শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


মা যশোরেশ্বরী

বহু বছর আগের কথা৷ দুলাল সর্দার তখন দশ-বারো বছরের এক ছটফটে বালক৷ মা ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গছিলেন৷ তখনই বাড়ির উঠোনে ছোটাছুটি করতে গিয়ে একধারে টাল করে রাখা পাটনাই ধানের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল সেই বালক৷ এক চোখে ধান ঢুকে গিয়ে সাংঘাতিক কাণ্ড! তখন গ্রামে পাশ করা ডাক্তার কোথায়?

আর এক গাঁ থেকে অনেক সাধ্য-সাধনা করে এক বদ্যি ডেকে এনে বালকের চোখের চিকিৎসার চেষ্টা করা হল৷ জড়ি-বুটি খাওয়ানো হল৷ কিন্তু সেই চোখ যে ক্রমশ ঠেলে বেরিয়ে আসে! হাতুড়ে চিকিৎসা চলতে লাগল৷

দুলালবাবু বললেন, ‘ছোট্টবেলার কথা৷ অখনও সব মনে পড়ে৷ কী যে কষ্ট পাইছিলাম৷ আমার বৃদ্ধ দিদিমা তখন নাতির চোখ বাঁচাইবার লাইগা যশোরেশ্বরী মন্দিরে আইসা কাইন্দা-কাইটা মানসিক করেন৷ কচুরমুখী আর চিংড়িমাছ (গলদা) রাঁইধ্যা-বাইড়া খাওয়াইবেন কইছিলেন দেবী মায়েরে৷’

আশ্চর্যের ব্যাপার, এরপরই দুলালবাবুর চোখ ধীরে ধীরে ভালো হল৷ কিন্তু মানসিকের পুজো এতদিন পরে? আসলে নাতি সুস্থ হওয়ার পরপরই ভদ্রমহিলাও মারা যান৷ তখন পুজো দেওয়া হয়নি৷ আজ সেই মানসিকের পুজো দিতে এসে দেবীমায়ের সামনে নিজের দু’কান মলে অপরাধ স্বীকার করেছেন দুলাল সর্দার৷ বাড়ি থেকে কচুরমুখী আর চিংড়িমাছ রেঁধে নিয়ে এসে যশোরেশ্বরী কালীমাতাকে অন্নভোগ দিয়েছেন৷
এক মুসলমান ভদ্রমহিলা এসেছেন তাঁর ছেলেকে নিয়ে৷ সঙ্গে একজোড়া পায়রা৷ মানসিক ছিল৷ পূজারির নির্দেশে পায়রাদুটো মন্দিরের বারান্দা থেকে উড়িয়ে দিলেন৷ কী মানসিক ছিল? মানসিকের কথা নাকি বলতে নেই৷ ভদ্রমহিলা তবুও বলে ফেললেন যে, তাঁর পায়রা পোষার খুব শখ৷ একদিন সকালে দেখলেন, অতগুলো পায়রার একটাও নেই৷ সব উড়ে গিয়েছে৷ অগত্যা যশোরেশ্বরীর কাছে মানসিক, যদি ওরা কোনোদিন ফেরে দেবীমাকে দুটো পায়রা ভেট চড়াবেন৷

দিন যায়৷ একদিন সব পায়রা ফিরেও এল৷ ওদের থেকে দুটোকে নিয়ে এসে আজ দেবীকে ভেট দিলেন৷ ভদ্রমহিলা যশোরেশ্বরীর উদ্দেশে প্রণাম করে বললেন, ‘মোরা অন্য ধর্মের হইলেও মাকে ভীষণ মান্যি করি৷ খুব জাগ্রতা! যা চাই তা-ই পাই৷’

একই কথার প্রতিধ্বনি কলেজের ছাত্রী মিঠু কর্মকারের মুখে৷ বি বি এ (গ্র্যাজুয়েশনের সমগোত্রীয়) পড়ছেন৷ বললেন, ‘সামনে পরীক্ষা৷ পূজা দিয়া মায়ের আশীর্বাদ লইতে আসছি৷ মা যে জাগ্রতা একথা সক্কলেই জানে৷’

স্ত্রী ও কোলের মেয়েকে নিয়ে অনেক দূর থেকে এসেছেন শ্যামল গায়েন৷ তাঁরাও পুজো দেবেন৷ মায়ের কোলে শুয়ে পিটপিট করে তাকাচ্ছিল টুসি৷ গাল টিপে আদর করতেই খিলখিল করে হাসি৷ মেয়ের কাণ্ডকারখানায় মা বেজায় খুশি৷

মাতৃদর্শন অবশ্যই হল৷ কিন্তু মন খারাপ হয়ে গেল৷ এত প্রসিদ্ধ এক জাগ্রত পীঠের আজ এ কী করুণ অবস্থা! কিন্তু চণ্ড ভৈরবের মন্দির তো দেখা হল না! ঢাকি শ্রীদাম আমাকে বলল, ‘কয়েক মিনিটেরই তো ব্যাপার৷ তা হইলে আপনাদের আমিই দেখাইয়া আনি গিয়া চণ্ড ভৈরবের মন্দিরখান৷’

ততক্ষণে জয় মহারাজের পুজো ও ধ্যান শেষ হয়েছে৷ মন্দিরের পিছনে কোনাকুনি হাঁটছিলাম আমরা৷ একটু দূরে গাছের ছায়ায় রঞ্জন বিশ্বাস তাঁর মোটর সাইকেল রেখে ফেরার অপেক্ষায়৷ ঘাটবাঁধানো বড় একটা পুকুরের একপাশ দিয়ে মেঠো রাস্তা৷ জয় মহারাজের গেরুয়া পোশাক দেখে গ্রামবাসী একটু অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে৷

শ্রীদামের দুঃখের কথা শুনছিলাম৷ যশোরেশ্বরী মন্দিরে সপ্তাহে দু’দিন ঢাক বাজিয়ে সাকুল্যে ১০০ টাকা রোজগার৷ সংসার আছে৷ ছেলে-মেয়েদের খাওয়াবে কী? তাই বাকি দিনগুলোতে জনমজুরের কাজ৷ মন্দিরের ফুল তোলা শ্রীদামকেই করতে হয়৷ বলল, ‘মায়ের মন্দিরেই পইড়া আছি গো বাবু৷ তিনিই দ্যাখবেন৷’
এবাড়ি ওবাড়ি ডিঙিয়ে অবশেষে মৃণাল সেনের আংশিক পাকা দালান৷ শ্রীদাম উৎসাহভরা কণ্ঠে বলল, ‘আরেকটু আউগাইলেই আপনাগো চণ্ড ভৈরবের দর্শন হইব৷’ জায়গাটা ঝোপঝাড় মতো৷ এখানে চণ্ড ভৈরবের মন্দির কোথায়? শ্রীদাম করজোড়ে প্রণাম করে বলল, ‘ওই তো চণ্ড ভৈরব আপনাগো বাম পাশে৷’
দেখলাম, কয়েকটা শ্যাওলাধরা ইট এদিক ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে৷ ছোট একটি শিবলিঙ্গ৷ তাঁর মাথার ওপর গাছের ডালে দড়ি বাঁধা একটা মাটির ঘট৷ সেই মুহূর্তে আমার দু’চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না৷ চণ্ড ভৈরবের মন্দির বলে আজ কিছুই নেই৷ ছোট একটি মন্দিরও এখনো কেন এখানে তৈরি হল না?
যশোরেশ্বরী মন্দিরের উত্তর-পূর্ব কোণে চণ্ড ভৈরবের ত্রিকোনাকৃতি মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন প্রতাপাদিত্য৷
মৃণালবাবুর কাপড়ের দোকান বংশীপুর বাজারে৷ জিজ্ঞাসা করলাম—আপনি পরিচালক মৃণাল সেনের নাম শুনেছেন?
মাথা কাত করে ভদ্রলোকের একগাল হাসি৷ ‘ওঁর মতো বিশ্ববরেণ্য পরিচালককে চিনুম না!’
চণ্ড ভৈরবের মন্দিরের এই দুরবস্থা কেন?

মৃণালবাবু বললেন, ‘চণ্ড ভৈরবের একটা মন্দির গঠন করা খুবই দরকার৷ কিন্তু মন্দিরের দু’জন সেবাইত উদ্যোগ না লইলে আমরাই বা কী কইরা আউগাই কন?’

মৃণালবাবুর ভ্রাতৃবধূ জয়শ্রী সেন বললেন, ‘মায়ের মন্দিরের পাশেই বসবাস করি৷ এ কি কম সৌভাগ্য আমাগো!’

ঈশ্বরীপুরে পদ্মপুকুর, বারদুয়ারী রাজবাড়িও দেখা হল৷ বিশাল মাঠের শেষপ্রান্তে এই রাজবাড়ি এখন দিবানিশি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার প্রহর গোনে৷ পদ্মপুকুরের বাঁধানো স্নানের ঘাটের দু’পাশে দুটো শিবমন্দির৷ ভেতরে শিবলিঙ্গ৷ ফুল-বেলপাতা পড়ে থাকতে দেখে বোঝা গেল এই মন্দিরদুটোতে পুজো হয়৷ কিছুটা দূরে প্রাচীরে ঘেরা অনেকটা জায়গা জুড়ে মসজিদ৷

রঞ্জনের মোটর সাইকেল চালানোর হাত বেশ ভালো৷ অহেতুক কেরামতি নেই৷ রঞ্জনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম—মাসে কীরকম রোজগার তোমার? স্বল্পভাষী যুবকটি একবার শুধু মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘স্যার, মোটামুটি খেয়ে-পড়ে বেঁচে আছি৷ আমার মায়ের মুখে একটু হাসি দেখতে পেলে তার দামই আমার কাছে লাখ টাকা৷’

রঞ্জনের কথা শুনে মনে মনে তারিফ করেছিলাম৷

যশোরেশ্বরী মন্দির থেকে কালীগঞ্জে ফিরতে বিকেল ৪টে৷ আবার বাসযাত্রা সাতক্ষীরা পর্যন্ত৷
আমার পাশের সিটে মহম্মদ বনি৷ বছর কুড়ি-বাইশের যুবকটি কলকাতার গল্প শুনতে রীতিমতো উৎসাহী৷ বাড়ি তাঁর পাবনায়৷ প্রয়াত মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের নাম করতেই সিট থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন৷ ‘উরি বাবাঃ! তাঁর মতন নায়িকা নাই৷ আর হইবও না৷ তাঁর বাড়িও তো পাবনায়৷’

মহানায়িকার মৃত্যুর খবরে পাবনার মানুষজনও যে শোকাচ্ছন্ন হয়েছিল সেকথাও মহম্মদ বনি বললেন৷ এই যুবক এখন কন্ট্রাক্টরি করেন৷ ওঁর বিজনেস পার্টনার এক হিন্দু, অলক মণ্ডল৷ বনি একটু ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘পড়ালিখা কইরা তো আর চাকরি জুটব না৷ সরকারি কি প্রাইভেট, ঘুষ না দিলে আমাদের দ্যাশে চাকরি মেলে না৷ তাই ব্যাবসায় আইছি৷ মোটামুটি চইলা যাইতাছে৷’ ওঁর মুখেই শুনলাম, সাতক্ষীরায় বড় বড় হিন্দু কন্ট্রাক্টর আছেন৷

বাংলাদেশের এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কথা শুনতে চাইছিলাম৷ বনি বললেন, ‘আমাগো ধর্মের এখনকার ছেলে-মেয়েরা কিন্তু ধর্ম লইয়া বেশি মাতামাতি করে না৷ অনেক বেশি উদার মনের৷ আমিও কীর্তন শুনতে যাই৷ চড়কের মেলায় যাইতেও ভালা লাগে৷ আমার সুকলের ইংরাজির শিক্ষক কালীচরণ দত্তকে আমি তো খুবই শ্রদ্ধা করি৷ এত সুন্দর কোরাণ পড়েন ও তার অর্থ বুঝাইয়া দেন কী কমু!’

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content