রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


তন্ত্র কী?
তন্ত্র হল, সাধনপ্রণালীপ্রধান শাস্ত্রবিশেষ৷ শিব-শক্তি সম্বন্ধীয় উপাসনাবিধিই তন্ত্রবিদ্যা৷ যাঁরা তন্ত্রবিদ্যাকে তাঁদের সাধনার সোপান বলে মনে করেন সেইসব পুরুষ ও নারী যোগী ও যোগিনী নামে পরিচিত৷

মানুষ কীভাবে আলোকপ্রাপ্ত হতে পারে? কীভাবে সাধনার মধ্যে দিয়ে ঐশ পরিমণ্ডলে পৌঁছতে পারে? খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে (৫৬৩-৪৮০) ভগবান গৌতম বুদ্ধ প্রকৃত আত্মজ্ঞান সঞ্চয়নের সাহায্যে আলোকপ্রাপ্তির কথা বলেছেন যা বৌদ্ধধর্মের মূল ভিত্তি৷ পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধধর্ম তিনটি পথে ভাগ হয়ে যায়—হীনযান, মহাযান ও বজ্রযান৷ গৌতম বুদ্ধের সরাসরি অনুসরণকারীরা হীনযান৷ এই হীনযানে ব্যক্তিগত স্তরে মুক্তির কথা বলা হয়েছে৷ মহাযানপন্থীরা শুধু নিজের নয়, অন্যদের মুক্তির কথাও বলেছেন৷ আর মূলত মহাযান দর্শন ও মতবাদের ওপর ভিত্তি করে বজ্রযান গড়ে ওঠে৷ তন্ত্র হল বজ্রযানীদের প্রধান অবলম্বন৷ অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷

বজ্রযান বৌদ্ধধর্মকেই তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বলা হয়৷ বজ্রযানপন্থীরা নানা গূঢ় তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মের মধ্য দিয়ে আলোকপ্রাপ্ত হওয়ার চেষ্টা করেন৷ এই ধর্মপথ তুলনামূলকভাবে জটিল ও বহুবিধ আচার-আচরণে পরিপূর্ণ৷
তৃতীয় খ্রিস্টাব্দে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের মূল তত্ত্ব প্রথম লিখিত আকারে প্রকাশিত হয়৷ ষষ্ঠ অথবা সপ্তম শতাব্দীতে বজ্রযান ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে৷ আর অষ্টম শতাব্দীতে এই ধর্মপথ জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছয়৷
কোথায় শুরু হয় বজ্রযানপন্থা?

এ ব্যাপারে নানা মতামত রয়েছে৷ তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ গবেষকের মতে, ভারতীয় উপমহাদেশে বজ্রযানের শুরু৷ প্রধানত বঙ্গদেশেই এর বিস্তারলাভ৷ ওড়িশা ও পাকিস্তানের সোয়াট উপত্যকায় বৌদ্ধধর্মের এই তান্ত্রিকপন্থা একসময় যথেষ্ট প্রভাব ফেলে৷

একদা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ও বজ্রযানপন্থার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে৷ তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের প্রতি ক্রমশ রাজা-রাজড়া, পণ্ডিত, সন্ন্যাসী, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ, এমনকী গণিকারাও আকর্ষণবোধ করেন৷ ইতিপূর্বে রাজা বল্লাল সেনের কথা বলা হয়েছে৷

বজ্রযানপন্থীরা পরমেশ্বরের আরাধনা করার সময় প্রধানত যে দুটো বিষয়ের দিকে নজর রাখতেন তা হল, নারীজাতির প্রতি শ্রদ্ধা ও জাতপাতের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব প্রদর্শন৷ বজ্রযানপন্থীরা একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সমানতালে তাঁদের ধর্মাচরণ করেছেন৷ এই ধর্মের অনেক নামী মহাসিদ্ধাই-এর নাম পাওয়া যায়৷

ভারতে বৌদ্ধধর্ম ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর থেকে ক্রমশ ক্ষীয়মান হতে থাকে৷ পাশাপাশি চলতে থাকে হিন্দুধর্মও৷ তবে সেইসময় ভারতবর্ষে হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের ওপর মুসলমান ধর্মের চাপ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে৷ তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের প্রভাব থেকে তখনও সমাজ মুক্ত হয়নি৷

আজও চিন, তিব্বত, জাপানসহ কয়েকটি দেশে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম কিছু পরিমাণে প্রচলিত রয়েছে৷
সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দী থেকে বৌদ্ধধর্মে তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম বিভিন্ন দেশে আধিপত্য বিস্তার করে৷ ৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ভারত থেকে বৌদ্ধগুরু পদ্মসম্ভব তিব্বতের রাজার সনির্বন্ধ অনুরোধে সেই দেশে বজ্রযান মতাদর্শ প্রচারে উপস্থিত হন৷ তিনি আফগানিস্তান ও ভুটানেও যান৷ পদ্মসম্ভব ছিলেন তান্ত্রিক মহাসিদ্ধ পুরুষ৷ শোনা যায়, অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন তিনি৷ পদ্মসম্ভবই প্রথম ধর্মগুরু যিনি তিব্বতে যান৷ তিব্বতি তন্ত্র চৈনিক তন্ত্রের থেকেও জটিল৷

বজ্রযানপন্থীরা এ কথাও বলেন যে, তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মের জন্মদাতা স্বয়ং বুদ্ধদেব৷ কাহিনি এরকম—একবার ভগবান গৌতম বুদ্ধের কাছে রাজা ইন্দ্রভূতি করজোড়ে নিবেদন করলেন, প্রজাদের দেখাশোনা ও তাদের সুখ-সমৃদ্ধিই তাঁর প্রধান দায়িত্ব৷ আবার রানিদেরও তিনি পরিত্যাগ করতে পারবেন না৷ এই অবস্থায় রাজা কীভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করবেন? অফুরন্ত সুখ ও ভোগবিলাসে তাঁর চারপাশ পরিব্যাপ্ত৷ রয়েছে নানা প্রলোভনের হাতছানি৷ এই পরিবেশে কীভাবে তাঁর জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হবে?

এ কথা শোনার পরই বুদ্ধদেব রাজা ইন্দ্রভূতিকে তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মে শিক্ষিত করে তোলেন, যার সাহায্যে রাজার ঐহিক সুখ স্বর্গীয় ভাববিহ্বল অবস্থায় পর্যবসিত হয়৷

মোটামুটি সপ্তম শতাব্দী থেকে মহাযান বৌদ্ধধর্মে সেই যুগের ধার্মিক ক্রিয়াকর্ম ঢুকে পড়ে যা বজ্রযান, সহজযান ও কালচক্রযান—এই তিনটি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের নতুন ধারার সূচনা করে৷ এই ধারাগুলোতে মন্ত্র, মুদ্রা ও মণ্ডলের ৬টি তান্ত্রিক অভিচারের (তান্ত্রিক মন্ত্র বা প্রক্রিয়া) কথা বলা হয়েছে যেমন—মারণ, স্তম্ভন (নিষ্ক্রিয় জড় বা শক্তিহীন করা), সম্মোহন, বিবশন, উচ্চাটন (উচ্ছেদ করা) ও বশীকরণ৷ বুদ্ধদেবের ভক্তদের মধ্যে বজ্রপাণি, মঞ্জুশ্রী, অবলকীটেশ্বর প্রমুখ তান্ত্রিক সিদ্ধপুরুষের নাম পাওয়া যায়৷ অত্যন্ত গূঢ় ও গুহ্য তন্ত্রশিক্ষা প্রকৃত গুরুর মাধ্যমে তাঁর ভক্তদের মধ্যে প্রসারিত হয়েছে৷ যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবলীলাক্রমে চলমান থেকেছে৷

অষ্টম শতাব্দীর বঙ্গদেশে সহজযান বৌদ্ধধর্মের সূচনা হয়৷ সহজযানপন্থী সাধকরা লম্বা কেশ রাখতেন৷ পরিভ্রমণ করতেন এক স্থান থেকে আরেক স্থানে৷ কালচক্রযান দশম শতাব্দীতে শুরু হয়৷

বজ্রযানের দৃষ্টিভঙ্গি এরকম—বৌদ্ধধর্মের ভিত স্থাপন করেছিল হীনযান৷ এরপর মহাযান এই ধর্মের প্রাচীর নির্মাণ করে৷ আর বৌদ্ধধর্মকে যদি এক পরম পবিত্র মন্দির বলে মনে করা হয়, তার স্বর্ণমণ্ডিত ছাদ হচ্ছে বজ্রযান৷

চিনদেশে ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের যে বিরাট প্রভাব লক্ষ করা যায় তাতে গুপ্ত ক্রিয়াকর্মই কালে কালে প্রধান হয়ে ওঠে৷ ৭ম শতাব্দীর প্রথমভাগে ট্যাং রাজত্বে রাজাদের অনুমোদনে বৌদ্ধধর্মে গুপ্ত ক্রিয়াকর্ম বেড়ে ওঠে৷ ভারত থেকে তিনজন বৌদ্ধগুরু বজ্রবোধি, অমঙ্গবজ্র প্রমুখ চিনে গমন করেন৷ তাঁদের উপস্থিতিতে গুপ্ত ক্রিয়াকর্ম আরও জনপ্রিয়তা লাভ করে৷

ইউয়ান রাজবংশের (১২৭১-১৩৬৮) শাসনকালে চিনে তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম বিস্তারলাভ করে৷ তন্ত্রনির্ভর বৌদ্ধধর্ম ওই দেশের সরকারি ধর্ম হিসাবেও স্বীকৃতিলাভ করে৷ তিব্বতি লামারা রাজদরবারে বিশেষ মর্যাদালাভ করেন৷ কিন্তু তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মের খারাপ দিকগুলো সমাজে আরও প্রভাব বিস্তার করায় নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়৷ ইতিমধ্যে ইউয়ান রাজবংশকে উৎখাত করে মিং রাজবংশ চিনদেশে শাসনক্ষমতা লাভ করে৷ এরপর রাজদরবার থেকে তিব্বতি তান্ত্রিক লামাদের বহিষ্কার করা হয়৷

ছবি প্রতীকী

‘কুণ্ডিচক্র’ তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মের প্রধান অঙ্গ, অর্থাৎ কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করার আন্তরিক প্রয়াস চলে তন্ত্রনির্ভর বৌদ্ধধর্ম অনুসরণকারীদের মধ্যে৷ এর মধ্য দিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে তাঁদের পরিবর্তন ঘটে৷ তন্ত্রশাস্ত্রমতে দেহমধ্যে মূলাধার পদ্মে অর্থাৎ অধোমুখে, তিনটি বেষ্টনে কুণ্ডলীভাবে বিরাজিত জীবগণের পরমাশক্তি বা শিবশক্তি, এই শক্তি জীবগণের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে জীবনদায়ী শক্তিরূপে বিরাজ করে৷

বজ্রযানে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ, গুরুর নির্দেশেই শিষ্যবর্গ এক গোপন স্থানে লোকচক্ষুর আড়ালে তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মে যোগদান করেন৷ আর গুরুর প্রত্যক্ষ ভূমিকার ওপরেই মূলত শিষ্যগণের সাধনায় সিদ্ধিলাভ নির্ভর করে৷ এই গুহ্য তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মের চারটি পবিত্র ধাপ এরকম—
১. একজনের শরীরকে ঈশ্বরের পবিত্র অঙ্গ বলে মনে করা৷
২. পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে ঈশ্বরের পুণ্যস্থান বা মণ্ডলরূপে ভাবা৷
৩. ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভূত সুখ ঈশ্বরেরই পরম সুখ হিসাবে গ্রহণ করা৷ তবে এই সুখানুভূতি আসক্তিহীন হওয়া প্রয়োজন৷
৪. অপরের হিতে আপন কর্ম সম্পাদন৷

উল্লেখ করা প্রয়োজন, বজ্রযান বর্তমানে প্রধান দুটো গোষ্ঠীতে বিভক্ত—তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম ও জাপানের গুহ্য বৌদ্ধধর্ম যা ‘শিনগন’ নামে প্রসিদ্ধ৷ বৌদ্ধধর্মের বেশিরভাগ মন্ত্র সংস্কৃত ভাষায় উচ্চারিত হয়৷ মন্ত্রের আবৃত্তি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ৷ কারণ, এই মন্ত্র তখনই সঠিকভাবে উচ্চারণ করা সম্ভব, যখন দেহ, মন ও স্বর একীভূত হয়৷

এ কথা বলা হয়তো ভুল হবে না যে, একসময় হিন্দুধর্মের শক্তিসাধনা ও বৌদ্ধধর্মের তন্ত্রসাধনার মেলবন্ধন ঘটে৷ তবে হিন্দু তান্ত্রিক আচার-আচরণের সঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের বাইরের মিল লক্ষ করা গেলেও পদ্ধতিগত দিক থেকে দুটো পথ সম্পূর্ণ আলাদা৷

তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মে যৌন মিলনের প্রসঙ্গে মনে রাখা জরুরি যে, নারী-পুরুষের এই মিলন প্রতীকি৷ দুটি নারী-পুরুষের সাধারণ যৌন মিলনের থেকে তা বহুলাংশে আলাদা৷ তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মে যখন যৌন আচারানুষ্ঠানের মুহূর্ত আসে, সেই সময় এক সাধককে শিবের প্রতিরূপ বলে মনে করা হয়৷ আর সাধকের সঙ্গিনী হলেন কুণ্ডলিনীশক্তি৷
তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে বিশিষ্ট গবেষক ইসাবেল ওনিয়ানসের বিশ্লেষণ এরকম—‘Tantric Buddhism is not the transcription of a native term, but a rather modern coinage, if not totally occidental. For the equivalent Sanskrit tantrika is found, but not in Buddhist texts. Tantrika is a term denoting someone who follows the teachings of scriptures known as tantras, but only in saivism, not Buddhism.

Tantric Buddhism is a name for a phenomenon which calls itself, in sanskrit, Mantranaya, Vajrayana, Mantrayana or Mantramahayana (and apparently never tantrayana). Its practitioners are known as mantrins, yogis or sadhakas. Thus, our use of the anglicised adjective ‘Tantric’ for the Buddhist religion taught in Tantras is not native to the tradition, but is a borrowed term which serves its purpose.’

বৌদ্ধ ধর্মগুরু দলাই লামা বৌদ্ধধর্মে তন্ত্রসাধনার প্রসঙ্গে পাশ্চাত্যের বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের্ সঙ্গে এক আলাপচারিতায় বলেছেন,—‘It is the uncommon characteristic of Tantric practice that through it one can evoke this most subtle consciousness at will and put it to use in a most effective way.

It is through specifically Tantric practices, the channels, that one can control and temporarily abandon the rougher levels of consciousness. When these become supressed, the subtler levels of consciousness become active. And it is through the use of the subtlest level of consciousness that the most powerful spiritual realizations can come about. Hence, it is through the Tantric practice involving the most subtle consciousness that the goal of enlightment can most quickly be realized.’

তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে স্বর্গীয় সত্তার সঙ্গে যৌনমিলনের মধ্য দিয়ে সাধক বা সাধিকার আলোকপ্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে৷ তবে বজ্রযানী গুরুরা বারংবার একথা বলেছেন যে, বৌদ্ধতন্ত্রে সাধারণ যৌনতা বলতে যা বোঝায় তার কোনও স্থান নেই৷ এ হল ব্যক্তিগত স্তরে সাধক বা সাধিকার মনঃশ্চক্ষে যৌনতার এক কল্পিত চিত্র ফুটে ওঠা মাত্র৷— চলবে

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content