শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


আচার্য শ্রীমৎ স্বামী প্রণবানন্দজি মহারাজের সাধক-জীবন সম্বন্ধে কিছু অমূল্য তথ্য এই বইয়ে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করি৷ তাই ভারত সেবাশ্রম সংঘের স্বামী আত্মানন্দ রচিত ‘শ্রীশ্রীযুগাচার্য্য সঙ্গ ও উপদেশামৃত’ গ্রন্থের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরলাম৷

‘সঙ্ঘনেতা আচার্যদেব (তখন— সাধু বিনোদ বা বিনোদ সাধু) সবেমাত্র ছাত্রজীবনের গণ্ডী অতিক্রম করিয়াছেন৷ তাঁহার যশঃসৌরভে চতুর্দ্দিক আমোদিত; ঘরে ঘরে বাল-বৃদ্ধ-যুবা, স্ত্রী-পুরুষ সকলের মুখে তাঁহার দিব্য ভাগবত জীবনের কথা নিত্য আলোচিত হইতেছে৷ ছাত্র ও তরুণ সমাজে তাঁহার ত্যাগ-সংযমপূত কঠোর নৈষ্ঠিক জীবন, উদার ও মহান হৃদয়, নিঃস্বার্থ পরোপকার দেবোপম চরিত্রবত্তা ও অত্যদ্ভুত শারীরিক শক্তি, সর্ব্বোপরি স্বর্গীয় সুষমা-মণ্ডিত স্বভাবমাধুর্য এক অপূর্ব্ব প্রভাব বিস্তার করিয়াছে৷ সে-দিন যে একবার ব্রহ্মচারী বিনোদের দর্শনলাভ করিয়াছে, যে একবার তাঁহার শ্রীমুখনিঃসৃত সুমধুর উপদেশ-বাণী শুনিয়াছে, আন্তরিক স্নেহ-আদর-যত্ন-ভালোবাসা-সমবেদনা ও সহানুভূতি পাইয়াছে, সে-ই মুগ্ধ হইয়াছে, নিজেকে ধন্য, কৃতকৃতার্থ মনে করিয়াছে; আর যাহার সেই সৌভাগ্য হয় নাই, সে শুধু ব্যাকুলভাবে সুযোগ খুঁজিয়াছে, কেমন করিয়া তাঁহার সাক্ষাৎলাভ করিবে৷

ছাত্রদের এমন দরদী, মরমী, ব্যথার ব্যথী বুঝি আর কেহ নাই৷ অভাব বুঝিয়া সাহায্য করে, ব্যথা বুঝিয়া সান্ত্বনা দেয়, ধৈর্য্য ধরিয়া জ্বালা-যন্ত্রণার কথা শুনিয়া তাহা দূর করিতে চেষ্টা করে, নিতান্ত আপনার জনের চেয়েও অধিক ভালবাসে, আদর করে— এমন আর কে আছে? পিতামাতা, ভাই, বন্ধু, শিক্ষক, অভিভাবক সকলেই নিজেদের নিয়া ব্যস্ত, কাহারও নিকট প্রাণের কথা, মনের ব্যথা খুলিয়া বলা যায় না, আর বলিলেও ফলোদয় হয় না; কিন্তু ইনি যে সর্ব্বদাই পরের জন্য ব্যস্ত! যে যখন আসিয়া উপস্থিত হয় তাহাকেই তখন তিনি স্নেহ-স্নিগ্দ মধুর বাক্যে মনঃ প্রাণ ভরিয়া দেন, সাধারণ একটি ছেলেকেও মুহূর্ত্তের মধ্যে জীবনগঠনের নূতন উদ্দীপনায় উদ্দীপিত করিয়া নূতন মানুষ করিয়া তোলেন৷ তাই দুই দিনের ছুটি পাইলেই দিনান্তের রাস্তা হইতে ছাত্রদল ছুটিয়া আসে, শনি রবিবারে তাঁহার ঘর তিল ধারণের স্থান থাকে না; নিদাঘ মধ্যাহ্ণের খরতাপ, ভরা বর্ষার নিরবচ্ছিন্ন বাদলধারা, শীত নিশীথের দুরন্ত হিমানী, পিতামাতা অভিভাবকের লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, সমবয়সীদের ঠাট্টা বিদ্রূপ, শিক্ষকদের শাসনদণ্ড, সব কিছু অগ্রাহ্য করিয়া কেহ দুই তিন মাইল, কেহ চার পাঁচ এমনকি সাত আট দশ মাইল দূর হইতে পর্য্যন্ত আসিয়া উপস্থিত হয়; মনের কথা, প্রাণের ব্যথা-বেদনা জানাইয়া শান্তি ও সান্ত্বনা লাভ করে৷ অন্য সমস্ত কাজ বন্ধ থাকিতে পারে, কিন্তু সপ্তাহের মধ্যে অন্ততঃ একটি দিন যেন এখানে না আসিলেই নয়, শ্বাস বন্ধ হইয়া আসে, প্রাণমন যেন অসহ্য জ্বালায় অস্থির হয়— হাঁপাইয়া উঠে৷
বাল্যকালে কিছুদিন (১৯১৪ খৃঃ) তাঁহাকে বিদ্যালয়ের ছাত্ররূপে দেখিবার সুযোগ হইয়াছিল৷ একই বিদ্যালয়ে (বাজিতপুর) আমি তখনClass-V এবং তিনি সর্বোচ্চ শ্রেণীর(Class-X) ছাত্র৷
শ্বেতবস্ত্র-পরিহিত, আগুলফ শ্বেতোত্তরীয়-পরিবৃত, নগ্ণপদ, মুণ্ডিত-মস্তক, সুবলিত, সুগঠিত, সমুন্নত সেই দিব্য মূর্ত্তি— সর্ব্বাঙ্গে কঠোর সংযমের তীব্র তেজোরাশি, প্রশান্ত গম্ভীর মুখমণ্ডলে অখণ্ড ব্রহ্মচর্য্যের উজ্জ্বল জ্যোতিঃপ্রভা— সর্ব্বদা যেন কি এক গভীর চিন্তায় মগ্ণ, কোন এক অজ্ঞাত রাজ্যে বিচরণশীল! করুণা, মুদিতা, স্নেহ ও ক্ষমার প্রতিমূর্ত্তি, আনন্দঘনবিগ্রহ৷ চাইলেই চক্ষু জুড়াইয়া যায়, প্রাণমন কাড়িয়া লয়, নিতান্ত আপনার জনের মত ভালোবাসিতে ইচ্ছা হয়৷

তাই যখনই দেখিয়াছি তখনই বিস্ময়বিমুগ্দচিত্তে কেবলই অবাক হইয়া ভাবিয়াছি— এই ব্যক্তি কে? প্রতিদিন শত সহস্র মানুষ দেখিতেছি, শত সহস্র মানুষের সংস্পর্শে আসিতেছি, কিন্তু কই, এমনটি তো কাহাকেও দেখি না— এ যেন আধিব্যাধি, পাপতাপ জ্বালাযন্ত্রণাপূর্ণ এই মরজগতের কেহ নয়, এ যেন সেই দুঃখ-শোক-মোহাতীত, দ্বন্দ্বদ্বেষশূন্য,নিত্যানন্দধামের আনন্দময় দিব্যপুরুষ, শুধু জগতের কল্যাণের জন্যই আমাদের মধ্যে আবির্ভূত হইয়াছেন৷ সে-দিন সত্যই বড় সাধ হইত— একবার তাঁহার নিকট ছুটিয়া যাই, একটিবার প্রাণ ভরিয়া মন খুলিয়া অন্তরের কথা বলি; কিন্তু বালক আমি, বিনা পরিচয় তাঁহার মত মহান্ ব্যক্তির সঙ্গে কি কথা বলিব? তাই অন্তরের আকাঙ্ক্ষা অন্তরেই বিলীন হইয়া যাইত, দূর হইতে শুধু তাহাকে নির্নিমেষ নেত্রে তাকাইয়া দেখিয়াই সন্তুষ্ট হইতাম৷

সুকলে যাইয়া তিনি বসিতেন একটি বড় জানালার পার্শ্বে৷ পড়ার ঘণ্টায় তিনি কখনও বড় একটা বাহিরে আসিতেন না বা কাহারও সহিত বিশেষ কোনও কথাও বলিতেন না৷ কেবলমাত্র দরিদ্র ভাণ্ডারের চাঁদা আদায়ের জন্য কখনও কখনও তাঁহাকে ক্লাসে ক্লাসে যাইতে দেখা যাইত৷ মাধ্যাহ্ণিক জলযোগের ছুটির সময় বাহিরে আসিয়া কোনও দিন তিনি (নিজের) ক্লাসের সম্মুখে, কোনও দিন বা লাইব্রেরির ঘরের সম্মুখে বেড়ায় ঠেস দিয়া প্রস্তর মূর্ত্তির মত বিস্ফারিত নেত্রে নিশ্চলভাবে সম্মুখের দিকে তাকাইয়া দাঁড়াইয়া থাকিতেন৷ তখন দেখিলে মনে হইত যেন সেই সম্প্রসারিত দৃষ্টি দূর দিকচক্রবাল অতিক্রম করিয়া দূরে, অতিদূরে— ইহজগতের পরপারে কোথায় কোন অজ্ঞাত রাজ্যে চলিয়া গিয়াছে, মনঃপ্রাণ কোন এক অতীন্দ্রিয় সত্তায় বিলীন, শুধু রক্ত মাংসের দেহটি পড়িয়া আছে প্রস্তর মূর্ত্তির মত নিথর, নিস্পন্দ, নিশ্চল৷

ভিতর চলিয়া যাইতেন৷ সেই স্বল্প ও মৃদুভাষী আত্মসমাহিত গম্ভীর মূর্ত্তির সম্মুখে সহপাঠীদের সর্ব্বপ্রকার চঞ্চলতা ও চপলতা যেন কঠিন প্রস্তরে ধাক্কা খাইয়া থামিয়া যাইত৷ শিক্ষক ও বয়োজ্যেষ্ঠ প্রবীণ ব্যক্তিরাও পর্য্যন্ত অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই ছাত্রটিকে শ্রদ্ধা না করিয়া পারিতেন না৷ তাঁহাদের চাপল্য ও হাল্কাভাব ইঁহার স্বাতন্ত্রিকতা ও গাম্ভীর্য্যের নিকটে কুণ্ঠায় সঙ্কুচিত হইয়া পড়িত৷ সমবয়স্ক সতীর্থগণ কখনও কখনও অনভীপ্সিত কাজে যোগ দিবার জন্য জেদ ধরিল তিনি সাধারণতঃ মৃদু হাসিয়াই তাঁহার অনিচ্ছা জ্ঞাপন করিতেন, কখনও খুব বেশী পীড়াপীড়ি করিলে সংক্ষেপে দুই একটি কথা বলিতেন, তাহাতেই তাহারা সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে অব্যাহতি দিত৷ সকলেই জানিত যে, তিনি যাহা অপছন্দ করেন, তাঁহাকে দিয়া তাহা করান যাইবে না এবং তজ্জন্য অনুরোধ করাও অনুচিত৷
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৬: রাম-পরশুরাম দ্বৈরথ অযোধ্যার পথে

ত্বকের পরিচর্যায়: হঠাৎ শিশুর জ্বর আর মুখে-হাতে দানাদানা? কোন রোগের উপসর্গ? জানুন বিশেষজ্ঞের মতামত

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৫: বাহুকরূপী নলের রথ ঋতুপর্ণরাজাকে নিয়ে তীব্র বেগে বিদর্ভের পথে চলল

মনের আয়না: ঘুমোতে গেলেই মগজে ভিড় করছে রাজ্যের দুশ্চিন্তা? জন্মাচ্ছে অকারণ ভয়? রইল সমাধান

সুকল ও গ্রামের যাবতীয় মহদনুষ্ঠানের তিনিই ছিলেন প্রাণ৷ ছাত্রদের নিকট হইতে দরিদ্র-ভাণ্ডারের চাঁদা তুলিয়া সুকলের দরিদ্র ছাত্র ও অসহায় ব্যক্তিদের তিনি সাহায্য করিতেন৷ তাঁহাকে কেন্দ্র করিয়া সেদিন একটি নির্ভীক, কষ্টসহিষ্ণু, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, নিঃস্বার্থ-সেবাপরায়ণ কর্মীদল গড়িয়া উঠিয়াছিল৷ ইহারা তাঁহাকে এমনই ভালবাসিত এবং শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করিত যে, আদেশ পাইলে তাহারা যে-কোন মুহূর্ত্তে যে-কোন বিপদকে বরণ করিয়া লইতে পারিত৷ ব্রহ্মচারী বিনোদ ইহাদিগকে লইয়া বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া মুষ্টিভিক্ষা সংগ্রহ করিতেন, বিপন্নদের সাহায্য করিতেন, অসহায় পীড়িতদের সেবাশুশ্রূষা করিতেন ও ঔষধ পথ্যাদি আনিয়া দিতেন, প্রত্যেকের অভাব অভিযোগ বিপদাপদ সম্বন্ধে খোঁজখবর লইয়া তাহা দূর করিতে চেষ্টা করিতেন৷ দুঃস্থ ভদ্র-পরিবারদিগকে তিনি সন্ধ্যার পরে গোপনে যাইয়া চাউল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দিয়া আসিতেন, যাহাতে অপর কেহ তাহা জানিতে না পারে এবং তাহাদের সম্ভ্রমহানি না হয়৷ উপবাস করিব তথাপি কাহারও সাহায্য গ্রহণ করিব না—এই প্রকার মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের সাহায্য তিনি তাহাদেরও অজ্ঞাতসারে রাত্রির অন্ধকারে ঘরের দরজায় রাখিয়া আসিতেন৷ কাহারও বাড়িতে আগুন লাগিলে বা আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটিলে, গ্রামে কলেরা প্রভৃতি দেখা দিলে তিনি তাঁহার সহকর্মীদের লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়িতেন সাহায্যের জন্য৷

এক সময় তিনি নিজে একাদিক্রমে সাত দিন সাত রাত্রি পর্য্যন্ত কলেরা রোগীর অবিশ্রাম শুশ্রূষা করিয়াছিলেন৷ এই জন্য রোগ-শোক-তাপগ্রস্ত, অভাব ও দুঃখ-দৈন্য-পীড়িত, বিপন্ন ব্যক্তি মাত্রই তাঁহার (সেই শান্তিপূর্ণ পবিত্র মূর্ত্তির)দর্শন লাভের আশায় গভীর আগ্রহের সহিত পথের দিকে তাকাইয়া থাকিত৷ তিনি ছিলেন সেদিন শান্তিদূত, আশা, ভরসা, সাহস ও সান্ত্বনার মূর্ত্ত প্রতীক, সকলের গভীর অন্তরঙ্গ পরমপ্রিয় মানসপুত্তলী৷ শুধু তাই নয়, তিনি একাধারে সকলের সখা, সুহৃদ্, নেতা, উপদেষ্টা ও অভিভাবক ছিলেন৷ কাহারও কোন প্রকার মানসিক অশান্তি বা পারিবারিক মনোমালিন্য ঘটিলে, কাহারও কোন প্রকার মানসিক অশান্তি বা পারিবারিক মনোমালিন্য ঘটিলে, কাহারও সহিত বিবাদ বিসম্বাদ হইলে, অথবা কোন জটিল সমস্যার সমাধান না হইলে, অমনি সকলে তাঁহার নিকট ছুটিয়া আসিত৷ আর তিনিও সম-আদরে দরদভরে সকলের ব্যথা-বেদনা দূর করিয়া শান্তি ও সান্ত্বনা দিতেন৷

শারীরিক শক্তিতে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়৷ তাঁহার বজ্রদৃঢ় শরীর ও লৌহতারের মত পেশীসমূহ সেদিন বিখ্যাত শক্তিমান্ ব্যক্তিদের প্রাণে ঈর্ষা এবং দুষ্টদুর্বৃত্তের প্রাণে ভীতির সঞ্চার করিত৷ তাঁহার নাম শুনিলে বা তাঁহার কথা বলিয়া নিষেধ করিলে এমন কোন দুষ্টদুর্বৃত্ত ছিল না যে কোন অন্যায় করিতে সাহস করিত৷ এই বিষয়ে তিনি ছিলেন ‘বজ্রাদপি কঠোর’; তিনি কখনও কাহারও বিন্দুমাত্র অন্যায়ও সহ্য করিতেন না৷ তাই তাঁহার বজ্রকঠোর মূর্ত্তি দুর্দ্ধর্ষ অত্যাচারীকেও সন্ত্রস্ত করিয়া তুলিত৷ দুষৃকতকারীকে শাসন করিয়া দুর্বল অসহায় নিরীহ ব্যক্তিদের রক্ষা করাই ছিল তাঁহার চরিত্রের বিশেষত্ব৷ পরবর্ত্তীকালেও আমরা ইহা বিশেষভাবে লক্ষ্য করিয়াছি৷ যেখানে অন্যায় অত্যাচার সেখানেই তিনি দুর্ব্বার৷ নটরাজ শিবের মত রুদ্রমূর্ত্তি ধারণ করিয়া সর্ব্বপ্রকার অত্যাচার উপদ্রবের বিরুদ্ধে তিনি দণ্ডায়মান হইয়াছেন৷
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৪: কবি যখন শিক্ষক

ষাট পেরিয়ে, পর্ব-১৫: এখন থেকেই যত্ন নিন কিডনির, গুরুত্ব দিন এ সব বিষয়ে

বরণীয় মানুষের স্মরণীয় সঙ্গ, পর্ব-৫: যামিনী রায়ের মতো এক কিংবদন্তির স্মরণীয় সঙ্গ আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল…/৩

পুজোর ছুটিতে সপরিবারে ঘুরতে যাচ্ছেন? কোন কোন বিষয় মাথায় রাখবেন? রইল ডাক্তারবাবুর জরুরি পরামর্শ

সাহস ও নির্ভীকতায় তাঁহার সহিত কাহারও তুলনাই চলিত না৷ শৈশবাবধি ভয় কাহাকে বলে তাহা তিনি জানিতেন না, বিপদ বা কষ্ট কি তাহা তিনি বুঝিতেন না৷ অমানিশার গভীর নিশীথে ঘনঘোর দুর্যোগ মাথায় লইয়া নিরন্ধ্র অন্ধকারের বুকে তিনি নিঃশব্দে নীরবে একাকী শ্মশানে-মশানে ঘুরিয়া বেড়াইতেন৷ যেখানে অতিবড় সাহসী বয়স্ক ব্যক্তিরাও সন্ধ্যার পরে দলবদ্ধ হইয়া যাইতে সাহস পাইত না, সেখানে তিনি নিঃসঙ্কোচে একাকী যাইয়া গভীর রাত্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়া থাকিতেন৷ এই সম্বন্ধে কেহ কিছু জিজ্ঞাসা করিলে মৃদু হাসিয়া বলিতেন—‘ভয় শুধু মনে, বাস্তবিক পক্ষে বাহিরে ইহার কোন অস্তিত্ব নাই৷’

মানুষের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ ও লোকচরিত্র অনুধাবনে তাঁহার বিশেষ দক্ষতা ছিল৷ কাহাকেও দেখিবামাত্রই তিনি মুহূর্ত্তে তাহার অন্তঃস্থলে প্রবেশ করিয়া সমস্ত মনোভাব ও প্রকৃতি বুঝিয়া লইতেন৷ যে যখন যেভাব লইয়াই উপস্থিত হউক না কেন, তিনি তাহাকে তাহার মনের কথাটি টানিয়া বাহির করিয়া সমস্ত বিষয় বুঝাইয়া দিতেন৷ কেহ মুখ ফুটিয়া কিছু না বলিলেও প্রত্যেকেই তাঁহার নিকট হইতে নিজ নিজ ভাবোপযোগী প্রয়োজনীয় উপদেশ পাইয়া বিস্মিত হইত৷

ছাত্র ও যুবক মহলে বাল্যকাল হইতেই তিনি ছিলেন অবিসংবাদী সর্ব্বজনপ্রিয় নেতা৷ প্রত্যেকের রুচি, প্রকৃতি, ভাব, বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতানুযায়ী দায়িত্ব ও কর্ত্তব্য ভার দিয়া প্রত্যেককে যথাযোগ্যরূপে পরিচালনায় তাঁহার অসাধারণ নৈপুণ্য ছিল৷ কিভাবে মনোজয় করিয়া মানুষকে আকর্ষণ করিতে হয় তাহা তিনি ভালভাবে জানিতেন৷ তাই সুকলে বা গ্রামের ছাত্রদের যে কোন অনুষ্ঠান তাঁহারই নেতৃত্বে সম্পাদিত হইত৷ সকলেই মনে করিত, ‘বিনোদদা’ ঠিক আমার উপযোগী মনের মত কাজটিই আমাকে দিবেন৷ আর হইতও তাহাই৷ এই জন্য তাঁহার উপদেশ ও নিয়ন্ত্রণে সকলেই সমস্ত কাজ করিতে ভালবাসিত৷ তাঁহার সেই শান্ত, সৌম্য, প্রিয়দর্শন মূর্ত্তি সকলের প্রাণে নূতন সাহস, ভরসা, উৎসাহ, বিশ্বাস ও আনন্দ জাগাইয়া তুলিত৷

যে কোন কাজে তিনি হাত দিবেন তাহাই সাফল্যমণ্ডিত হইবে—এই সিদ্ধান্ত সকলেরই প্রাণে বদ্ধমূল ছিল৷ তাহার ফলে যে কাজে তিনি হাত দিতেন, তাহাতে সকলে নিঃশঙ্কচিত্তে ঝাঁপাইয়া পড়িত, আর যে কাজে তিনি হাত দিতেন না, তাহাতে কাহারও কখনও আগ্রহ লক্ষিত হইত না৷ তিনি ছিলেন উৎসাহ-উদ্দীপনা, আনন্দ ও প্রেরণার ঘনীভূত জাগ্রত বিগ্রহ৷ তাঁহার সংস্পর্শে নিতান্ত নির্জীবের প্রাণেও অদ্ভুত জীবনীশক্তি, অকর্ম্মণ্যের ভিতরেও অপূর্ব্ব কর্ম্মশক্তি ফুটিয়া উঠিত৷…

আচার্যদেবের কঠোর সাধনা সম্পর্কে এই সময়ে বাহিরের লোকের বিশেষ কিছু জানিবার বা বুঝিবার উপায় ছিল না৷ অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মত লোকচক্ষুর অন্তরালে অতি সংগোপনে যে কৃচ্ছ্রসাধনময় জীবন-প্রবাহ বহিয়া চলিয়াছিল, সে সম্পর্কে তিনি সর্ব্বদা নীরবই থাকিতেন৷ তবে মধ্যে মধ্যে তাঁহার নিতান্ত অন্তরঙ্গ লীলাসহচর উত্তরসাধকদিগকে জীবন-সাধনায় উদ্বুদ্ধ করিবার জন্য অতি সংক্ষেপে দুই একটি কথা বলিতেন মাত্র৷’

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content