শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


৫১ পীঠের আরেকটি পীঠ যে বরিশালে সেকথা ইতিপূর্বে বলেছি৷ এ ছাড়াও বরিশাল শহরে বাসস্ট্যান্ডের গায়েই চারণকবি মুকুন্দ দাস প্রতিষ্ঠিত জাগ্রত কালীমন্দির৷ প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯১৬ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি৷ এরপর দু-বার মন্দিরটির সংস্কার করা হয় যথাক্রমে ১৯৭৬ ও ২০০৯ সালে৷ বাসস্ট্যান্ড থেকে কলেজ রোড ইজিট্যাক্সিতে চোখের পলকে পৌঁছনো যায়৷ কলেজ রোডের মুখেই রাজলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার৷ একটু পরেই সরকারি বি এম কলেজ৷ বরিশালের অত্যন্ত গর্বের এই কলেজের বয়স সোয়াশো বছর৷
বরিশালের অন্যতম কৃতী সন্তান বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত তাঁর পিতা ব্রজমোহন দত্তর নামে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুন বি এম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন৷ অনেকখানি জায়গা নিয়ে এই কলেজ৷
কলেজের পাশে রামকৃষ্ণ মিশনেই উঠেছিলাম৷ ব্রিটিশ শাসিত সংযুক্ত ভারতবর্ষের বরিশালে একসময় হিন্দুরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ সেই সংখ্যা উত্তরোত্তর কমেছে৷ এখন বরিশাল শহরে কুড়ি-পঁচিশ হাজার হিন্দুর বাস৷

কলেজ রোড নতুন বাজারে শেষ হয়েছে৷ তারপর হসপিটাল রোড৷ বরিশাল সদর হাসপাতাল৷ তবে হসপিটাল রোডের নাম বদলে এখন সরকারি খাতা-কলমে ‘অমৃতলাল দে সরণি’ হয়েছে৷ ‘কারিকর বিড়ি’ কোম্পানির মালিক অমৃতলাল দে ইহজগতে নেই৷ তাঁর ভাইরা ‘অমৃত ফুড প্রোডাক্টস’-এর সত্ত্বাধিকারী৷ ‘অমৃতলাল দে মহাবিদ্যালয়’ ‘অমৃত সংগীত অ্যাকাডেমি’, ‘অমৃত কিন্ডারগার্টেন’, পরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হসপিটাল রোডের ওপর৷ সদর হাসপাতালেও অশ্বিনী দত্তের দানধ্যান আছে৷

জেলখানার মোড় থেকে আরেকটু উত্তরদিকে এগোলেই নাজিরের পুল৷ একদা এই বরিশাল শহরেই মুকুন্দ দাসের আখড়া ছিল বিখ্যাত৷ শহরের রাস্তাঘাটে একটু ঘোরাফেরা করলেই গুপ্ত কর্নার, গন্ধেশ্বরী ভাণ্ডার, পার্থ ফার্নিচার, কর্মকার ভাণ্ডার এরকম অনেক হিন্দু বাঙালির দোকান-ব্যাবসাই চোখে পড়ে৷ বেশ জমজমাট বাজার৷
আরও পড়ুন:

বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব ৩৬: ‘যখন ব্যায়াম করিতাম তখন মনে হইত, সমস্ত রোমকূপ দিয়া যেন শ্বাস-প্রশ্বাস নির্গত হইতেছে…’

নিয়মিত ব্যবহারে হতে পারে ক্যানসারও! অভিযোগ উঠতেই বাজার থেকে তুলে নেওয়া হল ডাভ, ট্রেসামের মতো শ্যাম্পু

রামকৃষ্ণ মিশনের গেস্টহাউসের তিনতলার একটা ঘর আমাকে দেওয়া হয়েছিল৷ রুকস্যাকটা ঘরে নামিয়ে রেখে টয়লেটে গিয়ে চোখে-মুখে খানিকটা জল দিতেই বেশ আরামবোধ হচ্ছিল৷ সকাল থেকে বাসজার্নির ধকল এতক্ষণে বোধহয় কিছুটা কাটল৷

মিশনের এক সন্ন্যাসী আমাকে বললেন, ‘আপনি যদি কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে আসতে চান অনায়াসে যেতে পারেন৷ তবে রাত আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে ফেরার চেষ্টা করবেন৷ রাতের খাওয়ার পাট মোটামুটি ন’টার ভেতরেই চুকিয়ে ফেলা হয়৷ ‘অনিমেষ মণ্ডল নামে আশ্রমের একটি ছেলেকে আমার সঙ্গে দিলেন৷ অনিমেষ আমাকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাবে৷ হাতে সময় কম৷ দিন তিনেক থাকব বরিশালে৷ তারপর চাঁদপুর হয়ে চট্টগ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনা৷ তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বরিশাল শহরটা দেখে নেওয়াই ভালো৷ এখানে ব্যাটারিচালিত একটা সাইকেল-রিকশয় দু’জনে উঠে বসলাম৷
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৮: মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্বে ‘বসু পরিবার’ [১১/০৪/১৯৫২]

যোগা-প্রাণায়াম: পিসিওডি এবং পিসিওএস-এর সমস্যা? চিন্তা নেই যোগায় আছে সমাধান

হসপিটাল রোডে লোকনাথ বাবার মন্দির তখনও ভক্ত সমাগমে গমগম করছে৷ দর্শনার্থীর ভিড় রাস্তায় নেমে এসেছে৷ আপাতত বরিশালে বড় মাপের কোনো হিন্দু রাজনীতিক নেই৷ তেমন কোনো ব্যানার বা পোস্টারও চোখে পড়ল না৷ সদর রোডে ‘অশ্বিনী দত্ত হল’৷ এই অঞ্চলের বিভিন্ন রাজনৈতিক মিটিং এখানেই হয়৷ এখান থেকেই বরিশাল শহরে কোনো রাজনৈতিক মিছিলের শুরু হয়ে থাকে৷

বগুড়া রোডে কবি জীবনানন্দ দাসের স্মৃতিভবন৷ একসময় এখানে জীবনানন্দের ভিটাবাড়ি ছিল৷ টিনের ঘর৷ ওটা সরকার থেকে অধিগ্রহণ করে এখন অডিটোরিয়াম বানানো হয়েছে৷ নানা সাংসৃকতিক অনুষ্ঠান হয় এখানে৷

বরিশালে কয়েকজন বিখ্যাত বাঙালি জন্মগ্রহণ করেছেন—অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হক, নাট্যকার ও অভিনেতা উৎপল দত্ত, বিখ্যাত সাংবাদিক ও সম্পাদক বরুণ সেনগুপ্ত, বেগম সুফিয়া কামাল প্রমুখ৷
অনিমেষের মুখে শুনলাম, বরিশাল শহরের দক্ষিণে আলেকান্দায় শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল একসময় পাকিস্তানের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের আমলে তৈরি হয়৷ শহরের একপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কীর্তনখোলা নদী৷ গত শতকের তিন বা চারের দশকে এখানে যাঁদের ছোটবেলা কেটেছে, এমন কয়েকজন প্রবীণ মানুষের মুখে শুনেছিলাম যে, সেইসময় বরিশাল শহরে বড় বন্দর ছিল৷ শিপ-ইয়ার্ডও ছিল, যেখানে জাহাজ মেরামতি হত৷ তখন কীর্তনখোলা নদীতীর নাকি দেখার মতো এক জায়গা ছিল!

আশ্রমে ফেরার তাড়া ছিল৷ তাই নদীতীর না দেখেই ফিরে এলাম৷ অবশ্য মনে মনে ঠিকই করে রেখেছিলাম, পরদিন সকালে শিকারপুরের উগ্রতারা মন্দির দর্শন করার পর বিকেলের দিকে কীর্তনখোলা একবার দেখে নেব৷ —চলবে

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌজন্যে: দীপ প্রকাশন

Skip to content