়েছিল৷ আমি সাতক্ষীরায় গিয়েছি শুনে বললেন, ‘ওইখানে তো জামাত-ই-ইসলাম-এর বিরাট প্রতাপ! সোনার বাংলা সত্যই সোনার বাংলা হইতে পারত৷ কিন্তু এইরকম কিছু সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের লাইগ্যাই আমাগো দ্যাশ ছারখার হইয়া যাইতাছে৷’
আবার গতকাল রাতেই বরিশাল শহরের এক মুসলমান দোকানদারের মুখে সাতক্ষীরার গল্প শুনেছিলাম৷ জামাতরা নাকি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর একের পর এক মসজিদ গড়ে তুলছে৷ অনুপ্রবেশ চলছে অবাধে৷ আর, ভারতীয় সীমানায় গণ্ডগোল পাকানোরও চেষ্টা করছে৷ এমন কথাও শুনলাম, জামাত-ই-ইসলাম দলের তহবিলে যে অর্থ রয়েছে তা নাকি আওয়ামি লিগ ও বি এন পি দলের মিলিত সম্পত্তির কয়েক গুণ!
গ্রামাঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতির মনোভাব যথেষ্ট এমন দাবিও করলেন আবদুল রজ্জাক৷ তাঁর প্রিয় বন্ধু একজন হিন্দু—নিরঞ্জন মিস্ত্রি৷ আজই বন্ধুর ছেলের বউভাতের নেমন্তন্ন রয়েছে মাজিরপুরে৷ সেখানে সন্ধ্যায় সপরিবারে যাবেন৷
আবদুল রজ্জাক প্রশ্নের সুরে বললেন, ‘শুধু শুধু কেউ গন্ডগোল চায় কন তো? আসলে হিন্দু-মোসলমানের মিলন অনেকেই মনে মনে চায় না৷’ তাঁর মতো একজন উদার মনের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হবে ভাবিনি৷ আবদুল রজ্জাকের ছেলে বরিশাল ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন৷
বাসে ১৩ কিমি রাস্তা আর কতক্ষণ৷ শিকারপুর ব্রিজ পেরিয়ে ইচলাদি বাসস্ট্যান্ড৷ একে সোন্ধা নদীর সেতুও বলা হয়৷ এর আরও একটা নাম আছে—‘মেজর এম এ জলিল সেতু’৷ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন প্রয়াত মেজর জলিল৷
অনিমেষ বলল, ‘আমরা এখানেই নামব৷’
বাসস্ট্যান্ড থেকে একটা সাইকেল রিকশ নিয়ে উগ্রতারা মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হলাম৷ দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে পৌঁছেও গেলাম৷ উগ্রতারা অর্থাৎ সুগন্ধা দেবীর মন্দিরের তোরণটি সুন্দর৷ মন্দির চত্বরটিও বেশ প্রশস্ত৷ সামনে পিছনে অনেকটা জায়গা৷ মন্দির কমিটির সহ-সভাপতি স্থানীয় ধামসোর সোনার বাংলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক রাজেন্দ্রলাল মণ্ডলের সঙ্গে কথাবার্তা হল৷ তার আগে এই পীঠদেবী ও মন্দির সম্বন্ধে কিছু কথা জানিয়ে রাখি৷
পৌরাণিক সুগন্ধা নদী বর্তমানে সোন্ধা নদী৷ মহাকবি ‘রায়গুণাকর’ ভারতচন্দ্র রায়ের অন্নদামঙ্গল কাব্যে সুগন্ধার নাম পাওয়া যায়৷ পীঠনির্ণয়তন্ত্র অনুযায়ী সতীপীঠের তৃতীয় পীঠ হল সুগন্ধা৷ ভারতচন্দ্র এই পীঠস্থানের বর্ণনা করে বলেছেন, ‘সুগন্ধায় নাসিকা পড়িল চক্রহতা,/ত্র্যম্বক ভৈরব তাহে সুনন্দা দেবতা৷’
অবশ্য শিবচরিতে একে ষষ্ঠ পীঠস্থানরূপে উল্লেখ করা হয়েছে৷ সুগন্ধায় দেবীর নাসিকা পড়েছিল৷ তাই তাঁর নাম সুগন্ধা (সুনন্দা)৷ ভৈরব হলেন ত্র্যম্বক৷ দেবীর স্থানীয় নাম উগ্রতারা৷
তন্ত্রচূড়ামণিতে বলা হয়েছে—‘সুগন্ধায়াঞ্চ নাসিকা দেব স্ত্র্যকনামা চ সুনন্দা তত্র দেবতা৷’ দেবী সুগন্ধার ভৈরব ত্র্যম্বক হলেও মতান্তরে তিনি শ্রীবটুকেশ্বর নামেও প্রসিদ্ধ৷
মনে প্রশ্ন আসে, এই পুণ্যক্ষেত্রের নাম সুগন্ধা হল কেন? গন্ধের সঙ্গে নাসিকার একটা অচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে৷ নাসিকার সাহায্যেই ঘ্রাণ নেওয়া হয়৷ অতএব এই ক্ষেত্রটির নাম সুগন্ধা হওয়াই স্বাভাবিক৷
আবার গতকাল রাতেই বরিশাল শহরের এক মুসলমান দোকানদারের মুখে সাতক্ষীরার গল্প শুনেছিলাম৷ জামাতরা নাকি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর একের পর এক মসজিদ গড়ে তুলছে৷ অনুপ্রবেশ চলছে অবাধে৷ আর, ভারতীয় সীমানায় গণ্ডগোল পাকানোরও চেষ্টা করছে৷ এমন কথাও শুনলাম, জামাত-ই-ইসলাম দলের তহবিলে যে অর্থ রয়েছে তা নাকি আওয়ামি লিগ ও বি এন পি দলের মিলিত সম্পত্তির কয়েক গুণ!
গ্রামাঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতির মনোভাব যথেষ্ট এমন দাবিও করলেন আবদুল রজ্জাক৷ তাঁর প্রিয় বন্ধু একজন হিন্দু—নিরঞ্জন মিস্ত্রি৷ আজই বন্ধুর ছেলের বউভাতের নেমন্তন্ন রয়েছে মাজিরপুরে৷ সেখানে সন্ধ্যায় সপরিবারে যাবেন৷
আবদুল রজ্জাক প্রশ্নের সুরে বললেন, ‘শুধু শুধু কেউ গন্ডগোল চায় কন তো? আসলে হিন্দু-মোসলমানের মিলন অনেকেই মনে মনে চায় না৷’ তাঁর মতো একজন উদার মনের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হবে ভাবিনি৷ আবদুল রজ্জাকের ছেলে বরিশাল ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন৷
বাসে ১৩ কিমি রাস্তা আর কতক্ষণ৷ শিকারপুর ব্রিজ পেরিয়ে ইচলাদি বাসস্ট্যান্ড৷ একে সোন্ধা নদীর সেতুও বলা হয়৷ এর আরও একটা নাম আছে—‘মেজর এম এ জলিল সেতু’৷ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন প্রয়াত মেজর জলিল৷
অনিমেষ বলল, ‘আমরা এখানেই নামব৷’
বাসস্ট্যান্ড থেকে একটা সাইকেল রিকশ নিয়ে উগ্রতারা মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হলাম৷ দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে পৌঁছেও গেলাম৷ উগ্রতারা অর্থাৎ সুগন্ধা দেবীর মন্দিরের তোরণটি সুন্দর৷ মন্দির চত্বরটিও বেশ প্রশস্ত৷ সামনে পিছনে অনেকটা জায়গা৷ মন্দির কমিটির সহ-সভাপতি স্থানীয় ধামসোর সোনার বাংলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক রাজেন্দ্রলাল মণ্ডলের সঙ্গে কথাবার্তা হল৷ তার আগে এই পীঠদেবী ও মন্দির সম্বন্ধে কিছু কথা জানিয়ে রাখি৷
পৌরাণিক সুগন্ধা নদী বর্তমানে সোন্ধা নদী৷ মহাকবি ‘রায়গুণাকর’ ভারতচন্দ্র রায়ের অন্নদামঙ্গল কাব্যে সুগন্ধার নাম পাওয়া যায়৷ পীঠনির্ণয়তন্ত্র অনুযায়ী সতীপীঠের তৃতীয় পীঠ হল সুগন্ধা৷ ভারতচন্দ্র এই পীঠস্থানের বর্ণনা করে বলেছেন, ‘সুগন্ধায় নাসিকা পড়িল চক্রহতা,/ত্র্যম্বক ভৈরব তাহে সুনন্দা দেবতা৷’
অবশ্য শিবচরিতে একে ষষ্ঠ পীঠস্থানরূপে উল্লেখ করা হয়েছে৷ সুগন্ধায় দেবীর নাসিকা পড়েছিল৷ তাই তাঁর নাম সুগন্ধা (সুনন্দা)৷ ভৈরব হলেন ত্র্যম্বক৷ দেবীর স্থানীয় নাম উগ্রতারা৷
তন্ত্রচূড়ামণিতে বলা হয়েছে—‘সুগন্ধায়াঞ্চ নাসিকা দেব স্ত্র্যকনামা চ সুনন্দা তত্র দেবতা৷’ দেবী সুগন্ধার ভৈরব ত্র্যম্বক হলেও মতান্তরে তিনি শ্রীবটুকেশ্বর নামেও প্রসিদ্ধ৷
মনে প্রশ্ন আসে, এই পুণ্যক্ষেত্রের নাম সুগন্ধা হল কেন? গন্ধের সঙ্গে নাসিকার একটা অচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে৷ নাসিকার সাহায্যেই ঘ্রাণ নেওয়া হয়৷ অতএব এই ক্ষেত্রটির নাম সুগন্ধা হওয়াই স্বাভাবিক৷
শিকারপুরের পূর্বপ্রান্তে মেঘনা নদী প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে৷ এই নদীর উৎপত্তি সম্বন্ধে একটি পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে৷ যাইহোক, শিকারপুর-তারাবাড়ি স্থানটি যে অতি প্রাচীন তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ সুগন্ধা নদী থেকে এই মন্দিরের দূরত্ব দু-তিন কিমি৷ ইতিহাস প্রসিদ্ধ মন্দিরটির একসময় করুণ অবস্থা হয়েছিল৷ সেই সময় (২০০৩-০৪) এর আমূল সংস্কার করেন বরিশাল শহরের নামী অর্থোপেডিক সার্জেন ডাঃ পীযূষকান্তি দাস৷ তিনি মন্দির কমিটির বর্তমান সভাপতি৷ কমিটির মোট সদস্যসংখ্যা ১৫৷
তখনও পীঠদেবীর পুজো শুরু হয়নি৷ মন্দিরের চারপাশ ঘুরে দেখলাম৷ দু-একর জায়গার ওপর মন্দির৷ গর্ভগৃহে চতুর্ভুজা দেবীমূর্তি পূজিত হচ্ছেন৷ শিবের বুকের ওপর দণ্ডায়মান দেবীর চারহাতে রয়েছে খেটক (গদা বা মুগুর), খড়্গ, নীলপদ্ম ও নরকঙ্কালের খুলি৷ পাথরের বেদির ওপর প্রস্তর সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত মূর্তিটির উচ্চতা বড়জোর দু-ফুট৷ মাথার ওপর ছোট আকৃতির ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, সিদ্ধিদাতা গণেশ ও কার্তিকের মূর্তি৷ পীঠদেবীর উচ্চতা বেশি না হলেও মূর্তিটি খুবই আকর্ষণীয়৷ অনেকের মতে, মূর্তি পরিকল্পনায় বৌদ্ধ মহাযানী ও বজ্রযানী প্রভাব রয়েছে৷
সুগন্ধা দেবীর মন্দিরের পাশেই শিবমন্দিরের চূড়া অনেকটা মসজিদ আকৃতির৷ তাহলে কি এখানে সর্বধর্ম সমন্বয়ের একটা রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে? এই শিবমন্দিরটি কিন্তু পীঠদেবীর ভৈরব ত্রম্বক বা শ্রীবটুকেশ্বরের নন৷ তিনি লিঙ্গরূপে সগৌরবে অবস্থান করছেন তিন-চার কিমি দক্ষিণে পোনাবালিয়া গ্রামের উপকণ্ঠে এক শিবমন্দিরে৷
উগ্রতারা মন্দিরের পূজারি সুশান্তকুমার চক্রবর্তী৷ তিনি গত ২০ বছর ধরে পুজো করছেন৷ মন্দির দেখাশোনা করেন গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী৷ তাঁর স্ত্রী যমুনা চক্রবর্তী মায়ের ভোগ রাঁধেন৷ তাঁদের ছোট মেয়ে সঞ্চিতা চক্রবর্তী ক্লাস নাইনে পড়ে ‘শিকারপুর গঙ্গা গোবিন্দ মাধ্যমিক বিদ্যালয়’-এ৷ রাজেন্দ্রলালবাবুর সঙ্গে কথাবার্তার সময় সুশান্ত চক্রবর্তী এলেন৷ তাঁদের কাছেই শুনলাম, প্রতিদিন বেলা ১২টায় দেবীমায়ের তন্ত্রমতে পুজো হয়৷
তখনও পুজোর দশ-বারো মিনিট বাকি৷ সকাল ৮টায় মন্দির খোলে৷ বন্ধ হয় রাত ৮টায়৷ দুপুরে প্রসাদ বিতরণ৷ সন্ধ্যারতি দেখার জন্য নাকি ভালোই ভক্ত সমাগম হয়৷ প্রতিদিন দুপুরে মায়ের অন্নভোগ সাদা পোলাও, নানারকমের ভাজা, সবজি ও মিষ্টান্ন৷ প্রতি অমাবস্যায় সাড়ম্বরে মায়ের পুজো হয়৷ ছাগবলিও হয়৷ তবে বলির মাংস উগ্রতারা দেবীকে নিবেদন করা হয় না৷
এই মন্দিরের উন্নতিকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি মাননীয় প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছে মন্দির কমিটির তরফে একটি চিঠি ২০১৩-র জুনে পাঠানো হয়েছে বলে জানতে পারলাম৷
রাজেন্দ্রলালবাবু বললেন, মন্দির চত্বরে একটা সাধুনিবাস করা দরকার৷ ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিশেষ করে শিব চতুর্দশী ও দুর্গাপুজোর সময় অনেক সাধু-সন্ন্যাসী ও তীর্থযাত্রী আসেন৷ দোল পূর্ণিমার দিনই দোলযাত্রার যাবতীয় আয়োজন করা হয়৷ প্রতিবছর বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সাংসৃকতিক অনুষ্ঠান হয়৷
শিকারপুর তারাবাড়ির দেবীমূর্তিকে নিয়ে একটি জনশ্রুতি এরকম—পঞ্চানন চক্রবর্তী নামে এক ধার্মিক ব্রাহ্মণ ভোররাতে স্বপ্ণ দেখলেন, ভগবতী দেবী কালিকা সুগন্ধা নদীর গর্ভ থেকে তাঁর পাষাণময়ী মূর্তি উদ্ধার করে যথানিয়মে মন্দিরে প্রতিষ্ঠার পর পুজো-অর্জনার আদেশ করছেন৷
তখনও পীঠদেবীর পুজো শুরু হয়নি৷ মন্দিরের চারপাশ ঘুরে দেখলাম৷ দু-একর জায়গার ওপর মন্দির৷ গর্ভগৃহে চতুর্ভুজা দেবীমূর্তি পূজিত হচ্ছেন৷ শিবের বুকের ওপর দণ্ডায়মান দেবীর চারহাতে রয়েছে খেটক (গদা বা মুগুর), খড়্গ, নীলপদ্ম ও নরকঙ্কালের খুলি৷ পাথরের বেদির ওপর প্রস্তর সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত মূর্তিটির উচ্চতা বড়জোর দু-ফুট৷ মাথার ওপর ছোট আকৃতির ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, সিদ্ধিদাতা গণেশ ও কার্তিকের মূর্তি৷ পীঠদেবীর উচ্চতা বেশি না হলেও মূর্তিটি খুবই আকর্ষণীয়৷ অনেকের মতে, মূর্তি পরিকল্পনায় বৌদ্ধ মহাযানী ও বজ্রযানী প্রভাব রয়েছে৷
সুগন্ধা দেবীর মন্দিরের পাশেই শিবমন্দিরের চূড়া অনেকটা মসজিদ আকৃতির৷ তাহলে কি এখানে সর্বধর্ম সমন্বয়ের একটা রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে? এই শিবমন্দিরটি কিন্তু পীঠদেবীর ভৈরব ত্রম্বক বা শ্রীবটুকেশ্বরের নন৷ তিনি লিঙ্গরূপে সগৌরবে অবস্থান করছেন তিন-চার কিমি দক্ষিণে পোনাবালিয়া গ্রামের উপকণ্ঠে এক শিবমন্দিরে৷
উগ্রতারা মন্দিরের পূজারি সুশান্তকুমার চক্রবর্তী৷ তিনি গত ২০ বছর ধরে পুজো করছেন৷ মন্দির দেখাশোনা করেন গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী৷ তাঁর স্ত্রী যমুনা চক্রবর্তী মায়ের ভোগ রাঁধেন৷ তাঁদের ছোট মেয়ে সঞ্চিতা চক্রবর্তী ক্লাস নাইনে পড়ে ‘শিকারপুর গঙ্গা গোবিন্দ মাধ্যমিক বিদ্যালয়’-এ৷ রাজেন্দ্রলালবাবুর সঙ্গে কথাবার্তার সময় সুশান্ত চক্রবর্তী এলেন৷ তাঁদের কাছেই শুনলাম, প্রতিদিন বেলা ১২টায় দেবীমায়ের তন্ত্রমতে পুজো হয়৷
তখনও পুজোর দশ-বারো মিনিট বাকি৷ সকাল ৮টায় মন্দির খোলে৷ বন্ধ হয় রাত ৮টায়৷ দুপুরে প্রসাদ বিতরণ৷ সন্ধ্যারতি দেখার জন্য নাকি ভালোই ভক্ত সমাগম হয়৷ প্রতিদিন দুপুরে মায়ের অন্নভোগ সাদা পোলাও, নানারকমের ভাজা, সবজি ও মিষ্টান্ন৷ প্রতি অমাবস্যায় সাড়ম্বরে মায়ের পুজো হয়৷ ছাগবলিও হয়৷ তবে বলির মাংস উগ্রতারা দেবীকে নিবেদন করা হয় না৷
এই মন্দিরের উন্নতিকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি মাননীয় প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছে মন্দির কমিটির তরফে একটি চিঠি ২০১৩-র জুনে পাঠানো হয়েছে বলে জানতে পারলাম৷
রাজেন্দ্রলালবাবু বললেন, মন্দির চত্বরে একটা সাধুনিবাস করা দরকার৷ ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিশেষ করে শিব চতুর্দশী ও দুর্গাপুজোর সময় অনেক সাধু-সন্ন্যাসী ও তীর্থযাত্রী আসেন৷ দোল পূর্ণিমার দিনই দোলযাত্রার যাবতীয় আয়োজন করা হয়৷ প্রতিবছর বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সাংসৃকতিক অনুষ্ঠান হয়৷
শিকারপুর তারাবাড়ির দেবীমূর্তিকে নিয়ে একটি জনশ্রুতি এরকম—পঞ্চানন চক্রবর্তী নামে এক ধার্মিক ব্রাহ্মণ ভোররাতে স্বপ্ণ দেখলেন, ভগবতী দেবী কালিকা সুগন্ধা নদীর গর্ভ থেকে তাঁর পাষাণময়ী মূর্তি উদ্ধার করে যথানিয়মে মন্দিরে প্রতিষ্ঠার পর পুজো-অর্জনার আদেশ করছেন৷
আরও পড়ুন:
বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব ৩৭: বরিশাল শহরে জাগ্রত কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চারণকবি মুকুন্দ দাস
সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৪: পাঠক, লেখক ও শুভাকাক্ষীদের অনুপ্রেরণায় দেশের সর্বত্র পৌঁছে যাচ্ছে বইয়ের জাহাজ বাতিঘর সম্রাজ্যের দীপ্তি
অযোধ্যা: ইতিহাস ও জনশ্রুতি /২
ক্লাসরুম: Appropriate Prepositions কাকে বলে জানো কি?
সকালে নদীর গর্ভে নেমে প্রথমে বৃষভারূঢ় মহাদেবের মূর্তি পেলেন ওই ব্রাহ্মণ৷ তারপর দেবীমূর্তি উদ্ধার হয়৷ একটি ছোট দেবালয়ে মূর্তিদুটি প্রতিষ্ঠার পর তিনি পুজো শুরু করেন৷ শোনা যায়, বাকলার তৎকালীন রাজা এই অলৌকিক ঘটনাটি জানার পর মহা সমারোহে দেবীর পুজো করেন৷ এরপর দেবীমাতৃকার যথাযোগ্য সেবার জন্য ‘তারাবৃত্তি’ নামে দেবোত্তর সম্পত্তি দানের পর একটি মন্দির নির্মাণ করে দেন৷ ওই প্রাচীন মন্দিরটির আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই৷ বাংলাদেশের অশান্ত দিনগুলোতে কিছু দুষৃকতি দেবীমূর্তিটি চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়৷ এরপর ঘটের ওপর পুজো হত৷ পরে নতুন করে দেবীমূর্তি তৈরি হয়৷
ইতিমধ্যে পুজো শুরু হয়েছে৷ রাজেন্দ্রলালবাবু বললেন, ‘যদি একটু অপেক্ষা করেন মন্দির সংক্রান্ত দু-একটা জিনিস আপনাকে দেখাইতে চাই৷’ দেশে আমার চেনা-পরিচিত কয়েকজন পীঠদেবীকে তাঁদের নামে পুজো দেওয়া কথা বলেছিলেন৷ সেই ব্যবস্থা পূজারিকে বলে করা হল৷
রাজেন্দ্রলালবাবু এক ফাঁকে মন্দিরের ভিজিটার্স-বুক এনে আমাকে দেখালেন৷ পাতা ওলটাতে ওলটাতে দেখলাম, এই মন্দির নিয়ে ভারত, বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষের মন্তব্য রয়েছে৷ যেমন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের গবেষক শ্রীযুক্ত অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি উল্লেখ করার মতো৷ ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি এখানে এসেছিলেন৷ ভিজিটার্স বুকে লিখেছেন, ‘শিকারপুরের প্রাচীন তীর্থস্থান দেখে খুবই ভালো লাগল৷ অনেক পূর্বেই এই তীর্থের নাম শুনেছিলাম৷ নতুনভাবে সংস্কার হওয়ার কারণে তীর্থটি অতি সুন্দর হয়েছে৷ তবে এই সংকারের কারণে তীর্থের প্রাচীনত্ব বোঝা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে৷ প্রাচীন কাঠামো সংস্কারের সময় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করলে আরও ভালো হত৷’
কৃষ্ণ জন্মভূমি মথুরার কালেক্টর ও ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এইচ কে চতুর্বেদি ২০০৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর এই মন্দির দর্শন করে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন৷ ২০১২ সালের ২১ সেপ্টেম্বরে ঢাকার ভারতীয় হাই কমিশনের দ্বিতীয় সচিব অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় এই মহাপীঠে এসে পুজো দেন৷
সুগন্ধা দেবীর মন্দির প্রাঙ্গণেই দুর্গামন্দির, লোকনাথ বাবার মন্দির রয়েছে৷ প্রতিদিন বাবা লোকনাথের পুজো হয়৷ প্রতি শুক্রবার দুপুরে তাঁকে আলাদা করে ভোগ নিবেদন করা হয়৷ প্রতি বছর অক্ষয় তৃতীয়ায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড (৫১টি পীঠের অন্যতম) আশ্রমের সন্ন্যাসীরা শিকারপুরের উগ্রতারা মন্দিরে এসে দু-দিন ধরে শান্তিযজ্ঞ করেন৷ দুর্গাপুজোয় খুব ভিড় হয়৷ কালীপুজো, শীতলাপুজোতেও ভক্তসংখ্যা কম নয়৷
মন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলেন শ্রীমতী বকুল দাশগুপ্ত ও তাঁর মেয়ে বন্দনা বণিক৷ বন্দনার কোলে তাঁর শিশুপুত্র৷ ওঁর স্বামী ব্যাবসা করেন৷ ‘নাতির মঙ্গল কামনায় মা-কে পূজা দিতে আসছি’—বললেন বকুলদেবী৷
জিজ্ঞাসা করলাম—কেমন আছেন বাংলাদেশে?
হাসিখুশি বকুলদেবীর হাসি মিলিয়ে গেল এক নিমেষে৷ বললেন, ‘সেকথা কী আর কমু কন! ঘরে বইস্যা একটু জোকার দিলেই ওরা টিটকারি দেয়৷ বলির পাঁঠা হইয়া থাকি৷ এই কয়েক কিলোমিটার দূর উজিরপুরে আমাগো বড় একখান বাড়ি ছিল৷ জবরদখল হইবার ভয়ে জলের দলে অতবড় বাড়িখান বেইচা দিলাম, তারপরেই শিকারপুরে আসছি৷ এইখানকার অবস্থা তবুও একটু ভালো৷’
উজিরপুর পানের বরজের জন্য বিখ্যাত৷
উগ্রতারা মন্দিরের খরচ-খরচা কীভাবে চলে?
ইতিমধ্যে পুজো শুরু হয়েছে৷ রাজেন্দ্রলালবাবু বললেন, ‘যদি একটু অপেক্ষা করেন মন্দির সংক্রান্ত দু-একটা জিনিস আপনাকে দেখাইতে চাই৷’ দেশে আমার চেনা-পরিচিত কয়েকজন পীঠদেবীকে তাঁদের নামে পুজো দেওয়া কথা বলেছিলেন৷ সেই ব্যবস্থা পূজারিকে বলে করা হল৷
রাজেন্দ্রলালবাবু এক ফাঁকে মন্দিরের ভিজিটার্স-বুক এনে আমাকে দেখালেন৷ পাতা ওলটাতে ওলটাতে দেখলাম, এই মন্দির নিয়ে ভারত, বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষের মন্তব্য রয়েছে৷ যেমন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের গবেষক শ্রীযুক্ত অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি উল্লেখ করার মতো৷ ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি এখানে এসেছিলেন৷ ভিজিটার্স বুকে লিখেছেন, ‘শিকারপুরের প্রাচীন তীর্থস্থান দেখে খুবই ভালো লাগল৷ অনেক পূর্বেই এই তীর্থের নাম শুনেছিলাম৷ নতুনভাবে সংস্কার হওয়ার কারণে তীর্থটি অতি সুন্দর হয়েছে৷ তবে এই সংকারের কারণে তীর্থের প্রাচীনত্ব বোঝা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে৷ প্রাচীন কাঠামো সংস্কারের সময় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করলে আরও ভালো হত৷’
কৃষ্ণ জন্মভূমি মথুরার কালেক্টর ও ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এইচ কে চতুর্বেদি ২০০৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর এই মন্দির দর্শন করে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন৷ ২০১২ সালের ২১ সেপ্টেম্বরে ঢাকার ভারতীয় হাই কমিশনের দ্বিতীয় সচিব অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় এই মহাপীঠে এসে পুজো দেন৷
সুগন্ধা দেবীর মন্দির প্রাঙ্গণেই দুর্গামন্দির, লোকনাথ বাবার মন্দির রয়েছে৷ প্রতিদিন বাবা লোকনাথের পুজো হয়৷ প্রতি শুক্রবার দুপুরে তাঁকে আলাদা করে ভোগ নিবেদন করা হয়৷ প্রতি বছর অক্ষয় তৃতীয়ায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড (৫১টি পীঠের অন্যতম) আশ্রমের সন্ন্যাসীরা শিকারপুরের উগ্রতারা মন্দিরে এসে দু-দিন ধরে শান্তিযজ্ঞ করেন৷ দুর্গাপুজোয় খুব ভিড় হয়৷ কালীপুজো, শীতলাপুজোতেও ভক্তসংখ্যা কম নয়৷
মন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলেন শ্রীমতী বকুল দাশগুপ্ত ও তাঁর মেয়ে বন্দনা বণিক৷ বন্দনার কোলে তাঁর শিশুপুত্র৷ ওঁর স্বামী ব্যাবসা করেন৷ ‘নাতির মঙ্গল কামনায় মা-কে পূজা দিতে আসছি’—বললেন বকুলদেবী৷
জিজ্ঞাসা করলাম—কেমন আছেন বাংলাদেশে?
হাসিখুশি বকুলদেবীর হাসি মিলিয়ে গেল এক নিমেষে৷ বললেন, ‘সেকথা কী আর কমু কন! ঘরে বইস্যা একটু জোকার দিলেই ওরা টিটকারি দেয়৷ বলির পাঁঠা হইয়া থাকি৷ এই কয়েক কিলোমিটার দূর উজিরপুরে আমাগো বড় একখান বাড়ি ছিল৷ জবরদখল হইবার ভয়ে জলের দলে অতবড় বাড়িখান বেইচা দিলাম, তারপরেই শিকারপুরে আসছি৷ এইখানকার অবস্থা তবুও একটু ভালো৷’
উজিরপুর পানের বরজের জন্য বিখ্যাত৷
উগ্রতারা মন্দিরের খরচ-খরচা কীভাবে চলে?
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৯: দুঃসময়ের স্মৃতিগুলো ‘কার পাপে’? [১৫/০৮/১৯৫২]
বেগুন ভর্তা তো খেয়েছেন, এবার ঝটপট তৈরি করে ফেলুন লাউপাতার ভর্তা, রইল রেসিপি
দু’শো বছর আগে হলে তিনি ইঞ্জিনিয়ারের বদলে সতী হতেন
গল্প: পরশ
রাজেন্দ্রলালবাবুর কাছে শুনলাম, ভক্তদের কাছ থেকে চাঁদা বাবদ কিছুটা টাকা ওঠে৷ তাছাড়া মন্দিরের কিছু জমি-জায়গাও আছে৷ পুকুরে মাছ চাষ হয়৷ সেখান থেকে প্রতি বছর লিজ বাবদ ১২ হাজার টাকা পাওয়া যায়৷ রাজেন্দ্রলালবাবু জমি, পুকুর সব আমাকে ঘুরিয়ে দেখালেন৷ মন্দিরের উত্তর দিকে ধানি জমি ৯০ শতক৷ লিজ দেওয়া হয়৷ লিজবাবদ বছরে ৮ হাজার টাকা পাওয়া যায়৷
এই গ্রামের নাম ‘মুণ্ডপাশা’৷ তিন-চারশো ঘর হিন্দুর বাস৷ রাজেন্দ্রলালবাবু বললেন, ‘আমাদের গ্রামে কোনো কোন্দল নাই৷ হিন্দু-মুসলমানের মিলমিশ আছে৷ গণ্ডগোলের সময় মুসলমানরা এই মন্দিরের কোনও ক্ষতি করে নাই৷ ওদের নিমন্ত্রণ করলে আসে৷ দুর্গাপূজায় চাঁদাও দেয়৷ মসজিদের কোনও অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত তাঁবু মন্দিরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও দিছে৷ এই তো কিছুদিন পূর্বেই মন্দির প্রাঙ্গণে এক ধর্মসভা হইল৷ সক্কলকার বসার বন্দোবস্ত মুসলমান সম্প্রদায়ই করছিল৷’
মূল মন্দিরের বাইরে হিন্দু ও মুসলমানের বেশ কয়েকটি দোকান মন্দিরের জমির ওপর৷ মন্দির কর্তৃপক্ষ ভাড়া পান৷ মন্দিরের একটি পুকুরের স্নানের ঘাট লাগোয়া মা কালী ও শীতলা মাতার মন্দির৷ প্রতিদিন সন্ধ্যারতি হয়৷
মন্দিরের উন্নয়নের জন্য আরও টাকা-পয়সা প্রয়োজন৷ তাই রাজেন্দ্রলালবাবু মন্দিরের কিছুটা জমি বিক্রি করে সেখানে একটা মার্কেট তৈরি করতে চাইছেন৷ এদিকে পুকুরের এক কোনে দেখলাম, মন্দিরের জমির ওপর স্থানীয় কাউন্সিলারের বড়সড় অফিস৷ অবশ্য দখল না বলে রাজেন্দ্রলালবাবু এই জমিটি দান হিসাবেই দেখাতে চাইলেন৷ বললেন, ‘মন্দিরের জমির দলিল-পত্র কিছুই ছিল না৷ পরে অনেক কষ্টে সব রেকর্ড করাইতে হইছে৷’
হাঁটতে হাঁটতে আবার মন্দিরে ফিরে এলাম৷ মন্দিরের প্রবেশ পথে সঞ্চিতা ওর মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল৷ যমুনা চক্রবর্তীর মুখে ওঁর দুঃখের কথা শুনেছিলাম৷ মন্দিরে রান্নার জন্য প্রতি মাসে ২০০০ টাকা পারিশ্রমিক পান৷ স্বামীর রোজগারও তেমন নয়৷ কোনোরকমে সংসারটা টানছেন যমুনাদেবী৷ অনেক কষ্টে বড় মেয়ে নন্দিতার বিয়ে দিয়েছেন৷ মাদারিপুর পৌরসভায় নন্দিতার শ্বশুড়বাড়ি৷ তবে জামাইটি বেশ ভালো পেয়েছেন৷ যমুনাদেবী একটু খুশি হয়েই যেন বললেন, ‘জামাই আমার ঠিক পোলার মতো৷ পোলো না থাকার দুঃখ ভুলছি৷’
সঞ্চিতা পড়াশুনো করে বড় হতে চায়৷ কিন্তু অভাবই এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ যমুনাদেবী ছলছল চোখে বললেন, ‘কী করি কন তো? মেয়েটার মুখের দিকে চাইতে পারি না৷’
সঞ্চিতার কাছেই শুনলাম, ওদের সুকলে হিন্দুধর্মের আলাদা ক্লাসও হয়৷ ক্লাস নেন আশুতোষ চক্রবর্তী৷ হিন্দু ধর্মের ওপর আশুতোষবাবুর নাকি অগাধ জ্ঞান৷ সুকলের হেডমাস্টারমশাই হিন্দু, শ্রীযুক্ত হরেকৃষ্ণ রায়৷ তাঁকে হিন্দু-মুসলমান সব ছাত্র-ছাত্রীই ভীষণ মানে৷ বাংলা পড়ান দিলোয়ার হোসেন৷ শিকারপুর গঙ্গা গোবিন্দ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে হিন্দু শিক্ষকই বেশি৷
সঞ্চিতা আমাকে বলেছিল, ‘আংকেল, পড়াশুনা করতে আমার ভালো লাগে৷ দিদির মতো তাড়াতাড়ি বিয়া করতে চাই না৷ মানুষ হইয়া চাকরি কইরা মা-বাবার দুঃখ ঘুচাইতে চাই৷’
বললাম, ‘এ তো খুব ভালো কথা৷ নিশ্চয়ই আরও লেখাপড়া করবে৷ তা তুমি কী হতে চাও বললে না তো?’
সেই মুহূর্তে সঞ্চিতার মিষ্টি মুখখানা আরও উদ্ভাসিত হয়ে উঠল৷ বলল, ‘ইসুকল কিংবা কলেজে পড়াইতে চাই৷’
মনে মনে বলেছিলাম, মা উগ্রতারা তোমার মনের আশা নিশ্চয়ই একদিন পূরণ করবেন৷ সঞ্চিতার বই-পত্র কেনার জন্য ওর মায়ের হাতে কিছু টাকা দিয়েছিলাম৷
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
সৌজন্যে: দীপ প্রকাশন
এই গ্রামের নাম ‘মুণ্ডপাশা’৷ তিন-চারশো ঘর হিন্দুর বাস৷ রাজেন্দ্রলালবাবু বললেন, ‘আমাদের গ্রামে কোনো কোন্দল নাই৷ হিন্দু-মুসলমানের মিলমিশ আছে৷ গণ্ডগোলের সময় মুসলমানরা এই মন্দিরের কোনও ক্ষতি করে নাই৷ ওদের নিমন্ত্রণ করলে আসে৷ দুর্গাপূজায় চাঁদাও দেয়৷ মসজিদের কোনও অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত তাঁবু মন্দিরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও দিছে৷ এই তো কিছুদিন পূর্বেই মন্দির প্রাঙ্গণে এক ধর্মসভা হইল৷ সক্কলকার বসার বন্দোবস্ত মুসলমান সম্প্রদায়ই করছিল৷’
মূল মন্দিরের বাইরে হিন্দু ও মুসলমানের বেশ কয়েকটি দোকান মন্দিরের জমির ওপর৷ মন্দির কর্তৃপক্ষ ভাড়া পান৷ মন্দিরের একটি পুকুরের স্নানের ঘাট লাগোয়া মা কালী ও শীতলা মাতার মন্দির৷ প্রতিদিন সন্ধ্যারতি হয়৷
মন্দিরের উন্নয়নের জন্য আরও টাকা-পয়সা প্রয়োজন৷ তাই রাজেন্দ্রলালবাবু মন্দিরের কিছুটা জমি বিক্রি করে সেখানে একটা মার্কেট তৈরি করতে চাইছেন৷ এদিকে পুকুরের এক কোনে দেখলাম, মন্দিরের জমির ওপর স্থানীয় কাউন্সিলারের বড়সড় অফিস৷ অবশ্য দখল না বলে রাজেন্দ্রলালবাবু এই জমিটি দান হিসাবেই দেখাতে চাইলেন৷ বললেন, ‘মন্দিরের জমির দলিল-পত্র কিছুই ছিল না৷ পরে অনেক কষ্টে সব রেকর্ড করাইতে হইছে৷’
হাঁটতে হাঁটতে আবার মন্দিরে ফিরে এলাম৷ মন্দিরের প্রবেশ পথে সঞ্চিতা ওর মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল৷ যমুনা চক্রবর্তীর মুখে ওঁর দুঃখের কথা শুনেছিলাম৷ মন্দিরে রান্নার জন্য প্রতি মাসে ২০০০ টাকা পারিশ্রমিক পান৷ স্বামীর রোজগারও তেমন নয়৷ কোনোরকমে সংসারটা টানছেন যমুনাদেবী৷ অনেক কষ্টে বড় মেয়ে নন্দিতার বিয়ে দিয়েছেন৷ মাদারিপুর পৌরসভায় নন্দিতার শ্বশুড়বাড়ি৷ তবে জামাইটি বেশ ভালো পেয়েছেন৷ যমুনাদেবী একটু খুশি হয়েই যেন বললেন, ‘জামাই আমার ঠিক পোলার মতো৷ পোলো না থাকার দুঃখ ভুলছি৷’
সঞ্চিতা পড়াশুনো করে বড় হতে চায়৷ কিন্তু অভাবই এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ যমুনাদেবী ছলছল চোখে বললেন, ‘কী করি কন তো? মেয়েটার মুখের দিকে চাইতে পারি না৷’
সঞ্চিতার কাছেই শুনলাম, ওদের সুকলে হিন্দুধর্মের আলাদা ক্লাসও হয়৷ ক্লাস নেন আশুতোষ চক্রবর্তী৷ হিন্দু ধর্মের ওপর আশুতোষবাবুর নাকি অগাধ জ্ঞান৷ সুকলের হেডমাস্টারমশাই হিন্দু, শ্রীযুক্ত হরেকৃষ্ণ রায়৷ তাঁকে হিন্দু-মুসলমান সব ছাত্র-ছাত্রীই ভীষণ মানে৷ বাংলা পড়ান দিলোয়ার হোসেন৷ শিকারপুর গঙ্গা গোবিন্দ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে হিন্দু শিক্ষকই বেশি৷
সঞ্চিতা আমাকে বলেছিল, ‘আংকেল, পড়াশুনা করতে আমার ভালো লাগে৷ দিদির মতো তাড়াতাড়ি বিয়া করতে চাই না৷ মানুষ হইয়া চাকরি কইরা মা-বাবার দুঃখ ঘুচাইতে চাই৷’
বললাম, ‘এ তো খুব ভালো কথা৷ নিশ্চয়ই আরও লেখাপড়া করবে৷ তা তুমি কী হতে চাও বললে না তো?’
সেই মুহূর্তে সঞ্চিতার মিষ্টি মুখখানা আরও উদ্ভাসিত হয়ে উঠল৷ বলল, ‘ইসুকল কিংবা কলেজে পড়াইতে চাই৷’
মনে মনে বলেছিলাম, মা উগ্রতারা তোমার মনের আশা নিশ্চয়ই একদিন পূরণ করবেন৷ সঞ্চিতার বই-পত্র কেনার জন্য ওর মায়ের হাতে কিছু টাকা দিয়েছিলাম৷
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
সৌজন্যে: দীপ প্রকাশন