সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


স্বামী আত্মানন্দ লিখছেন, ‘এই সময়কার অবস্থা সম্পর্কে এক সময় স্বামী প্রণবানন্দজি বলেন—‘কি একটা সময়ই না গিয়াছে! ২৪ ঘণ্টা ডুবিয়া রহিয়াছি৷ ৬ বৎসরের মধ্যে ঘুম কাহাকে বলে জানি নাই, আহার-নিদ্রা-জ্ঞান, ক্ষুধা-তৃষ্ণাবোধ ছিল না৷ শনিবার পরীক্ষা, শুক্রবার সন্ধ্যার পরে পড়িতে বসিয়াছি, কি ভাবে যে রাত্রি ভোর হইয়া গিয়াছে তাহা টের পাই নাই৷ সকালবেলা আলো জ্বলিতে দেখিয়া যখন সকলে ডাক দিয়াছে, তখন হুঁস হইয়াছে৷ সর্ব্বদা কি একটা গভীর চিন্তায় মনঃপ্রাণ তন্ময় হইয়া থাকিত! মাথার এক হাত উপরে হাত রাখিলে পর্য্যন্ত বুঝা যাইত যে কি রকম heat (তাপ) উঠিতেছে৷ এই সময় কাহারও সহিত কথা বলিতে ইচ্ছা হইত না৷ কোনও পরিচিত লোক সামনাসামনি আসিলে তাহার সহিত কথা বলিতে হইবে, এই ভয়ে অন্য রাস্তা দিয়া ঘুরিয়া যাইতাম, তবু এক রাস্তায় চলিতাম না৷’ ৫/৬ ঘণ্টা ধ্যান জপ তো ন্যাংটা কালে করিয়াছি৷ যখন কাপড় ছাড়িয়া ন্যাংটা হইয়া স্নান করিতাম, তখনও ১০/১২ ঘণ্টা ধ্যান-জপ করিতাম৷’

পৌষ মাসে ব্রাহ্মমুহূর্ত্তে উঠিতে কষ্ট হয় কি না জিজ্ঞাসা করিয়াই তিনি বলিলেন—‘কষ্ট কি? আমার একদিন একটু কেমন কেমন বোধ হইয়াছিল; তখনই গা-ঝাড়া দিয়া উঠিয়া প্রতিজ্ঞা করিলাম—রাত্রে আর কিছু গায়ে দিব না৷ তখন হইতে আর কিছু গায়ে দিই নাই৷ খুব Exercise (ব্যায়াম) করিতাম, শরীরের রক্ত গরম ছিল, মাজায় কাপড় বাঁধিয়া একটা খালি চৌকির উপর মাঘ মাসের রাত্রিতে শুইয়া থাকিতাম৷ এখনও সেই চৌকিতে দাগ আছে৷’

শ্রীশ্রীস্বামিজী মহারাজ এই সময় প্রতিদিন নিয়মিতভাবে এক হাজার, দেড় হাজার বার বুক ডন ও এক হাজার হইতে দেড় হাজার বার বৈঠক দিতেন এবং অনুরূপ সংখ্যকবার মুগুর ঘুরাইতেন৷ ব্যায়াম সম্বন্ধে পরবর্তীকালে একদিন তিনি একজন সন্ন্যাসীকে বলিয়াছিলেন; ‘তোরা আর কি ব্যায়াম করিস৷ আমি যখন ব্যায়াম করিতাম তখন মনে হইত, সমস্ত রোমকূপ দিয়া যেন শ্বাস-প্রশ্বাস নির্গত হইতেছে৷ শরীরের অন্য কোন অংশ না লাগাইয়া শুধু হাতের উপর ভর দিয়া সুপারি গাছে উঠিতে পারিতাম, হাতের এত জোর ছিল৷ একটা ঘুষি মারিয়া ইটের দেওয়ালটাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিতে পারি—এইরকম বিশ্বাস ছিল৷’…

আর একদিন ডায়েরি লিখিতে উপদেশ দিলেন—‘তোমরা সকলে প্রতিদিন নিয়মিত ডায়েরি লিখিবে৷ দিনের মধ্যে কত রকমের চিন্তা ভাবনা আসে, কিভাবে বিচার করিয়া বিরুদ্ধ চিন্তা ভাবনার কবল হইতে আত্মরক্ষা করিলে, সে সমস্ত ডায়েরিতে লেখা থাকিবে৷ এমনিভাবে এক মাস পরে জীবনের কতদূর progress (উন্নতি) হইল, তাহা হিসাব করিয়া দেখিবে৷ আমি তো ঘড়ির দিকে তাকাইয়া জীবনের progress দেখিতাম৷ কালের দ্রুতগতির সঙ্গে সঙ্গে জীবনের অগ্রগতি সমান্তরালভাবে চলিতেছে কি না তাহা বুঝিয়া লইতাম৷’…
ইহার পর কয়েকটি বৎসর কাটিয়া গেল৷ একদিন যে জীবন-নির্ঝর বাজিতপুরের নিভৃত পল্লী-গুহায় আবদ্ধ ছিল, তাহাই ক্রমে গোমুখী নিষ্ক্রান্তা জাহ্ণবী-ধারার মত বিপুল বেগে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত করিয়া পূর্ব্ববঙ্গের জেলায় জেলায় ছড়াইয়া পড়িল৷ সেদিন কত যে ছাত্র আত্মসম্বিত ফিরিয়া পাইল, কত যে মুমূর্ষু যুবক নবজীবন লাভ করিল, কত যে অমানুষ মনুষ্যত্ব লাভ করিয়া ধন্য হইল, কে তাহার ইয়ত্তা রাখে? ইহা বাঙ্গলা সেই ১৩১৬ সন হইতে ১৩২৬ সনের কথা (ইং ১৯০৯-১০ হইতে ১৯১৯-২০)৷

মাদারিপুর মহকুমা শিক্ষা, অর্থবিত্ত ও রাজনৈতিক চেতনায় ফরিদপুর জেলায় শীর্ষ এবং সমগ্র পূর্ব্ববঙ্গের মধ্যে একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়াছিল৷ এই মহকুমা সম্বন্ধে গান্ধীজী মন্তব্য করিয়াছিলেন—Hot bed of politics. সরকারও এখানকার শাসনের জন্য সর্ব্বদা জবরদস্ত শাসক নিয়োগ করিতেন৷

বহু বিশিষ্ট বিপ্লবী নেতা ও কর্ম্মীর জন্ম ও কর্ম্মভূমি এই মাদারিপুর৷ ঘরে ঘরে অগ্ণি-শিশুর দল বিপ্লব-মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করিয়া তৈয়ারি হইতেছিল৷ দেশ-জননীর শৃঙ্খলভার মোচনের জন্য আত্মদান করিবার সে কী দুর্ব্বার আগ্রহ! ‘কার আগে প্রাণ, কে করিবে দান’-এর জন্য সে কী কাড়াকাড়ি৷ কে সর্ব্বাগ্রে সর্র্ব্বাপেক্ষা দুঃসাহসী কার্য করিবে, কে সর্ব্বাগ্রে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করিয়া বিপদসঙ্কুল কণ্টকাকীর্ণ পথে রক্তাক্ত চরণে অগ্রসর হইবার অধিকার বা সুযোগ পাইবে—সেইজন্য সকলে আকুল ব্যাকুল৷
এই বিপ্লবান্দোলনের সহিত আচার্য্যদেবের আন্তরিক সহানুভূতি থাকিলেও প্রত্যক্ষ কোন সম্বন্ধ বা সংযোগ ছিল না৷ কিন্তু বিপ্লবী নেতা ও কর্ম্মীদের সহিত তাঁহার সৌহার্দ্য ছিল অপরিসীম৷ এই জন্য ১৯১৪ সালে তাঁহাকে সন্দেহক্রমে ফরিদপুর ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করা হয় এবং অপর সকলের সহিত ধরিয়া তিন মাসের জন্য ফরিদপুর জেল হাজতে আবদ্ধ রাখা হয়৷ কিন্তু প্রমাণাভাবে শেষে তিনি মুক্তি পান৷

এক সময় বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ তাঁহাকে বিপ্লবান্দোলনে যোগদান করিবার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানান৷ তখন তিনি তাঁহাদিগকে বলিলেন : ‘আমার লক্ষ্য স্বতন্ত্র, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্ম্মধারাও স্বতন্ত্র৷ আপনারা জাতিগঠন চান রাজনৈতিক ভিত্তিতে, আমি চাই ধর্ম্মভিত্তিতে৷ আপনারা দেশমাতার মুক্তি চান পরাধীনতার শৃঙ্খল হইতে, আমিও তাহাই চাই৷ কিন্তু তাহার সঙ্গে সঙ্গে চাই লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষের অজ্ঞানতার অন্ধকার হইতে মুক্তি, দৈনন্দিন জীবনের জ্বালা যন্ত্রণা, শোকতাপ, দুঃখদৈন্য, অশান্তি হাহাকারের নিবৃত্তি৷
আপনাদের মত আমিও স্বাধীনতা চাই৷ কিন্তু সে স্বাধীনতা শুধু রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের অধিকার নয়, তাহার সঙ্গে সঙ্গে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার৷ রিপু-ইন্দ্রিয়ের শাসন হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিয়া বিবেক-বিচার সহায়ে মুক্তি—আত্মতত্ত্বোপলব্ধি—শুধু নিজের নয়, সমগ্র দেশ, জাতি, সমাজের— সমস্ত বিশ্বমানবের৷’

ইহার সঙ্গে সঙ্গে তিনি জানাইলেন, ‘প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান ও আন্দোলনের জন্য উপযুক্ত কর্মী প্রয়োজন৷ আমি আপনাদের কর্মী তৈয়ারি করিয়া দিব৷ ত্যাগ-সংযম-সত্য ও ব্রহ্মচর্য সাধনার ভিত্তিতে অটুট চরিত্রবল সম্পন্ন আদর্শ মানুষ গঠন করিয়া দিব৷’ আর করিতেনও তাই৷ সেইজন্য বিপ্লবী নেতা সর্ব্বদা কর্মীদের জীবন গঠনের জন্য শ্রীমৎ আচার্য্যদেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে উপদেশ দিতেন৷…

বাজিতপুর পূর্ব্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত মাদারিপুর মহকুমার একটি সুবৃহৎ গ্রাম,বহু শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত ও অবস্থাপন্ন লোকের বাসস্থান৷ দক্ষিণ প্রান্তে হাইস্কুল, বাজার, দাতব্য চিকিৎসালয় প্রভৃতি এবং উত্তর প্রান্তে শ্রীমৎ আচার্য্যদেবের সাধন-কুটির৷ এই সাধন-কুটিরের সংলগ্ন পূর্ব্বদিকে কিয়দ্দূরে উত্তর দক্ষিণে লম্বা একটি ক্ষুদ্র খাল এবং ইহারই সংলগ্ণ পূর্ব্বতীরে পরিকল্পিত মঠভূমি৷

জ্যৈষ্ঠের অপরাহ্ণ, রৌদ্রের প্রখরতা কথঞ্চিৎ শান্ত হইলেও খুব গরম৷ আচার্যদেব নগ্ণগাত্রে সাধ-কুটিরের বহিঃপ্রকোষ্ঠে মোটা পাটির উপর একটি খুঁটি ঠেস দিয়া স্বাভাবিকভাবে বসিয়া আছেন, দ্বার উন্মুক্ত৷ প্রথমে কুমুদদা (সংঘের প্রথম ও প্রধান ত্যাগী সন্তান; দ্বিতীয় সভাপতি শ্রীমৎ স্বামী সচ্চিদানন্দজি মহারাজ) ও পরে আমি কুটিরাভ্যন্তরে প্রবেশ করিলাম৷ আচার্য্যদেব মৃদু হাসিয়া উভয়কে স্নেহ জ্ঞাপন করিলেন৷ সে হাসি যেন মুহূর্তের মধ্যে আমাকে আপন করিয়া লইল, অন্তরের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করিয়া জানাইয়া দিল, আমি এখানে অজানা অচেনা নই, চিরজ্ঞাত চিরপরিচিত৷ অপরিচিতের সঙ্কোচ দূর হইয়া গেল, নিতান্ত আপনার জনের মতই নিকটে যাইয়া বসিলাম৷ কুমুদদা বসিয়াই বলিলেন—যে ছেলেটির কথা বলিয়াছিলাম, এই সেই ছেলেটি৷
আচার্য্যদেবের প্রসন্ন-গম্ভীর মুখমণ্ডল বিদ্যুৎ চমকের মত আবার একবার স্মিতমধুর হাসিতে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল৷ কী সুন্দর প্রাণবিমোহন, নয়নানন্দকর, দিব্যভাবঘন, অপরূপ মনোহর মূর্ত্তি৷ শ্রান্তি, ক্লান্তি দূর হইয়া হৃদয় জুড়াইয়া গেল, অন্তরে শান্তির হিল্লোল বহিল, মনে হইল—এ যেন কোন্ এক স্বর্গীয় রাজ্যে উপস্থিত হইয়াছি৷ এখানে কোন পাপ-তাপ, অসুখ-অশান্তি, জ্বালামালার প্রবেশাধিকার নাই৷

আমরা কিছু সময় চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলাম৷ শ্রীমৎ আচার্য্যদেব প্রথমত কুমুদদা’র সহিত দুই একটি কথা বলিয়া বলিতে লাগিলেন—‘সন্ধ্যা-বন্দনার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন কিছু সময় নিয়মিতভাবে ধ্যান-জপ করিবে৷ ভগবানের যে নাম তোমার বেশ ভাল লাগে, সেই নামের সহিত ওঁ যোগ করিয়া জপ করিবে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই মূর্ত্তিটি ধ্যান করিবে৷
আরও পড়ুন:

পর্ব ৩৫: যে একবার আচার্য স্বামী প্রণবানন্দজির শ্রীমুখনিঃসৃত সুমধুর উপদেশ-বাণী শুনিয়াছে, সে-ই মুগ্ধ হইয়াছে…

বরণীয় মানুষের স্মরণীয় সঙ্গ, পর্ব-১৪: সত্যজিৎ রায়ের চিকিৎসার দায়-দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ কান্তিভূষণ বক্সী

ত্বকের পরিচর্যায়: ফর্সা হওয়ার দৌড়ে না গিয়ে স্বাভাবিক রং নিয়েই সুন্দর ও সুরক্ষিত থাকুন, জানুন ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

শেষ রাত্রে উঠিয়া ধ্যান করিবে৷ ধ্যান করিতে বসিলে যদি ঘুম আসে, তবে চার পাঁচ মিনিট বদ্ধ-পদ্মাসন করিয়া বসিবে৷ তাহাতে ঘুম ও শরীরের সমস্ত আলস্য জড়তা দূর হইয়া যাইবে৷ যদি নির্জন স্থানে কোন আসনে (ধর্ম্মানুষ্ঠানাদি করিবার জন্য বসিবার ক্ষুদ্র আসন—কুশাসন, কম্বলাসন, মৃগচর্ম্ম বা ভেড়ার লোমের আসন প্রভৃতিই প্রশস্ত) বসিয়া ধ্যান-জপ করা সম্ভব হয় তবে তাহাই করিবে, না হইলে নিজের বিছানায় বসিয়া করিবে৷ প্রতিদিন কিছু সময় করিয়া পদ্মাসন অভ্যাস করিবে৷ ধ্যান-জপ করিবার সময়ই পদ্মাসন করিয়া বসা যায়, যখন অসহ্য হইয়া উঠিবে, তখন সাধারণভাবে বসিলেই চলিবে৷

নিজের পড়িবার seat-এ কোথাও একটা সাদা বা সবুজ কাগজের গোলক (ক্ষুদ্র গোল করিয়া কাটা কাগজ) আঠা দিয়া আঁটিয়া রাখিবে এবং প্রত্যহ প্রাতঃকালে পড়া আরম্ভ করিবার পূর্ব্বে কিছু সময় বদ্ধপদ্মাসন করিয়া নিস্পন্দভাবে তাহার দিকে তাকাইয়া থাকিবে৷ ইহাতে দৃষ্টিশক্তি ও মনের একাগ্রতা বৃদ্ধি পাইবে৷ এই সময় শরীর নড়িলে ক্ষতি হয়, তাই শরীর যাহাতে না নড়ে সেই দিকে দৃষ্টি রাখিবে৷

তোমরা নিজেরা কখনও বৃথা বা অনাবশ্যক কথা বলিবে না, বাজে আলোচনায় যোগ দিবে না৷ যে সমস্ত কথা বা আলোচনার কোন প্রয়োজন নাই, তাহা হইতে সব সময় দূরে থাকিবে৷ বাজে কথা, বাজে আলোচনায় অন্তর হাল্কা হয়, মনের শক্তি হ্রাস পায়৷ গণিয়া গণিয়া কথা বলিবে৷ প্রাতঃকালে ঘুম হইতে উঠিবার সময় সংকল্প করিয়া উঠিবে যে, আজ সমস্ত দিনে আমি এই কয়টি কথা বলিব, ইহার অতিরিক্ত কিছুতেই বলিব না৷ আবার শুইবার সময় হিসাব করিবে যে, ঠিক ঠিক ভাবে সঙ্কল্প রক্ষা হইয়াছে কি না৷ মধ্যে মধ্যে মৌনব্রত অবলম্বন করিতে হয়, তাহাতে মনের শক্তি বৃদ্ধি পায়৷

প্রত্যহ কিছু সময় মৃত্যুচিন্তা করিবে, বিচার করিবে—তুমি কে? কোথা হইতে আসিয়াছ? এখানে, এই জগতে কতদিন থাকিবে? এই সংসার, পিতামাতা আত্মীয় স্বজনের সহিত তোমার সম্বন্ধ কি? কতটুকু? দেহের সহিত সম্বন্ধ বশতঃই এই সংসার, পিতামাতা, আত্মীয় স্বজনের সহিত তোমার সম্বন্ধ৷ কিন্তু দেহের পরিণাম কি? এই মুহূর্ত্তে মৃত্যু আসিয়া গ্রাস করিলে তোমার এই সুন্দর সুঠাম দেহ, এই ঘর-সংসার, পিতামাতা ভাই বন্ধু কোথায় পড়িয়া থাকিবে, আর তুমিই বা কোথায় চলিয়া যাইবে? যাহাদের তুমি এত আপন মনে করিতেছ, যাহাদের সুখশান্তির জন্য তুমি জীবন পর্য্যন্ত বিসর্জ্জন দিতে কুণ্ঠিত নও, তাহারাই তোমার এই দেহকে ভস্মীভূত করিয়া ফেলিবে! এমন সুন্দর নধর কান্তি মুহূর্ত্তে পুড়িয়া ছাই হইয়া যাইবে! ইহাই তো এই ক্ষণভঙ্গুর জগতের নিয়ম, পরিণাম, পরিণতি!

এই ভাবে প্রত্যহ নিজ দেহ, এই দৃশ্যমান জগতের অনিত্যতা সম্বন্ধে চিন্তা করিয়া বৈরাগ্যবোধ জাগ্রত করিতে চেষ্টা করিবে৷ তাহা হইলে আর কোন পাপতাপ প্রলোভন তোমার স্পর্শ করিতে পারিবে না; কখনও কোন প্রকার কুচিন্তা কুভাবনা আসিয়া আক্রমণ করিলে এই মৃত্যু-চিন্তাই তোমাদের রক্ষা করিবে৷ যখন প্রয়োজনবোধ করিবে, তখন এখানে আসিবে, সমস্ত ঠিক করিয়া দেওয়া যাইবে৷’

এই বলিয়া শ্রীমৎ আচার্য্যদেব আমাদের সঙ্গী ছেলেটিকে যে স্থানে গত মাঘ মাসে উৎসব হইয়াছিল সেই স্থানটি আমাকে দেখাইয়া আনিতে বলিলেন৷ আমরা উভয়ে আদেশানুসারে গাত্রোত্থান করিলাম৷
সাধন কুটির হইতে বহির্গত হইয়া পুষ্করিণীর উত্তর দিক দিয়া খালপাড়ে শ্মশানে উপস্থিত হইলাম৷ সেখানে কিছু সময় অপেক্ষা করিয়া ক্ষুদ্র একটি বাঁশের সাঁকো পার হইয়া উৎসব-ভূমিতে (ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রথম কেন্দ্র, সঙ্ঘসিদ্ধপীঠ শ্রীশ্রীপ্রণবমঠ৷ শ্রীশ্রীস্বামিজী মহারাজ এই স্থানে মাঘী-পূর্ণিমার পুণ্য তিথিতে সিদ্ধি ও মহাশক্তি লাভ করেন৷) পৌঁছিলাম৷ কি সুন্দর মনোরম স্থান৷ প্রাণমন যেন জুড়াইয়া গেল৷ রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ইতিহাসের বর্ণনা পড়িয়া ঋষি-আশ্রমের যে রূপ আমরা এতদিন কল্পনা করিয়া আসিয়াছি, এ যেন তাহারই প্রত্যক্ষ মূর্ত্তি৷
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৭: হারিয়ে যাওয়ার আগে এ এক বিফল মৃত—‘সঞ্জিবনী’ [০৮/০২/১৯৫২]

শরীরে দেবদেবীর ট্যাটু রয়েছে? নিয়ম না মেনে চললে কিন্তু বিপদ হতে পারে

ইলিশ ছাড়া ভাইফোঁটা ভাবা যায় নাকি, তৈরি করে ফেলুন লোভনীয় স্বাদের সরষে ইলিশের পদ

আচার্যদেবকে একবার এক ছাত্র প্রশ্ন করিয়াছিল—রাত্রে অনেক সময় নানারকম ভয়ের স্বপ্ণ এবং অন্যান্য দুঃস্বপ্ণ দেখি৷ এইগুলি কিভাবে দূর হয়? আচার্য্যদেব বলিলেন ‘রাত্রে শুইবার পূর্ব্বে যে পর্যন্ত ঘুম না আসে সেই পর্য্যন্ত ভগবানের নাম জপ ও মূর্ত্তি ধ্যান করিবে৷ শুইবার সময় মনে করিবে যে, ভগবানের কোলেই শুইয়া আছ৷ তাহা হইলেই দুঃস্বপ্ণ দূর হইবে৷ এতদ্ব্যতীত শুইবার পূর্ব্বে বেলপাতার বেল কাঁটা দিয়া গায়ত্রী মন্ত্র অথবা জপের মন্ত্রটি লিখিয়া মাথার নীচে রাখিবে এবং ভাবিবে যে, এই বিছানা মন্ত্রপূত, বিছানার চতুর্দ্দিকে যে মন্ত্রের দুর্ভেদ্যগণ্ডী আছে তাহা ভেদ করিয়া কোন অপবিত্র চিন্তা, ভাবনা বা অন্য কোন কিছু আসিতে পারে না৷ আমি ঋষি-নির্দিষ্ট মন্ত্রসুরক্ষিত দুর্ভেদ্য দুর্গের ভিতরে অবস্থান করিতেছি, ঋষি ও মন্ত্রই এখানে আমার রক্ষক৷ ঘুম হইতে উঠিয়া পাতাটি জলে ফেলিয়া দিবে৷ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের সহিত কিছুদিন ইহা অভ্যাস করিলে আর দুঃস্বপ্ণ দেখিবে না৷’

মাঘী-পূর্ণিমা সঙ্ঘের ইতিহাসে এক মহাস্মরণীয় দিন, হিন্দুজাতি তথা সমগ্র বিশ্বমানবের এক মহাপুণ্য-তিথি৷ পুণ্যময়ী মহাপবিত্র তিথিতে যুগপাবন আচার্য্যরূপে যুগ-দেবতার মহাবির্ভাব, জাতির মহামুক্তিমন্ত্রের প্রকৃত রূপ দর্শন—মহাসিদ্ধি লাভ, জাতীয় মহামুক্তি-বিধানের প্রবল শক্তিশালী সঙ্ঘ-যন্ত্র—ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রাণ-প্রতিষ্ঠা, মহামুক্তি-মন্ত্রের উদ্গান—ধর্ম্মচক্রের প্রবর্তন হয়৷

১৩২৩ সনের মাঘ মাস (ইং ১৯১৭) শুক্লা একাদশীর গভীর রাত্রি৷ আচার্য্যদেব তপঃকুঞ্জের একটি নিভৃত বৃক্ষমূলে সিদ্ধাসনে সমাহিত৷ চতুর্দ্দিক নীরব, নিস্তব্ধ৷ সমগ্র তপোবন আচার্য্যের মহাভাবে সমাচ্ছন্ন৷ সহসা শশি-সূর্য্য-প্রভা-সমন্বিত উজ্জ্বল স্নিগ্দ জ্যোতিঃপ্রভায় চতুর্দ্দিক ঝলমল করিয়া উঠিল৷ ধীরে ধীরে প্রশান্ত গম্ভীর এক উদাত্ত বাণী সমগ্র দিঃণ্ডল প্রকম্পিত করিয়া ধ্বনিত হইল—‘আর বিলম্ব কেন? সুসময় উপস্থিত৷ কঠোর তপঃসাধনায় যে মহাজ্ঞান, যে মহাশক্তি লাভ হইয়াছে সেই মহাজ্ঞান ও মহাশক্তি সমগ্র জাতির মহামুক্তি আনয়নে সমর্থ৷ আগামী মাঘী-পূর্ণিমার পুণ্যদিনে সঙ্ঘ-যন্ত্রের প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করিয়া যুগ-ধর্ম্মের মৃতসঞ্জীবনী বাণী প্রচার কর৷’

মাঘী-পূর্ণিমার পুণ্যতিথি৷ অন্তরঙ্গ ভক্তগণ শেষ রাত্রে আসিয়া তপঃকুঞ্জে সমবেত হইল৷ আচার্য্যদেব তাহাদের নিয়া স্নান করিয়া আসিলেন৷ তৎপর দেবী বনদুর্গার আসন-বৃক্ষের নিকট অহোরাত্র নামকীর্ত্তনের সঙ্কল্প গ্রহণ করিয়া ‘রাধে কৃষ্ণ গোবিন্দ মধুসূদন রাম-নারায়ণ হরে’ নাম আরম্ভ হইল৷ আচার্য্যদেব নিজেই প্রথম কীর্ত্তন আরম্ভ করিয়া দিলেন, অন্য সকলে পিছনে তন্ময় হইয়া গাহিতে লাগিল৷ সমস্ত দিনরাত্রি বিভিন্ন দলে পালা করিয়া কীর্ত্তন চলিল৷

পর দিবস প্রত্যুষে অষ্ট প্রহর অতীত হইলে আচার্য্যদেব নিজে উপস্থিত হইয়া কীর্ত্তন সমাপন করিলেন৷ তারপর আরম্ভ হইল ভোগ পাক৷ ছেলেরা নিজেরা জল তুলিয়া, বাসন মাজিয়া খিচুড়ি ও মিষ্টান্ন রান্না করিল৷ গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিরা সমস্ত বিষয়ে তত্ত্বাবধান করিতে লাগিলেন৷ এদিকে বনদুর্গা ও রাধাকৃষ্ণের পূজারতি ভোগ হইয়া গেল৷ তখন সকলে মিলিয়া উপস্থিত দর্শনার্থীদের প্রসাদ বিতরণ করিতে আরম্ভ করিল৷
আচার্য্যদেব ভোজনরত ব্যক্তিদের (বিভিন্ন শ্রেণীর) মধ্যে ঘুরিয়া ঘুরিয়া সমস্ত কিছু দেখিতে লাগিলেন৷ মৃদুমধুর হাসিতে সমস্ত মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত, আনন্দ যেন আর ধরে না৷ ভোজনরত ব্যক্তিরা এক এক গ্রাস খায় আর মুখ তুলিয়া তাকাইয়া সেই পবিত্র মূর্ত্তি দর্শন করে৷ তাহাদেরও যেন আনন্দ উছলিয়া পড়িতেছে৷ ওদিকে যাহারা পরিবেশন ও তত্ত্বাবধান করিতেছে তাহাদেরও আনন্দোৎসাহের সীমা নাই৷ সর্ব্বত্র যেন আনন্দ, আনন্দ—মহানন্দের সীমাহীন মহাপারাবার৷

আনন্দময় পুরুষের সংস্পর্শে কি আর কোথাও এক বিন্দু নিরানন্দ থাকিতে পারে? তাই সকলে মহানন্দ-সাগরে মহানন্দে লুটোপুটি খেলিতেছে, হাবুডুবু খাইতেছে৷’

সাধুর ব্রিজ থেকে বাসে মস্তাফাপুর, গৌরনদী, বাবুগঞ্জ প্রভৃতি জায়গা ছুঁয়ে আমি বরিশাল শহরের বাসস্ট্যান্ডে যখন পৌঁছলাম, সূর্য পাটে৷

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content