রবিবার ২১ জুলাই, ২০২৪


রমনা কালীমন্দিরের সদ্য সংস্কারের পর এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ।

রমনা কালীমন্দিরে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজছিল৷ সেই মুহূর্তে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম মন্দির প্রাঙ্গণে৷ কালীমন্দিরের পাশেই দুর্গাদেউল৷ বড়সড় পাকা দালান৷ পাথরের বেদির ওপর নয়ন ভোলানো দুর্গাপ্রতিমা৷ কারিগর রতন পাল৷ তাঁর নাম ও মোবাইল নম্বর প্রতিমার সামনে নীচের দিকে লেখা রয়েছে৷

মা দুর্গার পরনে কারুকার্য করা শিফনের লাল বস্ত্র৷ মা সরস্বতীর হালকা বাসন্তী, মা লক্ষ্মীর আকাশি, গণেশের ধূসর ও কার্তিক ঠাকুরের অফ হোয়াইট৷ দুর্গাপ্রতিমার সামনে মাটির কলস৷ তার ওপর আস্ত ঝুনো নারকেল৷ নারকেলের ওপর কয়েকটা গাঁদাফুল ও রক্তজবা৷ আরতি ও প্রদীপ প্রজ্বলনের জন্য মাটির সাজ-সরঞ্জাম৷ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মতো রমনা কালীবাড়িতেও সারাবছর দেবী দশভুজা পূজিত হন৷

দুর্গামন্দিরের পাশেই শ্রীরাধা-গোবিন্দ মন্দির৷ সুসজ্জিত মন্দিরের গায়ে লেখা ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্’৷ রাধা-কৃষ্ণের প্রায় চার ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট সুন্দর যুগল মূর্তি৷ বাসন্তী রঙের পোশাক শ্রীকৃষ্ণের, নানা অলংকার ও মুকুট৷ উজ্জ্বল সোনালি-হলুদ শাড়ি শ্রীরাধিকার শ্রীঅঙ্গে৷ আলুলায়িত কেশরাশি৷ মাথায় মুকুট৷ রূপসী রাধারানি৷ শ্রীগৌর-নিতাই, শ্রীদ্বৈত আচার্য, শ্রীবাসাদির মাটির মূর্তি গর্ভগৃহে৷ মেঝে ও দেওয়ালে রঙিন টাইলস৷

‘হরে কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে হরে’ এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর ঐশ দুটি নাম দেওয়ালের সর্বত্র লাল রঙে লেখা রয়েছে৷ পিতলের কলস, ঘণ্টা ও শঙ্খ কোলাপসিবল গেট টানা মন্দিরের অভ্যন্তরে৷ গাঁদাফুল ও সাদাফুল ছড়িয়ে আছে শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধার বেদিতলে৷ ছোট একটি কাঠের সিংহাসনে বংশীধারী বালক কৃষ্ণ, পাশে রাধার আলোকচিত্র৷
শ্রীরাধা-গোবিন্দ মন্দিরের পাশেই শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারীর মন্দির৷ তবে লোকনাথ বাবার মন্দিরটির এখনও কিছু কাজ বাকি৷ বাবার দুটি বড় ফোটো মন্দিরে৷ তাঁর চরণপাদুকা, পিতলের ছোট ঘট, কুলো ও হাতপাখাও রয়েছে দেখলাম৷ ঘটের ওপর শিষযুক্ত কচি ডাব, নতুন গামছা, জবা ও টগর ফুল৷

লোকনাথের পাশে মা আনন্দময়ীর মন্দির৷ যেখানে মা আনন্দময়ীর বড় একটি মৃন্ময়ীমূর্তি রয়েছে, সেই কক্ষটি বেশ বড়৷ মূর্তিটি বেদির ওপর৷ বাঁ-হাতের ওপর ডান হাতখানি আলতো করে রাখা৷ বাঁ-হাতে শাঁখা৷ মুখে স্মিত হাসি৷ আশ্রিতবৎসলা এক মমতাময়ী মা৷

রমনা কালীমন্দিরে মায়ের মূর্তি

প্রাঙ্গণে ঘোরাঘুরির সময়ই কালীমন্দিরের পিছনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা আমার নজরে পড়েছিল৷ একপাশে চাটাইয়ের বেড়া দেওয়া টিনের চালের একটা সাধারণ বাড়ি৷ খোঁজখবর করতেই এক যুবক ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন৷ পরিচয়ের পর তিনি আমাকে সাদরে ঘরে এনে বসালেন৷

তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছিল৷ ঠিক সেই মুহূর্তে বিপুল রায় নামে ওই যুবক লেবু-চিনি দেওয়া এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত খুব যত্ন করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন৷ তাঁর এই আতিথেয়তার কথা ভুলতে পারব না৷ সত্যি বলতে কী, বাংলাদেশের মানুষ, তিনি হিন্দু হোন বা মুসলমান, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান, তাঁদের আদর-যত্ন আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে৷
বিপুলবাবুরা তিন পুরুষ ধরে রমনা কালীমন্দিরের সেবাইত ছিলেন৷ বিপুলবাবুর বাবা সীতানাথ রায় ও ঠাকুরদা গিরিধারী রায়৷ মাতামহ বাদলচন্দ্র রায় ও বিপুলবাবুর দাদা ত্রিদিব রায় ২৭ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাদের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন৷

রমনা কালীমন্দির প্রাঙ্গণে ঢোকার সময় মূল গেটের একপাশে টাঙানো ৫০ জন শহিদের তালিকায় বাদলবাবু ও ত্রিদিববাবুর নামও রয়েছে৷ তবে সকল শহিদের নাম পাওয়া যায়নি৷ কারণ, ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী ও ভুক্তভোগী অনেকেই বিভিন্ন সময়ে দেশত্যাগ করেছেন৷

বিপুলবাবু দুঃখ করে বললেন যে, এই শহিদরা আজ পর্যন্ত কোনো সরকারি স্বীকৃতি পাননি৷ এই মর্মে গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তিনি একটি চিঠিও পাঠিয়েছিলেন৷ মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তাজুল ইসলামকেও চিঠি দিয়েছেন৷ কিন্তু কারও কাছ থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাননি৷

বিপুলবাবুর মুখে শুনলাম যে, মন্দির কমিটি তাঁদের পরিবারের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদের মামলা করেছে৷ মন্দির প্রাঙ্গণে তাঁরা থাকতে পারবেন না৷ বিপুলবাবু ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘এখন আমরা যাব কোথায় বলুন তো? তাই বাধ্য হয়ে ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পালটা মামলা করেছি৷ আপাতত কোর্টের স্টে-অর্ডার আছে৷’
—চলবে

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content