বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


যশোরেশ্বরী মন্দির

কীভাবে আবিষ্কৃত হল যশোরেশ্বরী কালীমায়ের মূর্তি৷ সে এক আশ্চর্য ঘটনা! প্রতাপাদিত্যের রাজধানী গড়ে ওঠার সময় রাজার লোকলস্কর জঙ্গল পরিষ্কারের কাজে যখন ব্যস্ত, সেই সময় ভাঙাচোরা ঘরবাড়ির ভেতর থেকে কষ্টিপাথরের একটি ভয়ংকরী কালীমূর্তি পাওয়া যায়৷ সঙ্গে সঙ্গে প্রতাপাদিত্যের খুল্লতাত রাজা বসন্ত রায়ের কাছে খবর পৌঁছলে তিনি তান্ত্রিক সাধক তর্কপঞ্চানন মহোদয়কে যশোরে সসম্মানে নিয়ে আসেন৷ তিনি মূর্তিটি দেখে নানা বিষয় নির্ণয় করে অভিমত দেন যে, ইনিই ৫১ পীঠের অন্যতম পীঠদেবী—শ্রীযশোরেশ্বরী মাতা৷ এরপর ঈশ্বরীপুরেই মন্দির নির্মাণ করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হল৷

যশোরেশ্বরী দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে৷ এই ব্যাপারে স্বামী পরদেবানন্দ তাঁর ‘তীর্থের পথে পথে’ গ্রন্থে লিখেছেন—‘মতান্তরে ভারতের উত্তরপ্রদেশের মথুরাতে কংস রাজার রঙ্গস্থলে শিলারূপে অধিষ্ঠান দেবীর৷ দ্বাপর যুগে কংস এই শিলাখণ্ডে দেবকীর সন্তানদের আছড়ে মারত৷ তেমনভাবে যোগমায়ার বধকালে শিলা থেকে অষ্টভুজা হয়ে দেবীর আবির্ভাব৷ আর বাংলার প্রতাপাদিত্য সেই শিলা থেকে দেবীমূর্তি গড়ে সঙ্গে আনেন যশোরে৷ ১৬০৪-এ মানসিংহ বাংলা জয় করে দেবীকে অম্বরে নিয়ে যান৷ পুরোহিত আসেন বাংলা থেকে৷’

এই দেবী শিলাদেবী নামে প্রসিদ্ধ৷ অবশ্য সেখানকার বাঙালিরা দেবীকে যশোরেশ্বরী নামে সম্বোধন করতেই অভ্যস্ত৷ দেবী যশোরেশ্বরী শক্তি সাধনার অন্যতম প্রতীক৷ এই পীঠদেবীর দুই পরম ভক্ত ছিলেন রাজা প্রতাপাদিত্য ও বসন্ত রায়৷ তাঁরা বিশ্বাস করতেন সবরকম আপদে-বিপদে স্বয়ং যশোরেশ্বরী পাশে থেকে তাঁদের রক্ষা করেন৷ প্রতাপাদিত্য মনে করতেন তাঁর অতুল ঐশ্বর্য ও খ্যাতির পিছনে রয়েছে দেবীর আশীর্বাদ৷ কবি ভারতচন্দ্র রায়ের কবিতায় যশোর নগর ও যশোরেশ্বরীর একনিষ্ঠ সেবক প্রতাপাদিত্যের নাম অমর হয়ে আছে—
একবার প্রতাপাদিত্যকে শায়েস্তা করার জন্য সম্রাট আকবর যুবরাজ সেলিমকে সুজলা-সুফলা বঙ্গদেশে পাঠালেন৷ সেলিমের সঙ্গে বিশাল বাহিনী৷ প্রতাপাদিত্য এক ভয়ংকর যুদ্ধে তাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন৷ সেলিম পিতাকে জানিয়েছিলেন, দেবী যশোরেশ্বরীকে পুজো করে প্রতাপাদিত্য যুদ্ধযাত্রা করেন৷ দেবীর আশীর্বাদে তিনি বলীয়ান৷ তাঁকে পরাজিত করা মুশকিল৷ শেষপর্যন্ত আকবর মানসিংহকে পাঠালেন৷

চর মারফত প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে নানা খোঁজখবর নিলেন মানসিংহ৷ উৎকোচে কী না হয়! এক লোভী ব্রাহ্মণের সহায়তায় রাতের অন্ধকারে মন্দির থেকে যশোরেশ্বরী মাতার মূর্তি চুরি করে নিজ শিবিরে আনতে সক্ষম হলেন মোগল সেনাপতি৷ এদিকে মায়ের বিগ্রহ চুরি গিয়েছে শুনে গভীর বিষাদে ডুবলেন প্রতাপাদিত্য৷

রাজা প্রতাপাদিত্যের এহেন মানসিক বিহ্বলতার সুযোগ খুঁজছিলেন মানসিংহ৷ তিনি যশোর রাজ্য আক্রমণ করলেন৷ প্রতাপাদিত্য কোনো অবরোধই গড়ে তুলতে পারলেন না৷ মোগল বাহিনীর কাছে পরাজিত ও বন্দি হলেন৷ শৃঙ্খলিত সিংহ সদৃশ যশোর নৃপতির এ কী করুণ পরিণতি!

বারাণসীর কাছে নৌকার মধ্যে তিনি মৃত্যুবরণ করেন৷ মোগল সম্রাটের কাছে অপমানিত হওয়ার হাত থেকে বাঁচলেন বঙ্গভূমির এক শৌর্যবান স্বাধীন রাজা৷ পরবর্তী সময়ে যশোরেশ্বরীর মূর্তি আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয়৷

যশোরেশ্বরীর ভক্ত এক নিষ্ঠাবান হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ছিলেন প্রতাপাদিত্য৷ তাঁর মুসলমান সৈন্যদের জন্য ঈশ্বরীপুরেই ট্যাংরা মসজিদ ও খ্রিস্টানদের জন্য গির্জা তৈরি করিয়েছিলেন৷
যশোরেশ্বরী মন্দিরের বারান্দায় ঢাক বাজাচ্ছিল শ্রীদাম সরকার৷ গর্ভগৃহে ভক্তদের উপস্থিতিতে তখন পুজোর আয়োজন সমাপ্ত৷ মন্দির-বেদির ওপর প্রতিষ্ঠিত যশোরেশ্বরী মাতার মূর্তির শুধু মুখমণ্ডলই দৃষ্টিগোচর হয়৷ অনেকটা কালীঘাটের মা দক্ষিণাকালী মূর্তির সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় যশোরেশ্বরীর৷ মিল রয়েছে তারাপীঠের তারা মায়ের সঙ্গেও৷

যশোরেশ্বরীর কণ্ঠের নীচে তাঁর শ্রীহস্ত ও শ্রীচরণ কিছুই নজরে পড়ে না৷ মূর্তির অবয়ব পুরোটাই মখমলে আবৃত৷ মাথার ওপর চাঁদোয়া৷ কণ্ঠে ফুলের মালা ও অলংকার৷ মাথায় সোনার মুকুট৷ লোলজিহ্বা দেবীর ভীষণ মূর্তি৷ মুখগহ্বর খানিকটা দৃশ্যমান৷ ইতিপূর্বে মা কালীর এরকম মুখমণ্ডল আমি দেখিনি৷ ভীষণ দর্শন হলেও মায়ের শ্রীবদনে কী অপূর্ব দেবীভাব! যুগপৎ আত্মনিবেদন ও পরম আশ্রয়ের শেষ কথা যেন তিনিই৷
মন্দিরের বারান্দায় নতজানু হয়ে দেবীমাতাকে প্রণাম করলাম৷ তারপর গর্ভগৃহে এলাম৷ মাঝারি মাপের এই গর্ভগৃহে তখন বেশ কয়েকজন ভক্ত৷ মায়ের পুজোয় সমবেত ভক্তগণ ফুল, ফল ও নানা রকমের মিষ্টি এনেছেন৷ মাতৃমূর্তির সামনে সুন্দর করে নৈবেদ্য সাজানো৷ ধূপ ও দীপ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ পূজারি দিলীপ মুখোপাধ্যায় পুজো শুরুর আগে সবকিছুতে শেষবারের মতো চোখ বোলাচ্ছেন৷ জয় মহারাজ তখন পূজারির উলটোদিকে গর্ভগৃহের দর্শনী দরজার এক কোণে চোখ বুজে ধ্যান করছেন৷ পূজারির এক সহকারী চণ্ডীপাঠ শুরু করেছেন৷ মা যশোরেশ্বরীর পুজো তন্ত্রমতেও হয়৷

পুজো শুরুর মুহূর্তে দিলীপবাবুকে কিছু জিজ্ঞাসা করব কি না সে ব্যাপারে একটু দোনোমনা করেছিলাম৷ শেষপর্যন্ত দু’চারটে প্রশ্ণ করে বসলাম৷ দিলীপবাবু বললেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের এই অঞ্চলেও প্রচণ্ড গণ্ডগোল শুরু হয়৷ কত দেশভক্ত হিন্দু-মুসলমান যে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে মারা পড়ল৷ যশোরেশ্বরীসহ এই অঞ্চলের বহু মন্দির লণ্ডভণ্ড হল৷ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হল৷ অবশ্য তার আগেই যশোরেশ্বরী মাতার শ্রীবিগ্রহ বসিরহাটের টাকি-তে এক নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়৷ পরে এই মন্দির ঠিকঠাক করে ওই মাতৃমূর্তি এনে আবার প্রতিষ্ঠা করা হল৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকদিন মন্দির বন্ধ ছিল৷’
শুধু শনি-মঙ্গলবারই কেন মন্দির খোলা থাকে?

পূজারি বললেন, ‘বহুদিন বন্ধ থাকার পর কালিকানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও মাখনলাল চট্টোপাধ্যায় দু’ভাই যশোরেশ্বরী মন্দির খোলেন৷ এক ভাই মঙ্গলবার ও আর এক ভাই শনিবার মায়ের পুজোর যাবতীয় খরচ দেবেন বলে স্থির হয়৷ তখন থেকে সপ্তাহের এই দুটো দিনেই মন্দির খোলা রাখার নিয়ম চালু হয়৷ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা মন্দিরে এসে সরাসরি পুজো দিতে পারেন ভক্তরা৷’

মাঝবয়সি হাসিখুশি ভদ্রমহিলা চারুরানি আপাতত মন্দির দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন৷ বললেন, ‘কালিকানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের দুই পুত্র জয়ন্তবাবু ও জ্যোতিবাবু মন্দিরের বর্তমান সেবাইত৷’

জয়ন্তবাবু একজন খ্যাতনামা আবৃত্তিকার৷ সপরিবারে ঢাকা শহরে থাকেন৷ জ্যোতিবাবুও ঢাকায় বসবাস করেন৷ মন্দিরে বড় করে শ্যামাপুজো হয়৷ বছরে একবারই সেদিন তাঁরা এখানে আসেন৷ শ্যামাপুজোয় যশোরেশ্বরী মন্দিরে বহু ভক্ত পুজো দেন৷ মানত করেন৷ মন্দিরের সামনে তিনদিন মেলা বসে৷ ছাগবলি হয়৷
কীভাবে যশোরেশ্বরী মন্দিরের ব্যয়নির্বাহ হয়?

চারুরানি বললেন, ‘সেবাইত দুইজনাই সমস্ত খরচ-খরচা চালান৷ কিছু ভক্ত আছেন৷ তাঁরাও অর্থসাহায্য দেন৷ তিন বচ্ছর হইল যশোরেশ্বরী মাতার স্বপ্ণাদিষ্ট আপনাগো এক মাড়োয়ারি ভদ্দরলোক ১৫ জন ব্রাহ্মণ পাঠাইয়া এই মন্দিরে বড় কইরা হোমযজ্ঞ করাইছিলেন৷ উনিও মায়ের সেবার লাগি কিছু টাকা-পয়সা পাঠাইছিলেন বইলা শুনছিলাম৷’

মায়ের পুজো শুরু হয়েছে৷ মন্দিরের চওড়া বারান্দায় ইতস্তত ঘোরাফেরা করছিলাম৷ সেই সময়ই দুলাল সর্দারের সঙ্গে আলাপ৷ সঙ্গে তাঁর নাতি তাপস৷ দুলালবাবু তাঁর দিদিমার মানসিকের পুজো দিতে এসেছেন৷ কীসের মানসিক জানার ইচ্ছা হল৷ যে ব্যাংদা গ্রাম থেকে ওঁরা এসেছেন যশোরেশ্বরী মন্দির থেকে তার দূরত্ব প্রায় ৭৫ কিমি৷ দুপুরের চড়া রোদ মাথায় নিয়ে এত দূর থেকে বয়স্ক লোকটি এসেছেন! দুলালবাবুর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক অদ্ভুত ঘটনার কথা জানতে পারলাম৷

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content