সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন।

প্রায় সন্ধ্যার মুখে ফরিদপুরে পৌঁছলাম৷ বাসটা এখান থেকে আরও ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ কিমি দৌড়ে রাজবাড়ি পর্যন্ত যাবে৷ রাজবাড়ি ফরিদপুর জেলার অন্যতম বড় শহর৷ প্রয়াত বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সন্তোষকুমার ঘোষের জন্মস্থান৷ বাসস্ট্যান্ড থেকে ইজিট্যাক্সিতে ফরিদপুর রামকৃষ্ণ মিশন বেশিদূর নয়৷

বাংলাদেশে একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি, বড় বড় শহর যেখানেই গিয়েছি সেইসব জায়গার রামকৃষ্ণ মিশনের অবস্থান ঠিক কোথায় সমস্ত অটোরিকশ ও রিকশচালকের মুখস্থ৷ যখন পৌঁছলাম রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরে সান্ধ্যকালীন ভক্তিসংগীত শুরু হয়ে গিয়েছে৷ একসময় আমিও নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াশুনো করেছি৷ শ্রীরামকৃষ্ণকে নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ রচিত ভক্তিসংগীত ‘খণ্ডন ভব বন্ধন জগবন্দন বন্দি তোমায়…’ কোথাও গাওয়া হচ্ছে শুনলে সকলের প্রাণের ঠাকুরের প্রতি ভক্তিতে আমারও মাথা নত হয়ে আসে৷

মন্দিরের সিঁড়িতে বসেছিলাম৷ পিঠে অতবড় রুকস্যাক নিয়ে মন্দিরের ভেতরে ঢোকা শোভনীয় নয়৷ আশ্রমেরই এক সন্ন্যাসী হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছেন৷ তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছে ধুতি ও উত্তরীয় পরা একদল ছেলে৷ নিশ্চয়ই আশ্রমের ছাত্রাবাসে থাকে৷ কয়েকজন মহিলাকেও দেখলাম মন্দিরে৷ সম্ভবত স্থানীয় অধিবাসী৷
যশোর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে ফোন এসেছিল৷ ফরিদপুর আশ্রমের সম্পাদক স্বামী ভার্গবানন্দ আমার আসার কথা জানতেন৷ আতিথেয়তা রামকৃষ্ণ মিশনের সেবাকর্মের অন্যতম পরিচয়৷ অনাথ মহারাজ নিজের হাতে দোতলার একটা ঘরের তালা খুলে আমার রাত্রিবাসের জায়গাটি দেখিয়ে দিলেন৷ লাইট-ফ্যান ঠিক আছে কি না দেখে বললেন, ‘আপনি অনেকটা জার্নি করে এসেছেন৷ একটু ফ্রেশ হয়ে আশ্রমের অফিসঘরে আসুন৷
অনেকক্ষণ হয়তো আপনার চা-টা খাওয়া কিছু হয়নি৷ এখন চা খেলে ভালোই লাগবে৷’ মুদুভাষী ও অসম্ভব বিনয়ী অনাথ মহারাজের আন্তরিকতার প্রশংসা করতেই হয়৷ ফরিদপুরে বেশ কয়েকটি কলেজ আছে৷ সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ কো-এডুকেশন, সারদাসুন্দরী কলেজ মেয়েদের, সরকারি ইয়াসমিন কলেজ প্রভৃতি৷ বে-সরকারি ফরিদপুর মহাবিদ্যালয়, সিটি কলেজ৷ ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজেরও যথেষ্ট নামডাক৷
চা খেতে খেতে অনাথ মহারাজের কাছে শুনলাম, ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আশ্রমের একটা স্কুল আছে৷ নাম, মহাকালী পাঠশালা৷ জনা পঞ্চাশেক ছাত্র-ছাত্রী৷ একটা সংস্কৃত টোলও আছে৷ সপ্তাহে একদিন ক্লাস৷ আশ্রমের ছাত্রাবাসে যারা থাকে তারা স্থানীয় কলেজে পড়াশুনো করে৷ বড় পুকুর-সহ অনেকটা জায়গা এই আশ্রমের৷
আমাদের আলোচনা চলাকালীন এক ভদ্রলোক অফিস ঘরে ঢুকলেন৷ অনাথ মহারাজ পরিচয় করিয়ে দিলেন৷ ভদ্রলোকের নাম কার্তিকচন্দ্র চক্রবর্তী৷ ফরিদপুর হর্টিকালচারের বড় অফিসার৷ সরকারি চাকরি৷ পড়াশুনো নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে শুনে কার্তিকবাবু বললেন, ‘এ ব্যাপারে অপুবাবুর ‘সানরাইজ’ স্কুলের কথা না বললে বিষয়টাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে৷’

এরপর যা শুনলাম তাতে আমার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়৷ অপুবাবুর ভালো নাম অপরেশচন্দ্র রায়৷ তিনি একটা প্রাইভেট স্কুল খুলেছেন ফরিদপুর শহরে৷ কয়েকশো ছাত্র-ছাত্রী৷ ‘সানরাইজ’ সুকলের খুব নামডাক৷ ফি বছর অ্যাডমিশন ফর্ম নিতেই বিরাট লাইন পড়ে৷ মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় অপরেশবাবুর৷ তাঁর জনপ্রিয়তাও যথেষ্ট৷ সমাজসেবী৷ প্রতি বছর দুর্গাপুজোয় ফরিদপুর রামকৃষ্ণ মিশনে খিচুড়ি প্রসাদের জন্য কয়েক মণ চাল-ডাল দেন৷ কার্তিকবাবু বললেন, ‘আমাদের ফরিদপুর শহরের এরকম একজন সফল মানুষের জন্য গর্ববোধ হয়৷’
এবারেও এখানকার রামকৃষ্ণ মিশনে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ১৭৯-তম জন্মোৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়৷ প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার খোন্দকার মোশারফ হোসেন৷ শুনলাম, শেখ হাসিনার আত্মীয় তিনি৷ তিনদিনের এই উৎসব৷ প্রথম দিন স্বামী বিবেকানন্দের ওপর আলোচনা, দ্বিতীয় দিন শ্রীশ্রীমাকে নিয়ে আলোচনা, তৃতীয় দিন শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্যজীবন ও বাণীর আধারে সুচিন্তিত মতামত রাখেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা৷ প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার মানুষ এই আলোচনা সভায় এসেছেন৷ খিচুড়ি প্রসাদের ব্যবস্থা ছিল৷ সঙ্গে পাঁচমিশেলি তরকারি আর পায়েস৷

ফরিদপুর শহর ও আশপাশে অনেক মন্দির৷ গৌরগোপাল মন্দির, ইসকনের মন্দির, ছোট ছোট কালীমন্দির৷ ব্রাহ্মণকান্দায় শ্রীকৃষ্ণমন্দির, শিবমন্দির দর্শন করতে অনেকেই যায়৷ শ্রীঙ্গনে শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দর মঠ দেখার মতো এক তীর্থস্থান৷ ১৯০৯ সালে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের এই আশ্রমটি তৈরি হয়৷ শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দর মঠের (ভারত) সাধারণ সম্পাদক বন্ধুগৌরব ব্রহ্মচারী আমাকে বলেছিলেন, ‘আমাদের সম্প্রদায় বিশ্বাস করে রাধা-কৃষ্ণের মিলিত রূপ হলেন প্রভু শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দর (১৮৭১-১৯২১)৷ আমাদের দিবা-রাত্রি ২৪ ঘণ্টা নামগান চলে—হরিপুরুষ জগদ্বন্ধু মহাউদ্ধারণ/চারিহস্ত চন্দ্রপুত্র হা কীট পতন/প্রভু প্রভু প্রভু হে অনন্তানন্তময়৷’
মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর গুরুদেব মহেন্দ্রজির ইষ্টদেবতা প্রভু শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দর৷

১৯৭১ সালে ফরিদপুরের এই আশ্রমে পাক সেনারা তাণ্ডব চালায়৷ ডিনামাইট লাগিয়ে আশ্রমের মন্দিরের সু-উচ্চ চূড়া ভেঙে দেয়৷ সেইসময় মঠের আটজন সন্ন্যাসীই শুধু ছিলেন৷ বাকি সন্ন্যাসী ও ভক্তরা অন্যত্র চলে যান৷ কীর্তনরত ওই আটজন সন্ন্যাসীকে কীর্তন থামাতে আদেশ করলে হানাদার বাহিনীর নির্দেশ অমান্য করেছিলেন তাঁরা৷ সন্ন্যাসীদের এরকমই মনোভাব ছিল—জীবন যায় যাক, নামগান বন্ধ হবে না৷

তখন ভরদুপুর৷ গোটা ফরিদপুর শহর জুড়ে বাতাসে গোলা-বারুদের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ৷ মঠের চালতা গাছের নীচে সন্ন্যাসীদের দাঁড় করিয়ে প্রথমে পিছমোড়া করে বাঁধা হয়৷ তারপর গুলি করে হত্যা করা হল৷ মহাপুরুষ শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দর সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানিয়ে রাখি৷—চলবে

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content