শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


পথচলতি কত মানুষের সঙ্গেই না আলাপ-পরিচয় হয়! মন্দির নিয়ে লেখালেখির সূত্রে ভারতের পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর সময় হাজারো মানুষের দুঃখ-সুখে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি আরও পূর্ণ হয়েছে৷ কারও চোখের জল আমাকে কাঁদিয়েছে, কারও সুখের কথা শুনে আমার মুখেও তৃপ্তির হাসি ফুটেছে৷ তবে বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে আমার ঘোরার অভিজ্ঞতা অন্যরকম বইকি!

মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা আলাদা৷ সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দুদের প্রতিনিয়তই নানা সমস্যার মোকাবিলা করে বাঁচতে হয়৷ অদ্ভুত এক অনিশ্চয়তা ঘিরে থাকে তাঁদের৷ তবুও তাঁদের প্রাণের উষ্ণ ছোঁয়া পেয়েছি৷ চোখের জল মুছে অবশেষে হেসেছেন তাঁরা৷ বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত৷

বরিশাল থেকে রাতের স্টিমারে চাঁদপুর যাওয়ার পথে অথৈ মেঘনার বুকে যে বাঙালি ভৈরবীর বুকফাটা জীবনযন্ত্রণার কথা আশ্চর্য হয়ে শুনেছিলাম, শেষপর্যন্ত তিনিও যে ক্ষমা করে দিয়েছেন ওই নরখাদকদের! অন্যদিকে, বাংলাদেশে মুসলিম সমাজের পুরুষ ও মহিলা অনেকের মুখেই শুনেছি যে, একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশকে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বাড়িয়ে দিতে হবে সত্যিকারের বন্ধুত্বের হাত৷ যাতে বিশ্বাসের বাতাবরণে সহাবস্থানের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে ওঠে৷ নিরাপত্তাহীনতায় আর না ভোগে সংখ্যালঘুরা৷

বাসেই আলাপ প্রভাত ঘোষের সঙ্গে৷ স্ত্রী শেফালি ও ছেলে অভিজিৎকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ঝাউডাঙা থেকে ফিরছেন৷ যশোরেশ্বরী মন্দিরে যাওয়ার কথা শুনে প্রভাতবাবু মোবাইলে খোঁজখবর নিয়ে সঠিক পথ জানিয়ে দিলেন কীভাবে আরও তাড়াতাড়ি সেখানে পৌঁছব৷ বাসের কনডাকটরকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম—কালীগঞ্জ আর কতদূর? মুখে তার উত্তর জোগানোই—এই তো দশটাকার পথ কালীগঞ্জ৷ অর্থাৎ ওই জায়গা থেকে কালীগঞ্জের বাসভাড়া দশটাকা৷ কিন্তু দশটাকার পথ যে আর ফুরোতেই চায় না! বলা বাহুল্য, সেই মুহূর্তে আমার ধৈর্য পরীক্ষার পালা চলছিল৷

নলতায় বাস থামল৷ ছোট্ট মফঃস্বল শহর৷ বাসস্টপের ডানদিকে মাঝারি মাপের নলতা কালীমাতার মন্দির৷ বাসটা মিনিট কয়েক দাঁড়িয়েছিল৷ মন্দিরে ঢোকার ইচ্ছা থাকলেও বাস দাঁড়াবে না৷ তাই মন্দিরের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে প্রণাম করে ফিরে এলাম৷

কালীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে যখন নামলাম বেলা সাড়ে বারোটা৷ আমাদের যশোরে ফেরার তাড়া আছে৷ ফেরার পথে সাতক্ষীরায় রামকৃষ্ণ মিশনের এক ভক্তের বাড়িতেও যাবেন জয় মহারাজ৷ সব মিলিয়ে অফুরন্ত সময় আমাদের হাতে নেই৷

প্রভাতবাবুর পরামর্শ অনুযায়ী মোটর সাইকেল ভাড়া করা হল৷ একটা বড় গাছের নীচে অনেকগুলো মোটর সাইকেল৷ চালকরা বসে আছে৷ খাতা হাতে বয়স্ক একজন মুসলমান ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন আমরা কোথায় যাব?

কালীগঞ্জ থেকে যশোরেশ্বরী মন্দিরে যাতায়াত রফা হল আড়াইশো টাকায়৷ চালক রঞ্জন বিশ্বাসের বয়স বছর পঁচিশেক৷ বাইক ভাড়া দিয়েই জীবিকানির্বাহ৷ বাবা মারা যাওয়ার পর লেখাপড়া করতে পারেনি৷ সংসারের হাল ধরতে হয়েছে রঞ্জনকে৷ চালকের পিছনে আমি৷ আমার পিছনে জয় মহারাজ৷ একরকম ঠাসাঠাসি করেই বসলাম৷ মোটর সাইকেল ছুটে চলল হাইওয়ে ধরে৷ বেশ পাকা হাত রঞ্জনের৷
রাস্তার ডানদিকে ও বাঁ-দিকে মাছের হ্যাচারি৷ স্থানীয় ভাষায় বলে ‘গের’৷ চাষের জমির অবলুপ্তি ঘটিয়ে মাছ চাষের জন্য জমি ব্যবহার করা হচ্ছে ইচ্ছামতো৷ এরকম অনেক ছোট-বড় হ্যাচারি যশোর শহরের আশপাশেও রয়েছে৷ পথে ইছামতী নদীর ওপরে লম্বা সেতু পেরোতেই ডানহাতে শেখ মুজিবর রহমান ও শেখ হাসিনার বিরাট বড় ম্যুরাল৷ জনসাধারণের প্রতি আওয়ামি লিগের অভিনন্দন বার্তা৷ বড়রাস্তা থেকে নেমে বাঁদিকে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে এক গ্রাম্যপথ৷ সে পথে যশোরেশ্বরী মন্দিরে পৌঁছলাম সোয়া একটা নাগাদ৷

মন্দিরের ঢাকের শব্দ আর ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেল৷ সম্ভবত যশোরেশ্বরী দেবীর পুজো শুরু হয়েছে৷ মন্দিরের নওবতখানা এখন ভগ্ণস্তূপ৷ রাজা প্রতাপাদিত্যের আমলের লম্বা-চওড়া সেই বিরাট নাটমন্দিরের আজ কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই৷ দু’একটা স্তম্ভ শুধু কালের সাক্ষী হয়ে ইটের পাঁজর বের করে দাঁড়িয়ে আছে কোনওরকমে৷ একদা মন্দিরের চারদিক সু-উচ্চ প্রাচীরে ঘেরা ছিল৷ সারি সারি ঘর ছিল মন্দির প্রাঙ্গণের ধার ঘেঁষে৷ মূল মন্দিরটি বাদে আর সবকিছুই আজ বিলীন হয়ে গিয়েছে৷ কে বলবে একসময় যশোরেশ্বরী মন্দিরকে কেন্দ্র করে এই স্থানে সুখী ও সমৃদ্ধ এক জনপদ গড়ে উঠেছিল৷

এখন শুধুই সেই গর্বের স্মৃতি বুকে ধরে ৫১ পীঠের অন্যতম পীঠরূপে লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থীর অন্যতম তীর্থক্ষেত্র সাতক্ষীরা জেলার এই প্রাচীন মন্দির৷
তন্ত্রচূড়ামণিতে বলা হয়েছে—
‘যশোরে পাণিপদ্ম দেবতা যশোরেশ্বরী,
চণ্ডশ্চ ভৈরব যত্র তত্র সিদ্ধি ন সংশয়৷’


যশোরে সতীর পাণিপদ্ম অর্থাৎ করকমল পড়েছে৷ দেবীর নাম যশোরেশ্বরী, ভৈরব হলেন চণ্ড৷ এই সতীপীঠে পুজো-অর্চনা করলে ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হয় বলে বিশ্বাস৷ বলা বাহুল্য, যশোহর বা যশোর নামটি অতি প্রাচীন৷

এই নামটির সঙ্গে মহাভারতের সময়ের সম্বন্ধ রয়েছে৷ রাজা যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করবেন৷ দ্বিতীয় পাণ্ডব মহা বলশালী ভীমের ওপর পূর্বদেশ জয় করার দায়িত্ব দিলেন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা৷ সেই সময়ে যশোরসহ বঙ্গদেশের পূর্বভাগে সমুদ্র সেন ও চন্দ্র সেন রাজত্ব করতেন৷ পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞে এই দু’জন নরপতি প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে উপস্থিত হন৷

তন্ত্রচূড়ামণিতে বলা হয়েছে—চণ্ড ভৈরব নদীর তীরে যশোহর অবস্থিত৷ সেই নদীর অস্তিত্ব আজ বিপন্ন৷ একসময় যমুনা ও ইছামতী নদীর মিলিত স্রোতধারা কদমতলি নাম নিয়ে ঈশ্বরীপুরের পাশ দিয়ে ভীমবেগে প্রবাহিত হত৷ এই নদী এখন অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছে৷

কিংবদন্তি, প্রাচীনকালে অনবি নামে ঈশ্বরভক্ত এক ব্রাহ্মণ পীঠদেবী যশোরেশ্বরীর জন্য এমনই এক বিরাট বড় মন্দির নির্মাণ করেন যার দ্বারের সংখ্যাই ছিল একশো৷ মন্দিরটি অষ্টম শতাব্দীর পর ধ্বংস হয়৷ এরপর গোকর্ণ বংশের ধেনুকর্ণ নামে এক রাজা তীর্থদর্শনে যশোরে এসে যশোরেশ্বরী দেবীর মন্দির নতুন করে নির্মাণ করেন৷

লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে ধেনুকর্ণের এই মন্দিরটি অক্ষত অবস্থায় ছিল বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা৷ কিন্তু সেইসময় চণ্ড ভৈরবের কোনো মন্দির ছিল না৷ লক্ষ্মণ সেন চণ্ডদেবের একটি মন্দির নির্মাণ করেন মূল মন্দিরের সন্নিকটে৷ সেন রাজত্বের শেষভাগে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবন অঞ্চল নিমজ্জিত হয়৷ সেইসময় যশোরেশ্বরী ও চণ্ড ভৈরব দুটো মন্দিরই ভূমিগর্ভে হারিয়ে যায়৷

এরপর ধীরে ধীরে সমগ্র অঞ্চল জঙ্গলে ঢাকা পড়ে৷ কয়েকশো বছরের ব্যবধানে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকালে যশোরেশ্বরী দেবীমূর্তি পুনরায় প্রকট হলে, সেই দেবীমূর্তিকে নতুন মন্দিরে যথোচিত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি৷ প্রতাপাদিত্য ঈশ্বরীপুরের ধুমঘাটে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন৷

Skip to content