শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

ফরিদপুরের শহরতলি ব্রাহ্মণকান্দায় দিগম্বরীদেবীর চোখের জলে বুক ভাসে৷ ভাই জগৎসুন্দর বিনা তাঁর দিন যেন আর কাটে না৷ বোন গোলকমণি পাবনায় থাকেন৷ সেখানেই দিগম্বরীদেবীর যাওয়ার ইচ্ছা৷ গৃহভৃত্য পেনাকে সঙ্গে নিয়ে কুষ্ঠিয়া পর্যন্ত ট্রেনে এসে রাতে পাবনাগামী স্টিমারে চড়ে বসলেন৷ স্টিমারের এককোণে বসে চোখ বন্ধ করে নানারকম চিন্তা করছেন দিগম্বরীদেবী৷ জগৎসুন্দরকে দেখার জন্য উচাটন মন৷

গড়াই নদীর বুকে ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফোটে৷ দিগম্বরীদেবীর ঘুম ভাঙে৷ হঠাৎ তিনি লক্ষ করেন—কিছুটা দূরে ডেকের ওপর এক সাধু মৃগচর্মাসনে উপবিষ্ট৷ দিগম্বরীদেবী উঠে দাঁড়িয়ে ওই সাধুর দিকে এক পা দু’পা করে এগিয়ে যান৷ সেই মুহূর্তে নিজের দু’চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারেন না৷ —এ যে জগৎ! আবার পরমুহূর্তেই মনে হয়, এ জগৎ হতে পারে না৷ কারণ, জগতের মাথায় ঘন সন্নিবিষ্ট যে কেশ তা কোথায়!

এরপর আরও কাছে গিয়ে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করে দিগম্বরীদেবীর সন্দেহ দূর হল, না, এই সাধু জগৎসুন্দরই! মাধুর্যময় সেই অপরূপ মুখখানি বারংবার দেখেও যে তৃষ্ণা মেটে না৷ দিগম্বরীদেবী আবেগভরা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘জগৎ, তুই এখানে?’

নবীন তাপসের সমস্ত গাম্ভীর্য দূর হল৷ তিনি বলে ওঠেন, ‘বড়দি, আপনি!’
জগৎসুন্দরের আদরের ডাকে দিদি দিগম্বরীর চোখে আনন্দাশ্রু৷ ঈশ্বরের কাছে দিগম্বরীদেবীর বারবার প্রার্থনা অবশেষে পূরণ হয়েছে৷ জগৎসুন্দর ব্রজের ধূলি দিদির হাতে দিয়ে বললেন, ‘বড়দি, এই নিন যুগলকিশোরের পদরজ৷’

যথাসময়ে স্টিমার পাবনার ঘাটে পৌঁছল৷ বড়দির অনুরোধে শেষপর্যন্ত গোলকমণির গৃহে উপস্থিত হলেন প্রভু জগৎসুন্দর৷ তাঁর আগমন বার্তা রটি গেল দিকে দিকে৷ যাঁরা এতদিন প্রভুর পথ চেয়ে বসে আছেন, এই সংবাদে তাঁদের আনন্দ ধরে না৷ প্রভুকে ঘিরে উচ্চ কীর্তন শুরু হল৷ হরিনামের ধ্বনি শ্রবণ করে মহানন্দে বারংবার মাথা আন্দোলিত হয় প্রভুর৷ মহা ভাবাবেশ হয় তাঁর৷

রাধানাম প্রভুর কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই দু’নয়ন দিয়ে অবিরল ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ে৷ তাঁর বুকের বসন ভিজে যায়৷ জগদ্বন্ধুর শ্রীমুখে অস্ফুটে শোনা যায়—‘ভাইরে, ত্যজিয়াছি গোলকে আসন৷/আমার রাধা মন্ত্র জপ-তপ হৃদয় ভূষণ৷৷’
অনেক সময় কীর্তন চলাকালীন প্রভু সেখানে পদ্মাসনে বসেন৷ উচ্চ কীর্তনে তিনি পদ্মাসনে উপবিষ্ট অবস্থাতেই ধুলোয় গড়াগড়ি দেন৷ সে এক অপূর্ব দৃশ্য! তখন শ্রাবণের শেষ৷ প্রভু ব্রাহ্মণকান্দায় এসেছেন৷ তারপর ঝুলনযাত্রা, জন্মাষ্টমী উৎসব এল৷ তাঁকে ঘিরে ভক্তের ঢল নামে৷ দেখতে দেখতে দুর্গোৎসব সমাসন্ন৷ চক্রবর্তী-বাড়িতে জগজ্জননীর পুজোয় নর-নারীর ভিড়৷ মহাষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত কয়েকদিন ধরে কীর্তন চলে৷ প্রভু জগদ্বন্ধুর কী আনন্দ! তাঁকে পেয়ে ধন্য ব্রাহ্মণকান্দা লীলাধাম৷ এই আশ্রমকে ঘিরে এক নব উন্মাদনা জাগে৷ সকলেই আনন্দ সহকারে হরেকৃষ্ণ নাম গাইতে থাকে—‘হরে-কৃষ্ণ হরে-রাম বল অবিরাম৷’

শ্রীশ্রীজগদ্বন্ধু কী বলেছেন শোনাই সকলকে৷ তিনি বলেছেন, ‘হরিনাম এত উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করিবে, যেন সহস্র হস্ত দূর হইতে শোনা যায়৷ স্থাবর জঙ্গম কীটপতঙ্গ সবাই উদ্ধারণ প্রয়াসী হয়ে চেয়ে আছে৷ নামই উদ্ধারণ৷’ শ্রীমুখের এই শাশ্বত বাণী শ্রবণ করে ভক্তগণ পরম উল্লাসে কীর্তন সহযোগে নৃত্য শুরু করলেন৷ কেউ ধুলোয় গড়াগড়ি দিল৷ কেউ নয়ন জলে ভাসল৷ কেউ আবার ভাববিহ্বল হয়ে পড়ল৷ মহিলারা বারবার উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি করতে লাগল৷ ‘হরিবোল…হরিবোল’ ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হল৷

ফরিদপুর শহরের বাগদি পাড়া৷ অঞ্চলটি শহরের পূর্বদিকে৷ কীর্তনের শোভাযাত্রা দেখে বাগদি পাড়ার পুরুষ ও মহিলাদের চোখের পলক পড়ে না৷ বালিকারা হাততালি দিয়ে নাচতে থাকে৷ সকলের দৃষ্টি প্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দরের দিকে নিবদ্ধ৷ প্রভুর স্বর্গীয় রূপে সকলেই বিমোহিত৷ তাঁর নির্দেশমতো নগরকীর্তন ফরিদপুর শহর পরিক্রমা করে পুনরায় ব্রাহ্মণকান্দায় ফিরে এল৷ ‘কৃষ্ণ গোবিন্দ গোপাল শ্যাম/রাধামাধব রাধিকা নাম’ সকলের মুখে মুখে৷
আরও পড়ুন:

মশায় জ্বালায় অতিষ্ঠ? জানেন শরীরে কোন গ্রুপের রক্ত থাকলে বেশি মশার কামড় খেতে হয়?

প্রভু জগদ্বন্ধুর অলৌকিক জীবনের কথা জানতে হলে রজনী সর্দারের প্রসঙ্গ আসবেই৷ বাগদি সম্প্রদায়ের নেতা রজনীর ইয়া তাগড়াই চেহারা! বাবরি চুল, দাড়ি-গোঁফে ঢাকা মুখ, কপালে লম্বা রক্তবর্ণ তিলক, জবাফুলের মতো লাল দু’চোখ৷ লাঠি খেলা, সড়কি খেলা, তির-ধনুকের খেলা—সবেতেই রীতিমতো ওস্তাদ রজনী৷ তার হাঁক শুনে ভয়ে মানুষের বুক কাঁপে৷ তবে এহেন রজনী সর্দারের মন কিন্তু শিশুর মতোই নরম৷ ভীষণ পরোপকারী সে৷ নানা লোক নানা প্রয়োজনে রজনীর শরণাপন্ন হয়৷ কিন্তু যে লোকটা সকলের এত উপকার করে, হিন্দু সমাজ তাকে সেই মর্যাদা দেয় না৷ এমনকী তার ছায়া মাড়াতেও ব্রাহ্মণরা ভয় পায়৷ কিন্তু কোল, ভিল, সাঁওতালদের বংশধর বাগদিরা রজনীকে তাঁদের নেতা বলে মান্য করে৷

সমাজের এত অনাদরে রজনী সর্দারের মনে ভারী দুঃখ৷ খ্রিস্টান পাদরিরা এরকমই এক সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন৷ তাঁরা রজনী সর্দারকে তার দলবলসহ হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান ধর্ম নেওয়ার জন্য নানা প্রলোভন দেখান৷ খ্রিস্টান ধর্ম নেওয়ার কথা স্বপ্ণেও ভাবতে পারে না রজনী সর্দার৷ কিন্তু উপায় কী৷ হিন্দুধর্মের মুরুব্বিরা তো বাগদি মানুষগুলোকে মানুষ বলেই মনে করে না৷ শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রজনী সর্দার৷

এ কথা শোনামাত্রই বিচলিত হলেন শ্রীপ্রভুজগদ্বন্ধু৷ রজনীর সঙ্গে সাক্ষাতের অভিপ্রায় প্রকাশ করলেন৷ প্রভু ডেকেছেন শুনে রজনী সর্দার তাড়াতাড়ি এসে হাজির হল৷ শ্রীজগদ্বন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন—তোমরা নাকি খ্রিস্টান হবে রজনী?

‘হ্যাঁ প্রভু, কাল পাদরিরা আসবেন৷’ মাথা নিচু করে পরম বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দেয় রজনী৷
কী কারণে খ্রিস্টান হতে চায় রজনী ও তার সম্প্রদায় সেকথা জানতে চাইলেন প্রভু৷

রজনী সর্দার করজোড়ে বলল, ‘প্রভু, কোনও কিছুই তো আপনার অজানা নয়৷ হিন্দু সমাজে আমাদের স্থান নেই৷ এই অপমান অত্যাচার আর সহ্য হয় না প্রভু৷ আমরা দীনহীন বুনো জাত৷ এই সমাজে আমাদের স্থান কোথায়?’ রজনীর কণ্ঠস্বর কান্নায় বুজে আসে৷
আরও পড়ুন:

বর্ষাকালে তাড়াতাড়ি কাঁচালঙ্কা পচে যাচ্ছে? জেনে নিন দীর্ঘদিন তাজা রাখার সহজ উপায়

শ্রীজগদ্বন্ধু স্মিত হেসে বললেন, ‘রজনী, কে বলেছে তোমরা হীন৷ তোমরা হীন নও, তোমরা মহান৷ হরিনাম করলে তোমরা আরও মহান হবে৷ তোমরা বুনো জাতি নও৷ তোমরা মানব জাতি৷ তোমরা আমার অতি প্রিয়৷ শ্রীহরির দাস তোমরা, ইহাই তোমাদের আসল পরিচয়৷ রজনী, তুমি সেই নিত্যকালের পরিচয়ে পরিচিত হও৷ সকল দুঃখ ঘুচবে৷ আজ হতে তুমি আর রজনী নও৷ তুমি হরিদাস৷ হরিনাম করো৷ প্রাণভরে নিতাই গৌরের জয়গান গাও৷ সগোষ্ঠী ধন্য হও৷ আজ এইক্ষণ হতে তোমরা আর বুনো নও৷ তোমাদের উপাধি হবে মোহান্ত৷’

প্রভুর অমৃতোপম কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনল রজনী৷ এমন দরদভরা কথা আজ পর্যন্ত শোনেনি সে৷ প্রভুর মুখনিঃসৃত কয়েকটি শব্দ ‘তোমরা মানব জাতি, তোমরা আমার অতি প্রিয়’ রজনী সর্দারের মনে বিরাট আলোড়ন তুলেছে৷ প্রভু তাকে আলিঙ্গনবদ্ধ করলেন৷ জাতপাতের সমস্ত বাধানিষেধ এক ফুৎকারে উড়ে গেল৷ প্রভু বললেন, ‘হরিদাস, কাল তুমি স্বগোষ্ঠী এখানে এসে শ্রীশ্রীরাধা-গোবিন্দের প্রসাদ গ্রহণ করবে৷’
শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দরের আদেশে রজনী সর্দারসহ বাগদি গোষ্ঠীর প্রত্যেকে কণ্ঠে তুলসীর মালা ধারণ করল৷ শ্রীশ্রীপ্রভু হরিদাসের হাতে করতাল তুলে দিয়ে বললেন, ‘প্রাণ ভরে জীবন ভরে গৌরহরির নাম করো৷’
এই ঘটনার কথা চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে বেশিদিন লাগেনি৷ ঘটনাটি কলকাতার কাগজে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল৷—চলবে

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content